নারীমুক্তি ও লেনিন: ১৫০ বছরের এপার-ওপার

অহনা গাঙ্গুলি

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও গবেষক

 

 

 

একটা ১৫০ বছরের পুরনো কফিনের দিকে এগোতে গিয়ে…

একটা পচা পাতকুয়োর ভিতরে লিখতে বসেছি। আমার আশে পাশে নয়টা মৃতদেহ ভাসছে। একটা এক্কেবারে ছোট। চুলহীন, নরম চামড়া… বারবার গায়ে-পিঠে এসে লাগছে আমার। ছোট ছোট আঙুল, ছোট্ট একটা নাক আমার পেটে কোমরে ঠেকছে… …উফ! আমি এখানে বসে লিখতে চাইনি জানেন? ওনারা ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়ে আমার অজান্তেই আমায় টেনে নিয়ে এসেছেন। যেমন খিদে ওনাদের টেনে নিয়ে এসেছিল, তেমন। খিদে তো আমারও পায়! অতএব, এখন আর গা বাঁচানোর উপায় নেই। আমি এখানে বসেই লিখব। আমার সমস্ত আ-কার, ই-কার, বিকার জুড়ে পচা গন্ধ থাকবে, আপনারাও পাবেন। অভাবনীয়ভাবে প্রয়োজন এই গন্ধ চিনে রাখা।

“… আমি জানি একজন প্রায়োন্মাদ পাসপোর্ট বানাতে পারে না, তাছাড়া ইসলামেও আমার বিশ্বাস নেই, তাই বাগদাদ পৌঁছবার সৌভাগ্য হয়তো হয়ে উঠবে না, তবু এই শহরে আমারই মতো অসংখ্য প্রায়োন্মাদের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে আমি পৌঁছে যেতে পারব মার্কিন দূতাবাসের সামনে, নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে পারব। একটি নিষ্পাপ শ্বেতাঙ্গ দম্পতির জন্য, তারপর… তরুণ মার্কিনটির কণ্ঠায় ঠেকানো ছুরিটা সরিয়ে আনার আগেই, তার ফ্যাকাশে মেরে যাওয়া স্ত্রী-র নীল চোখের দিকে চেয়ে বলব: এর্নেস্তো চে… আমাদের এর্নেস্তোরও এমনই একটা বউ ছিল মাদাম… ভয় পাবেন না, তার মতো অবস্থা কখনওই আপনার হবে না, কেন না শেষ পর্যন্ত আমরা মানুষ… অসহায়ভাবে মানুষ… যা আপনার প্রেসিডেন্ট নন… লিঙ্কনের পর থেকে যা আপনাদের প্রেসিডেন্টরা কখনও ছিলেন না…” (জয়দেব বসু, অ্যান্টি ইউএস সিন্ড্রোম)। আপনিও এক প্রায়োন্মাদ, আমিও, বসে দেখেছি আমার-আপনার দেশের মেয়ে, সদ্য বছর পনেরো পেরনো জ্যোতি তার অসুস্থ বাবাকে সাইকেলে বসিয়ে ১২০০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করেছে; মাত্র সাত দিনে। আধ-পেটা খেয়ে, না ঘুমিয়ে, প্রখর রোদের তাপ ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে গেছে বাড়ির দিকে। রাষ্ট্র, অন্য সমস্ত অভিবাসী শ্রমিক পরিবারের মতো এদেরও দায়িত্ব নেয়নি। অথচ, এই নির্মম ঘটনা “চমৎকার” লেগেছে মার্কিনী প্রেসিডেন্ট-কন্যার, নীল চোখ মাদামের। ভালোবাসা আর সহ্যশক্তির পরীক্ষায় ইভাঙ্কা ট্রাম্পের মতে ভারতবর্ষ পৃথিবীর ভাবনার আঙিনায় সেরা। ভারতবর্ষের কিশোরীরা ১৫ বছর বয়স থেকেই খিদে, তাপ, নিদ্রাহীনতা, শিক্ষাহীনতা সহ্য করতে পারেন বলে ভীষণ গায়ে কাঁটা দেয় ডোনাল্ড ট্রাম্প-দুহিতার। জানি গা গুলিয়ে উঠছে। স্বীকার করছি, আমারও খানিক। তবে দয়া করে সহ্য করুন, এর থেকে বহুগুণ বেশি গা-গুলিয়ে ওঠা এক-একটা কথা আসবে আজ। আচ্ছা, প্রবল ঘেন্নায় কখনও আপনার থুতু দলা পাকিয়েছে মুখের মধ্যে? ওহ, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, ভারতের লোকেরা দারুণ সাইকেল চালাতে পারেন এবং এ দেশের বুকে একটা সাইকেল ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার ডাকও দিয়েছে “মিস্টার প্রেসিডেন্টের মেয়ে”। এদিকে আবার ইনি বিশ্বনারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ বলে নিজেই নিজের তর্জনীটা ব্যবহার করেন, নিজের দিকে। সর্বজনীন ভগিনীত্ব নিয়ে প্রচুর কথা বলেন। সারা পৃথিবীর নারীমুক্তি একই সহমর্মিতার সুতোয় বাঁধা, বারবার বলেন নানান সাক্ষাৎকারে। আবারও জিজ্ঞেস করছি, ১৫ বছরের জ্যোতির প্রতি সাম্রাজ্যবাদের পোষ মানা নারীবাদ আর তার অন্যতম কর্ণধারের মনোভাব দেখে, প্রবল ঘেন্নায় আপনার থুতু দলা পাকাচ্ছে তো মুখের মধ্যে? অবশ্য একথা বলে রাখতে চাই, এখানে ব্যক্তি ইভাঙ্কা ট্রাম্প বিষয়বস্তু নয়; ইভাঙ্কা ট্রাম্পের মতো চরিত্ররা, ‘প্রেসিডেন্ট-কন্যা’রা পুঁজির পাহারাদার এবং উত্তরাধিকারী। সাম্রাজ্যবাদের মুখে লেগে থাকা উন্নতশীল দেশের ভুখা মানুষের রক্তের দাগকে ইভাঙ্কারা লিপস্টিকের মতো করে উপস্থাপন করেন। যেন ওটা রক্ত না, প্রসাধনী। কথাগুলো বলতে বলতে কলমের ডগায় চলে আসছে, ২০১৯-এর লেজ পেরোতে গিয়ে পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসা বিশালাকার প্যান্ডেমিক করোনা, উন্মুক্ত করছে এইধরনের বাস্তবগুলো। প্রসাধনীর উগ্র গন্ধের পিছনে পচা-গলা-রক্তের দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছে রোজ। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পা রাখার মুখেই মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্বব্যপী দাপিয়ে বেড়ানো পুঁজিবাদ। মানবসভ্যতার পক্ষে এই ব্যবস্থা, এই দর্শন কতখানি অকার্যকর— তা আজ প্রমাণিত। সঙ্কটের সময়ে এই ব্যবস্থা পারেনি ব্যক্তি মালিকের হাতে সঁপে দেওয়া শপিং মল, ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট টাওয়ার, দুর্মূল্য ফাইভ স্টার হাসপাতাল ইত্যাদিকে সচল রাখতে; সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে নিজেরই গঠনের ধারক ও বাহক মানবসম্পদ রক্ষা করতে। এই ব্যবস্থা মানুষকে খাওয়ার, বাসস্থান, ওষুধ, জামাকাপড়— কিচ্ছু দিতে পারে নি। খালি দিয়েছে রোগ, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমিছিল, জাতিবিদ্বেষ, অনাহার, শিশুমৃত্যু এবং আরও অসংখ্য সভ্যতার ব্যধি। উপরন্তু, লাগামছাড়া লাভ করার ঘোড়দৌড়ে পুঁজিবাদ ডেকে আনছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পৃথিবীকে মুষ্টিমেয়র স্বার্থে তাসের ঘর বানিয়ে রাখার দিন শেষের পথে— জানান্ দিচ্ছে পরিবেশ-পরিমণ্ডল। উদাহরণস্বরূপ পঙ্গপালের অকাল আক্রমণ বা প্রাণঘাতী দাবানল, ঘূর্ণিঝড়— মানুষের ছাড় নেই করোনা পর্বেও। সবকটি মৃত্যুঘণ্টা একসঙ্গে বেজে উঠেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা, সম্পদ, মৃত শ্রম পুঞ্জীভূত হতে হতে খেটে-খাওয়া মানুষের উপর নির্যাতন স্তরে স্তরে জমা হয়েছে। এই স্তরের সরণ সরলরৈখিকভাবে উল্লম্ব নয়। এর অনুভূমিক সরণও আছে। সমাজজীবনের মূলস্রোত থেকে প্রায় মৃত্যুসমান তীব্র শোষণ মানুষকে আরও প্রান্তে ঠেলছে প্রতিদিন। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনছে আরও শক্তিশালী সামাজিক শোষণ। পুঁজির করাল ঘাত ততই জোরালো, যতই আর্থ-সামাজিক অবস্থান প্রান্তিক। শ্রেণিসম্পর্কের হাত ধরে নির্মিত লিঙ্গ-ধর্ম-জাতপাত-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্র বিনুনির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে শোষিতকে। বলে রাখা ভালো হবে, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিকভাবে লাঞ্ছনার এই সবকটি সিংহদুয়ারের মধ্যে, সর্বশেষ ঘা পড়েছে লিঙ্গবৈষম্যের দরজায়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে ধমনী, শাখাধমনী, স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে লিঙ্গের ধারণা সাঙ্ঘাতিকভাবে অনমনীয়। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা নানানভাবে পুষ্টি জুগিয়ে যাই পুরুষতন্ত্রের দর্শন আর ভাবনাকে। এসব কথা শোনার এবং শোনানোর মতো জায়গা আদায় করা খুব লম্বা সময়রেখা পায়নি। এ আলোচনার তীব্রতা বড়ই সাম্প্রতিক। আর আজকের এই দুঃসময়ে আরও বেশি করে পুঁজিবাদ হাতিয়ার করছে সমাজের বৈষম্যমূলক ফাঁকফোকরগুলোকে। করোনা-কালে বিভীষিকায় পড়া পুঁজিবাদ এবং তার সর্বোচ্চ ধারালো নখ সাম্রাজ্যবাদের হাত, আরও জোরালোভাবে খামচে ধরছে লিঙ্গসমীকরণে প্রান্তে থাকা মানুষদের— মহিলাদের। একথা ছবির মতো দেখতে পাবেন ভারতবর্ষের যে কোনও ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলা অসংখ্য অভিবাসী শ্রমিকের মিছিলে তাকালে। বিশেষত তাঁদের মধ্যে যাঁরা মহিলা। এক একটি আখ্যান শুনলে শিউরে উঠতে হয়।

বিশ্বপুঁজিবাদের এই সর্বগ্রাসী চরিত্রের বিশ্লেষণ এবং তার ভবিষ্যৎ অনুধাবন ও নিরীক্ষা আজকের নয়। উনিশ শতকের শেষ দফা থেকে কাগজ-কলমের তত্ত্ব ছাপিয়ে ক্ষেতে-কলে-বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে দ্বারে পুঁজিবাদের বৈজ্ঞানিক বিকল্পের মার্ক্সীয় বীজ, ব্যবহারিক প্রয়োগসহ বপণ করেছিলেন ভ্লাদিমির ইলিয়চ লেনিন। দেড়শ বছর দাঁড় বেয়ে এসে এই সময়ে, শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়া, যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা পুঁজিবাদের শরীরটার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যার হাত ধরে এই দর্শন আর তাতে পরিপুষ্ট ব্যবস্থার মৃত্যুকামনা করতে পারি, তিনিই আজকের সবচাইতে প্রাসঙ্গিক বিষয়। লেনিন।

 

প্রসঙ্গ নারীমুক্তি— ফিরে দেখা কমান্দান্তে লেনিন

লেনিনকে সব চাইতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় মার্ক্সবাদের লেন্সে। এই লেন্সে দেখতে পারার গোড়াকার শর্ত, পৃথিবীকে প্রথমবার সমাজতন্ত্র উপহার দেওয়ার মরণপণ যুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা হলেও, মহামতি লেনিনকে কোনও পরাবাস্তব, অতিমানবীয় ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে না দেখা এবং এই প্রবণতাকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ফেলে বাতিল করা। আমাদের এই আলোচনা লেনিনকে দেখবে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ইতিহাসের পাতায়, বলশেভিক পার্টিকে সুদৃঢ় করতে পারার কলমে এবং অবশ্যই বিপ্লব সঙ্ঘটিত করার ঐতিহাসিক অনুষঙ্গে। এই পর্যায়ক্রমে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে সংগঠিত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক (পরবর্তীতে কমিউনিস্ট) আন্দোলনে নারীদের অংশীদারিত্ব এবং সেই কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব প্রদানে লেনিনের ভূমিকা— নারীমুক্তি প্রসঙ্গে তাঁর প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেবে। সবটা নয়, নিশ্চয়ই। বাকিটা আরও এগিয়ে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করব। সোভিয়েত রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণির মহিলাদের অবস্থান ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে গেলে, খুব অল্প হলেও, জায়গা দিতেই হবে বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ায় মহিলাদের অবস্থানকে। ১৯১৭ সালের আগে পর্যন্ত জার-শাসিত রাশিয়ার একটি বড় অংশের মানুষ নিযুক্ত ছিলেন কৃষিকাজে, তাঁদের বাসস্থান মূলত কেন্দ্রীভূত ছিল গ্রাম-রাশিয়ায়। কেবল আঠেরো শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের শেষার্ধ; এই ১০০ বছরের মধ্যে রাশিয়া ৫১টি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখেছিল। খিদে মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে গিয়েছিল, যার কোনও সুরাহার আশা রাশিয়ার জনগণ প্রায় ত্যাগ করেছিলেন। পুঁজির অসম বিকাশ এবং সামন্ততন্ত্রের মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে স্বভাবতই মহিলারা ছিলেন পুরুষদের সম্পত্তিস্বরূপ। জারের আইনমতে মহিলারা তাদের পরিবারের ঘোষিত দাস এবং আদেশের কোনওরকম অন্যথা ঘটলে আইনত তাদের শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা ছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই বিধানগুলি সংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অর্থ্যাত গির্জা এবং ভূ-স্বামীদের যৌথ উদ্যোগে প্রণয়ন করা হত। এর সঙ্গে প্রতি বসন্ত ডেকে আনত দুর্বিষহ পরিযান, একটু কৃষিকাজের আশায় বা ছোটখাটো কোনও কলকারখানায় একটু কাজ পাওয়ার জন্য। এনাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিলেন শিশু ও মহিলা শ্রমিক, যাঁরা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে চলে যেতেন দক্ষিণ রাশিয়ার ডন আর্মি, তাভরিয়া, জেকাটেরিনোস্লাভ প্রভৃতি জায়গায়। ১৮৯৭ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়ার মোট মহিলা জনসংখ্যার মাত্র ১৩.১ শতাংশ স্বাক্ষর ছিলেন। ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৯ জুড়ে “Development of Capitalism in Russia” লিখতে গিয়ে লেনিন বারবার বিশ্লেষণ করেছেন, রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণির পরিস্থিতির মধ্যেও মহিলাদের উপর শোষণের দ্বিগুণ মাত্রার কথা। প্রতিটি পরিবারের মেয়ে এবং শিশুরা একাধারে গৃহস্থালির কাজকর্মে শ্রমনিয়োগ করতেন, অন্যদিকে তাদের প্রতিদিন খাটতে হত মাঠে-ক্ষেতে-খামারে। পূর্ণ শারীরিক বিকাশের বহু আগেই তাঁরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের থেকে বহুগুণে অধিক পরিশ্রমের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে বাধ্য হতেন। লেনিনের উপরোক্ত দলিলে উঠে এসেছে ১২-১৪ বছরের মেয়েদের ১৮ ঘণ্টার উপর দৈনিক কাজ করার বদলে নামমাত্র মজুরি পাওয়া এবং প্রতি মুহূর্তে মালিকদের লালসার শিকার হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাসমূহ।

লেনিনের আলোচনার মধ্যে একথাও উঠে আসে, কলকারখানাসহ সামগ্রিক শিল্পের বিকাশ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও, এই বদল মহিলাদের সমাজজীবনে বেশ কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই আর্থ-সামাজিক প্রগতিশীলতা ‘ব্যক্তিগত’ বলে বিবেচিত গণ্ডির বাইরে মহিলাদের টেনে আনে। উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও সরাসরি হয়ে উঠতে থাকায় পুরুষতন্ত্রের বাতলে দেওয়া সম্পর্কগুলো ছাপিয়ে গিয়ে সমাজের পরিসরে একজন স্বতন্ত্র শ্রমিক হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন শ্রমিকশ্রেণির মহিলারা। লেনিন লিখেছেন, “By destroying the patriarchal isolation of these categories of the population who formerly never emerged from the narrow circle of domestic, family relationships, by drawing them into direct participation in social production, large-scale machine industry stimulates their development and increases their independence, in other words, creates conditions of life that are incomparably superior to the patriarchal immobility of pre-capitalist relations.”

বাড়তি দৃষ্টিনিক্ষেপ ছাড়া কালের নিয়মে একদিন লিঙ্গসমস্যা মিটে যাবে, এরকম স্থাবর কোনও ভাবনার বৃক্ষরোপণ করে থাকলে, লেনিন তাঁর একের পর এক লেখনীতে এই আলোচনা আনার প্রয়োজন বোধ করতেন না। শ্রমিকশ্রেণির তৎকালীন অবস্থা বুঝতে গিয়ে, তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, মহিলাদের কথা আর তাদের উপর ঘটে যাওয়া গুরুতর শোষণের কথা লেনিন তাঁর ভাবনায়, লেখায় এবং সংগঠনের কাজের মধ্যে রেখেছিলেন। বলশেভিক পার্টিতে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার এত সংখ্যক মহিলাদের অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দেখা যায়। বলাই বাহুল্য, এই বলশেভিক পার্টির মতাদর্শ ও সাংগঠনিক নেতৃত্বে এক্কেবারে সামনের সারিতে ছিলেন লেনিন। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ জুড়ে শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিটি স্তরে, কোণায়, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ছাপ রেখেছেন মহিলা কমরেডরা, নেত্রীরা এবং অবশ্যই অভাবনীয় সাহসী মহিলা শ্রমিকেরা। তবে এনাদের জঙ্গি লড়াই শুধুই এই নয় মাসের একত্রিত শ্রেণিসম্পদ, তা একেবারেই নয়; লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টি তার আগে প্রায় এক দশকের কাছাকাছি সময় ধরে রাশিয়ার প্রতিটি শ্রমনিবিড় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদ্য অঙ্কুরোদগমরত এগিয়ে থাকা মহিলা শ্রমিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর কাজে বাড়তি গুরুত্ব দেন। তাঁদের সংগঠিত করে বলশেভিক পার্টির দায়িত্বশীল পদগুলিকে আরও ফলপ্রসূ করে তোলেন মহিলা নেতৃত্বরা সুচারু হস্তক্ষেপে। একথা অচিরে বলা যায়, এই ধরনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা ও পরিকল্পনা ছাড়া বলশেভিকদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সম্ভব হত না; এমনই অসংখ্য সংবেদনশীল পদক্ষেপ উত্তোলিত করেছে শ্রেণিসচেতনতা এবং শ্রমিকশ্রেণির একতাবোধগুলি। অতীতের সমস্ত নথি ছাপিয়ে গিয়ে এবার আর শুধুই জাতিগত বিভাজন নয়, এই আরোহণ ভিজিয়ে দিয়ে গেছে লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদ। ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গিই শ্রমিকশ্রেণির চোখ থেকে বুর্জোয়া উদারপন্থী নারীবাদের অলীক পর্দা উন্মোচিত করতে পেরেছিল। শ্রমিকশ্রেণির মহিলারা সহজেই বুঝেছিলেন, মুখে সমানাধিকারের কথা বললেও বুর্জোয়া মহিলারা কোনওদিন রাষ্ট্রের শ্রমিক-বিরোধী নীতিগুলি সম্বন্ধে একটি টুঁ শব্দ করেনি। অথচ জারের ভয়াল জাতীয় নীতিগুলির জন্যেই দারিদ্র্য এবং অধীনতায় জরাজীর্ণ হয়ে এতদিন ধরে ইতিহাসের বকলমে পড়েছিলেন অপার ক্ষমতাশীল লড়াকু মহিলা শ্রমিকরা।

অভিজ্ঞতার চোখ খুলতে থাকায়, প্রসারিত হতে শুরু করে নিজের শ্রেণি-অবস্থান বুঝে নেওয়ার রাজনৈতিক অনুশীলন। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে মিখাইল ইভানোভিচ ব্রুসনেইভের পাঠচক্রে যোগদান করেন একের পর এক মহিলারা। মার্ক্সীয় দর্শনের চর্চা, রাশিয়ায় আগামীদিনে বিপ্লবের পথ রূপায়ণ সহ শোষিত মানুষের মুক্তির বিশ্বজোড়া রাজপথ নির্মাণ করার মতো সাংঘাতিক কঠিন এবং দৃঢ় কাজে নিপুণভাবে অংশ নেন মহিলারা। বিপ্লবী মহিলাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মূলত কলে-কারখানায় ছড়িয়ে গিয়ে মহিলা শ্রমিকদের সংগঠিত করা। কিন্তু এই কাজ খুব দ্রুত বিস্তারলাভ করতে থাকে মহিলা-দর্জি, গৃহ পরিচারিকা, শহরতলির দিকে ক্ষেতমজুর মহিলাদের মধ্যে (Revolutionary Women in Russia 1870-1917 – Anna Hillyar and Jane McDermid, p. 64)। এঁনাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষ তাত্ত্বিক ও সংগঠক ছিলেন নাদেজা ক্রুপস্কায়া, সোফিয়া পমেরানেটস পেরাজিক, রাডোসেঙ্কো, নেভজোরোভা, লাকুবোভা, কাটাসেওয়া নাতাশা প্রমুখ। এঁদের নেতৃত্বে পাঠচক্রে দীর্ঘসময় ধরে চলা আলোচনাগুলোয় আলোকিত হয়েছেন লেনিন। বারবার তাঁর সুদক্ষ সহযোদ্ধা মহিলা কমরেডদের নাম উল্লেখ করে নিজের লেখনীর মধ্যে নারীদের সমস্যা এবং বুর্জোয়াদের এই প্রশ্নে চূড়ান্ত সুবিধেবাদী অবস্থান উন্মোচিত করেছেন তিনি। ১৯০৭ সালে স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে পেশ করা রিপোর্টে লেনিন লিখছেন, “The Congress condemned the opportunist practices of the Austrian Social-Democrats who, while conducting a campaign for electoral rights for men, put off the struggle for electoral rights for women to ‘a later date’.” (Preface to The Emancipation of Women Nadezhda K. Krupskaya)। লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্টতই মহিলা সহযোদ্ধারা, তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষকও ছিলেন। অর্থাৎ এই দাবী করাই যায়, ১৯০৫-এর অভ্যুত্থানকে লেনিন যেমন “dress rehearsal” বলেছিলেন, ১৯১৭–র মাহেন্দ্রক্ষণ আসার আগেই সেই মহড়ায় অন্ত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে সাফল্য পেয়েছিলেন মহিলারা।

আরও একটি ক্ষেত্র এই প্রসঙ্গে সামনে আনা দরকার, যা সচরাচর বেশ খানিকটা কম আলোচনার মধ্যে এসে থাকে। বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্মাদি ছাড়াও লেনিনের সাংবাদিকতা বিপুলভাবে আকর্ষণ করে বহু মানুষকে। মুখপত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর নথি এবং রাষ্ট্রের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে প্রাভদা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কালজয়ী ইতিহাস আমরা নানা জায়গায় শুনে থাকি। কিন্তু, আমরা একেবারেই মনে রাখিনি কমরেড সামোইলোভাকে। ১৯০২ সালে প্যারিসে ছাত্রাবস্থায় লেনিনের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং বলশেভিক পার্টির প্রতি মতাদর্শগতভাবে আস্থা অর্জন তাঁর। ১৯১২ সালে মলোতভ বন্দি হওয়ার সময় থেকে প্রাভদার সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন সামোইলোভা। আমি সেই সময়ের প্রাভদার কথা বলছি, যখন এটি শ্রমিকশ্রেণির কথা বলার, শোনার এবং শোনানোর এক এবং একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সামাইলোভা প্রাভদার দফতর সামলাতেন অসংখ্য শ্রমিকের মাঝে, যাঁরা নিজেদের কথা জানাতে ভিড় করতেন রোজ। এমনও দিন গিয়েছে, জানাচ্ছেন ক্রুপস্কায়া, যেইদিন সামাইলোভা ৩০০ থেকে ৪০০ জন শ্রমিকের কথা শুনেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন ছাপিয়েছেন প্রাভদায়। সাংবাদিকতার সদর্থক এবং শ্রেণিসচেতন সংজ্ঞা তৈরির যে কাজ লেনিন শুরু করেছিলেন, অচিরেই তা এগিয়ে গিয়েছিল সামোইলোভার হাত ধরে। লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টির অভ্যন্তরে, অন্তত এই সময়কাল জুড়ে, মহিলাদের অবস্থান এবং তাঁদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এমনটাই ছিল। লেনিন, অবশ্যম্ভাবীভাবে, পার্টিনেতা হিসেবে এই ভঙ্গিবলয়ের বাইরে পড়তেন না।

আরও এক বলশেভিক নেত্রীর কথা বলতেই হবে আমাদের। ইতিহাস তাঁকে লেনিনের স্ত্রী নামক উঠোন ছাড়া কোথাও জায়গা দেয়নি, তাই আরও বেশি করে বলতে হবে ওনার কথা; লেনিনের নেতৃত্বে আরও মহিলা কমরেডদের সঙ্গে সঙ্গে নাদেজা ক্রুপস্কায়ার ভূমিকাও নারীমুক্তির প্রসঙ্গে লেনিনকে চিনতে সাহায্য করতে পারে বলেই মনে করি।

এই লেখা পুকুরের পাড় বাঁধার মতো। যতটা আলোচনার জল ধরে রাখা যায় এক জলাশয়ে, তার চারপাশ দিয়ে পরিখার মতো মাটি দিয়ে দেওয়া। জল যাতে এদিক-ওদিক বয়ে না যায়। সেই জমা জলের মধ্যিখানে একখানা ঢিল পড়ল। আলোড়িত হল জল। একের পর এক গোলক সৃষ্টি হতে লাগল আর সেগুলো পাড়ে এসে ধাক্কা দিতে লাগল। পরিখার সীমারেখা ভাঙল। এখুনি। ক্রুপস্কায়ার কথায় আসছিলাম; মাঝখানে একটা শ্রমিক স্পেশাল ঢুকল, পাটনায়। ২৪ ঘণ্টা দেরিতে। ১৫ ঘণ্টার সফর পেরোল ৩৯ ঘণ্টায়। ভিতরে বাবা-মায়ের সঙ্গে আছে ৪ বছরের মহম্মদ ঈরশাদ। মানে, ছিল। গোটা রবিবার জুড়ে খিদেয় ছটফট করেছে, খাওয়ার চেয়ে গেছে। এখন, একেবারেই গেছে। ল্যাটা চুকে গেছে। প্ল্যাটফর্মের বন্ধ দোকান-পাট নিরাশ করেছে বাবা-মাকে। ঈরশাদের পাটনা ফেরা হয়নি। খিদে তেষ্টা নিয়েই বাবা-মাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে মহম্মদ ঈরশাদ।

কমরেড ক্রুপস্কায়াও সাক্ষী ছিলেন এমনই জরাজীর্ণ রাশিয়ার। পিটাসবার্গের টেক্সটাইল কারখানাগুলোয় আধপেটা শিশুর পাশবিক শ্রম, স্কুলের ঘণ্টা কোনওদিন না শুনতে পাওয়া শৈশব আর অপুষ্টি— কমরেড ক্রুপস্কায়াকে তৈরি করেছে। ১৯১০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্ক্বাল থেকেই এই উদ্যোগের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা কমরেড নাদেজা। রাবোনিৎসার পাতায় পাতায় উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন তিনি, কীভাবে টেক্সটাইল শিল্পের শ্রমিক মহিলাদের নেতৃত্বে ১৯১৭-র বিপ্লব সলতে পাকিয়েছিল। শিক্ষাবিদ হিসেবে সর্বজনবিদিত এই কমরেড ১৯১৭-র নভেম্বরে পিপলস কমিসার অফ এডুকেশন অ্যান্ড এনলাইটেনমেন্ট–এ যোগ দেন ডেপুটি হিসেবে। প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুশিক্ষার প্রসার বিষয়ের উপর তাঁকে জোর দেওয়ার দায়িত্ব দেয় পার্টি। সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি অত্যন্ত জরুরি অংশ লেখেন ক্রুপস্কায়া, যেখানে বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ার শিশুদের ভবিষ্যত কীরকম হবে তার স্পষ্ট রূপরেখে টানা হয়, “The task of the Party at the present moment is mainly to carry on ideological and educational work for the purpose of finally stamping out all traces of the former inequality and prejudices, especially among the backward strata of the proletariat and the peasantry and their hungry children. Not satisfied with the formal equality of women, the Party strives to free women from the material burden of obsolete domestic economy, by replacing this with the house-communes, public dining-halls, central laundries, crêches, etc.” (Political Program of the CPSU, 1919)। ১৯২০-র ৩রা নভেম্বরের মধ্যেই ক্রুপস্কায়া সফলতার সঙ্গে গঠন করেন রাশিয়ার প্রথম উন্মুক্ত জয়েন্ট লাইব্রেরি নেটওয়ার্ক। ১৯২৯ সাল থেকে আমৃত্যু সোভিয়েত রাশিয়ার ডেপুটি শিক্ষা মন্ত্রকের দায়ভার সামলে আসেন।

আশা করি, এখন ক্রুপস্কায়া আর ঈরশাদের দেখা হয়েছে, ঈরশাদ এখন ভালো আছে। আশা করি, ঈরশাদদের ভালো থাকার ব্যবস্থা শিগগিরি হবে।

ইতিহাসে নারীর অবস্থান, সমাজের প্রগতির প্রশ্নে নারীর ভূমিকা ও দায়িত্ব, সমাজ পরিবর্তনে তার অংশীদারিত্ব এবং সমাজ বদলের পরে তার নতুন অবয়ব: প্রতিটি বিষয়ের উপর দর্শন, অর্থনৈতিক পর্যালোচনা, সমাজবিজ্ঞান, রাজনৈতিক চর্চা, ইতিহাস-রচনা প্রভৃতি অত্যন্ত কম। আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রায় ছিল না বললেই চলে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলশেভিক পার্টির যে কমরেডকে দিয়ে এই পর্যায়ের আলোচনা শেষ করব, তিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ মানুষ। আলেকজান্দ্রা কলোন্তাই। “A Sexually emancipated communist woman”— এভাবেই নিজেকে ব্যাখ্যা করতেন তিনি। বলশেভিক পার্টির ভিতর মহিলাদের অবস্থান সম্পর্কে সর্ব্বোচ্চ উচ্চতার তার্কিক: কমরেড আলেকজান্দ্রা কলোন্তাই। গণ-আন্দোলনের জন্য মহিলাদের জড়ো করার অপার দক্ষতা রাখায় কলোন্তাই অচিরেই জার-পুলিশের নজরে আসেন এবং ১৯১৭ সালের আগেই বেশ কটি বছর তাকে আত্মগোপনে কাটাতে হয়। লেনিনের পরিকল্পিত প্রথম সোভিয়েত জনগণের সরকারের প্রথম মহিলা পদাধিকারী হন কলোন্তাই। সমাজ কল্যাণ বিভাগের কমিসার হিসেবে তুখোড়ভাবে কাজ শুরু করেন অসামান্য বক্তা মানুষটি। নারীবাদী তত্ত্ব, যৌনতার প্রশ্নে নারীর অবস্থান এবং ভবিষ্যত— এরকম আরও অনেক তৎকালীন সময়ের না-শোনা দুর্বোধ্য বিষয়ে তাত্ত্বিক হস্তক্ষেপ করেন কলোন্তাই। তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক চর্চার সঙ্গে সমাজের চলতি নিয়মগুলির বিস্তর ফারাক থাকায়, পার্টির ভিতরে এবং বাইরে দুক্ষেত্রেই প্রশ্ন ওঠে। ক্রিস্টিনা সীপনোওইচ সহ একাধিক নারীবাদী তাত্ত্বিক এই প্রসঙ্গে লেনিনের ভূমিকাকেও প্রশ্ন করেন, “Kollontai’s ideas on free love and her liaison with the sailor Dybenko, a man both younger than her and lower in social status, were the source of considerable suspicion in the Party, where conservative views about sexuality”। তাঁকে সোভিয়েতের অ্যাম্বাস্যাডার হিসেবে সুইডেন পাঠানো হয় ১৯২২ সালে। ইতিহাসের মূলপাতাগুলোয় কলোন্তাইয়ের এই পরিচয়টুকুই থেকে গেছিল গত ষাটের দশক পর্যন্ত। কিন্তু সমাজতন্ত্রে নারীর ভূমিকা নিয়ে পার্টি ও তার মতবিরোধ সম্পর্কে চর্চা চিরস্থায়ীভাবে নারীবাদী তাত্ত্বিক সাহিত্য হয়ে থেকে যাবে। ওই বিশেষ সময়টিতে, এই বিশেষ কমরেডের প্রতি লেনিনের আস্থা-অনাস্থা মতানৈক্য আমাদের জানান দেয়, নারীজনিত সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে সোভিয়েত রাশিয়া, বলশেভিক পার্টি এবং লেনিন— কেউই সম্পূর্ণ পরিষ্কার ছিলেন না। এত অল্প সময় আর অল্প ইতিহাস মাথায় নিয়ে এগুলি থাকার কথাও ছিল না। লেনিনের এই প্রসঙ্গে দ্বন্দ্ব, আমাদের পরবর্তী এবং প্রায় শেষ পর্যায়ের আলোচনায় উত্তীর্ণ করবে।

 

লেনিন ও ক্লারা জেটকিন: এক ঐতিহাসিক ও বহুল চর্চিত কথোপকথন

বলশেভিক পার্টির এগিয়ে থাকা কমরেডরা সহ তাঁদের নেতা কমরেড লেনিন কমিউনিস্ট ইশতেহারের নীলনকশা ধরে চলতে থাকায়, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দ্রুত অতিক্রম করে রাশিয়ার সীমান্ত। আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের হাত ধরে রাশিয়া এবং জার্মানির একটা বড় অংশের কমরেডদের মধ্যে মতাদর্শ ও রাজনৈতিক আদান-প্রদান দৃঢ় হয়। জার্মানির পরিস্থিতি, প্রতিবিপ্লবের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার মহিলা শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে অন্যতম পুরোধা ক্লারা জেটকিন, কার্ল লিবনেখট, রোজা লুক্সেমবার্গের মতো দক্ষ কমরেডদের সঙ্গে লেনিনের বহু কথোপকথন হতে থেকেছে। ক্লারা জেটকিনের সঙ্গে হওয়া এমনই একটি আলোচনা পরবর্তীকালে নারীবাদের রাজনৈতিক চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। ভীষণরকম বহুমাত্রিক এই আলোচনা। মহিলাদের সঙ্কটগুলি ছাড়াও শ্রেণিসংগ্রামের নানান পথের রূপরেখা আঁকায় এই কথাবার্তা আলাদা ধরনের ক্যানভাসের স্বাক্ষর রাখে, সেগুলি নিয়েও আলোচনা হওয়া একান্ত জরুরি। কমরেড ক্লারার সঙ্গে নিজের মতামত ভাগ করে নেওয়ার সময়ে কমরেড লেনিনের, সমাজে লিঙ্গসম্বন্ধে ধারণা বেশ খানিকটা উঠে আসে। ক্রেমলিনের এক হেমন্তের দুপুরে বসে একথা শুরু হচ্ছে। ক্লারা বলছেন ১৯২০-র এই কথা তাঁর লেনিনের সঙ্গে “First long conversation”। লেনিন কথাটা শুরু করেন এভাবে, “We must create a powerful international women’s movement, on a clear theoretical basis. There is no good practice without Marxist theory that is clear. The greatest clarity of principle is necessary for us communists in this question. There must be a sharp distinction between us and all other Parties. Unfortunately, our Second World Congress did not deal with this question. It was brought forward, but no decision arrived at. The matter is still in commission, which should draw up a resolution, theses, and directions. Up to the present, however, they haven’t got very far. You will have to help.” রাশিয়ার মহিলা সংগঠক, শ্রমিক মহিলা ও অসংখ্য মহিলা টেড ইউনিয়ন কর্মীরা তখন বিপ্লব-পরবর্তী তৃতীয় বছরের দুর্গম পথ পার হচ্ছেন। প্রতি মুহূর্তে অজানা রাস্তা কেটে এগোনো, প্রতি মুহূর্তে ইতিহাস তৈরি করার দায়ভার বয়ে চলেছেন কমরেডরা। ক্লারা উৎসাহের সঙ্গে জানিয়ে চলেছেন তাঁদের কথা জুড়ে, জার্মানির মহিলাদের কী সাংঘাতিকভাবে অনুপ্রাণিত করছেন, লেনিনের নেতৃত্বে লড়ে চলা বলশেভিক মহিলা কমরেডরা। উত্তরে লেনিন ভাগ করে নিচ্ছেন গত তিন বছর ধরে তাঁর দেখা মহিলাদের জঙ্গি লড়াই। শ্রেণিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে মহিলারা যতখানি সামাজিক গোঁড়ামি ধ্বংস করতে পেরেছেন, ততখানি এতদকালের নারীবাদী সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চাও পারেনি। এই তিন বছর লেনিনকে চাক্ষুষ করিয়েছে, “It shows the capacity of women, the great value their work has in society. The first proletarian dictatorship is a real pioneer in establishing social equality for women. It is clearing away more prejudices than could volumes of feminist literature. But even with all that we still have no international communist women’s movement, and that we must have. We must start at once to create it. Without that the work of our International and of its Parties is not complete work, can never be complete.” এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যে আলোচনা করেছি, তাতে লেনিনকে নিয়ে প্রশ্ন আসার পরিসর কম ছিল। আগামী পর্যায়ে, যেখানে ঢুকে পড়তেই হবে, সেখান থেকেই প্রশ্ন শুরু হবে। ক্লারা জেটকিন লেনিনকে জানান, জার্মানির মহিলা কমরেডরা সেই সময়ে পাঠচক্র থেকে সাংগঠনিক সভাগুলোতে সবচাইতে বেশি আলোচনা করছেন “যৌনতা, বিবাহ এবং মহিলাদের ভূমিকা” প্রসঙ্গে। লেনিনের উত্তর এখানে হুবহু উদ্ধৃত করা সমীচীন হবে; “Your list of sins, Clara, is still longer. I was told that questions of sex and marriage are the main subjects dealt with in the reading and discussion evenings of women comrades. They are the chief subject of interest, of political instruction and education. I could scarcely believe my ears when I heard it. The first country of proletarian dictatorship surrounded by the counter-revolutionaries of the whole world, the situation in Germany itself requires the greatest possible concentration of all proletarian, revolutionary forces to defeat the ever-growing and ever-increasing counter-revolution… The most widely read brochure is, I believe, the pamphlet of a young Viennese woman comrade on the sexual problem. What a waste! What truth there is in it the workers have already read in Bebel, long ago? Only not so boringly, not so heavily written as in the pamphlet, but written strongly, bitterly, aggressively, against bourgeois society…. It seems to me that these flourishing sexual theories which are mainly hypothetical, and often quite arbitrary hypotheses, arise from the personal need to justify personal abnormality or hypertrophy in sexual life before bourgeois morality, and to entreat its patience. This masked respect for bourgeois morality seems to me just as repulsive as poking about in sexual matters. However wild and revolutionary the behaviour may be, it is still really quite bourgeois. It is, mainly, a hobby of the intellectuals and of the sections nearest them. There is no place for it in the Party, in the class-conscious, fighting proletariat.” অর্থাৎ, মহিলা শ্রমিকদের মধ্যে যৌনতা, বিবাহ ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনা, সেই সময়ে, এটা খুব জরুরি তাই আবার বলছি, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে লেনিনের চোখে “what a waste!” ছিল।

বেশ খানিকক্ষণ আগেই ছুঁড়ে আসা একটি কথা এখানে প্রথিত করছি। লেনিনকে সবচাইতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় মার্ক্সবাদের লেন্সে। এই লেন্সে দেখতে পারার গোড়াকার শর্ত, পৃথিবীকে প্রথমবার সমাজতন্ত্র উপহার দেওয়ার মরণপণ যুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা হলেও, মহামতি লেনিনকে কোনও পরাবাস্তব, অতিমানবীয় ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে না দেখা এবং এই প্রবণতাকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ফেলে বাতিল করা। লেনিন একথা ঠিক বলেননি, তাঁর ভুল ক্লারা নিজে ঐ মুহূর্তে ধরিয়ে দিয়েছেন। সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের অন্দরে, বিবাহ নামক একপেষে পাশবিক চুক্তির শিকলে একজন মহিলার নিরেট ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ-যৌনতা সবটা পুরুষের পায়ের তলায় পিষে যেতে থাকে। এই নিষ্পেষণ কোনও উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয়; প্রতিদিনকার খোয়া যাওয়া আত্মসম্মান, আত্ম-ঔৎকর্ষ জাঁতাকলের নীচে তলিয়ে যেতে যেতে টেনে নিয়ে চলে যায়, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিজের জীবনের প্রতি ন্যূনতম ভালোবাসা, নিজের ক্ষমতা-দক্ষতার উপর এক চিমটে হলেও আত্মবিশ্বাস। অতএব, কারখানায় কাজ করার জন্য পরিবারের রঙ্গমঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসলেই এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহিলাদের মধ্যে উজ্জীবিত হয়ে যাবে, এমন নয়। এই প্রতিটি সমস্যা একজন শ্রমজীবী পরিবারের মহিলার জীবনে অনেক বেশি প্রকট। যুগ যুগ ধরে যে ভূমিকাগুলো দিয়ে নারীত্বের উদযাপন হয়ে এসেছে: স্বামীর সেবা করা, পরিবারের সকলের যত্ন নেওয়া, সন্তান-পালন, সঙ্গে ঘরে-বাইরে সবধরনের শ্রমনিয়োগ এবং সর্বোপরি এই সবকটি ভূমিকার মুখ্য চরিত্রে থেকেও এক বিন্দুও মতামত দিতে না পারা ও সেটা হাসিমুখে মেনে নিয়ে থেকে যাওয়া— এসবের বাইরেও যে একজন মহিলার পরিচয় নির্মাণ করা যেতে পারে, একইরকম বা আগের চেয়েও বেশি উজ্জ্বলতর জীবন তার হতে পারে কোনও এক নতুন মোড়কে, একথা আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেইসময়েই সবথেকে বেশি ছিল। প্রতিবিপ্লব, সাম্রাজ্যবাদ, চারপাশ থেকে গিলতে আসা শক্তিগুলোকে প্রতিহত করে, যাঁরা বিশ্বের প্রথম সর্বহারার একনায়কতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখবেন, তাঁদেরই সবার আগে আত্মবিশ্বাস, নিজের মতামতের নির্মাণ, তার উপর ভর করে বেঁচে থাকার মতো মতাদর্শ ও সামাজিক অবস্থান প্রয়োজন ছিল। লেনিন একথা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি বলেই ওনার কথায় স্পষ্ট। রাজনৈতিকভাবে, মননে, চেতনায় স্ব-শ্রেণিচ্যুত হয়ে সর্বহারার পার্টিকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুশীলন কীভাবে সম্ভব তা মার্ক্স-এঙ্গেলসের লেখনীর মধ্যে বার বার টের পেয়েছি আমরা। কিন্তু লিঙ্গ-অবস্থানচ্যুত হওয়ার প্রাথমিক পাঠ তখন একেবারে অনুপস্থিত। এই পাঠ এখনও নেই; আমরা তো এখনও বলি জেন্ডার স্টাডিজ বিদ্যালয় স্তর থেকে অবশ্যপাঠ্য না করলে সমাজের শিকড়ে নাড়া দেওয়া যাবে না। সমাজের সুবিধে-প্রাপ্ত লিঙ্গের মানুষেরা যে লিঙ্গবৈষম্যের সমস্ত কিনারা ছুঁতে পারেন না, আন্দাজ করতে পারেন কেবল, তাও যদি যথেষ্ট সংবেদনশীল হন; এই তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক অবস্থান আমরা নিতে পেরেছি নারীবাদের তৃতীয় ঢেউয়ের শেষ পর্যায়ে এসে, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে। আর লেনিন, যিনি আসলে বিশ শতকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা, গোটা জীবন শুধু এবং শুধুই শ্রেণিসংগ্রামের আধারে সঁপে দেওয়া একজন কমরেড, তিনি কোনও আলাদা সুযোগ পাননি এই অনুশীলনের। তাই ব্যর্থ হয়েছেন একথা বুঝতে, ‘ইট ওয়াজ নট আ ওয়েস্ট অফ টাইম’। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য, কোনও কোনও বিতর্কের ধারালো সূঁচ থেকে লেনিনকে উদ্ধার করা বা বাঁচানো নয়; সেই প্রয়োজন বোধ করাও অপ্রয়োজন। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, বস্তুগতভাবে যেমন, সেটা তাঁর সময়ের নির্মাণ। সময়ের বাইরে গিয়ে লেনিনকে মূর্তিস্বরূপ যাঁরা ভাবেন না, তাঁরা কেউই এই আলোচনাকে “ডিফেন্স” ভাববেন না। একটি সময়োপযোগী মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা এবং ক্লারার হাত ধরে অতীতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার প্রকল্পের নথিটুকু হয়েই এই যুক্তি রইল।

শেষদিকে ক্লারা জেটকিন ‘গ্লাস অফ ওয়াটার’ তত্ত্বের কথা বলেন। সেইসময়ে একথা বহুল চর্চিত হতে শুরু করে। যৌনতার সঙ্গে জলপিপাসার তুলনা করা হয়। মহিলাদের যৌনতাকে পরাধীন করার মধ্যে দিয়েই বিবাহ নামক চুক্তি এবং তার মাধ্যমে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ‘সঠিক’ উত্তরাধিকারী হিসেবে পুরুষ-সন্তানকে বেছে নেওয়ার পদ্ধতি পরিবারের মধ্যে চলে আসছে— একথা ভাবায় মহিলাদের। ফলস্বরূপ তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, একমাত্র অবাধ যৌনতাই মহিলাদের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেবে। যৌনতাকে সম্মতির ভিত্তিতে তৈরি হওয়া একটি পারস্পরিক পিপাসার আদান-প্রদান হিসেবেই দেখা হবে, উঠে আসে ক্লারা জেটকিনের কথায়। লেনিন জানান, “I am nothing but a gloomy ascetic, the so-called ‘new sexual life’ of the youth – and sometimes of the old – often seems to me to be purely bourgeois, an extension of bourgeois brothels. That has nothing whatever in common with freedom of love as we communists understand it. You must be aware of the famous theory that in communist society the satisfaction of sexual desires, of love, will be as simple and unimportant as drinking a glass of water. This glass of water theory has made our young people mad, quite mad. It has proved fatal to many young boys and girls. Its adherents maintain that it is Marxist. But thanks for such Marxism which directly and immediately attributes all phenomena and changes in the ideological superstructure of society to its economic basis! Matters aren’t quite as simple as that. A certain Frederick Engels pointed that out a long time ago with regard to historical materialism”। কোন সমাজে দাঁড়িয়ে সম্মতিকে “পারস্পরিক” বলতে পারি আমরা? এক গ্লাস জল খেয়ে পিপাসা মিটে যাওয়া যতটা সহজ ও সরল, সদ্য বিপ্লব হওয়া একটি সমাজব্যবস্থার মধ্যেও কি ততটাই সহজ সরল? অবাধ যৌনতা যদি সাংস্কৃতিক, সামাজিক, সাংগঠনিক ক্ষমতা-বিন্যাসের মধ্যে ঘটে, যেখানে ক্ষমতার সমান ভাগাভাগি সম্পন্ন হয়নি, সেখানে কি এই চর্চা একটি গণিকালয়ের ব্যাপ্তি ঘটাবে না? এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো উঠে আসে লেনিনের কথায়, ঐ ব্যবস্থার মধ্যেই। অথচ আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটি বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্রব্যবস্থায়। সমাজ থেকে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষই এখনও অবলুপ্ত নয়। জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুদূর গ্রামে বিস্তৃত খাপ পঞ্চায়েত— কোথাও লিঙ্গ-সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিকে বিশেষ অগ্রসর হইনি আদতে। তারই মাঝে থেকে গেছে ক্ষমতা সম্পর্কের নানান সমীকরণ। সেখানে দাঁড়িয়ে সম্মতি-নির্মাণের বিপুল উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। এরকম সময়ে, কোনও একটি যৌন-সংযোগও রাজনৈতিক দায়িত্ব-মুক্ত একটি পিপাসার গ্লাস হতে পারে না। জোর করে বানানোর চেষ্টা করা হলে কী ফল হবে লেনিন অনুধাবন করে গিয়েছেন, পরতে পরতে আমরা টের পাই। মুজফফরনগর, সুরাট, জয়সলমিরের প্রত্যন্ত গ্রাম হয়ে বিহারের গোপালগঞ্জ পর্যন্ত অসংখ্য খবর এসেছে, ত্রাণের বিনিময়ে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ। এই সমস্ত ক্ষেত্রে একজন ভুখা মহিলাও বাঁধা দেননি, সন্তানের মুখে গ্রাস তুলবেন বলে পাথর হয়েই থেকেছেন হয়তো, তবু আপনি কি ধর্ষণ ছাড়া অন্য কিছু বলবেন এগুলোকে? ত্রাণের বিনিময়ে এক গ্লাস জল খেয়ে তেষ্টা মিটিয়েছেন তাঁরা?

আমি সেই দেশে বাস করি, যেখানে মহিলা শ্রমিকরা কয়েকশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ফেরার পথে, পথেই ভূমিষ্ঠ করেন তাঁর সন্তানকে। জেলার সীমান্তে ঢোকার মুখে করোনা পরীক্ষার নামে যাঁদের উপর যৌন অত্যাচার করা হয়। আমার দেশের বেশিরভাগ মহিলারা, যাঁরা ক্ষেতমজুর, দিনমজুর, অস্পৃশ্য সাফাইকর্মী, অযোধ্যার ঝুপড়িবাসী একলা সংখ্যালঘু রমণি— তাঁরা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চকচকে দেওয়াল আর সোশ্যাল মিডিয়ার ভিড়ে ঠাসা দেওয়াল থেকে বহু দূরে লড়ে চলেছেন। কখনও একলা, কখনও গোষ্ঠীতে, কখনও ট্রেড ইউনিয়নের ঝান্ডা হাতে। এই দেশের বুকে দাঁড়িয়ে আজকের সময়ে ১৫০ বছর আগে কমরেড লেনিনের বলা, সর্বহারা ও শ্রমিক মহিলাদের মুক্তি সংগ্রামের পথ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। লেনিন যা কিছু বুঝতে ভুল করেছেন, সেই প্রতিটি ভ্রান্তিও সাংঘাতিক প্রাসঙ্গিক, এই পথকে আরও সুগম করার জন্য, আরও কাছে টেনে আনার জন্য। ভীষণ মনে পড়ছে, ১৯১৭-র অক্টোবরে, সদ্য ভূমিষ্ঠ বিপ্লবের আকাশ ভাঙা চিৎকার ভেদ করে সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় কারখানার মহিলা শ্রমিকরা কমরেড লেনিনের উদ্দেশ্যে স্লোগান দিচ্ছেন,

Take power, Comrade Lenin: that is what we working women want.

লেনিন, যাঁর নারী প্রসঙ্গে মনোভাব নিয়ে এত কথা হল, সেই কমরেড লেনিন উত্তরে জানালেন,

It is not I, but you – the workers – especially the militant women, who must take power. Return to your factories and tell the workers that.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...