লেনিন সত্যিই ছিলেন ব্যতিক্রমীদের একজন

ফিদেল কাস্ত্রো

 

ফিদেল কাস্ত্রো-র কয়েকটি বক্তৃতার অংশ গ্রন্থিত করে এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় কিউবার ‘গ্র্যানমা’ পত্রিকায়। তার বাংলা ভাষান্তর চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর পাঠকদের জন্য। তর্জমা: সত্যব্রত ঘোষ

কোনও একটি প্রক্রিয়ায় এবং সম্ভবত কোনও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ চিন্তন, মনন বা এক ব্যক্তির ধীশক্তির তাৎপর্যপূর্ণ অবদান অতি দুর্লভ। লেনিন ছিলেন এক অবিশ্রান্ত অন্বেষক এবং কর্মী। বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক বোধ অর্জন করবার পর তিনি জীবনে এক মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেননি, অন্বেষণে তিনি ছেদ ঘটতে দেননি, অবিরত চর্চার মাধ্যমে বিপ্লবের পথ নির্ধারণ করেছেন।

কোনও যোদ্ধাই লেনিনের থেকে বেশি বৌদ্ধিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হননি। ভাবলে অবাক হতে হয় আদর্শের রণক্ষেত্রে তিনি কতবার যুদ্ধে নেমেছেন। লেনিনের ইতিবৃত্তের সঙ্গে আর কারও জীবন তুলনা করা যাবে না, যাঁরা ব্যক্তিগত সৌকর্যে অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন।

লেনিন সত্যিই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী। ওনার জীবন এবং কর্মের বিবরণ সাদা চোখে পড়ে এবং ওনার চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ডকে বস্তুভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়। আমি আবার বলছি সব মানুষের চোখে উনি সত্যিই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী।

আজীবন নতুন নতুন তত্ত্ব নির্মাণের রাস্তা খোলাই ছিল লেনিনের সামনে। তা না করে উনি সারাক্ষণ এমন একটি উপযুক্ত কর্মভূমি খুঁজছিলেন যেখানে উনি নিজের তত্ত্বকে প্রয়োগ করা যায়।

লেনিনের প্রতি আবেগঘন সম্মান আমরা জানাই বটে। কিন্তু ওনার জীবন এবং কর্মকাণ্ড অধ্যয়ন এবং ওনার চিন্তাধারা এবং মতবাদের গভীরে প্রবেশ করলে মানুষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পরিপ্রেক্ষিতে এক অমূল্য সম্পদ অর্জন করতে পারবে।

ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের মূল্যায়ন আরও উন্নত করতে পারলে দেখা যাবে যে লেনিনের সঙ্গে মার্ক্স সর্বোৎকৃষ্ট ভাবনা, মেধা ওবং নিজেদের প্রয়াসের কারণে মানবসভ্যতার নিরিখে বিশিষ্ট হয়ে রয়ে যাবেন।

২৬শে জুলাই ১৯৫৩[1]-র আগের মাসগুলি আমাদের মনে প্ড়ছে। কমপ্যানেরো-রা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেরিলা আক্রমণে যেতাম তখন। আমাদের সঙ্গে থাকত মার্ক্স আর লেনিনের বই। মনে আছে মোনকাদা হানার পরে তল্লাশি করতে গিয়ে পুলিসের হাতে লেনিনের কিছু বই চলে যায় এই কারণে যে সেগুলি লেনিনের লেখা বই।

মনে আছে মোনকাদা মামলার সময়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এক সরকারি উকিল আমাদের বিরুদ্ধে যে গুরুতর অভিযোগটি নিয়ে তাঁর সবচেয়ে ছিটগ্রস্ত প্রশ্নটি আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেন, তা হল আমাদের কাছে লেনিনের বই আছে কিনা, আর থাকলে সেগুলি আমাদের কিনা।

গোড়া থেকেই লেনিন শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ছিলেন না। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন এক কর্মবীর, অক্লান্ত এক চিরকালীন বিপ্লবী।

একটি মতাদর্শকে আরও উন্নত করবার সুযোগ হয়েছিল ওনার। এবং যে কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি সেই মতাদর্শকে প্রয়োগ করেছিলেন, তার চেয়ে দুরবস্থা কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে সত্যিই অসম্ভব।

আমরা লেনিনের কৃতি অনুধাবন করেই বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য আমি যখন লেনিনজম নিয়ে বলছি, তখন মার্ক্সিজম নিয়েও বলছি। মার্ক্সের চিন্তাধারাগুলির নির্যাসকে উন্নততর করেছিলেন লেনিন। বিশেষ করে লেনিনের একটি চিন্তন– রাষ্ট্র ও বিপ্লব, আমাদের অনেকগুলি ধারণাকে স্পষ্ট রূপ দিয়েছিল, যার দ্বারা আমরা আমাদের বৈপ্লবিক কৌশল নির্ধারণে, আমাদের বৈপ্লবিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের সময়ে অত্যন্ত আলোকিত হয়েছিলাম।

যে সময়টাতে ইউরোপের আলোকদিশারী বিপ্লবী চিন্তাবিদরা রাশিয়ান বিপ্লবীদের একেবারেই পাত্তা দিচ্ছেন না, যখন ওনারা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে রাশিয়ার বিপ্লবীদের দিকে তাকাচ্ছেন, যখন ওনাদের অনেকেই লেনিনের ভাবনাগুলিকে এমনকি রাশিয়ান জারদের বিরুদ্ধে মার্ক্সীয় বিপ্লবের সম্ভাবনাটুকেও কৃপাদৃষ্টিতে দেখছেন, লেনিন তখন ওনার দীর্ঘ তীর্থযাত্রার পথিক– সেই দেশটাতে মার্ক্সীয় বিপ্লব ঘটানোর জন্য ওনার দীর্ঘ, প্রসারিত সংগ্রামে লিপ্ত।

কিন্তু ইতিহাসের একটি বস্তুনিরপেক্ষ অধ্যয়নও ওনার তুল্য আরেকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারবে না, তুলে ধরা যায় না। লেনিনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন কোনও চিন্তনই নেই, কারণ লেনিনের চিন্তন শুরু থেকে শেষ অবধি বিশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত। এবং বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার মেরুদণ্ড এবং মর্ম হয়ে তা রয়ে গেছে।

এবং সেই দেশের একেবারে হৃদয়ে, জার সাম্রাজ্যের হৃদয়ের থেকে এই তুখোড় মানুষটির উত্থান ঘটেছিল, যেখানে উনি মার্ক্সীয় মতাদর্শকে অসামান্য এক সৃজনশীল উপায়ে প্রয়োগ করেছিলেন।

যাবতীয় অতীন্দ্রিয়করণ এবং বিকৃতি থেকে উনি মার্ক্সের চিন্তনগুলিকে রক্ষা করে দেখিয়েছিলেন যে উনিই কতদূর ঠিক। ঐতিহাসিক তথ্যাবলি ঘাঁটলে দেখা যাবে যে ওইসময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কত ধরনের চিন্তার স্রোত বহমান ছিল, যেগুলির বিরুদ্ধে লেনিনকে লড়তে হয়েছে। বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্কটে, ব্যর্থ মুহূর্তগুলিতে এবং আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্রগুলিতে উনি লড়াইয়ের ময়দান না ছেড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য নতুন নতুন অবদান রেখেছেন।

লেনিন বলতেন, বিপ্লব তখনই বাস্তব চেহারা নেবে যখন সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। সত্যি কথা বললে, আমদের বিপ্লব দেখিয়েছে যে নিজেকে বাঁচাবার জন্য শক্তিশালী সাধনগুলি তার আয়ত্তে আছে।

আমরা লেনিনের প্রশস্তি থামাব না, প্রতিদিন লেনিনের গুণগান গাইব। আমরা ওনার অভাব বোধ করি বড় বেশি।

ওরা (আমেরিকা) কি কখনও কল্পনা করতে পেরেছিল আমাদের এতটুকু একটা দেশ, তার এত কাছে হয়েও তার থেকে একটা পয়সা, একটা অস্ত্র কোনও কিছু না গ্রহণ করে সম্পূর্ণ নিজের জোরে দাঁড়িয়ে আছে! তার নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে! আমাদের পরম্পরায় দেশপ্রেমিক এবং নায়কদের এবং মার্টি-র চিন্তাধারা থেকে অনুপ্রেরিত হওয়ার পাশাপাশি মার্ক্স, লেনিন, এঙ্গেলস এবং অন্যান্যদের ভাবনা গ্রহণ করে আমরা ঠিক করেছি কেমন সমাজ আর কেমন দুনিয়ায় আমরা বাঁচব।

এখানে বলা প্রয়োজন যে লেনিন শুধুমাত্র সেরা সৃজনশীল, সেরা লড়াকু এবং সেরা মেধাসম্পন্ন মানুষদের একজন ছিলেন না। উনি নৈতিক সাহসসম্পন্ন সেরা মানুষগুলির মধ্যেও অন্যতম। যে সাহস উনি জীবনভর এবং সামগ্রিক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষাগুলিতে কঠিন সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে দেখিয়ে গেছেন।


[1] কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার একনায়ক ফালজেনিও বাতিস্তাকে উৎখাত করবার লক্ষ্যে সান্তিয়াগো দ্য কিউবায় অবস্থিত সেনা ব্যারাকগুলিতে লাগাতার আক্রমণ মারফত কিউবার বিপ্লব শুরু হয়, যার শেষ ঘটে ১৯৫৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর— একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ম্যানুয়েল উরুতিয়া ল্লিও-র সরকার গঠিত হয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...