ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, নেই বিদ্যুৎ, নেই খাবার, নেই জল— আমফান-বিপর্যস্ত সুন্দরবনে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট

অভিজিৎ ঘোষাল

 



লেখক পেশায় সাংবাদিক

 

 

 

 

চালটা স্রেফ উড়ে গেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে চারটে দেওয়ালের একটা। বাকি তিনটেও নড়বড়ে— যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। অগোছালো একটা খাটের একপাশে সপসপে ভেজা জামাকাপড় আর চাদরের স্তূপ। ঘরের একটাই জানলা। সেটা আপাতত ঝুলে রয়েছে কোনক্রমে, কব্‌জা থেকে।

‘বাড়ির’ বাইরে জাহানারা খাতুনের দৃষ্টিতে শুধুই শূন্যতা। “সব শেষ। মুক্তি পাব কবে আমরা?” তাঁর প্রশ্ন।

প্রায় অসংলগ্ন তাঁর বাক্যগুলো— সবহারানো মানুষের ভাষা যেমন হয়। “লকডাউনে বড় ছেলের কাজটা গেল। তার ওপরে, ওর লিভারের ব্যামো। ওই যে গাছটা দেখছেন, তার ওপাশে ওর ঘর। সে ঘরটাও আর নেই।”

সর্বগ্রাসী এক মানবিক সঙ্কটে ধুঁকছে দক্ষিণবাংলার উপকূলবর্তী কয়েকটি জেলা, এবং এই সর্বনাশের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সুন্দরবন, রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভ-অঞ্চল।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে, যতবার বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসে ঘূর্ণিঝড়, ততবার এই সুন্দরবনই শুষে নেয় তার ভয়াবহ আঘাত। এইবারে যখন আমফান উঠে এল বঙ্গোপসাগরের ঘন নীল জল থেকে, সুন্দরবনের সেই পরিত্রাতার ভূমিকায় কোনও অদলবদল ঘটেনি।

“হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজ আর কালনাগিনী নদীর জল ফুলে উঠতে দেখেই বুঝছিলাম, ভাগ্যে এবার কী আছে। হাতের কাছে জরুরি জিনিসপত্র যেটুকু পেয়েছি কুড়িয়েবাড়িয়ে নিয়ে প্রাণপণে ছুটে গেছি এলাকার পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিতে,” বলছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লকের গোবিন্দরামপুরের বাসিন্দা, নারায়ণ পালুই।

এ সঙ্কটের অনেকগুলো মুখ… এক, লক্ষ-লক্ষ মানুষ খুইয়েছেন তাঁদের মাথা গোঁজার একমাত্র সম্বলটুকু। চালা উড়ে গেছে, দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। যে ঘরগুলো হাওয়ার সঙ্গে লড়ে মাথা সোজা রাখতে পেরেছে, সেগুলোতে ঢুকে পড়েছে সর্বনাশা নোনাজল।

দুই, সমস্ত খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়ে গেছে। এককথায়, অথবা যে ‘সাপ্লাই চেন’ করোনা লকডাউনে আগে থেকেই কোমর ভেঙে পড়েছিল, এই সাইক্লোনের ধাক্কায় তা একেবারে মাটিতে মিশে গেছে।

তিন, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনায় সুন্দরবনের ১৯টি মহকুমায় ক্ষেতের জমিগুলোয় সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে চাষের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। “এই নোনাজলে চাষের জমি একেবারে বরবাদ হয়ে যায়। চাষবাসের উপযুক্ত থাকে না আর। মাটিতে এসে বসা নুন কাটিয়ে জমির আগের অবস্থায় ফিরতে বহুদিন লেগে যাবে,” বলছিলেন সুজয় মাহাতা, কাকদ্বীপে একটি মিষ্টির দোকান ও একফালি ছোট্ট জমির মালিক।

চার, সুন্দরবনে মাকড়শার জালের মতো বিছিয়ে থাকা প্রচুর নদনদী, সেগুলোতে সমুদ্রের জল ঢুকে স্যালিনিটি বেড়ে যাওয়ার ফলে মরে গেছে সমস্ত মাছ। “পুকুর ও জলাশয়ের সমস্ত মাছ মরে গেছে। মিষ্টি জলের মাছ, জলে নুনের পরিমাণ বেড়ে গেলে বাঁচে না,” জানালেন নামখানার সুধাকান্ত পাখিরা।

পাঁচ, অজস্র ইলেকট্রিক পোল উপড়ে গেছে। তার ছিঁড়ে, জড়িয়ে একেবারে যা তা অবস্থা। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার তো করাই যাবে না মাসের পর মাস, চাষিরা বলছিলেন। জলসেচের শ্যালোগুলোও চলবে না। ফলে, এইসব এলাকায় পুকুরগুলোয় মাছ চাষ করেও রোজগার করতে পারবে না মানুষ। সুধাকান্তবাবু বলছিলেন, “দু-তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে এখন। বৃষ্টির জলে যদি জলাশয়গুলোর লবণাক্ততা কমে।”

এই অঞ্চলের এই অসহায় বাসিন্দারা ফি-বছরই এই জাতীয় দুর্ভোগের মুখোমুখি হন। ২০০৯-এ আয়লায় বিধ্বস্ত হয়েছিল সুন্দরবন। ২০১৯-এর নভেম্বরে এল বুলবুল। আর তার ঠিক ছ’মাসের মাথায় আমফান এসে ছারখার করে দিয়ে গেল সব। নামখানার নারায়ণ পালই জানালেন, “১১ বছর আগে আয়লায় ভেসে যাওয়া বাঁধগুলোই সরকার এখনও পুনর্নির্মাণ করে উঠতে পারেনি।”

একে প্রশাসনিক গাফিলতি ছাড়া আর কী বলবেন? এখানকার বাসিন্দারা যে উত্তেজিত হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। “কত বছর ধরে শুনছি, বাঁধগুলো সারিয়ে তুললে গ্রামে বন্যার জল ঢোকা বন্ধ হবে। কিছুই হয়নি। এখন তো বলাও বন্ধ করে দিয়েছে,” বলছেন স্বপন দাস। স্বপনবাবুর দুধের ব্যবসা লকডাউনে ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত।

আর এক গ্রামবাসী সুকুমার মাইতি জানালেন, তাঁরা প্রশাসনকে আশ্বস্ত করেছেন বাঁধের জন্য মাটি যোগাড় করে দেবেন, তাতেও কিছু হয়নি। বললেন, “বর্ষাকালে ক্ষেতে যখন জল জমে তখন প্রশাসন মাটি চায়। কিন্তু বর্ষাকালে তো মাটি দেওয়া খুব কঠিন। অন্য যে কোনও সময়ে আমরা মাটি দিতে তৈরি, কিন্তু কেউ চাইতে আসে না।”

দেখা গেল, সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরার ওপর এঁদের বেশ রাগ। “পাশের গ্রামেই থাকেন, জানেন? অথচ একবার এসে দেখেও গেলেন না, আমরা কেমন আছি। কোনও মাথাব্যথা নেই,” ক্ষোভ উগরে দেন সুকুমারবাবু।

রাগ উপচে পড়ছে সাংবাদিকদের অপরেও। ক্যামেরা দেখে কেউ-কেউ বললেন, গাছে বেঁধে মারধোর করবেন। “এখানে এসে করেনটা কী মশাই? ২০০৯-এ আয়লার পরেও তো কত সাংবাদিক এলেন, কে কী করল? আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই পড়ে রইলাম,” জানালেন গ্রামবাসীদের অনেকেই। ওঁদের খুব দোষ দেওয়া যায় না।

কীভাবেই বা দোষ দেব? লড়াই করার ইচ্ছাশক্তি ছাড়া আর সবই তো হারিয়েছেন তাঁরা।

নদনদীর দেশে, জলাশয় আর ক্ষেতভর্তি জল যেখানে, সেখানে গবাদি পশুগুলোর জন্য একফোঁটা খাওয়ার জল পর্যন্ত নেই। এ কী দুর্দশা! গ্রামের মহিলারা বহুদূর হেঁটে গিয়ে টিপকল থেকে জল তুলে আনছেন। “কিছু কিছু টিপকল আছে এই এলাকায়, যেখান থেকে খাওয়ার জল আনতে পারছি। গবাদি পশুদের জন্যও তো জল তুলতে হয়,” বললেন নারায়ণের ভাই শিবায়ন পালই।

পশুদের জন্য জল তুলে আনা এতটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কেউ-কেউ গরুবাছুর বেচেই দিচ্ছেন। “আজ সকালেই আমার এক প্রতিবেশী জলের দরে ছটা গরু বেচে দিলেন। পাঁচ-ছ হাজার টাকায় বেচলেন, যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় অনায়াসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দাম পেতে পারতেন,” আফশোস ঝরে পড়ছে শিবায়নের গলায়।

পর্যটনের প্রচারপত্রে বারবার ফিরে আসা সুন্দরবন আজ যেন শুধু নেই-এর দেশ— নেই ঘর, নেই খাদ্য, নেই ওষুধ, নেই ত্রাণ। “কোনও ত্রাণসামগ্রী আসেনি এখনও। বাইরে থেকে আপনারাই প্রথম এলেন। এবার অনাহারে মরব। এর মধ্যে আন্ত্রিক অসুখ ছড়ালে যে কী হবে, ভেবে শিউরে উঠছি ভয়ে,” আশঙ্কায় গলা কেঁপে যায় মধ্য-পঞ্চাশের গৃহবধূ নির্মলা পারালির।

প্রতিবেশীরা দেখালেন করোনা-ত্রাণে পাওয়া এক বস্তা চাল, যা এখন পুরোপুরি নোনাজলে ভেজা। চটের বস্তা পেতে তার ওপরে চাল শুকোতে দিয়েছেন।

২০ মে, ঘূর্ণিঝড় থামার ঘণ্টাদুয়েক পরে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, “সব শেষ হয়ে গেছে।” একেবারে নির্জলা সত্যি কথা, এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়। ঘূর্ণিঝড় থেমে গেছে বটে, তবে ধ্বংসের যে চিহ্নগুলো রেখে গেছে, তা মুছতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে।

 

ছবি সৌজন্য : লেখক

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...