শমীক ঘোষ
লেখক গদ্যকার
‘ক ঘণ্টা পড়েন দিনে?’
মনে হচ্ছে যেন লাস্ট বেঞ্চে প্রতি পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রকে দাঁড় করিয়েছেন মাস্টারমশাই। নিল ডাউন শুধু সময়ের অপেক্ষা! অমনই অবস্থা আমার। গলা শুকিয়ে কাঠ। পা দুটো সামান্য কাঁপছে। ভাবছি পালাব কোন দিক থেকে।
“আপনার তো কোনও পড়াশুনোই নেই। আপনি লিখবেন কী করে?”
এই দ্বিতীয়বার ওঁর বাড়িতে এসেছি আমি। অনেক আগে এসেছিলাম একবার। সাহিত্যিক অমর মিত্রের সঙ্গে। এবার এসেছি একাই। সদ্য বের হওয়া বইটা দিতে। বোধহয় এতটা সাহস দেখানো মোটেই উচিত হয়নি আমার।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর বলি, ‘উঠি তাহলে।’
মুখটা ঘুরিয়ে নেন একটু। ছোট্ট একটা শব্দ। ‘যান।’
এত রেগে যাবেন আমি সত্যিই বুঝিনি। বইটা দেওয়ার পরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার প্রিয় লেখক কে?’
অতিরিক্ত স্মার্টনেস নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কাফকা!’
ব্যাস! আর যাই কোথায়। প্রবল রেগে গেলেন। ‘কাফকা? কেন কাফকা? আমার বাবার সময়েও লোকে বলত কাফকা। আপনিও বলছেন কাফকা! আপনি মাণিকের নাম নিতে পারতেন, বিভূতিভূষণের নাম নিতে পারতেন, সেই সব নয় কাফকা!’
প্রথমবার ওঁকে দেখেছিলাম অন্তত আরও দশ বছর আগে। তখন আমি কলেজে পড়ি। সদ্য একটাই গল্প ছাপা হয়েছে। খুব ইচ্ছে লেখক হব। কিন্তু লেখালেখির ধার বিশেষ মাড়াই না। হঠাতই চলে গিয়েছিলাম বাংলা আকাদেমিতে ওঁর বক্তৃতা শুনতে। বিষয়– ‘উপন্যাস পড়া, না-পড়া।’
আর সেইখানেই প্রথম দেখেছিলাম দেবেশ রায়কে। ফর্সা। খুব উজ্জ্বল দুটো চোখ। আর ধারালো কথা বলার ধরন। সেই সময়ে লেখা উপন্যাস ব্যাখ্যা করছেন না তো, ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে কেটে ফালাফালা করেছেন। উড়িয়ে দিচ্ছেন, আমার সেই সময়কার ভালো লাগার অনেক উপন্যাসকেই।
দীর্ঘ বক্তৃতার পর নেমে হেঁটে যাচ্ছেন। সিঁড়ি অবধি পৌঁছতে পারলেন না। অডিটরিয়ামের এদিক ওদিক বসে থাকা মাঝবয়েসি লেখকরা পেছনে ছুটছেন। ‘দেবেশদা, দেবেশদা।’ সুপারস্টার যেন।
আর অডিটরিয়ামে এক কোণে জড়সড় হয়ে বসা আমি ভাবছিলাম, এই লোকটার সামনে কোনওদিন সোজা হয়ে কথা বলতে পারব না আমি। কিছুতেই পারব না। ওঁর পাণ্ডিত্যের ধারে কেটে কেটে ফালাফালা হয়ে যাব।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই কথাটাই। কেন যে আসতে গেলাম। আসলে সাহস সঞ্চয় করেছিলাম ওঁরই একটা এসএমএস পেয়ে। আমার একটা গল্পের প্রতিক্রিয়া এসএমএসে পাঠিয়েছিলেন অমরদাকে। সেটাই আমায় ফরোয়ার্ড করেছিলেন অমরদা।
সেই এসএমএসের উত্তর দেওয়ার পর কিছু কথাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। লেখাটা আরও ভালো কী করে হত, সে কথাও লিখেছিলেন নিজেই।
বাগুইহাটিতে ওঁর বাড়ি থেকে বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশন দুটো অটোর দূরত্ব। অটোতে বসে রাগ হয়ে গেল খুব। কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই ফের ওঁকে এসএমএস করলাম। ‘আপনি তো বললেন, আমি কিছুই পড়িনি। আমার প্রিয় উপন্যাস কিন্তু সওদাগর।’
মেসেজ পাঠাতে না পাঠাতেই উত্তর এল। ‘আপনি কোন সওদাগরের কথা বলছেন?’
এবার আমি আরও উদ্ধত। লিখলাম, ‘আপনার সমরেশদার লেখা সওদাগর।’ আমি জানতাম সমরেশ বসুর সঙ্গে ওঁর সখ্য ছিল। টপ ফর্মের সমরেশ বসুর উপন্যাসকেও ফালাফালা করেছিলেন তরুণ বয়সে।
এবার আবার একটা মেসেজ এল। দীর্ঘ মেসেজ। তার শেষ লাইনে লেখা, “আপনি আসবেন আবার। গল্প করব।”
যেমন খরখরে লোক, তেমনই তাঁর গদ্যভাষা। নইলে একটা উপন্যাসের শুরু কীভাবে এমন হতে পারে?
একই হাটে একসঙ্গে দুটো সাইনবোর্ড যাচ্ছে– এ বড় একটা দেখা যায় না।
একটা বেশ লম্বা-চওড়া, বড়, নতুন। হলুদের ওপর কাল, সরকারি সাইনবোর্ড যেমন হয়, শিলমোহর আঁকা, ‘কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’। আরো কী সব। টানতে লোকটির বেশ কষ্ট, একবার ঝুলিয়ে নেয় – কিন্তু তাতে রাস্তায় ঠুকে যায়। বগলেও নেয় দু’একবার – তাতে কাত হয়ে বেড় পাওয়া যায় না। অবশেষে মাথায়। সেটাই সবচেয়ে সুবিধের।
আসলে একটা মানুষের হেঁটে যাওয়ার বর্ণনা। কিন্তু সেই বর্ণনা আদ্যন্ত অন্যরকম। বাংলা গদ্যের জনপ্রিয় রীতির বাইরে।
‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ দেবেশ রায়ের সব থেকে আলোচিত উপন্যাস। এই উপন্যাস সুমন মুখোপাধ্যায় মঞ্চস্থ করেছেন। সেই প্রোডাকশন অত্যন্ত আলোচিত। অথচ তার পরেও এই লেখা সাধারণ পাঠকের অনায়াস পাঠের বাইরে।
প্রথমদিনই পড়াশুনো নিয়ে খোঁটা দিয়েছিলেন। তাই একটু আলাপ হতেই অনেকবার ওঁর কাছে একটা অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকা চেয়েছিলাম। অনেক অনেকবার। কোনওদিন দেননি। একবার আমি নাছোড়বান্দা। অনেক বলার পর বললেন, ‘দস্তেয়োভস্কির দ্য ইডিয়ট পড়েছেন?’
‘পড়েছি।’
‘আবার পড়ুন। পড়ে আমাকে জানাবেন কী মনে হয়েছে।’
পড়লাম। জানালামও সে কথা। এসএমএস করেই। উত্তর এল, এবার একটা প্রশ্ন। ‘উপন্যাসটা পড়তে আপনার কষ্ট হয়নি? মনে হয়নি যেন একটা বিরাট পাহাড়ে চড়ছেন? উপন্যাসটা শেষ করার পর আপনার শৃঙ্গজয়ের অনুভূতি হয়নি?’
সেদিন আমি সামান্য আন্দাজ করেছিলাম উনি কী বলতে চাইছেন। হয়তো ওঁর উপন্যাসকে আমি সেদিন কিছুটা বুঝতেও পেরেছিলাম। একটা পর্বতশৃঙ্গ, একটা ম্যাস্টিফ, আসলে খুব বড়। দীর্ঘ তার প্রসার। অনেক শৃঙ্গ, উপশৃঙ্গ, গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে ওঠা যায় তাতে। একটা খাঁটি উপন্যাসও তেমনই। দীর্ঘ তাঁর বিস্তার। না কয়েকটা চরিত্রের সামান্য সরলরেখা তাকে নির্মাণ করতে পারে না। বরং উপন্যাসের মতো বিরাটাকার কিছুকে ধরতে গেলে হয়তো আপাত সংযোগহীন, আখ্যানের সমান্তরাল বিস্তারের প্রয়োজন হয়। ঠিক যেমন একই সময়ের মধ্যে সমকালীন অথচ সাযুজ্যহীন বহুস্বর লুকিয়ে থাকে।
আলাদা আলাদা পর্ব, ছোট ছোট অধ্যায়। সেই অধ্যায়েরও নাম আছে। কখনও কখনও তার মধ্যে নিখাঁদ সাংবাদিকসুলভ ডকুমেন্টেশন। যেমন– ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ উপন্যাসের ‘কলকাতা এআইসিসিই ৩৯’ বা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-এর ‘বাঁধ কী করে হল’। দেবেশ রায় যেন আসলে উপন্যাসের বুনোটের মধ্যে একটা পলিফোনিক ডিসকোর্স বা বহুস্বরীয় প্রকরণকে নিয়ে আসতে চাইছিলেন।
কিন্তু কেন? দেবেশ রায়ের লেখা ‘উপন্যাস নিয়ে’ পড়তে পড়তে এই নিয়ে বেশ কিছু কথা আমার মনে হয়েছে। এই বইতে উপন্যাসের ভাবনা ও প্রকরণ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ একজোট করেছিলেন তিনি। ইউরোপের উপন্যাস ভাবনা ও প্রকরণকে যে ভাবে চিহ্নিত করেছেন মিলান কুন্দেরা, দেবেশ রায়ের এই লেখাও কোনও অংশে কম নয়।
আর এখানেই বঙ্কিমের উপন্যাসের ফর্ম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন দেবেশদা। সত্যি কথা বলতে গেলে কম বেশি গত দেড়শো বছরের বাংলা উপন্যাসের মূল ধারার গতিপ্রকৃতি আসলে সেই বঙ্কিমের তৈরি করা ধাঁচাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে। দেবেশদা লিখেছেন, বঙ্কিমের উপন্যাসের এই ফর্ম আসলে ইংরাজি উপন্যাস থেকে নেওয়া। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে স্কটের প্রকরণকে ভীষণভাবে ব্যবহার করেছিলেন বঙ্কিম। আর তার ভাষাকে করেছিলেন খুব বেশি বেশি সংস্কৃত ঘেষা। ইংরাজি শেখা, উপনিবেশবাদ মেনে নেওয়া বাঙালি সেই ফর্মের সঙ্গে যেন আগে থেকেই পরিচিত ছিল। তাই বঙ্কিমের সেই লেখার মধ্যে চেনা সেই ফর্মকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই সেটাকেই উপন্যাস বলে মেনে নিয়েছিলেন অনেকে। আর তার ফলেই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল বাংলার দেশজ গদ্যভাষা থেকে উঠে আসা নিজস্ব উপন্যাস ভঙ্গিমা। ঠিক যে ভাবে তৈরি হয়েছিল ইউরোপীয় উপন্যাসের ফর্মও। আসলে এইভাবেই বাংলা উপন্যাসের ভিতরে চেপে বসেছিল উপনিবেশবাদের আধিপত্য।
এই লেখাগুলোতেই, আফ্রো-আমেরিকান লেখক টনি মরিসন, লাতিন আমেরিকার আলেহো কার্পেন্তিয়ের, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হুয়ান রুলফোর নাম নিচ্ছেন দেবেশদা। বলছেন, ‘এককালের উপনিবেশবিস্তারী ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের উপন্যাসমালার বিপরীতে’ উপন্যাস তৈরি করেছেন এঁরা। একইভাবে অনুসারী হয়ে উঠতে চাইছেন বিভূতিভূষণ, সতীনাথ, কমলকুমার, জীবনানন্দ। আক্ষেপ করছেন, বিভূতি মানিক তারাশঙ্করের মতো ঔপন্যাসিক সত্ত্বেও ‘বাংলা উপন্যাস তার উনিশ শতকীয় জন্মলগ্নের আধুনিকতার বিভ্রম কাটিয়ে উঠতে পারেনি, পারে না, পারার কোনও উদ্যম দেখায় না।’
কাহিনির সেই ‘মায়ামৃগ আত্মপরিচয়কে’ বারবার লেখা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। বরং লিখতে চেয়েছেন এই পৃথিবীর প্রধান নদী-বদ্বীপ এই বাংলার মানুষের ক্রমাগত যুঝতে থাকার কাহিনি, সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র এই বাংলাতেই বয়ে চলা এক রহস্যময় মৌসুমী বায়ুর কথা। এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বকীয় বাঁচার কাহিনি।
আর ভূমিপুত্রের জীবনধারণের অবিরাম যুদ্ধকৌশলের কথা লিখতে লিখতে তিনি লিখে ফেলেছেন অন্ত্যজ শ্রেণির কথা। ব্যবহার করেছেন আমাদের ভাষার প্রতি ক্রোশে বদলে যাওয়া আলাদা উপভাষাগুলোকে। সাতের দশকের পর থেকে আস্তে আস্তে এই দেশের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে ‘পিছড়ে বর্গ’ আর হিন্দুত্বের রাজনীতি। হয়ত তার আসল প্রকরণ বুঝতেই ইতিহাসের ফুটনোট খুঁড়ে ম্যাগনাম ওপাসের প্রোটাগোনিস্ট করে তুলেছেন বরিশালের যোগেন মণ্ডলকে।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে ওঁকে ইন্টারভিউ করতে হবে। মেসেজ করলাম। উত্তর এল। ‘এসব করেন কেন? আপনি বরং গল্প লিখুন।’ চাপাচাপি করার পর রাজি হলেন শেষমেশ। শর্ত আছে অবশ্যই। আগে থেকে প্রশ্ন পাঠিয়ে ওঁর সম্মতি নিতে হবে। দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় তখন উত্তরবঙ্গ সংবাদের বিভাগীয় সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে কথা বলে তৈরি হল চুয়াল্লিশটা প্রশ্ন। মেল করলাম। কোনও উত্তর নেই। ইন্টারভিউয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা। আবার মেসেজ করলাম। এক কথার উত্তর, ‘আসুন’।
যাওয়ার পর লুচি-তরকারি মিষ্টি এল। কিন্তু ইন্টারভিউ দেবেন না। কারণ প্রশ্ন পছন্দ হয়নি। একজন লেখকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত প্রশ্ন কেন?
চুপ করে বসে আছি। দেবেশদা কথা শুরু করলেন। গল্পচ্ছলে। একটু পরেই বুঝতে পারলাম আমার সব প্রশ্নগুলোরই উত্তর দিচ্ছেন উনি। রেকর্ডার অন করলাম। টানা প্রায় তিন ঘণ্টা নাগাড়ে গল্প বলে গেলেন উনি। শুধু ছবি তোলা বাকি। বন্ধু ফটোগ্রাফার সব্যসাচীদা আড় চোখে দেখছে।
‘ছবি তুলব দেবেশদা?’
আবার সেই পুরনো দেবেশ রায়। বাইরে খরখরে। ভিতরে নরম। উত্তর এল, ‘আমি কিন্তু পাওডার মেখে আসিনি।’ ছবি তোলার প্রবল আতিশয্যে ওঁর শোয়ার ঘর, লেখার টেবিল, বারান্দা সব জায়গায় ঢুকে গেলাম নিঃসঙ্কোচে। কোনও আপত্তি নেই।
‘ছাদে যাবেন?’ নিজেই বললেন। শুধু যেতে যেতে আবার বললেন, ‘আপনাদের ওপর আমি খুব রেগে আছি।’
ছাদ জুড়ে সারি সারি টব। একটা লম্বা গাছের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ‘এই গাছটা আগে আমার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে ছিল। শুকিয়ে গিয়েছিল। এইখানে নিয়ে এসেছি তাই।’ বসে পড়লেন টবের ওপর। গাছটার তলায়। ‘একটা ছবি তুলুন তো।’
অল্প বয়সে ছবি তোলার নেশা ছিল খুব। ভেবেছিলেন নাকি ছবি তোলাকেই পেশা করবেন। নিজে ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন। ছবি বানানোরও ইচ্ছেও ছিল খুব।
একবার এই ছবি তোলার প্রসঙ্গ তুলেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এত ডিটেলড বর্ণনা আপনার লেখায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ফটোগ্রাফিক। সেটা কী এক সময় ছবি তোলার জন্য?’
বলেছিলেন, ‘ওটাকে কেউ কেউ আমার সমস্যাও ভাবে!’
‘এই উনি অফিস থেকে এসেছেন। ওঁকে একটু চাউমিন করে দাও।’
‘দ্য ওয়াল’-এর সঙ্গে আমি তখন যুক্ত। আনকোরা সংবাদমাধ্যম। নতুন প্রতিষ্ঠান। ঠিক হয়েছে ডিজিট্যাল পুজোবার্ষিকী করা হবে। মাঝে মাঝে ওখানে উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন দেবেশদা। আমিই ঝুলে পড়ে রাজি করিয়েছিলাম। রুল টানা কাগজে, টানা টানা হস্তাক্ষরে লেখা পাঠান। তবে কাগজ নয়। কাগজের ছবি তুলে হোয়াটস্যাপে। ডিজিট্যালি।
এবার গল্প চেয়েছি। দেবেন বলে রাজিও হয়েছেন। তার পরেই হঠাৎ বাড়ি আসার ডাক।
কিছুতেই আর লেখার প্রসঙ্গ তোলেন না। একথা সে কথার পর বোমাটা ফাটালেন। খুব নামী এক সংবাদপত্রে একটা লেখা দিয়েছিলেন উনি। সেই লেখাটা তুলে নিয়ে ছাপতে হবে।
একটা হাত-চিঠি লিখে দিলেন বিভাগীয় সম্পাদককে।
আমার মাথায় হাত। এমন আবার হয় নাকি? দেবেশদার গল্প পুজোবার্ষিকীতে আর ছাপানো হল না।
পরদিন সকালে আবার মেসেজ। ‘আপনি ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন?’
বুঝলাম, আমি ফ্যাসাদে পড়েছি। অগত্যা ফোন করলাম বিভাগীয় সম্পাদককে। ইনিয়ে বিনিয়ে পাড়লাম কথাটা। তিনিও বেশ অবাক! ‘তুমি ওঁকে বলো লেখাটা আমরা ছাপব।’
দেবেশদা নিজেও বোধহয় তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। প্রায় পাঁচদিন পর সেই সংবাদপত্রের অফিস থেকে লেখাটা নিয়ে এলাম আমি। না হাতে লেখা নয়। কম্পোজ করা।
ছাপা হল ‘আমরা নর্থবেঙ্গলরা’।
কিন্তু এটা কী গল্প? এই লেখার মধ্যে তো উত্তরসম্পাদকীয়, ফিচার সবই লুকিয়ে আছে!
দেবেশদাকে সে কথা জানানোর সাহস হয়নি। কিন্তু উনি নিজেই তুলেছিলেন কথাটা। ‘দেখুন, ওটা গল্প হিসেবেই ছাপুন।’
আসলে আখ্যানকে গল্প উপন্যাসের আলাদা ফর্মে আর বাঁধতে চাননি উনি। লিখেছিলেন, ‘আখ্যানকে একটি ছোটগল্প বা একটি উপন্যাসের ভিতরে সম্পূর্ণ আঁটাতে গেলে আখ্যানের সর্বাতিশয়তা খর্ব হয়। আখ্যানকে যদি সেই নিগড় থেকে মুক্ত করে দেওয়া যায় তা হলে তা কখনও ছোটগল্পে, কখনও বিবরণে, কখনও উপন্যাসে, কখনও কাহিনীতে ছড়িয়ে যেতে পারে।’
‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’ লেখার সময় থেকেই আখ্যানকে এইভাবেই নির্মাণ করেছেন উনি। কখনও এক একটা অধ্যায়কে আলাদা আলাদা উপন্যাস হিসাবে ছাপতে দিয়েছেন। কখনও তার ভিতর থেকে টুকরো করে বের করে নিয়ে এসেছেন ছোটগল্পকে। কখনও আবার ছোটগল্পকেই অথারিটেরিয়ন দক্ষতায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন বৃহৎ উপন্যাসের বুনোটে।
এই তো কয়েক বছর আগেই একই সঙ্গে দুটো শারদীয়া পত্রিকায় উনি দুটো ছোট গল্প লিখলেন। দুটো গল্পের শরীরেই একই আখ্যান গাঁথা আছে। অথচ প্রকরণ ভিন্ন। ভিউ পয়েন্টও ভিন্ন। একই কাহিনিকে আলাদা দুটো চোখ দিয়ে দেখলেন দেবেশদা। একটা গল্পে পুরুষ চরিত্রের মাধ্যমে। অন্যটায় মহিলা চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে।
আমার ওঁর ‘যুযুৎসু’ গল্পের কথা মনে পড়ছে। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু মণীন্দ্রনাথ চৌধুরী। জীবিকার জন্য তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে কলেজের বেয়ারার কাজ। অথচ বেয়ারা হলেও, যথাসম্ভব নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা করে সে। কিন্তু সমস্যা হল তার মেয়েই সেই কলেজের ছাত্রী হয়ে আসার পর। বাড়ির লোকের সামনে ক্ষয়ে যাওয়া আভিজাত্যের যেটুকু আড়াল ছিল এবার তাও গেল। মণীন্দ্রনাথ তাই এবার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বেয়ারার কাজের চেষ্টা করে। মাইনে বেশি। সরকারি চাকরিও। কিন্তু সমস্যা অন্য। সেখানে চাকরি পেলে বেয়ারার উর্দি পরতে হবে।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের চাকরিটা শেষ অবধি পায় না মণীন্দ্র। কারণ তাঁর বয়স আর সাইকেল চড়তে না জানা। ইন্টারভিউয়ের ফল জানতে পেরে বাবাকে প্রবোধ দিতে চায় মেয়ে। তার তো উর্দি পরায় আপত্তি ছিল! কিন্তু সে কথাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মণীন্দ্র। পালটা অভিযোগ করে, আসলে মেয়েরই আপত্তি ছিল বাবার উর্দি পরা নিয়ে। তাহলে তার বন্ধুবৃত্তে মান থাকবে না।
মানবচরিত্রের অদ্ভুত সব ডাইমেনশন তুলে নিয়ে আসেন লেখক। আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় বাবা ও মেয়ে দাঁড়ায় পরস্পরের বিপরীতে। মণীন্দ্র জানে তার মেয়ে আর তার মধ্যে শ্রেণিগত ফারাক তৈরি হচ্ছে। সামাজিক কাঠামোর উপান্তে দাঁড়িয়ে সে। আর মেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠছে।
১৯৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সময় লিখেছিলেন ‘রাষ্ট্রপতির শাসন’ গল্পটা। একদিন একটা গৃহস্থ বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কের মধ্যে পাওয়া যায় একটি পচা মৃতদেহ। এই মৃতদেহ খেঁকিমণির স্বামী রামগোপালের। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে খেঁকিমণি বা রামগোপাল বলে আসলে কেউ নেই। কারণ যে চরে তারা, তাদের মতই হাজারো মানুষ থাকে, রাষ্ট্রের চোখে সেই চরে বসবাসকারী কোনও মানুষের কোনও অস্তিত্বই নেই। আসলে রাষ্ট্রপতি শাসন গণতান্ত্রিকভাবে নিযুক্ত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ওপর থেকে বসানো এক শাসনতন্ত্র। সেখানে মানুষের ব্যক্তি ইচ্ছে-অনিচ্ছে, অস্তিত্বের কোনও গুরুত্বই থাকে না।
এমনই আরেক গল্প ‘উদ্বাস্তু’। গল্পটা বহু আলোচিত। উত্তরবঙ্গের এক সীমান্তবর্তী আধাশহরে মেয়েকে নিয়ে থাকে এক দম্পতি। হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে হাজির হয় তাদের কাছে। জানা যায়, আসলে এই দম্পতির দেওয়ার পরিচয়ে অনেক ফাঁকফোকর আছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বয়ান, পুলিশের লেখা ডায়রির ভাষায় পাঠককেও গুলিয়ে দেন লেখক। কী এই দম্পতির আসল পরিচয়? এরা কি পরিচয় গোপন করা পাকিস্তানি মুসলমান? গল্পের বয়ানে কোথাও এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয় না।
আজকের ভারতবর্ষে, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর হাজার জিগিরের সামনে এই গল্পটা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।
ঠিক যেমন এই লকডাউনের সময়েও ভীষণ প্রাসঙ্গিক ‘নিরস্ত্রীকরণ’ গল্পটা। এই গল্পের বুনোট ট্রেনের একটা কামরায়। আলাদা আলাদা চরিত্র দিয়ে সময়টাকে ধরে ফেলেন লেখক। দুই মধ্যাবয়স্কা মহিলার কথায় ফুটে ওঠে আটপৌরে অন্দরমহল। নতুন সন্তানের জন্ম দেওয়া তরুণ তরুণীর সন্তানকে ঘিরে ব্যস্ততা। বেকার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যুবকদের স্বপ্নভঙ্গ। এর মধ্যেই ট্রেন এসে দাঁড়ায় একটা স্টেশন। শোনা যায়, ওখান থেকে যাত্রী সেজে চোর ওঠে।
ভয় পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন যাত্রীরা। আর ঠিক তখনই কেউ বাইরে থেকে ধাক্কা দেয় দরজায়। যাত্রীরা খোলে না কেউই। কারণ তারা বদ্ধপরিকর ওটা চোরই। মাইনরিটি দু-একজন দোলাচলে ভোগেন। কিন্তু দরজা খুলতে চাইলে বাকিরা যদি তাদের চোরের অনুচর ভেবে বসে?
দরজা খোলে না কেউই। পরে কাউকেই আর দেখা যায় না দরজার বাইরে।
দুর্বল নিরাপত্তা না দেওয়া রাষ্ট্রে এইভাবেই বোধহয় সমগ্রের আত্মরক্ষার অধিকার সহনাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার খর্ব করে দেয়। সত্যিই তো। নইলে কোভিড-১৯ এর ভয়ে, আমাদের সবার আত্মরক্ষার, নিরাপত্তার তাগিদে আমরা কীভাবে আমাদের একদল সহনাগরিককেই পরিযায়ী শ্রমিক বলে দেগে দিই? ভুলে যাই তাঁদের জীবনধারণের অধিকারের কথা?
দেবেশদা আমার বাবাকে চিনতেন। বাবার ছোটবেলার শিক্ষক ছিলেন ওঁর স্কুলজীবনের সহপাঠী। জলপাইগুড়ি সূত্রে পরেও দেবেশদার পরিচয় বাবার সঙ্গে। বাড়ি থেকে পালিয়ে জলপাইগুড়ি পৌঁছে বাবা প্রথমে ওঁর সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল। অথচ ওঁর কাছে আমার বাবার পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন করে গিয়েছিলাম আমি। অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছেন, বাবার কথা। কী করেন, কী নাম। আর প্রতিবারই অস্পষ্ট গোলগোল উত্তর দিয়েছি আমি। আসলে বোধহয় লেখক ছাড়া ওঁর কাছে আমার অন্য কোনও পরিচয় থাকুক, আমি চাইনি।
আবার ‘সেতুবন্ধন’-এর জন্য অনেকবার আমার গল্প চেয়েছেন। লেখা চাইতে গেলেই মজা করতেন, ‘আপনার গল্প দিন, আমার লেখা দেব।’ কিন্তু কোনওদিন গল্প দেওয়ার সাহস হয়নি। বোধহয় খারাপ লিখলে, ওঁর কাছে আমার লেখার পরিচয় খাটো হবে ভেবেই।
“আপনি লেখেন না কেন বলুন তো?”
আমি চুপ। আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন দেবেশদা।
“গল্প লেখেন না কেন?”
গলাটা খাদে নিয়ে গিয়ে উত্তর দিই। “কাজের খুব ব্যস্ততা।”
শুনতে পান না। হিয়ারিং এডের উপর হাত দিয়ে মুখটা একটু ঝুঁকিয়ে আনেন।
আমি চিৎকার করি এইবার। ‘জীবিকা, জীবিকার প্রবল চাপ।’
চুপ করে যান আবার। কী যেন ভাবেন।
গলাটা নরম হয়। “আপনি যখন ব্যস্ত থাকবেন না, তখন আসবেন। রাত বারোটায় হলেও।”
দেবেশদার সঙ্গে আর আমার দেখা করা হয়নি।
হেডার ও সঙ্গের ছবি: সব্যসাচী ব্যানার্জি
অসামান্য। অনবদ্য স্মৃতিচারণা।
দেবেশ রায়’কে নিয়ে খুব ভালো একটি স্মৃতিচারণা পড়ার সৌভাগ্য হল
ভালো লাগলো।
ভালো লাগল। আমি দেবেশ বাবুর বাড়িতে গেছি অনেকবার। আমি যে সংস্থায় কাজ করি তাদের অনুষ্ঠানে বহুবার এসেছেন। আতিথেয়তা করতে হয়েছে। তাই আপনার স্মৃতিচারণ ছবির মতো ঠেকল।
Chomotkar ekta lekha. Khub bhalo laglo. Lekhokke dhonyobad.