নীলোৎপল বসু
লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও রাজনীতিবিদ, ভারতের প্রাক্তন সাংসদ
এমন এক ব্যক্তিত্বের সার্ধশতবর্ষ উদযাপন করা— বিশ্বেতিহাসের বাঁক বদলে যাঁর প্রত্যক্ষ অবদান অনস্বীকার্য এবং যাঁর ভাবাদর্শ বর্তমান ও আগামীকে প্রভাবিত করার ক্ষমতায় উজ্জ্বল— এর থেকেই বুঝতে পারা যায় এখনও তিনি কতটা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। রুশ বিপ্লবের নেতৃত্বদান করে পিছিয়ে-পড়া রাশিয়াকে জারের শাসনমুক্ত করাই শুধু নয়, এই পৃথিবীর বুকে প্রথমবারের মত শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বাধীন একটি দেশের প্রধান স্থপতিও ছিলেন তিনি, লেনিন। সব দিক থেকে দেখতে গেলে সেই মঞ্চটি ছিল অদ্বিতীয়, অনন্য— রাষ্ট্রচালনার জন্য এমন কিছু নিয়মনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্র, যার দার্শনিক ও ভাবাদর্শিক ভিত্তিগুলি মানুষের ইতিহাসে জন্ম দিল একটি নতুন প্রবাহের।
শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিকতার কথা বাদ দিলেও মহামতি লেনিনের বিষয়ে জানার যে নতুন আগ্রহ তৈরি হয়েছে তা-ও অগ্রাহ্য করার মত নয়। এই আগ্রহ ব্যক্তি লেনিনকে নিয়ে ততটা নয়, যতটা তাঁর মতাদর্শ ও দর্শনকে নিয়ে। এই আগ্রহ বিশেষভাবে চোখে পড়তে শুরু দু বছর আগে থেকে, যে বছর মার্ক্সের দ্বিশতবর্ষ পালিত হল সারা বিশ্ব জুড়ে।
তাঁর ‘How to change the world: Tales of Marx and Marxism’ নামক গ্রন্থে বৃটিশ ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী আলোচক এরিক হব্সবম্ তাঁর সঙ্গে পুঁজির বিশ্বখ্যাত উদ্গাতা জর্জ সোরশের একটি আলাপের উল্লেখ করেছেন। সেই আলাপে সোরশ মার্ক্স সম্বন্ধে অধ্যাপক হব্সবমের অভিমত জানতে চান। সোরশকে ভাল করেই জানতেন বলে তর্কবিতর্ক এড়ানোর জন্য হব্সবম্ তাঁর উত্তরে কিছুটা যেন ইতস্তত ভাব দেখান। কিন্তু সোরশ নাছোড়। বলেন, “ওই মানুষটি দেড়শো বছর আগেই পুঁজিবাদে এমন কিছু সম্ভাবনা দেখেন যা আমাদেরও নজরে রাখা উচিত।” সেপ্টেম্বর ২০০৮-এর বিশ্বব্যাপী মন্দার সময় এই আগ্রহ বিশেষভাবে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ওই বছরের অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ডের ফাইনান্সিয়াল টাইমস যখন হেডলাইন করেন ‘Capitalism in Convulsion’ (দুর্বিপাকে পুঁজিবাদ), তখন যেন মনে হয় সাধারণের আলোচনায় মার্ক্সের ফিরে আসাটা একটা সুমধুর প্রতিশোধ বই কিছু নয়!
মার্ক্স থেকে লেনিনে
মার্ক্স পুঁজির বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেন। পুঁজির কাজ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মুনাফা নিশ্চিত করা, শোষণের মাধ্যমে। পুঁজিবাদ-পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনাসমূহ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের ধাপগুলির থেকে এখানে সে আলাদা। পুঁজি আবার উৎপাদনের পদ্ধতি ও শ্রমশক্তির ওপর দখল-ইত্যাদি বিষয়ে মালিকে-মালিকে মেরুকরণের কারণও হয়ে উঠতে পারে। পুঁজির এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিই এর ক্রমাগত কেন্দ্রীভবনের কারণ। এভাবেই নিজেকে রক্ষা করার ও বাড়িয়ে তোলার তাগিদে পুঁজি উৎপাদিকাশক্তিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলতে চায়।
এখানেই মার্ক্সের তাত্ত্বিক উত্তরাধিকার নিয়ে লেনিনের আবির্ভাব। তিনি বললেন, পুঁজির প্রসার জন্ম দেবে লগ্নি পুঁজির (Finance Capital), যা কী না শিল্পজাত (Industrial) ও ব্যাঙ্কজাত (Banking) পুঁজির মিলিত রূপ। পুঁজির এমন প্রকাণ্ড প্রসার এবং ফলস্বরূপ উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণে বিপুল বৃদ্ধি চাপ ফেলতে শুরু করবে দেশীয় সীমানার মধ্যে থাকা ছোট ছোট বাজারের ওপর। এর থেকে ভিত্তি তৈরি হবে জাতীয় লগ্নি পুঁজি-নির্ভর সাম্রাজ্যবাদের। এখানেই একজন মার্ক্সবাদী হয়ে তাত্ত্বিকভাবে ভাবনার দিগন্তকে আরও কিছুটা বিস্তৃত করে দিলেন।
তবে পুঁজিবাদের প্রান্তিক দশা যে সাম্রাজ্যবাদ, লেনিনের এই উপসংহার মোটেও নিছক তাত্ত্বিক অনুশীলন ছিল না। তত্ত্ব ও প্রয়োগের নকশা বা Praxis নিয়ে স্বচ্ছ ধারণাই সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধিকে পোক্ত করেছিল। লেনিন বারংবার বুঝিয়েছেন, কীভাবে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যকার বিভাজন এবং একের পর এক বুর্জোয়াতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত সরকারকে সমর্থন দান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইকে দুর্বল করে। প্র্যাক্সিসের, সুতরাং, আরও একটু বিশদ তাত্ত্বিক আলোচনার দরকার পড়ল। আলোচনা হল সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের মধ্যকার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করার পথ প্রশস্ত হল। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের কণ্ঠে শান্তির যে জোরালো দাবি উঠল, অক্টোবর বিপ্লবে জয়লাভ তার অন্যতম কারণ।
লেনিন ও বিপ্লব
অক্টোবর বিপ্লব ও তার ফলশ্রুতিতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টা এতটাই নজরকাড়া ছিল যে প্রধান নেতা ও ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’-এর নেপথ্যনায়ক, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের গড়ে-ওঠার দিনগুলির প্রধান কাণ্ডারী হিসাবে লেনিনের ভূমিকা লগ্নি পুঁজি ও তার কর্মপ্রণালীকে উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানকে ঢেকে দেয়।
বর্তমানের প্রেক্ষিতে লেনিনের পরিচালনাধীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের দুটি ক্ষেত্রে কাজের কথা উল্লেখ করব।
প্রথম ক্ষেত্রটি বৈশ্বিক স্প্যানিশ ফ্লু-র সঙ্গে সম্পর্কিত। সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনতি পরেই, ১৯১৮ সালের গোড়ার দিকে এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয়, এবং এর ফলে পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ প্রাণ হারান। বিপ্লবে সাফল্যলাভের পরেই শান্তিপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লেনিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। এ-বিষয়ে যুদ্ধলোভী দুটি সাম্রাজ্যবাদী ক্যাম্পের কোনও সমর্থন মেলে না, যদিও এই দুই দেশের মানুষই বিশাল সংখ্যায় এই মহামারির কবলে পড়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার এই প্রস্তাবে সমর্থন না মিললেও ১৯২০ সালে তিনি লেখেন— “এই মহামারির মোকাবিলায় আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে, এবং গৃহযুদ্ধের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।”
সাম্রাজ্যবাদের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের ফলে লেনিনের বুঝতে দেরি হয় না, যে এই সমস্যার মোকাবিলা না করতে পারলে উন্নতি তো দূর অস্ত, নতুন দেশ হিসাবে প্রাথমিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের যেটুকু গুছিয়ে ওঠা দরকার সেটুকুও আয়ত্ত করা সম্ভব হবে না। জাতপাতের ইহুদিবিদ্বেষী রাজনীতির প্রকোপে রাশিয়ার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যকার অনৈক্য ছিল নতুন দেশের কাছে আশু বিপদ। ঐক্যের ডাক দিলেন লেনিন। “অন্যান্য দেশেও আমরা দেখি, পুঁজিবাদীরা শ্রমিকদের নজর ঘোরানোর জন্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে দ্বেষ উগরে দেয়। শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত শত্রু যে পুঁজি, তার থেকে নজর ঘোরানোই তাদের উদ্দেশ্য। যে দেশগুলিতে জমিমালিক ও পুঁজিবাদীদের লালিত দাসপ্রথা শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে অজ্ঞানতার চাষ করেছে, সেখানেই এই ইহুদিবিদ্বেষ। ইহুদিদের বিরুদ্ধে ছড়ানো মিথ্যা অপবাদগুলি সবথেকে অনবগত ও নিপীড়িত মানুষেরাই বিশ্বাস করে থাকে। প্রাচীন সামন্ততন্ত্রকে বাঁচিয়ে তোলা ছাড়া এ কিছু নয়, যে অবস্থায় পুরোহিতেরা ধর্মদ্রোহিতার দায়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারত মানুষকে, যেখানে কৃষকেরা ছিল দাস, আর মূক জনতাকে পিষে মারা হত কথায় কথায়। এই প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে মানুষের দৃষ্টি।”
লেনিনের লগ্নি পুঁজি ও বিশ্বায়নের সৃষ্টিতত্ত্ব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বছরগুলোয় ধনী দেশের লগ্নি পুঁজির রমরমা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে তার সহায়তা ছিল অব্যাহত। ত্রিশের দশকের মহামন্দা, ইতালি ও জার্মানিতে মাথা চাড়া দেওয়া ফ্যাসিবাদ এবং আগের হারানো অঞ্চলগুলোকে দেশের সঙ্গে পুনঃসংযোজন করতে লালায়িত চরম সমরবাদী শক্তিগুলোর হাত ধরে আমরা প্রবেশ করলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে। যুদ্ধশেষে ফ্যাসিবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। নিজের দেশের পাঁচ কোটি সন্তানকে যুদ্ধের আগুনে উৎসর্গ করা সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তি হিসাবে মান্যতা পেল।
নিজেদের মধ্যে হানাহানি যে আখেরে নিজেদের পক্ষেই ক্ষতিকর, যুদ্ধোত্তর বাস্তবতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মনে এমন একটা উপলব্ধির জন্ম দিল। তার ফলে আমরা পেলাম অপেক্ষাকৃত শান্ত ও সুস্থিত কিছুটা সময়। এই সময়কালকে আবার ‘পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ’ বলেও অভিহিত করা হল। অ্যামেরিকা হয়ে উঠল সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের অবিসংবাদী নেতা।
এ-কথা লেনিনের বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল— “সাম্রাজ্যবাদের সময়ে লগ্নি পুঁজির বাড়বাড়ন্তের হাত ধরে ‘পুঁজিবাদী একাধিকারীদের “ব্যবসায়িক কার্যকলাপ” কালক্রমে লগ্নি গোষ্ঠীশাসকদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।” সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ‘পুঁজির রফতানি’-র চরিত্রগুলির পুনর্বিশ্লেষণ করে তিনি বললেন— “লগ্নি পুঁজি তার জাল, আক্ষরিকভাবেই যা জাল, সমস্ত দেশের ওপর ছড়িয়ে দিতে চায়।” আরও বললেন— “সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত অভিজ্ঞান শিল্পজাত পুঁজি নয়, লগ্নি পুঁজি।”
যাই হোক, যুদ্ধের পর শুরু হল দেশভিত্তিক পুঁজিবাদের সমকেন্দ্রিক যাত্রার পালা, যা কিছুটা ত্বরান্বিত হল সত্তরের দশকের গোড়ায়, পুঁজিবাদের ফিরে-ফিরে আসা সঙ্কটের কারণে, এবং কালক্রমে যা রূপ নিল অধুনার বিশ্বায়নে। সাম্রাজ্যবাদের একই পর্যায়ের মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম পুঁজির বিপুল আহরণ এবং কেন্দ্রীভবন, আর বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকে গত তিন দশকের আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির পুঞ্জীভবন। এর ফলে দুনিয়ার চেহারাটা যেন কিছুটা পুনর্বিন্যস্ত হল, যেখানে মুনাফার বৃহদায়নের লক্ষ্যে পুঁজি চাইল সারা বিশ্বে অবাধ গতায়াত। এর ফলে আবার পুঁজির প্রবাহের ওপর যেটুকু শর্তাবলি প্রযোজ্য হয় সেটুকুও সরিয়ে নেবার জন্য চাপ আসতে লাগল। এক কথায় একেই বলা হল আর্থিক উদারীকরণ। এর সঙ্গী অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে নব্য উদারবাদী আক্রমণ দেশগুলোর, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে বিপদে ফেলল। স্বল্প-কর ব্যবস্থার সঙ্গে সংস্কারের এই নমুনা সরকারি ব্যয় কমানোর দিকে নজর দিল, যার ফলে জনশিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত সামাজিক সেবার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে সর্বনাশা ফল ফলল। অর্থের এই বিপুল প্রতিপত্তিতে পরিষেবাসমূহের গণহারে অর্থায়ন ঘটে গেল, যার ফলে যা ছিল জনগণের পাওনা, তা বনে গেল বেচাকেনার বাজারি দ্রব্য। বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিমা কোম্পানির শিকার হয়ে জনস্বাস্থ্যের মতন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। এই সংস্কারের ফল পাওয়া গেল লাগামহীন অসাম্যে, যার সঙ্গে এল প্রবল বেকারত্ব ও আংশিক বেকারত্বের সমস্যা।
বিশ্বায়ন, নব্য উদারবাদ ও অতিমারি
সাম্রাজ্যবাদীদের নজরদারিতে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির হুকুমে তৈরি ‘মানুষের চেয়ে মুনাফা শ্রেয়’ নীতি যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার জন্ম দিল, করোনাভাইরাসের প্রকোপে জনস্বাস্থ্যসঙ্কটের সময়ে দেখা গেল তা কতটা অন্তঃসারশূন্য। ২০০৮-এর বিশ্বব্যাপী মন্দা যদি এই অবস্থার দুর্বলতার প্রতি প্রথম ঈঙ্গিতটা করে থাকে, এই প্যাথোজেন এসে ‘এই ব্যবস্থার বিকল্প নেই’ দাবি যে আদতে কতটা ঠুনকো তা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল! জনস্বাস্থ্যের এই সঙ্কটের মোকাবিলায় প্রয়োজন ছিল যে ব্যাপক হস্তক্ষেপের, নব্য উদারবাদী নীতির ফলে তার মোকাবিলা করার অবস্থায় রইলেন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ।
কিন্তু এ অবস্থা অনভিপ্রেত হলেও অপ্রত্যাশিত কি? লেনিনের বিশ্লেষণ বাদ দিলেও, জেরেমি করবিন বা বার্নি স্যান্ডার্সের মত নেতারাও নিজের নিজের দেশে স্বাস্থ্যের অধিকারভঙ্গ নিয়ে সরব। তাঁদের এই দাবিগুলি মানুষের সমর্থনও পেয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক লেখায় স্যান্ডার্স বলছেন— “পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের দেশ ধনীতম। কিন্তু আয় ও সম্পদের বণ্টনে বিপুল অসাম্যের কারণে বাস্তবে আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের মাসমাইনের পুরোটা এক মাসেই খরচ হয়ে যায়, চার কোটি মানুষকে থাকতে হয় দারিদ্র্যসীমার নিচে, ৮.৭ কোটি মানুষের নেই কোনও বীমাসুরক্ষা (বা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম), আর পাঁচ লক্ষের মাথার ওপরে নেই কোনও ছাদ। করোনাভাইরাস অতিমারি আর অর্থনৈতিক মন্দা— এই দুইয়ের মধ্যে পড়ে আমাদের আশু কর্তব্য আমাদের সমাজের ভিত্তিগুলোকে ফিরে দেখা। বোঝার চেষ্টা করা, কেন এ সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। আর একটা আরও অনেক বেশি ন্যায্য রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য লড়াই করা। আমাদের মালিকভিত্তিক, অসরকারি স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার অর্থহীনতা আর নিষ্ঠুরতা তো আমরা সকলেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।”
স্যান্ডার্সের মতের গুরুত্ব যে কারও চোখে পড়ছে না এমন নয়। তিনি বলছেন, “ধরে নিন আমরা রুবিকন নদী পার করলাম। ভবিষ্যতের ইতিহাসবেত্তারা যখন খোলাবাজারি পুঁজিবাদ থেকে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের দিকে আমাদের অর্থনীতির যাত্রার ইতিহাসকে নথিবদ্ধ করবেন, এই সপ্তাহের কথা তাঁরা লিখবেনই। এ সবকিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্লো মোশনে কোনও বিমান দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখছি।” ওয়াশিংটন পোস্টের “Sanders: The coronavirus shows Bernie won”, এই শিরোনামের একটি ওপিনিয়ন পিস-এ বলা হচ্ছে— “…নোভেল করোনাভাইরাস অতিমারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, পণ্ডিতেরা তা নিয়ে ভাবিত।” এই লেখাটির শেষ হচ্ছে এইভাবে— “বার্নি স্যান্ডার্স, অন্তত তাঁর দর্শন, জয়ী হয়েছে।” করবিনের নেতৃত্বে বৃটেনের লেবার পার্টির অভিজ্ঞতাও অনেকটা একরকম। এঁদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে অতিমারি রোধ করার প্রশ্নে অর্থচালিত নীতি, যা জনস্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে, কতটা সারবত্তাহীন।
একটি ন্যায্য বন্ধুতাপূর্ণ বিশ্বের দিকে
অ্যামেরিকা ও ইউরোপের ধনী দেশগুলিতে এই অতিমারির কারণে মৃত্যুর রেখাচিত্রে চোখ রাখলে স্পষ্ট হয় মৃত্যু রুখতে এই দেশগুলির ব্যবস্থাগত ত্রুটি। এর ফলে তৈরি হচ্ছে ভয়, আর তার হাত ধরে আসছে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
তাঁর সঙ্গে চিনের অগ্রগতি বিষয়ে চিন্তিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আলোচনার কথা বলতে গিয়ে চুরানব্বইয়ের বৃদ্ধ অ্যামেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন। উনি বলছেন, “১৯৭৯ সাল থেকে চিন কতবার নিজেকে যুদ্ধে জড়িয়েছে আপনি তা জানেন? একবারও নয়! আর আমরা কেবলই লড়ে চলেছি।” দেশের ২৪২ বছরের ইতিহাসে অ্যামেরিকা পেয়েছে মাত্র ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। পেয়েছে “বিশ্বের ইতিহাসে সবথেকে লড়িয়ে” দেশের তকমা। এর কারণ অন্য দেশকে চিরকাল নিজের মতে টেনে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছে অ্যামেরিকা— তারা যেন “অ্যামেরিকান প্রিন্সিপলস” অনুসরণ করে চলে।
ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করতে গিয়ে অতিমারির মধ্যেই হু-কে প্রদেয় আর্থিক সাহায্য না দেবার ঘোষণা করে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এবার ক্ষুধাজনিত মহামারির আগাম সতর্কতা দিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প বা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। এই দুই সংস্থাই স্পষ্ট জানিয়েছেন, পারস্পরিক সহায়তা বা বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান না থাকলে এই পৃথিবী দ্রুত এগিয়ে যাবে ধ্বংসের দিকে।
অক্টোবর বিপ্লবের পর লেনিনের একটি ন্যায্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ পৃথিবীর জন্য ডাকে সাড়া দেবার জন্য কেউ ছিল না। একশো বছর পার করে যখন দেখি লগ্নি পুঁজি নিয়ে লেনিনের বিশ্লেষণ ফলে যাচ্ছে, তখন একে পোয়েটিক জাস্টিস ছাড়া অন্য কিছু ভাবার উপায় থাকে না। ‘মানুষের চেয়ে মুনাফা শ্রেয়’— এই মন্ত্র যে দীর্ঘদিন চলতে পারে না তা আজ পুঁজিবাদের গড় থেকেই স্বীকৃতি পাচ্ছে। ফাইনান্সিয়াল টাইমস-এর একটি সাম্প্রতিক সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে— “গত চার দশকের নীতির আমূল বদল এনে নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে। দেশীয় অর্থনীতিতে সরকারগুলিকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। সরকারি পরিষেবাকে গণ্য করতে হবে বিনিয়োগ বলে, বোঝা বলে নয়। আর দেখতে হবে শ্রমের বাজারকে কীভাবে আরও সুরক্ষিত করে তোলা যায়। পুনর্বিন্যাসই হবে আগামীর মূলমন্ত্র…।”
সমস্ত সঙ্কটের ওপর, সুতরাং, জেগে আছে লেনিনের চির-উন্নত শির— হয়ত আগের থেকে আরও অনেক বেশি বাস্তবতা নিয়ে।