মৃণাল চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
১১
একটা সময় বেশিরভাগ চিন্তাই চুপ করে গেল। শুধু কে যেন নানান যন্ত্রের মধ্যে বসে কাজ করে চলেছে। নিশ্চই সেই ছেলেটা যে আমাকে প্রথমে সাহায্য করেছিল।
–হেল্প ডেস্ক?
–না।– অন্যমনস্ক গলায় ছেলেটা বলল— আমি অনেক গ্যাজেটের সঙ্গে থাকি। কোনও নতুন মানুষ ঝামেলায় পড়লে সাহায্য করি। আউটসোর্সিং আর কি।
–কিন্তু আপনাকে তো তাহলে এই বাসের মধ্যে সারা জীবন কাটাতে হয়।
–আমি বাসে নেই তো। আমি আছি আলাস্কায়। বাইরে থেকে কানেক্ট করে আপনাদের সঙ্গে থাকি। পুরনো চিন্তা জানতে ইচ্ছে করে।
–পুরনো চিন্তা মানে?
–অন্য সময়ের চিন্তা। অনেক দূরের। যেমন আপনার।
অদ্ভুত লাগল আমার। আমার চিন্তা কত পুরনো? আমি কত দূরের? ছেলেটা গুনগুন করে বলল—
–এখন অনেক দূরের। ফিরে এলে অন্যরকম। চললাম।
যন্ত্রপাতির শব্দ থামতে একটু সময় লাগল। তারপর কে যেন একটা শব্দ আটকানোর পর্দা নামিয়ে দিল। এখন সব চুপ। এখন আমার ভয় পাওয়ার কথা। কোথায় যাচ্ছি আমি? ফিরতে পারব? কিন্তু সেরকম হল না। যেন হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে আছি। কে যেন বলেছিল আলো ফুটলে ডেকে দেবে। তার অপেক্ষায় আছি। পেরিয়ে যাচ্ছি মাইল মাইল নিঃশব্দ দুনিয়া। কে বলেছিল চিন্তার গতি সব চেয়ে বেশি? বখোয়াস! এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে চিন্তা ফেটেফুটে চুরমার হয়ে যেত। তাই সব নিয়ন্ত্রণ করে রাখা।
বেরিয়ে এলাম চিন্তাসিগনালের বাইরে। সঙ্গে সঙ্গেই পুল্টুশ খুকখুক করে কাশল।
–খাবার-টাবার না খেয়েই তো দিব্যি আছি, কী বলো?
–হ্যাঁ।
–খাবার জিনিসটা অত জরুরি নয়। অনেক ঝামেলা। খাবারে বেশি লোভ থাকা ভালো না। ডাক্তাররা সব কিছুতেই টক্সিন আর পলিউটেন্ট দেখছে।
–তোমার সমস্যা নয় পুল্টুশ। এতদিন ধরে ওই সব কাজগুলো আমায় করতে হচ্ছিল বলে তুমি ফুর্তিতে ছিলে। সেই অর্থে তোমার জীবনে কোনও পরিবর্তন হয়নি।
–সেটা ঠিক কথা। তোমার কনস্টিপেশনের প্রবলেমও আমাকে ফেস করতে হয়নি।
বোদ্ধার মত বলল পুল্টুশ। আর তখনই একটা একতরফা চিন্তা ভেসে এল আমার মনে। এবার অন্য একটা গলার চিন্তা বলল—
–আলো ফুটেছে বাইরে। আপনাদের নামার সময় হয়ে আসছে। ইচ্ছে হলে পর্দা টেনে দিতে পারেন। নাহলে পরে আমরাই খুলে দেব। ধন্যবাদ।
–আমার খুব আলো দেখতে ইচ্ছে করছে পুল্টুশ। পরে কথা হবে।
আমি পর্দা টেনে দিলাম। অন্যেরাও এদিক-ওদিক থেকে টানতে লাগল তাদের পর্দা। চারদিকটা অদ্ভুত বিকেলের আলোয় ভরে গেল। বাইরে তাকালাম। একটা নির্জন রাস্তা। কাছে-দূরে জঙ্গল। একেবারে উত্তরবঙ্গের ছবি। এখানকার জঙ্গল একদম আলাদা। এদের গায়ে পাহাড়ি জলের গন্ধ লেগে থাকে। সেই জল পাহাড় থেকে নদী হয়ে বৃষ্টি হয়ে সরাসরি নামে গাছের মাথায় আর ঘাসজমিতে। জঙ্গল ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে। চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না আমার। জানতে ইচ্ছে করছে বাকিরা কী ভাবছে। আমি গ্রুপে এলাম।
সবাই আছে আর গুঞ্জন এখন তুঙ্গে। সবাই খুশি। মনে হল এক হুলহীন মৌচাকের মধ্যে বসে আছি।
–ভালো ভাবলেন। হুলহীন মৌচাক। তবে মধুর চ্যাটচেটে ব্যাপারটাও নেই।
কে একজন হাসির চিন্তা ছুঁড়ল। আমিও হাসলাম। এক মহিলার গলায় হাসির চিন্তা এল।
–রানি মৌমাছি আছে কিনা জানতে চাইবেন না?
আমি হাসলাম। কিন্তু আমার মন উদাস হয়ে গেল। আমি তো তাই জানতে চেয়েছিলাম। সেই জন্যেই এত দূরে আসা। অনেক মহিলার চিন্তাহাসিতে গ্রুপ ভরে গেল।
–ইনি একটু রোমান্টিক টাইপের।
–নগেনবাবুর মত কাঠখোট্টা নয়।
–হ্যাঁ, নগেন বলল এসব গাছ থেকে ভালো কাঠ হয় না।
সবাই হাসল। আমিও।
–নগেনবাবুকে আমি চিনি। শিলিগুড়িতে দেখা হয়েছিল। উনি তো কাঠেরই ব্যবসা করেন।
আমি বললাম। মহিলাদের মধ্যে চাপা চিন্তা বিনিময় হল। আমরা একটা ছোট নদী পেরিয়ে এলাম।
–আর আপনি কী করেন?
–আমি একটা কলেজে পড়াই। আমি কোচবিহার যেতে চেয়েছিলাম। যাওয়া হল না।
–পুরনো প্রেমিকার কাছে?
মহিলা ভাবলেন। বাকি সব মহিলাদের চাপা হাসি। একজন বললেন—
–মিনুটা না বড্ড ছ্যাবলা।
–এতে ছ্যাবলামোর কী আছে রে মনু? তুইই তো বললি উনি রোমান্টিক মানুষ।
–না, শুধু প্রেমিকার কাছে না। বাবা-মায়ের কাছেও। আমি ইন্দ্রজিৎ।
–আমি মীনাক্ষী। ট্যুরিজমে চাকরি করি। ও মণীষা। ইনকাম ট্যাক্সে।
–আমি নগেন, শীতঘুম কাটিয়ে এই উঠলাম।
চাপা হাসির তরঙ্গ চারদিকে। ঠিক, শীতঘুমের মতই তো।
–আমি আদিত্য। বন-দপ্তরে কাজ করি। একবার বাইরে তাকান।
নগেনকে আলাদা করে তাকাতে হল না। পর্দা সরে গেল বাকি সব জায়গা থেকে। বাইরে দেখলাম। বিকেল পড়ে আসছে। অদ্ভুত মায়াবী রঙে ভরে গেছে চার দিক। দূরে একটা বিরাট নদী। আধখানা দেখা যাচ্ছে এদিকের জানলা থেকে। আকাশে বকের ঝাঁক। নানান ডিজাইনে উড়ে বেড়াচ্ছে। শিরশিরে হাওয়ায় হঠাৎ ঠান্ডা লেগে গেল। সেই নতুন গলা আমাদের কানে ভেসে এল।
–আমরা এসে গেছি। আপনারা তৈরি হয়ে নিন। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকবেন সন্তোষ পাল, কাজরী ঘোষ এবং নেহা ইসলাম। ধন্যবাদ।
কালো টুপি কালো প্যান্ট পরা লোকেরা আর এল না। আমরাই সব এক এক করে বাস থেকে নামতে লাগলাম। এখনও মুখ দেখা যাচ্ছে না কারও। জিন্স, কটনের প্যান্ট, স্কার্ট, শাড়ি, সালোয়ার পরা বিভিন্ন অংশ নেমে আসছে দুদিক থেকে। বাইরে এত আলো কিন্তু বাসের ভেতরটা প্রথম থেকেই মেঘলা মেঘলা। সবাই সম্ভবত এক কথাই ভাবছিল, দেখতে চাইছিল পাশের-আগের-পরের মানুষদের মানুষীদের। তাই চিন্তা শোনা যাচ্ছিল না কারও। বাস থেকে নেমে এলাম আমরা।
বিকেল প্রায় শেষ আর সামনে এক আশ্চর্য নদীতীর। দূর থেকে দুটো দ্রুতগামী কিন্তু নিঃশব্দ লঞ্চ আসছিল। মনে হয় আমাদেরই জন্যে। এই অবস্থায় আমি সন্তোষ পালের মুখোমুখি হলাম। এক গাল হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে হাত দুটো ধরলাম।
–কতদিন ধরে যে দেখতে চাইছি আপনাকে! আমার কোচবিহার যাওয়া হল না।
–আমি খুব লজ্জায় আছি দাদা। এত খুচরো কাজ পড়ে যায়। উটকো কাজ। এবার আপনাকে আমি পুরনো বাজারে নিয়ে যাব। একটা কথা তো রাখতে পেরেছি।
–নদীর ওপারে যেতে হবে? রাত হয়ে যাবে না?
–সেটাই তো মজা। পুরনো রাতের বাজার। আদিত্যবাবুও আমার লোক।
সন্তোষ পালের ডাকে আদিত্য এল। বছর চল্লিশের দাড়িওলা অন্যমনস্ক মানুষ। আমি মাথা নাড়লাম। ও হাত তুলল।
–আলাপ-পরিচয় সব লঞ্চে উঠেই হবে। এরপর সব অন্ধকার হয়ে যাবে।
সন্তোষ পাল আমাদের নিয়ে এগোতে লাগলেন। আমি বুঝতে পারলাম, আর কোনও চিন্তা শুনতে পাচ্ছি না। কয়েকজন মহিলাকে তাদের এসকর্ট এর মধ্যেই তুলে দিয়েছিল। লঞ্চে ম্লান লণ্ঠনের আলো জ্বলে উঠল। আর আমাদের পেছন দিকটা পিচের মত অন্ধকার। কী করে হল? বাসটা কোথায়? লোকগুলো? মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এক আলোর দিকে। পাশাপাশি একই গতিতে চলছে দুটো লঞ্চ। বুলেটের মত ছুটছে।
বাকিদের মুখ স্মৃতির মত। লণ্ঠনের আলোয় আটকে পড়া স্মৃতির টুকরো। আমি তাদেরই মত একটা ডেক চেয়ারে বসলাম। আদিত্য অন্যদিকে চলে গেল। সন্তোষ পাল কথা বললেন।
এই লঞ্চে আমরা সাত জন আছি। ওই লঞ্চে ছ-জন। আমরা যাচ্ছি পুরনো বাজারে। সেখানে অন্য সময়ের মানুষেরা আসেন। এটা প্রাচীন বাজার। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই বাজারে কোনও অশান্তি হয়নি। এবারও নিশ্চই হবে না। আমরা প্রায় এসে গেছি। আপনারা নিজেরাই সব দেখে বুঝে নিন এবার। বাজারেই দেখা হবে।
লঞ্চ দুটো একই সঙ্গে পাশাপাশি দুটো ঘাটে নামল। লণ্ঠন আর হ্যাজাকের আলোর বাজার। প্রথম দিকে হ্যাজাওকুলো, তেমন তেজ নেই। হ্যারিকেন আর হ্যাজাক মিলে এক অদ্ভুত লালচে আলো। ভেতরের দিকে শুধু লণ্ঠন। আমরা ধীরে ধীরে নেমে এলাম। বাজারের আলোয় তাকালাম একে অন্যের দিকে। তেরো জোড়া দৃষ্টিবিনিময়। সবায়ের মুখে হাসি আর সম্ভাবনার ইঙ্গিত। কীসের সম্ভাবনা? আমার মন খুক করে একটু ফুঁপিয়ে আবার চুপ করে গেল। হাটে উঠে এলাম আমরা। অনেক দোকান অনেক পসরা অন্য পোশাক পরা অনেক মানুষ। তারা যেন একটু ধীরলয়ে ঘোরাফেরা কথা বলা চালাচ্ছে। কেমন একটা টান লাগল শরীরে। চমকে গেলাম, পুল্টুশ বলল—
–তুমিও স্লো মোশানে ঢুকে গেলে আর কি।
দেখলাম আমার পেছনের মানুষেরা কীভাবে একটা জায়গায় পৌঁছে আচমকা নাচের ভঙ্গিতে ঢুকে পড়ল বাজারে। চমকে গেল। আমাকে দেখে হেসে এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে এগোল। আমার বুকে তিরের মত ঢুকে গেল এক চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই নারী। সে আমাকে দেখলও না। গণ্ডি পেরনোর সময় হালকা ধাক্কা খেয়ে ঢুকে এল আমাদের দিকে। অন্য একটি মেয়েকে দেখে হাসতে হাসতে চলে গেল তার দিকে।
–তুমি কী করে বুঝলে পুল্টুশ?
–সবার আগে তো আমিই বুঝব। মোশান বদলে গেলে আগে ধাক্কা লাগে ভেতরে। আগে আমি ধাক্কা খাই। তারপর তুমি শরীরকে সামলাও। এসব বুঝতে হবে।– জায়গাটা ইন্টারেস্টিং হবে মনে হচ্ছে।
আমি কথা না বাড়িয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করি গোটা বাজারটাকে। প্রায় গোল একটা জায়গা যার এখানে সেখানে টুকরো টুকরো অন্ধকার ঢুকে পড়েছে। সেখানকার কোনও স্টলে ক্রেতা নেই। বিক্রেতাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এখানে কারও গলাই ওপরে ওঠে না। শরীরের… মেয়েদের শরীরের… চলকে পড়া হাসি ঝরে পড়ে জুঁইফুলের মত। জলতরঙ্গের মত শব্দ বেরোয় তার থেকে। ছেলেদের কথার প্রতিধ্বনি হয় অল্প অল্প। বিক্রেতারা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সবায়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে। বিভিন্নভাবে প্যান্ট-ধুতি-পাজামা পরে আছে পুরুষেরা। মেয়েরাও নানানভাবে পরেছে তাদের পোশাক। কেউ কেউ লাউ সাইজের খোঁপা বানিয়েছে আর কেউ বা সাপের মত বিনুনি। কারো চুল খোলা, কপালে টিপ। কয়েকজন দেখলাম খুব ছোট জামা-কাপড় পরে আছে যার নাম আমি জানি না। যেমন পরতে দেখি আজকাল নদীর ওপারে যেখান থেকে আমি এসেছি। আমরা এসেছি। শিশু নেই, খুব ভেঙে পড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নেই। আমি এগোলাম।
আবার আগামী সংখ্যায়