কালের খেয়ার যাত্রী: স্মৃতিপরম্পরা

আনিসুজ্জামান | বঙ্গবিদ্যাচর্চার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব

আবুল আহসান চৌধুরী

 


লেখক বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক। আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক।

 

 

 

 

মেধা ও প্রজ্ঞা, সুরুচি ও সৌজন্য, বিনয় ও দার্ঢ্য— বাঙালি সমাজে খুব কম মানুষের জীবনেই একসঙ্গে এইসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে। আর এক জীবনে বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি, স্বীকৃতি ও সাফল্য, অর্জন ও প্রাপ্তির সমাহারও দুর্লভ বটে। কথাগুলো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে উপলক্ষ করে।

 

দুই

আশি বছরের আনিসুজ্জামান এক প্রাজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের নাম। বাঙালি সমাজে সব মিলিয়ে তাঁর মত মানুষের আমাদের কালে দেখা মেলা ভার। মেধাবী শিক্ষক, প্রাজ্ঞ গবেষক, প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী, উদার মন ও মতের সহৃদয় মানুষ, দায়িত্ববান নাগরিক, প্রগতিপন্থী সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি চিহ্নিত ও শ্রদ্ধেয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালের বিবেকী মানুষ তিনি। দেশকালের নানা ঐতিহাসিক ঘটনার নিকট-সাক্ষীও তিনি। সঙ্গ-সান্নিধ্য-সাহচর্য পেয়েছেন দেশবিদেশের কীর্তিমান মানুষের। সেই হিসেবে নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ তাঁর জীবন– এই বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতি-অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে তাঁর আত্মকথনে-স্মৃতিচর্চায়। এ শুধু ব্যক্তির নিজের জীবনের কথা নয়, তাঁর জীবনকালের বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিক কাহিনি। আমরা তাঁর জীবননির্মাণের সেই আফসানার ভেতর দিয়ে তাঁকে যতটা পারি চিনে নিতে চাই।

 

তিন

তিন পর্বে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর জীবন ও তাঁর কালের কথা শুনিয়েছেন। ঘটনা-পরম্পরায় সেই স্মৃতিচর্চার উল্লেখ এইরকম: ‘কাল নিরবধি’ (২০০৩), ‘আমার একাত্তর’ (১৯৯৭) ও ‘বিপুলা পৃথিবী’ (২০১৫)। (অনেকটা এর পরিপূরক রচনা ‘চেনা মানুষের মুখ’ (২০১৩)।) এই তিন পর্বের স্মৃতিকাহিনি এসে থেমেছে ২০০০-এ। ‘কাল নিরবধি’র সূচনা তাঁর বংশপুরাণ দিয়ে এবং শেষ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘটনায়। ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিকথা’ বিবৃত হয় ‘আমার একাত্তর’-এ। এর পরে শুরু হয় ‘১৯৭২ থেকে পরবর্তী সময়ের’ স্মৃতিচর্চা, যার পরিধি ২০০০ পর্যন্ত। ‘বিপুলা পৃথিবী’র ‘নিবেদনে’ তিনি যা বলেছিলেন স্মৃতিকথা-বর্ণনে তাই তাঁর দর্শন ও মূল কথা: “নিজের সম্পর্কে জানানোটা জরুরি নয়। কিন্তু যা দেখেছি, যা শুনেছি, তার অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ।” তাই তাঁর অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণই একান্ত নিজের কথা ছাপিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর স্মৃতিকথায়।

 

চার

আত্মকথা নিছকই ব্যক্তির নিজের জীবনভাষ্য নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও কখনও বৈশ্বিক সম্পর্কসূত্র। তাই অনেক ব্যক্তির স্মৃতিভাষ্য তাঁর জীবন ছাপিয়ে হয়ে ওঠে কালের দলিল— সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের মহার্ঘ্য উপকরণ। আনিসুজ্জামানের ‘কাল নিরবধি’ প্রসঙ্গেও এই কথাটি অনায়াসে বলা যায়।

শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতি নানা অনুষঙ্গে আনিসুজ্জামান বাঙালি সমাজে পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লালিত উদার মানবিকতার সাধক তিনি। একদিকে অন্তরে লালন করেন সাম্যবাদী চিন্তা, অপরপক্ষে প্রেরণা পান বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকেও। বিচিত্র পরিবেশ ও অভিজ্ঞতায় গড়ে উঠেছে তাঁর জীবন। তাঁর জীবনকাল স্পর্শ করেছে রাষ্ট্রীয় তিন জমানাকে। দেশি-বিদেশি অসংখ্য কীর্তিমান গুণী ব্যক্তির সঙ্গ-সান্নিধ্য লাভ করেছেন– সেইসঙ্গে সুহৃদ-সতীর্থদের অন্তরঙ্গ সৌহার্দ্য-বন্ধুতাও। নানা ঘটনার সাক্ষী তিনি– অম্লমধুর অভিজ্ঞতাও কম সঞ্চয় করেননি। জীবনের এই সব কথা তিনি বড় অন্তরঙ্গ সুরে শুনিয়েছেন। তাঁর বৈশিষ্ট্য এইখানে যে, তিনি যেন এই কাহিনির নায়ক নন, একাগ্র কথক মাত্র– নায়ক তাঁর কাল, তাঁর সময়। তাই আত্মচরিতকারের অহম-কে ছাপিয়ে এখানে রূপ পেয়েছে অন্তরঙ্গ সেই সময়।

‘কাল নিরবধি’ আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত: ‘জন্মের আগে’, ‘জেগে উঠিলাম’, ‘অন্য কোনোখানে’, ‘আলো ভুবনভরা’, ‘বিচিত্র চিত্র’, ‘প্রথম প্রবাস’, ‘সমাজ-সংসার’ এবং ‘নতুন ঠিকানা’। অধ্যায়-শিরোনামে পাওয়া যায় বক্তব্য-বিষয়ের আভাস। কথক জানাচ্ছেন: “এই রচনার শুরু আমার পূর্বপুরুষের বৃত্তান্ত দিয়ে, শেষ মুক্তিযুদ্ধের সূচনায়।” কেন এই স্মৃতিচর্চার আয়োজন সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন: “আমি বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এবং বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সাহচর্যধন্য। যে-পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিতে আমি ‘হয়ে’ উঠেছি, সে-সম্পর্কে জানাবার সঙ্গে সঙ্গে তাই আমি অন্য অনেকের এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নানান ঘটনার কথা বলতে চেয়েছি। কোনো কোনো ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শী না-হয়েও তার বর্ণনা দিয়েছি।” আর এই আত্মকথনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন: “এ-ধরনের লেখায় অকপটে বলার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। যেসব ক্ষেত্রে অন্যের গোপনীয়তা ভঙ্গের অধিকার আমি অর্জন করিনি, সেসব ক্ষেত্রে কিছু কথা অনুক্ত থেকে গেছে। স্মৃতিও হয়তো প্রতারণা করেছে। এই শর্তসাপেক্ষে দাবি করতে পারি, সদা সত্য কথা বলিয়াছি।”

আনিসুজ্জামান একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিবান পরিবারের সন্তান। সলতে পাকানোর পর্বের মতো তাঁর নিজের কথা বলতে গিয়ে সেই পরিবারের পূর্ব-ইতিহাস স্মরণ করেছেন। তাঁর বংশপুরাণ থেকে জানা যায় পরিবারের বিত্তের অহঙ্কার না থাকলেও বিদ্যা আর ঐতিহ্যের গৌরব ছিল। সাহিত্যচর্চার আবহও ছিল পরিবারে। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম সাহিত্যচর্চা, বিশেষ করে সাময়িকপত্র প্রকাশনা-সম্পাদনার ক্ষেত্রে সেকালে বাঙালি মুসলমান সমাজে পথিকৃতের সম্মান পেয়েছিলেন। পিতামহের মাতুল শেখ গোলাম কিবরিয়াও লেখক ছিলেন। মাতৃকুলেরও কেউ কেউ সাহিত্যচর্চা করতেন বলে জানা যায়। এমনকি বাড়ির মেয়েরাও এ-বিষয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। মা-বাবারও সাহিত্যের প্রতি ছিল প্রবল অনুরাগ। আনিসুজ্জামানের সাহিত্য বিষয়ে পঠন-পাঠন ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে এই পারিবারিক আবহ ও ঐতিহ্য যে একটা প্রভাব ফেলেছিল, প্রেরণা জুগিয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা চলে।

আনিসুজ্জামানের জন্ম কলকাতায়, আর তাঁর ছেলেবেলার একাংশও কেটেছে এই মহানগরীতেই। তাঁর জীবনের প্রথম এক দশকের স্মৃতি এই কলকাতাকে ঘিরেই। চিকিৎসক-পিতার সূত্রে ও বিশেষ অঞ্চলে বাসের সুবাদে সেকালের অনেক নামকরা মানুষকে দেখেছেন-জেনেছেন— তাঁরা কেউ সাহিত্য বা সাংবাদিকতার জগতের, কেউ রাজনীতির, কেউ সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের, আবার কেউ বা ছিলেন বড় আমলা। অল্প কথায় এঁদের ঘরে-বাইরের অনেক খবরই পরিবেশিত হয়েছে। নিজের পারিবারিক ঘরোয়া কথাও পেশ করেছেন অকপট আন্তরিকতায়। মহাসমর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, দেশভাগ তাঁর মনের ওপরে গভীর ছাপ ফেলেছে। দাঙ্গার বীভৎস রূপ তাঁকে বিচলিত করেছিল, তাঁর মনে জন্ম নিয়েছিল ভিন্ন এক মানবিক উপলব্ধি। তাই অনায়াসেই তিনি বলতে পারেন:

পরিবার এবং পরিবেশ থেকে যেটুকু সাম্প্রদায়িক ভেদজ্ঞান আমার জন্মেছিল, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার অভিজ্ঞতার ফলে মন থেকে তা সম্পূর্ণ মুছে যায়। যা দেখলাম এবং যা শুনলাম, তাতে মানুষের প্রতি জ্ঞানকৃত অপরাধের জন্যে যাদের প্রতি মনে ধিক্কার জন্মালো, তাদের জাত আলাদা হলেও কাজ অভিন্ন।

সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারায় সাতচল্লিশের দেশভাগ ছিন্নমূল করল হাজার হাজার পরিবারকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বাস্তব সমস্যা ও মনস্তাত্ত্বিক অসহায়তা তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করল। ফলে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের আশায় ‘পাকিস্তান’ নামের নতুন রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডে শরণার্থী হতে হল আনিসুজ্জামানদের পরিবারকেও। শুরু হল বিচলিত কিশোরের জীবনের নতুন এক পর্ব– স্বপ বপন আর স্বপ্নভঙ্গের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে।

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর— এই চব্বিশ বছর, এক অনুদার ও বৈরী রাষ্ট্রীয় পরিবেশে বাঙালির জীবন কেটেছে। রাজনৈতিক বঞ্চনা, আর্থনীতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পূর্ব বাংলার মানুষকে করেছে আশাহত, ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী। এর প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বশাসনের আকাঙ্খা। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এক নতুন জাগৃতির বোধে উত্তীর্ণ হয়েছে বাঙালি জাতি। আনিসুজ্জামান খুব কাছ থেকে এইসব সংগ্রাম-আন্দোলন প্রত্যক্ষ-পর্যবেক্ষণ করেছেন— কখনও অংশ নিয়েছেন, সক্রিয় থেকেছেন, ঝুঁকি নিয়েও সম্পৃক্ত হয়েছেন এই কর্মকাণ্ডে— রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, আক্রান্ত বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার প্রয়াস কিংবা রবীন্দ্র-বর্জন-বিরোধিতা-বিদূষণ মোকাবিলার মতো কাজে। নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়েছেন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাংগঠনিক কাজে। এক বৃহৎ সামাজিক ক্যানভাসে তিনি তাঁর সময়ের ছবি এঁকেছেন নিপুণ হাতে।

আনিসুজ্জামানের স্মৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে পঠন-পাঠনের বাইরে তিনি নানা সংগ্রাম-আন্দোলন, শিক্ষক-রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। চেনা-জানা সতীর্থ ও শিক্ষকদের কথা উঠে এসেছে নানা প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গে। অপ্রিয় সত্যকথনে কুণ্ঠিত হননি কখনও— যাঁর যা ভূমিকা বা আচরণ অবিকৃতভাবে সেসব তুলে ধরেছেন তাঁর স্মৃতিচারণায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামী অধ্যাপকের নিত্য স্ত্রী-নির্যাতনের খবর কিংবা একজন মনীষী-অধ্যাপকের রবীন্দ্র-বর্জনের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানে অনীহা কিংবা আইয়ুবী আমলে তাঁর কথিত উন্নয়ন দশকের স্তুতি-কীর্তনে একজন প্রগতিপন্থী অধ্যাপকের অংশগ্রহণ– এইসব কথা তিনি রাখঢাক না করে সত্যের অনুরোধে প্রকাশ করেছেন। রঙ্গ-কৌতুকও অনেক ঘটনার বর্ণনায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। যেমন ধর্মনিষ্ঠ অধ্যাপক কাজী দীন মুহম্মদের নামাজ পড়াকে ‘উঠবোস করে আসি’ বলা কিংবা বাজার ও রন্ধনপটু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সামনেই তাঁকে উদ্দেশ করে এক রসিক ছাত্র যখন বলে ‘স্যারের মাংসে ভালো স্টু হয়’, তখন তাঁর সরস প্রফুল্ল জবাব ভেসে আসে, ছেলেটি ‘রান্না বোঝে’। এমন সব মজার ঘটনা, বিচিত্র চরিত্র বা সরস মন্তব্যের পরিচয় আনিসুজ্জামানের স্মৃতিচর্চায় আকসারই পাওয়া যায়।

প্রবাসজীবনেও আনিসুজ্জামান চোখ-কান খোলা রেখে ব্যক্তি ও ঘটনাকে অবলোকন করেছেন— অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিদেশের মাটিতে তাঁকে সাময়িক সমস্যা-অসুবিধা যেমন মোকাবিলা করতে হয়েছে, তেমনি মুশকিল আসানের জন্য আন্তরিক সহায়তাও পেয়েছেন স্বদেশি-বিদেশি অনেক সহৃদয় মানুষের। মার্কিন মুলুকে তাঁর গবেষণাকাজের পাশাপাশি কিছু সারস্বত কাজ ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়েছে। মজলিশ-জমানো আড্ডা— তার সুযোগও মিলেছে। এই প্রবাসকালেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়— সেই গভীর শোক বুকের ভেতরে লালন করেই তিনি দেশে ফেরেন।

‘কাল নিরবধি’— এই বৃহৎ পরিসরের স্মৃতিকথনে কয়েকটি বিষয় স্পষ্টই চোখে পড়ে: এক, কথকের অসামান্য স্মৃতিশক্তি; দুই, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য; তিন, ঘটনার নিরাবেগ-নিরপেক্ষ বিবরণ; চার, নিজের ভূমিকাকে কখনওই বড় করে না-দেখানোর যৌক্তিক সংযম; এবং পাঁচ, আলাপচারী স্বাদু গদ্যভাষা, যা স্মৃতিকথাকে সরস-গতিময়-প্রাঞ্জল ও অনেকটাই উপন্যাসের আদলে পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করে। এইসব বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘কাল নিরবধি’ ইতিহাস, উপন্যাস ও স্মৃতিকথার একটি মিশ্র রূপ যেন পেয়েছে।

‘কাল নিরবধি’র কথকতা শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে— পঁচিশে মার্চের কালরাতে যে শঙ্কা-সংশয় ও সেইসঙ্গে যে ক্ষীণ আশাবাদ জেগেছিল বাঙালির মনে তারই আভাস দিয়ে:

আমরা বুঝতে পারলাম, ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কি মুক্ত আছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কি মেরে-ধরে পদানত করে ফেলবে আমাদের? আমরা কি পারব প্রতিরোধ করে তাদের হারাতে? বাংলাদেশ কি স্বাধীন হবে শেষ পর্যন্ত? তার জন্য কত মূল্য দিতে হবে?

এই প্রশ্নের জবাব মিলেছে তাঁর উত্তরপর্বের পরিপূরক স্মৃতিচর্চা ‘আমার একাত্তর’-এ।

 

পাঁচ

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণার প্রাককথনে আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেছেন: “১৯৭১এর স্মৃতি যার সঞ্চয়ে আছে, তারই কিছু বলবার মতো কথা আছে। আমি তাদেরই একজন।” এর রেশ ধরে বলেছেন: “আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটা খণ্ডচিত্র অঙ্কন করেছি। তাতে আমাদের গৌরবের কথা আছে, শুভাকাঙ্খীদের সহায়তার কথা আছে, নিজেদের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও আছে।” মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান যথাসম্ভব নির্মোহ ও নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন। ফলে এই স্মৃতিকথা বিশ্বাসযোগ্য ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে এবং সেইসঙ্গে নির্ভর করার মতো উপকরণের জোগানও এর থেকে পাওয়ার সুযোগ মিলেছে। মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন, এর কুশীলবদের অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই সদর-অন্দরের অনেক না-জানা বা স্বল্প-জানা ঘটনার বিশ্বস্ত বিবরণ পাওয়া যায় ‘আমার একাত্তরে’।

এই স্মৃতিকথার পট উন্মোচিত হয়েছে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের কালে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট হিসেবে। কীভাবে একটি নিগৃহীত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী ক্রমশ মুক্তিকামী লড়াকু জাতিতে পরিণত হয়েছে, এ হল তারই বয়ান। ১৯৭১-এর মার্চের গোড়া থেকেই সূচনা হয় বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি দিশা খুঁজে পায়— প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়। এ-সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের প্রতিক্রিয়া এইরকম:

কী অসাধারণ ভাষণ! সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখনই মনে হল, পৃথিবীর বুকে একটি নতুন জাতির জন্ম হল।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দু বছর আগে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে চট্টগ্রামে— বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরকেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। কিন্তু পাকবাহিনী ও তার দোসরদের হিংস্র মনোভাব ও বর্বর আচরণের ফলে মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও স্বাভাবিক জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন নিরাপত্তার খোঁজে আনিসুজ্জামান এপ্রিলের শেষে সপরিবার ভারতে আশ্রয় নেন— প্রথমে আগরতলা, পরে কলকাতায়। কলকাতা পৌঁছে মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে নেন। প্রথমে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, পরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সেলে। এরই ফাঁকে ফাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারের জন্য নানা সেমিনারে-সভা-সমিতিতে বক্তব্য পেশ করেছেন, ভারতীয় সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ রচনা বা তর্জমার দায়িত্ব নিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিকথায় মোটাদাগে দুই ধরনের আলোচ্য-বিষয়ের সন্ধান মেলে: ব্যক্তিগত-পারিবারিক-স্বজনমণ্ডলীর কথা এবং মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও কাজের সঙ্গে লেখকের যোগসূত্র। তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও আন্তরিক অভিজ্ঞতায় ব্যক্তি ও ঘটনার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছেন। একদিকে মানবিকতার বোধন, অনন্য সংগ্রামী চেতনা, দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার কাহিনি, অপরদিকে বিভাজনের রাজনীতির কুটিল পন্থা, উচ্চাভিলাষের লালসা, চক্রী ও চক্রান্তের নেপথ্য-কথা— এ-সবের উন্মোচন রয়েছে ‘আমার একাত্তরে’।

বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহচর ও আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী তাজউদ্দীন আহমেদের নিরন্তর সংগ্রাম, নিরাপস দৃঢ়তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি, পরিস্থিতির চাপে কখনও ক্ষণিক অসহায়ত্ব, অতুলনীয় কৃচ্ছ্রসাধনের নিকট-সাক্ষী আনিসুজ্জামান। ইতিহাসের এই নিঃসঙ্গ নায়ক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের কালেও বাস করতেন একটি নিরাভরণ ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে— খাওয়া-পরা ছিল অতি সাধারণ মানের, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করতেন নিজের হাতেই— আর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশ যতদিন না স্বাধীন হবে সে-পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে বসবাস করবেন না। এসব কথা আনিসুজ্জামানের বিবরণ থেকেই জানা যায়।

খোন্দকার মোশতাক আহমেদের কুটিল ষড়যন্ত্র, শেখ ফজলুল হক মনির আলাদা প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা, প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন ও দ্বন্দ্ব, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বিভাজন, পাকিস্তানের সঙ্গে আপসের গোপন প্রয়াস, বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় জনগণ এবং রাজনীতিক ও সরকারি মহলের দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-সাহস ও মনোবলের সমাচার, শরণার্থী লেখক-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা— লেখকের কলমে এইসব ঘটনা ও কথা ফুটে উঠেছে। বিবরণে কোথাও অতিরঞ্জন বা অস্বাভাবিক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাবে না। লেখকের সংযম তাঁর আত্মকথনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়তা করেছে।

মনে দাগ কাটার মতো কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে ‘আমার একাত্তরে’। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী। তিনি পরিজনহীন অবস্থায় দেশত্যাগ করে কলকাতায় আসেন, তাঁর ঠাঁই হয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনের কাছাকাছি একটি সাধারণ আবাসিক হোটেলে। ‘নিঃসঙ্গ উদ্বাস্তু জীবনে’ তাঁর ‘বিষণ্ণতার মাত্রা’ কেমন ছিল তার বিবরণ দিতে গিয়ে আনিসুজ্জামান বলেছেন:

সেবার ঈদের দিনে সকালে তার সঙ্গে দেখা করতে হোটেল পূর্বরাগে যাই। ঘরের দরজা খুলে দিয়ে তিনি আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমি যাওয়ার আগে থেকেই তিনি কাঁদছিলেন। আমি যাওয়ার পরেও নীরব অশ্রু তাঁর বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছিল।

শ্রুতিনির্ভর আর একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার উল্লেখ মেলে আনিসুজ্জামানের এই বইয়ে। নাটকীয় মুহূর্ত-রচনার এই কাহিনি শরণার্থী শিবিরের:

ক্যাম্পে শিশুদের জন্য দুধের ব্যবস্থা আছে, তাদের কোলে নিয়ে বা হাতে ধরে মায়েদের লাইনে দাঁড়াতে হয়।… সামনে শিশু কোলে নিয়ে এক মা দাঁড়িয়ে, ভদ্রলোক তাকে যেই দুধ দিতে যাবেন, পেছন থেকে কেউ তখন বলল, ওকে দেবেন না— ও বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারে। ভদ্রলোক মগে দুধ উঠিয়েও ইতস্তত করছেন, দেবেন কি দেবেন না। ভদ্রলোকের মুখের দিকে এক মুহুর্ত তাকাল সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি। তারপর কাপড় সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম খুলে নিজের বুক অনাবৃত করে দিল– সন্তানকে স্তনদানের ক্ষমতা তার আছে কিনা, দাতা তা নিজেই বিচার করুন।

‘এ ঘটনার স্মৃতি’ আনিসুজ্জামানের মতো পাঠককেও নিরন্তর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

এই স্মৃতিচর্চা শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিতে, লেখকের দেশে ফেরার পর। ১৯৭২-এর জানুয়ারির ৫ তারিখে খুলনায় তিনি আসেন, ৮ তারিখে সেখান থেকে ঢাকায়। আর ১০ জানুয়ারিতে ‘আমার একাত্তরে’র তামাম-শুদ। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর ও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এর ফাঁকে লেখক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে আসেন— তাঁর চোখে পড়ে অস্ত্রধারীদের অরাজকতা, সেইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতি। ১০ জানুয়ারি রাতে এক বিপন্ন অবাঙালি পরিবারকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কসাইখানা মিরপুরে পৌঁছে দেওয়ার মানবিক ও নৈতিক কর্তব্য পালন করেন লেখক।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্রে রেখে তার পটভূমির বিবরণ ও চূড়ান্ত বিজয়ের পর স্বাধীন স্বদেশে স্মৃতিচর্চাকারীর ফিরে আসা পর্যন্ত এই বইয়ের সময়পরিধি। আনিসুজ্জামানের ‘আমার একাত্তর’ ইতিহাস-ছোঁয়া সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-নিরাশা, শোক-বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির এক অনন্য স্মৃতি-সম্পদ।

 

ছয়

আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ (২০১৫) নামের আত্মজীবনীতে বাংলাদশের প্রায় তিন দশকের (১৯৭২-২০০০) সমাজ ও ইতিহাসের চালচিত্রের পরিচিতি পাওয়া যায়। গ্রন্থ-পরিচিতিতে বলা হয়েছে:

নবীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মুহূর্তে আনিসুজ্জামানের এ আত্মজীবনীর সূচনা। এর পর তা ছড়িয়ে পড়েছে এ দেশের ইতিহাসের তিনটি দশকের বিস্তৃত পটভূমি জুড়ে। গবেষক আনিসুজ্জামান একদিকে বিদ্যায়তনের অন্বেষণে নিবিষ্ট। অন্যদিকে এই উত্থান-পতনময় সময়ের নানা কর্তব্যের আহ্বানে নাগরিক আনিসুজ্জামানের জীবন মুখর। তাঁর অন্তরঙ্গ স্মৃতিকথা এগিয়ে চলেছে সমান্তরাল এ দুই ধারার ভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে।… এ আত্মস্মৃতি তাই শুধু আনিসুজ্জামানের নিজেরই উন্মোচন নয়, এ আত্মস্মৃতি নবীন এক রাষ্ট্রের অন্তরঙ্গ সামাজিক উন্মোচন।

এই বক্তব্য অনুসরণ করলে গ্রন্থের বিষয় সম্পর্কে একটি আভাস পাওয়া যায়৷

‘নতুন যুগের ভোরে’, ‘অস্তাচলের গান’, ‘হননের কাল’, ‘কাছে-দূরে’, ‘হালখাতা’— এই পাঁচটি পর্বে ‘বিপুলা পৃথিবী’-র পরিচয় ব্যাপ্ত। নিজের কথার পাশাপাশি সেই সময়ের চিত্রও এতে ধরা পড়েছে। সরকারের তরফে অনেক প্রস্তাব এলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি, শিক্ষকতা পেশাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্যে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদে ইস্তফা দেন। বাংলা অ্যাকাডেমির পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে যেমন সহায়তা করেছিলেন, স্বাধীন দেশেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। নতুন রাষ্ট্রের শিক্ষা ও সংস্কৃতি-নীতি কী হবে সে বিষয়ে ভূমিকা পালন করেছেন। তবে সবচেয়ে দায়িত্বশীল ও সম্মানজনক কাজ ছিল বাংলাদেশের সংবিধানের ইংরেজি-ভাষ্যের বাংলা তর্জমা। আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে এই কাজে তিনি যুক্ত হন। বলেছেন তিনি:

বাংলাদেশের সংবিধান-রচনার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি [ড. কামাল হোসেন] খসড়া তৈরি করবেন ইংরেজিতে, আমাকে তার বাংলা করে দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত বাংলাটাই গৃহীত হবে প্রামাণ্য ভাষ্য বলে। …আমি অনুবাদ করতে শুরু করলাম। একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগল দেহে-মনে: এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান-রচনার কাজে হাত দিয়েছি।

ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন আনিসুজ্জামান। কমিশনে তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা। এক সভায় বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন সরকার বাজেটে শিক্ষাখাতে কেমন বরাদ্দ করবে, তার ওপর ভিত্তি করেই শিক্ষা কমিশন সুপারিশ তৈরি করবে। বঙ্গবন্ধু আশ্বাস দিয়েছিলেন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অর্থের কোনও সমস্যা হবে না। কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের জন্যে আনিসুজ্জামানের প্রস্তাবেও বঙ্গবন্ধু সম্মতি জানান। আবার অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বাজেট-বক্তৃতা লিখে দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি সহায়তা করেছেন।

তবে নানা কমিশন-কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে আনিসুজ্জামানের বিচিত্র ও কখনও তিক্ত অভিজ্ঞতাও কিছু হয়েছে। যেমন, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাও বহাল রাখার বিষয়ে অন্য কারও কারও মতো তাঁরও আপত্তি ছিল, কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। বাংলা একাডেমির সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের একীকরণকেও তিনি সঙ্গত মনে করেননি, কিন্তু তাঁর এই মতও গ্রাহ্য হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানও যে কখনও কখনও কত সঙ্কীর্ণ ও অনুদার হয়ে উঠতে পারে, আনিসুজ্জামান তা নিজের অভিজ্ঞতায় টের পেয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তাঁর নিয়োগ-প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তার খোলামেলা বিবরণ তিনি দিয়েছেন। এতে তাঁর ক্ষোভ ও বেদনা গোপন থাকেনি।

১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আনিসুজ্জামান সপরিবারে লন্ডন যান মূলত গবেষণার কাজে— বিষয় পুরনো বাংলা গদ্য, আরও নির্দিষ্ট করে বললে সেটা ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দের, অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ-প্রতিষ্ঠার আগের বাংলা গদ্য।’

লন্ডনে দেশি-বিদেশি অনেক গুণীজনের সঙ্গে আনিসুজ্জামানের দেখা ও পরিচয় হয়— সেই তালিকা কম দীর্ঘ নয়। গবেষণা, লেখালেখি, বিবিসি-র সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ঘরোয়া আড্ডা-আলোচনা, সামাজিক মেলামেশা— এইভাবেই দিন কাটতে থাকে। লন্ডনের জীবনযাত্রার সামান্য পরিচয় মেলে আনিসুজ্জামানের এই কথায়:

লন্ডনে আমাদের সামাজিক জীবন আবর্তিত হত মূলত প্রবাসী আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কেন্দ্র করে। সপ্তাহান্তে একটি দিন ঘরবাড়ি গোছানো এবং আরেকটি দিন বেশিরভাগ অন্যত্র খেতে গিয়ে, কখনও অতিথি সৎকার করে কেটে যেত।

এই লন্ডনে বসেই বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব খবর তিনি পান, তাতে হতাশ ও উদ্বিগ্ন হন— সে-রকমই একটা ঘটনা— ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির সরকার এবং একটি মাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল [বাকশাল] প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

সরাসরি বা অন্য সূত্র থেকে দেশের বা পরিবারের ভালোমন্দ খবর এসে পৌঁছয় তাঁর কাছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজলের আন্তরিকতাপূর্ণ চিঠি তাকে আনন্দিত ও অভিভূত করে। সেই চিঠি দেখে নবনীতা দেব সেন মন্তব্য করেন “কি ভাগ্য তোমার! এমন ভাইস-চ্যান্সেলরের সঙ্গে কাজ করো। আমাদের ভাইস-চ্যান্সেলররা কোনও টিচারের জন্য এত ভাবনা-চিন্তা করে না, তাদের সে সময় নেই।” কালান্তক ব্যাধিতে আক্রান্ত পিতার শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর শুনে বিচলিত হন। দেশে ফিরে আসার একটা জোরালো তাগিদ অন্তরে জাগে।

১৯৭৫-এর ১৩ আগস্ট সপরিবার দেশে ফিরে আসেন। প্রত্যাবর্তনের পর কী মর্মান্তিক পরিণতি-পরিস্থিতির কথা শুনতে হবে তা কল্পনাও করেননি। জানাচ্ছেন তিনি:

১৫ তারিখ সকালে তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। দরজায় করাঘাত করে আব্বা বললেন, ‘শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে— রেডিওতে বলছে।’ সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া ভাষায় ব্যক্ত করা শক্ত। খুব বড়রকম শূন্যতা বোধ করেছিলাম, এটুকু শুধু বলতে পারি। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশে জাত কিছু লোক তা অনায়াসে করে ফেলল— ভাবতেও অবাক লাগে!

২৭ অক্টোবর, বঙ্গবন্ধু-হত্যার ২ মাস ১২ দিন পর, পিতার মৃত্যুতে ঘটল পারিবারিক বিপর্যয়, তবে তা ছিল অনেকটাই প্রত্যাশিত, সেজন্যে মানসিক প্রস্তুতিও ছিল।

বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে শুরু হল রাজনৈতিক পালাবদলের খেলা— একের পর এক ঘটে চলল নারকীয় সব ঘটনা। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান হলেন, জেলখানায় বন্দি চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী-এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ঘটল পাল্টা ব্যর্থ-অভ্যুত্থান। এরপর ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লবে’র ফলে বন্দি জিয়াউর রহমানের মুক্তিলাভ, বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের দেশত্যাগ, মোশতাকের পদচ্যুতি ও প্রধান বিচারপতি  আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ, জাতীয় সংসদ বাতিল, দেশে সামরিক আইন জারির পর জিয়া হলেন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, তবে ‘ক্ষমতার চাবিকাঠি তাঁর হাতে রয়ে যায়’— এসব ঘটনার সার ও তাৎপর্য আনিসুজ্জামানের কলমে উঠে এসেছে।

প্রায় দুবছর আনিসুজ্জামান দেশে ছিলেন— খুব যে আনন্দে-স্বাচ্ছন্দ্যে তা মোটেই নয়। এই সময়ে অধ্যাপনা করেছেন, কিছু লেখালেখির কাজ করেছেন, বই বেরিয়েছে, উপকৃতজনের নিন্দা-সমালোচনা ভোগ করেছেন। এরই মধ্যে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির আমন্ত্রণ পেয়ে ১৯৭৭-এর ২৫ মার্চ আবার লন্ডন গেলেন। এর আগে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির কাগজপত্রের যে হ্যান্ডলিস্ট’ তিনি তৈরি করে দেন, কর্তৃপক্ষ তার ‘পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রনয়ণের’ জন্যে তাঁকে অনুরোধ জানান। এবারের লন্ডন-সফর সংক্ষিপ্ত হলেও কাজের পাশাপাশি বন্ধু-স্বজনদের সানন্দ-সান্নিধ্যে সময় কেটেছে। তাঁর কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে বলেছেন: ‘ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি এক মহামিলনক্ষেত্রও বটে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলনের এবং নতুন বন্ধুলাভের অনুকূল স্থান।’

বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক বিদেশভ্রমণের ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের নাম স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। মূলত গবেষণা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নেওয়ার জন্যে তিনি বিশ্বের সব কটি মহাদেশেই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আলাদা করে সেসব সফরনামা না লিখলেও তাঁর আত্মকথাতে তার বিবরণ মেলে। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির চেয়ে মানুষ ও তার সংস্কৃতির প্রতি তাঁর নজর পড়েছে বেশি। বিদগ্ধ নাগরিক মন নিয়ে তিনি এসব পর্যবেক্ষণ করেছেন। তবে একথাও কবুল করতে হয়, যত দূরেই তিনি যান না কেন, দূর-প্রবাসেও নাড়ির টান অনুভব করেছেন স্বদেশ ও স্বজনের জন্য।

দীর্ঘজীবনের বড় ট্রাজেডি এই, অসংখ্য স্বজন-প্রিয়জন ও চেনা মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী হতে হয়— শোক সইতে হয়— নিঃশব্দে, একাকী। মৃত্যু যে বিচ্ছেদের শূন্যতা আনে তা বহন করে চলতে হয় সারাটি জীবন। আনিসুজ্জামানের জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘বিপুলা পৃথিবী’ তে ধরা আছে তারই কিছু চিত্র— কিছু বিবরণ।

 

সাত

স্মৃতিই হারিয়ে যাওয়া সময় ও মানুষকে ফিরিয়ে আনে। ‘স্মৃতি সততই সুখের’— প্রবচনতুল্য এই কথাটির দ্যোতনা অস্বীকার না করেও বলা যায়, এই সুখের আড়ালে আবার লুকিয়ে থাকে কত না দুঃখের ইতিহাস, শোক-বেদনা-বিচ্ছেদের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার। ‘চেনা মানুষের মুখ’ (২০১৩)— এই বইতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্মৃতির সরণি বেয়ে এই ভূখণ্ডের আঠাশজন কৃতী ও স্মরণীয় মানুষের ‘আলেখ্য নির্মাণের প্রয়াস’ পেয়েছেন, যাঁরা ছিলেন সাহিত্য-সাংবাদিকতা-শিক্ষা-রাজনীতি-সমাজসেবা-সংস্কৃতিচর্চা— নানা বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের মধ্যে আবার অনেকেই ছিলেন একই সঙ্গে নানা গুণের অধিকারী। অবশ্যই খ্যাতি-পরিচিতি-প্রতিষ্ঠা-গুরুত্বে এঁরা যে সমপর্যায়ের ছিলেন তা নয়, মাপে-মানে ফারাক তো ছিলই। কিন্তু লেখক সমান আগ্রহ ও অনুরাগে তাঁদের উপস্থাপিত করেছেন পাঠকের কাছে। বইয়ের পরিচিতি দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, লেখাগুলোতে “কোথাও আছে তাঁদের কৃতির আলোচনা, কোথাও তাঁদের সম্পর্কে স্মৃতিচারণ, কোথাও বা কৃতির কথা ও স্মৃতির কথা মিলেমিশে গেছে।” মোহাম্মদ আকরম খাঁ, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, মুহম্মদ হবিবুল্লাহ বাহার, শামসুন নাহার মাহমুদ, সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম, মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও শহীদুল্লা কায়সার সম্পর্কে আলোচনায় কৃতির বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। স্মৃতিচারণের পর্যায়ে আবুল ফজল, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, মন্মথনাথ নন্দী, আব্দুর রাজ্জাক, মাহমুদ নুরুল হুদা, আখতার ইমাম, এ আর মল্লিক, আহমদুল কবির, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, রোকনুজ্জামান খান, সন্তোষ গুপ্ত, হাসান হাফিজুর রহমান, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, নাজমা জেসমিন চৌধুরী, সেলিনা বাহার জামানের নাম বিশেষ করে আসে। আর স্মৃতি ও কৃতি মিলিয়ে চরিত্র-চিত্রণের কথা উঠলে রণেশ দাশগুপ্ত ও খান সারওয়ার মুরশিদের নাম বলতে হয়। তবে এই বিভাজন চূড়ান্ত নয়। মাঝেমধ্যেই তা একে অপরের সঙ্গে মিশে যায় স্থানবদল করে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরিসরের এই লেখাগুলো সবই উপলক্ষের ফসল– শোক-স্মরণ-সংবর্ধনা কিংবা জন্মদিনের।

মওলানা আকরম খাঁকে দিয়ে এই বইয়ের আলোচনা শুরু, আর শেষ হয়েছে সেলিনা বাহার জামানের স্মৃতিচর্চায়। এঁদের সবার সঙ্গেই যে লেখকের সমান পরিচয় বা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তা নয়। কিন্তু সম্পর্কের গভীরতা যতটুকুই থাকুক না কেন, তাতে সেই মানুষটির মূল্যায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আকরম খাঁর সঙ্গে আনিসুজ্জামানের নিজের ততটা না থাকলেও পরিবারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। নিজের পঠন ও পর্যবেক্ষণে আকরম খাঁর একটি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন। “প্রাচীনপন্থীদের তুলনায় মাওলানা আকরম খাঁ’র ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল; আর আধুনিকদের তুলনায় ছিলেন রক্ষণশীল”– তাঁর এই মন্তব্যে আকরম খাঁর মন-মানসের পরিচয় সঠিকভাবে ফুটে ওঠে। প্রচলিত ধারণায় আকরম খাঁকে যে ঘোরতর রক্ষণশীল ও প্রগতিবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয় লেখক সেই বক্তব্য যৌক্তিক বলে বিবেচনা করেননি।

আনিসুজ্জামান পেশাসূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন (এখনও সেই যোগ ছিন্ন হয়নি)। তাই তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরমহলের অনেক অজানা ও চমকজাগানো খবরের সন্ধান মেলে। যাঁদের কথা লেখকের কলমে এসেছে তাঁদের মধ্যে অন্তত চারজন উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। উপাচার্য যাঁরা ছিলেন তাঁদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা-মেধা-সততা-সাহস-অবদান-ব্যক্তিত্বের সঙ্গে হাল আমলের ওই পদের অধিকারী অনেকের তুলনা করলে শরম পেতে হয়। আলোচনার সারিতে এঁদের বাইরে চার-পাঁচজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও আছেন। ছয়জন ওজারতিও করেছেন— তার মধ্যে তিনজন শিক্ষক, দুইজন আমলা, একজন রাজনীতিক। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ও আনুকূল্যে এ আর মল্লিক ও মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও বন্দুকের নলের মুখে তাঁরা মন্ত্রিত্ব করতে বাধ্য হন এক অস্বাভাবিক পরিবেশে। আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দিয়েছেন, দুজনেই অনুশোচনায় পীড়িত হয়ে মনে করেছেন, তাঁদের হাতে যেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত লেগে রয়েছে। আবুল ফজলও এর কিছুকাল পরেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েই হয়তো মন্ত্রীর পদমর্যাদায় সামরিক শাসকের উপদেষ্টা হন। তাঁর এই অভাবনীয় স্খলনে আনিসুজ্জামানের মতো গুণগ্রাহী প্রিয়জনেরাও ব্যথিত ও হতাশ হন। তবে বিবেকের দায়ে তিনি ‘মৃতের আত্মহত্যা’ লিখে তাঁর ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেন।

এ-বইয়ের তিনটি লেখা— আব্দুর রাজ্জাক, খান সারওয়ার মুরশিদ ও গিয়াসুদ্দিন আহমদকে নিয়ে— সবচেয়ে বেশি মন কাড়ে। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন জীবন্ত জ্ঞানকোষ— খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন লেখক। ছিলেন মজলিশি মেজাজের মানুষ, আড্ডার শিরোমণি— যা বলতেন সবই মুখে মুখে, লেখালেখিতে একেবারেই আগ্রহ ছিল না। বিচিত্রস্বভাবী এই মানুষটির আগ্রহ ছিল রান্না থেকে রাজনীতি এবং আরও অনেক কিছুতে। ঘনিষ্ঠ সাহচর্য ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে আব্দুর রাজ্জাকের চরিত্রের নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে তাঁর লেখায়। আব্দুর রাজ্জাকের চিন্তা-চেতনার একটা ছাপও লেখকের ওপরে পড়েছিল। আনিসুজ্জামানের শিক্ষক ও পরে সহকর্মী ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ। মার্জিত রুচির সংস্কৃতিবান এই শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে প্রগতিচেতনা ছাত্রশিক্ষকদের মধ্যে চারিয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন৷ ইতিহাসের শিক্ষক গিয়াসুদ্দিন আহমদের সঙ্গে ছাত্রাবস্থা থেকেই আনিসুজ্জামানের ছিল গভীর সখ্য-সম্পর্ক। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী হিসেবে নানা কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে তা আরও নিবিড় হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত এই তরুণ শিক্ষকের মর্মান্তিক পরিণতি লেখককে গভীরভাবে শোককাতর করেছিল।

কোনও কোনও ‘আলেখ্য’ কলেবরে একটু বেশিই ছোট, যাতে পুরো মানুষটিকে ধরা যায় না, সামান্য স্পর্শেই যেন হারিয়ে যায়, যেমন— মন্মথনাথ নন্দী, মধুসূদন দে, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, রোকনুজ্জামান খান কিংবা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। সম্পর্কের গভীরতার কারণে হাসান হাফিজুর রহমান লেখকের স্মৃতিচর্চায় যে আরও মনোযোগ দাবি করেন, তা মানতেই হবে। বইয়ের দু-একটি তথ্যে গরমিল চোখে পড়ে। আকরম খাঁ-এর বইয়ের নাম, যতদূর জানি, ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’— ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক সমস্যা’ নয়। ‘কোহিনূর’-সম্পাদক প্রথমে তাঁর নাম লিখতেন এস কে এম মোহাম্মদ রওশন আলী— পরে এস কে এম বর্জন করে নামের শেষে চৌধুরী যোগ করেন। কিন্তু কখনও এস কে এম মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী লিখতেন, এমন খবর মেলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে গিয়ে একই ঘটনার পুনরুক্তিও ঘটেছে দু-এক জায়গায়।

‘চেনা মানুষের মুখ’ ব্যক্তির স্মৃতিচর্চা ও মূল্যায়নের এক রম্য যুগলবন্দি। লেখকের পরিমিতিবোধ, সত্যকথন ও নিরপেক্ষদৃষ্টি বইটিকে ভিন্ন তাৎপর্যে মণ্ডিত করেছে। স্মৃতিচারণার কথক হিসেবে নিজেকে তিনি যথাসম্ভব আড়ালে রেখে নির্মোহ ভঙ্গিতে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ও ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। সমালোচনা-বিদ্ধ হতে পারেন জেনেও সত্যপ্রকাশের দায় না এড়িয়ে জানিয়েছেন বিতর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএনআর-আয়োজিত সেমিনারেও প্রবন্ধ পড়েছেন তিনি। খণ্ড খণ্ড ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতিচিত্রণে তিনি তাঁর কালকে ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। নির্মেদ স্বাদু গদ্যে অনেকটা গল্পের বিন্যাসে আনিসুজ্জামান অতীত দিনের ধূসর ক্যানভাসে তাঁর কালের চেনা মানুষের যে অন্তরঙ্গ ছবি এঁকেছেন তা পাঠককে মুগ্ধ ও স্মৃতিকাতর করে তোলে৷ এই আপাত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতিগুচ্ছ ভিন্ন অর্থে তাঁর ধারাবাহিক আত্মজৈবনিক রচনা ‘কাল নিরবধি’ (২০০৩),  ‘আমার একাত্তর’ (১৯৯৭) ও ‘বিপুলা পৃথিবী’র (২০১৫) কিছুটা পরিপূরক ও সংশ্লিষ্ট বলে ভাবা যায়।

 

আট

‘বিপুলা পৃথিবী’র কাহিনি শেষ করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান বলেছিলেন:

কথা ফুরোয় না, সময় ফুরিয়ে যায়। লেখায় ছেদ টানা যায়, জীবন কিন্তু প্রবহমান। জীবন ক্রমাগত সামনের দিকে চলে। আমাদের পথ চলা এক সময়ে থেমে যায়, জীবন থামে না।

এই স্মৃতিচর্চা এসে থেমেছে ২০০০ সালে৷ তারপর কেটে গেছে আরও কুড়ি বছর— ব্যক্তি-রাষ্ট্র-সমাজের বুকে ঘটে গেছে আরও কত ঘটনা। কথক সেই পর্বের কথা কখনও তাঁর স্মৃতির মোড়কে পরিবেশন করবেন পাঠকের এ-ই প্রত্যাশা।

কিন্তু এই বছরের ১৪ই জুন তাঁর প্রয়াণে সেই সম্ভাবনা আর রইল না। পাঠক বঞ্চিত হলেন এক বহুমাত্রিক বিদ্বজ্জনের জীবনের শেষ পর্বের স্মৃতিচারণা থেকে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...