কলকাতা থেকে ভিয়েনা: ভারতে সাইকিয়াট্রি চর্চার অজানা ইতিহাস

কলকাতা থেকে ভিয়েনা: ভারতে সাইকিয়াট্রি চর্চার অজানা ইতিহাস -- পল্লব সরকার

পল্লব সরকার

 


লেখক গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক এবং শারীরবিদ্যার অধ্যাপক

 

 

 

 

আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগের কথা। আস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের এক ‘পাগল’-এর ডাক্তার সকালবেলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টেবিলে রাখা ডাকগুলো দেখছিলেন। এ তাঁর প্রতিদিন রুটিন। দেশবিদেশ থেকে প্রতিদিনই বহু ডাক্তার বিজ্ঞানী এমনকী সাধারণ মানুষের চিঠি আসে। তবুও আজ একটা খামের উপর প্রেরকের নাম ঠিকানা দেখে একটু চমৎকৃত হলেন। খামের মুখ ছিঁড়ে বেরোল একটি বই এবং একটি চিঠি। লিখেছেন তাঁরই পেশার একজন মানুষ, এক ডাক্তার। বইয়ের নাম ‘কনসেপ্ট অফ রিপ্রেসন’ (Concept of Repression)। পাতা উলটে কয়েক লাইন পড়েই মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। ছত্রে ছত্রে এ যে তাঁর নিজেরই ভাবনা। সুদূর প্রাচ্যে বসে লেখক যে অসাধ্যসাধন করেছেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিস্মিত, আনন্দিত ডাক্তার জবাবি চিঠিতে লিখলেন:

I acknowledge the receipt of your book on the Concept of Repression and I am glad to testify the correctness of its principal views and the good sense appearing in it. My surprise was great that psychoanalysis should have met with so much recognition in your far off country.

(আপনার বই কনসেপ্ট অফ রিপ্রেশন-এর প্রাপ্তিস্বীকার করছি এবং আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে এতে বর্ণিত মূল ভাবনা এবং শুভ বোধগুলি সত্য। আপনার সেই সুদূর দেশে সাইকোঅ্যানালিসিস (মনোবিশ্লেষণ) যে এই পরিমাণ স্বীকৃতি লাভ করেছে জেনে আশ্চর্য বোধ করছি।)

পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই ডাক্তারের মধ্যে এইভাবে যে সখ্যতার শুরু তা পরবর্তী দুই দশকেরও বেশি অটুট ছিল। যদিও ইহজীবনে তাঁদের সামনাসামনি দেখা হয়নি। বহু বছর পরে লেখকের মেয়ে ইউরোপ ভ্রমণকালে গিয়েছিলেন সাহেবর সঙ্গে দেখা করতে। বাবার একখানা ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অদেখা-বন্ধুকন্যাকে সামনে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন বুড়ো ডাক্তার। নাম তাঁর সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯), সারা বিশ্ব যাঁকে চেনে সাইকোঅ্যানালিসিসের পিতা হিসাবে। আর তাঁর ভারতীয় বন্ধু হলেন কলকাতার পার্সিবাগান লেনের বোস বাড়ির ছোট ছেলে ডাক্তার গিরীন্দ্রশেখর বোস (১৮৮৭-১৯৫৩)। তাঁর মেজদা রাজশেখর, বেঙ্গল কেমিক্যালের কর্ণধার এবং পরবর্তীকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক পরশুরাম।

গিরীন্দ্রশেখরের পিতা চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন দ্বারভাঙ্গা রাজ এস্টেটের জেনারেল ম্যানেজার; দ্বারভাঙ্গা-রাজের প্রধানমন্ত্রী। বেদ পুরাণে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। কিন্তু কায়স্থর বেদ-চর্চা যে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের মোটেই পছন্দ নয়। বিশেষ করে গ্রামদেশে। উৎপাতের ঠেলায় নিজের পৈতৃক ভিটে নদীয়ার উলা বীরনগর ছেড়ে তিনি কলকাতার পার্সিবাগানে এসে বাড়ি করলেন। এলাকাটা ব্রাহ্ম অধ্যুষিত। খানিক দূরেই বাদুড়বাগান। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়ি। উলটোদিকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের উপর রাজা রামমোহন রায়ের বিশাল অট্টালিকা (যদিও দুজন বহুকাল হল গত হয়েছেন)। পাশেই ব্রাহ্ম নেতা অনন্দমোহন বসু প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজ (অনন্দমোহন ছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সিনিয়ার র‍্যাংলার— গণিতে স্নাতকস্তরে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত)। এদিকে আপার সার্কুলার রোডের (আজকের এপিসি রয় রোড) উপর দুই বিশ্ববিশ্রুত বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বোসের বাড়ি।

গিরীন্দ্রশেখর মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে বাড়িতেই চেম্বার খুললেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সেখানে রুগীর ঢল নামে। সকলের চিকিৎসাই বিনামূল্যে। আশপাশের পাড়া, বস্তির সমস্ত মানুষ গিরীন্দ্রশেখরের পেশেন্ট। সকাল দশটায় কলে বেরোন ডাক্তার। আচার্য রায়, আচার্য বোস সহ এলাকার অনেক গণ্যমান্য পরিবারের তিনি হাউস ফিজিশিয়ান। বহু ইউরোপিয়ান এবং চিনা পেশেন্টও ছিল তাঁর। সাধারণ রোগভোগের চিকিৎসা করলেও গিরীন্দ্রশেখরের মূল আকর্ষণ ছিল মনের রোগ। সে সময় দেশে দু-একটা ‘পাগলা গারদ’ থাকলেও চিকিৎসা যে তেমন কিছু ছিল না তা বলাবাহুল্য। আর কেবল পাগলদেরই যে মনের রোগ ‘হয়’ এমন তো নয়। এমন অজস্র লোক আছে যারা বিভিন্নমাত্রায় মানসিক রুগী। শুচিবাইয়ের ঠেলায় দিনের মধ্যে কতবার যে হাত ধোয় তার ঠিক নেই (করোনার বাজারে নিজেকে কিন্তু তা ঠাওরাবেন না দয়া করে); কোনও কাজ করার আগে এক থেকে পঞ্চাশ অব্দি গুনছে। গুনছে তো গুনছেই। বাধা যদি পেয়েছে তো কাজের দফারফা।

বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা যখন ক্রমশ খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে, সেই প্রেক্ষাপটে মন-চিকিৎসায় গিরীন্দ্রশেখরের আগমন। পত্রপত্রিকায় ফ্রয়েড সম্বন্ধে পড়ে মনঃসমীক্ষণ এবং সম্মোহনবিদ্যার প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সাইকোলজি-এমএসসি ব্যাচের ছাত্র তিনি। সেই বছর বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার ছাত্রদের মধ্যেও তিনি প্রথম। ১৯২১ সালে সাইকোলজিতে ডিএসসি ডিগ্রির জন্য তিনি যে থিসিস লেখেন সেটির নাম কনসেপ্ট অফ রিপ্রেশন। সেটাই পরে বই হয়। ফ্রয়েডের ভাবনার সঙ্গে যে তাঁর আশ্চর্য মিল সেটা Great men think alike প্রবাদটিকেই আরেকবার প্রমাণ করে। কারণ ১৯২১ সালেই ফ্রয়েডের লেখার ইংরাজি অনুবাদ কলকাতায় পৌঁছোয়। তার আগে ফ্রয়েডের জটিল তত্ত্বের খুঁটিনাটি জানা তাঁর পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিল না। ফ্রয়েডের সঙ্গে তাঁর ভাবনার অমিলও ছিল অনেক। তা নিয়ে দুজনের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক চলেছে। দুজনের মধ্যে যে পত্রবিনিময় হয়েছিল তারই সঙ্কলন পরবর্তীকালে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়। নাম ‘বোস-ফ্রয়েড করেসপন্ডেন্স’। গিরীন্দ্রশেখর নিজের মত করে এদেশে গড়ে তুলেছিলেন সাইকিয়াট্রি ডিসিপ্লিনটিকে। তিনিই ভারতবর্ষের প্রথম প্র্যাক্টিসিং সাইকিয়াট্রিস্ট। পশ্চিমি ধ্যানধারণার সঙ্গে তিনি মিশিয়েছিলেন ভারতের নিজস্ব জ্ঞানের উত্তরাধিকার। পারিবারিক কারণে সে বিদ্যের জোর তাঁর ছিল। এমনকী এদেশের লোকায়ত টোটকা চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও তিনি তাঁর নলেজ-সিস্টেমের অঙ্গ করতে দ্বিধা করেননি।

মনোবিদ্যার জটিল তত্ত্বকথায় না ঢুকে তাঁর লেখা থেকে দু-একটি উদাহরণ দিই:

‘ছেলে বলিল, বাবা আম পড়ে কেন? বাবা বলিলেন, মাধ্যাকর্ষণ। ছেলে কথাটা বুঝিতে না পারিয়া বলিল, বাবা মাধ্যাকর্ষণ কেন হয়? বাবা বলিলেন, চুপ কর ব্যাটা— অমন হয়। ছেলে বুঝিল। কিন্তু থাবড়া দিয়া সব ছেলেকে বুঝান যায় না। এই কারণ-ধারার বাস্তবিকই কি অন্ত নাই? বৌদ্ধরা বলিলেন, ইহা অনন্ত। ভক্ত বলিলেন, ভগবানই ইহার মূল। নাস্তিক বলিলেন, সব জিনিসের কারণ খুঁজে ভগবানে এসে চুপ করে গেলে কেন? ভক্ত বলিলেন, ও-সব সহজে বোঝা যায় না, সাধন-ভজন চাই। ভগবৎ প্রেম জাগলে সব বুঝতে পারবে। সাধারণ লোকে ঘর-করণা চালাইবার জন্য জটিল প্রশ্নের প্রয়োজনই দেখিল না। তাহার এ দিকে মোটেই ঘেঁসিল না। কিন্তু দার্শনিক চুপ করিবার লোক নহেন, ওই সব ‘কেন’ লইয়া বাদ-বিতণ্ডাই যে তাঁহার জ্ঞানের খোরাক…’

.

‘…আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করিতেছি, এ ধারণা মনে থাকিলেও আমাদের ইচ্ছা সব সময়ে বাস্তবিক পক্ষে স্বাধীন নহে। কোন কোন দার্শনিকের মতে, আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা একেবারেই নাই। আমরা কেবল জ্ঞানের অভাবেই ইচ্ছার কারণ ঠিক করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যের ইচ্ছা একেবারেই পারিপার্শ্বিক ঘটনার দাস।’

(সুধী বন্ধুরা শেষ কথাটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখা দরকার। নিজেকে স্বাধীন ভাবার ভ্রান্তি তাহলে কিছুটা দূর হবে)

গিরীন্দ্রশেখরের উদ্যোগে ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সাইকো-অ্যানালিটিক্যাল সোসাইটি (এর দপ্তর রয়েছে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পাশে পার্সিবাগান লেন-এ বোস-বাড়ির চৌহদ্দিতে)। দাদা রাজশেখর বসু ১৯৩৮ সালে সোসাইটিকে কলকাতার তিলজলায় বেদিয়াডাঙ্গা রোডে বিশ হাজার টাকা মূল্যের একখণ্ড জমি ও বাড়ি দান করেন। সেখানেই গড়ে ওঠে লুম্বিনী পার্ক মেন্টাল হসপিটল। রাজশেখরের আনুকূল্যে বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে আসে বিনামূল্যের আসবাবপত্র, ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম। তাঁরই উদ্যোগে কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা গ্যাস বার্নার বসিয়ে কেরোসিন থেকে গ্যাস তৈরির ব্যবস্থাও করে দেন।

ডাক্তার হিসাবে গিরীন্দ্রশেখর ছিলেন ধ্বনন্তরী। বিধান রায়ের মত তাঁরও ভিজিট ছিল ৬৪ টাকা। সে সময় মনের অসুখের তেমন ওষুধপত্র ছিল না। যা দু-একটা ছিল সেগুলোই তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করতেন। রুগীর উপশমও হত যথেষ্ট।

কিন্তু রেনেসাঁস-চরিত্রের মানুষরা তো কেবল এক কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে পারে না। তাঁদের প্রতিভার বিকাশ হয় বহুমুখী। গিরীন্দ্রশেখর চর্চা করেছেন পুরাণ-ইতিহাস। অনুবাদ করেছেন ভগবদ-গীতা। লিখেছেন শিশুসাহিত্য। তাঁর বিখ্যাত বই ‘লাল কালো’। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ইতিহাস বইয়ে লেখে না। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সাঙ্কেতিক বার্তা কোডিং-ডিকোডিং তিনি পুলিশের নাকের ডগায় বসে করে গেছেন। কাকপক্ষী টের পায়নি কোনওদিন। শেষ বয়সে ভাইপো ডাক্তার বিজয়কেতু বসুকে ইঙ্গিতে জানিয়েছিলেন সে কথা। এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায় অজানা তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। রাজশেখর ছিলেন মানিকতলা বোমা মামলায় অরবিন্দ ঘোষের দলের বোমার ফর্মুলা এবং মশলার যোগানদার। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের বেঙ্গল কেমিক্যাল ছিল উৎস। কারখানা থেকে বোমার মশলা পাচারের সময় রাজশেখর সম্ভবত সায়ানাইড ক্যাপসুল সঙ্গে রাখতেন। কারণ, ধরা পড়ে গেলে সেলুলার জেলের অত্যাচার যে তাঁর অসক্ত শরীর সইতে পারবে না তা তিনি ভালো করেই জানতেন।

আজ দেশজোড়া লকডাউনে সকলেই প্রায় গৃহবন্দি। অনেকেই ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। ফুরিয়ে আসছে রসদ। অধিকাংশের তো প্রথম দু-এক দিনেই সব খতম। তারা আজ ভারতবর্ষের রাস্তায়। হেঁটে চলেছে এক নিরুদ্দেশ লংমার্চে। ফেসবুকজীবী মধ্যবিত্ত আমরা সেই শূন্য পাকস্থলী, ক্ষতবিক্ষত পায়ের প্রতি সমবেদনা জানাতে পারি। হয়তো দিতে পারি ‘ত্রাণ’ও। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের উদ্বেগ এবং মানসিক যন্ত্রণা কি আমরা রক্তেমাংসে অনুভব করতে পারি? না পারি না। কারণ এই ‘অপর’ থেকে এতদিন আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে পেরেছিলাম। কারখানা লকআউটে শ্রমিক বস্তিতে কেন চোলাই বিক্রি বেড়ে যায়, খরায় সর্বস্বান্ত বিদর্ভের চাষি কেন গলায় কীটনাশক ঢেলে দেয় আমরা বুঝতাম না। জলজঙ্গল উজাড় করে আদিবাসী মানুষের জমি রাষ্ট্র কর্পোরেট কোম্পানির হাতে তুলে দিলে অসুবিধা কোথায় বুঝতাম না তাও। বোঝার চেষ্টাও করতাম না। লকডাউন আমাদের সেটাই বুঝিয়ে ছেড়েছে। এই মুহূর্তে আমার আপনার মত অসংখ্য মানুষ কাজ হারানোর আশঙ্কায় নির্ঘুম। লকডাউনের শেষে কাজের জায়গায় পৌঁছে হয়তো অনেকেই দেখবেন কাজটাই আর নেই। সন্তানসন্ততির মুখ চেয়ে তাই ক্রমাগত বাড়ছে মানসিক চাপ। নব্যযুবক-যুবতী যারা একটা কাজের আশায় জীবন বাজি রেখে লড়ছে তারাও হতবুদ্ধি। কী হবে? কবে হবে? সুস্থ-স্বাভাবিক, প্রেম-ভালোবাসায় ভরা একটা জীবন কি আর পাওয়া হবে এ জীবনে?

আগামীতে যাদের কিছু মাত্র সামর্থ্য থাকবে তাদেরই দাঁড়াতে হবে এই মানুষগুলোর পাশে। তারাই হবে অন্য মানুষের সাইকিয়াট্রিস্ট। এই লেখার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আপনাকে এইটুকু মনে করিয়ে দেওয়া যে বঙ্গবাসী এবং ভারতীয় হিসাবে আপনি এক উজ্জ্বল ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আপনার ইতিহাসেই রয়েছে। তর্কহীন, যুক্তিহীনভাবে কিছু মেনে নেওয়া আপনাকে মানায় না। গড্ডলিকাপ্রবাহ আপনার জন্য নয়। গড্ডলিকা শব্দটির অর্থ মনে আছে তো— ভেড়ার পালের মত পরস্পরের অনুসরণ; অপরকে অন্ধভাবে অনুসরণ। মনে রাখবেন সামগ্রিক ব্যবস্থা চায় আপনি সেটাই করুন। সেটা যে কত ভালো কাজ তা বোঝাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে গড়ে উঠেছে ফেক নিউজ ইন্ডাস্ট্রি। আপনাকে ‘প্রোগ্রামিং’ করতে লড়ে যাচ্ছে কত না আইটি-ভাইটি-বোনটি। তাদের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা শেয়ার হয়ে চলেছে তা একেবারে লক্ষ্মী ঘিয়ের মত ‘বিশুদ্ধ’ ঘৃণা। আসলে মানুষের ভাবনাচিন্তার উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে ধর্ম ভাঙিয়ে রাজনীতি করা এই লোকগুলো এবং তাদের প্রভু— দেশের লুটপাট চালানো বেওসায়িদের সমূহ ক্ষতি।

শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন ইউরোপের সঙ্গে আমাদের তফাত কেবল চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতায়। তাদের অগ্রগতির মূলে রয়েছে চিন্তা করার প্রবৃত্তি। ৯৯ শতাংশ ভারতবাসীর যা নেই। মেনে নেওয়াতেই তাদের আনন্দ। অন্ধের মত অনুসরণেই তাদের স্বস্তি। তাই তো দেশজুড়ে গুরুদেবদের এমন রমরমা। যাঁরা বলেন সবকিছুতে রাজনীতি করবেন না তারা আসলে আপনাকে এই ভাবনার কাজটি থেকেই দূরে রাখতে চায়। আপনার চাকরি থাকবে কি না, আপনার অসুস্থ সন্তান হাসপাতালে ঠিক চিকিৎসা পাবে কি না— এ সবই নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা। তাই রাজনীতি করা ছাড়া অপনার মুক্তি নেই। শিরদাঁড়া সোজা রেখে প্রশ্ন করুন— ওটাই রাজনীতি। ভাগ্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভাগ্য বলে কিছু হয় না।


সঙ্গের ছবি: দুই বন্ধু— প্রফেসর ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসু এবং প্রফেসর ডা. সিগমুন্ড ফ্রয়েড

তথ্যসূত্র

  • গিরীন্দ্রশেখর বসু: অগ্রন্থিত বাংলা রচনা। সম্পা. অমিতরঞ্জন বসু, অনুষ্টুপ।
  • সাম্পান রাজশেখর বসু সংখ্যা।
  • ডা. বিজয়কেতু বসু ও দীপঙ্কর বসুর সাক্ষাৎকার।
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. গিরীন্দ্রশেখর বসুর পিতা চন্দ্রশেখর বসু সুলেখক ছিলেন। মূলত ধর্ম বিষয়ক লেখা লিখলেও তার বিজ্ঞান বিশয়ের লেখাও আছে। রাজশেখর বসুরা চার ভাই তাঁরা সকলেই স্বনামধন্য। এই লেখায় এক জেয়গার সাথে আমি একমত নই। চন্দ্রশেখর বসুর উলা- বীরনগর ছেড়ে আসার সাথে ব্রাহ্মণ বিরোধিতা সম্পর্ক নেই। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বীরনগরে ম্যালেরিয়া জ্বরের কারণে মহামারী ঘটেছিল, যে কারণে ঐ সময় প্রায় বীরনগরে দশ হাজার মানুষের জীবনহানি ঘটেছিল, অনেকেই দেশান্তরী হন, ঐ পরিবারটি তেমনই ছিল। উলা-বীরনগরের ম্যালেরিয়া দূরীকরণে ঐ পরিবারের বিরাট ভূমিকা রয়েছে যা মহামারী দূরীকরণের আদর্শ। গিরীন্দ্রশেখরের দাদা কৃষ্ণশেখর বসু (১৮৮৪-১৯৭১খ্রিঃ) ছিলেন Superintendent, Imperial Records Department, Govt. of India। তিনি বীরনগরের বাড়িতে বাস করতেন তিনি বীরনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং মহামারীর পর নতুন করে শহরটি গড়ে তোলার জন্য আজীবন সচেষ্ট ছিলেন।

    • আপনার মতামত সম্পূর্ণ ঠিক। ম্যালেরিয়ার মহামারী একটা কারণ তো ছিলই। তবে আমি যা লিখেছি সেটা রাজশেখরের নাতনির ছেলে দীপংকর বসুর কাছে শোনা।

আপনার মতামত...