স্টেশন মাস্টার
বিশ্বের হালহকিকত যে নিতান্ত ফাসকেলাস নহে তাহা বুঝিতে আমাদিগকে কী হারবার্ট কী হার্ডোয়ার্ক কোনও অস্থানে কুস্থানেই যাইতে হইতেছে না। শুনিয়াছি মহাবিদ্যালয়ে অর্থনীতির পাঠের সূচনালগ্নে বলা হইয়া থাকে— ইহা এমন এক বিজ্ঞান যাহা বুঝিতে গবেষণাগারে যাইবার প্রয়োজন পড়ে না। চারিদিক অবলোকন করিলেই তাহা দিব্য বুঝা যায়। বর্তমান দশাটি এমন যে অবলোকনকার্যটিও করিতে হইতেছে না। দুর্দশার চপেটাঘাত অল্পবিস্তর প্রত্যেক ব্যক্তিকেই অকাতরে তাহার স্নেহস্পর্শ দিতেছে।
সাম্প্রতিককালে ২০০৮-এর বিশ্বব্যাপী মন্দা আমরা দেখিয়াছি। দেখিতেছি, আজিও বহুসংখ্যক দেশ সেই মন্দার করাল ছায়া অতিক্রম করিতে পারে নাই। এ-ও দেখিতেছি, সেই মন্দা-পরবর্তী কালে বিশ্বে বিলিওনেয়ার (অর্থাৎ একশত কোটি টাকার মালিক)-এর সংখ্যা দ্বিগুণ হইয়াছে। অক্সফ্যাম নামক অজানি দেশের একটি না-জানি কী-এর একটি খতিয়ান বলিতেছে, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সনের মধ্যে এই সমস্ত মহামান্য ক্রোড়পতির ধনসম্পদ দৈনিক ২.৫ বিলিয়ান ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় দুই সহস্র কোটি) করিয়া বৃদ্ধি পাইয়াছে। শুনিতেছি সকলের অর্থনীতিই মন্দাক্রান্ত। না জানি আরও কত ধনীর দুলাল আমাদিগকে দর্শন দিবার কারণে রেডি হইতেছেন! মা লক্ষ্মীর কৃপা ভিন্ন ইহাকে কী কহিব?
ইহা তো দুর্ভোগ হইল না! সত্য, এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষা করাও কর্ম (যদিচ কর্মযোগ, হায়, অধীন শিখে নাই!)। তবু এ বাবুগণের পরম হিতৈষীগণও ইহাকে দুর্ভোগ বলিবেন বলিয়া মনে হয় না। দুর্ভোগ, তুমি কাহার?
অক্সফ্যাম-এর খতিয়ানটি আরও বলিতেছে, এই বিশ্বে মোট যত মনুষ্য বাস করিতেছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র তিনশত আশি কোটি মানুষের সম্পত্তি হ্রাস পাইয়াছে শতকরা একাদশ শতাংশ। দুনিয়ার অর্ধেক মনুষ্য দৈনিক চারিশত টাকার সামান্য অধিক অর্থেই জীবনধারণ করিয়া থাকেন। এই মনুষ্যজাতির মধ্যে পুরুষ মহিলাদিগের অপেক্ষা ত্রয়োবিংশ শতাংশ অধিক উপার্জন করিয়া থাকে।
আইসল্যান্ডের নবজাতকের তুলনায় সোমালিয়ার নবজাতকটির জন্মের পাঁচ বৎসরের ভিতর মরিয়া যাইবার সম্ভাবনা ষাটগুণ অধিক। সর্বাপেক্ষা দরিদ্র দেশ হইতে সর্বাপেক্ষা ধনী দেশের অধিবাসীর গড় আয় প্রায় দ্বিশতগুণ অধিক।
আতরাফ ও আশরাফের মধ্যকার এই ক্রমবর্ধমান সাগর ‘অজাগর গরজে’ কেবলই ফুলিয়া উঠিতেছে। নীতিপ্রণয়কদিগের বিশ্ব লইয়া আমোদজাত এই ব্যবধান নূতন নহে। সোবিয়েতের প্রয়াণ-পরবর্তী বিশ্বায়ন ও ভুবনগ্রামের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠা-উত্তর কালে এই ব্যবধানের যে বিপুল বিস্তার– তাহা নূতন। এই দুস্তর ব্যবধান আজি এতখানি দৃষ্টিকটু হইয়াছে, যে খোদ রাষ্ট্রসংঘ তাঁহার স্ববহ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ স্থির করিবার কালে সব প্রধান দেশের রাষ্ট্রনায়কদের দিয়া বলাইয়া লইয়াছেন— দারিদ্র্যই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দুরারোগ্য পীড়া, এবং ইহার একটি সহি বন্দোবস্ত না হলেই কিছুতেই কিছু হইবার নহে।
এই যে সমুদ্রের ন্যায় ব্যবধান রচিত হইল, এই নূতন করোনাবীজটি আসিয়া তাহার সব কুকর্মের মোহন আবরণ যেন পলকে খসাইয়া দিল। সৌন্দর্যশোভিত রুচিমণ্ডিত নকাবটি হঠিয়া যাইতেই দেখিলাম, সৃষ্টির আদি হইতে প্রকৃতপক্ষে আমরা শ্বাপদসঙ্কুল একটি অরণ্যে বসবাস করিতেছি। এই দীর্ঘ মানবসভ্যতার যাত্রাপথে যে স্থানে পঁহুছিলাম তাহাতে দৃশ্যের কিছু তারতম্য হইল সত্য, অদৃষ্ট বদলাইল না। দেবী কমলাসনার কিছু বরপুত্র ছাড়া (এবং এইসব মহামান্যের আরও কিছু দত্তকসন্তান ব্যতিরেকে) প্রায় সকলেই মরিতে বসিয়াছি। একদলের কিছুই নাই, আর এক দলের আজি কিছু রহিয়াছে বটে, তবে কল্য থাকিবে তাহার কোনও নিশ্চয়তা নাই।
আমাদিগের এমন দুর্দশা, যে গুরুদেবের বাণী স্মরণ করিয়া দুঃখ ও মৃত্যুর পারে শান্তি ও জাগ্রত অনন্তকে খুঁজিব তাহারও সময় বা উপায় নাই!
আমাদিগের কেবল আছে এক করুণ চাওয়া। সন্তানের অন্ন ও দুগ্ধ যেন সুনিশ্চিত হয়।
সকলের অন্ন ও দুগ্ধ সুনিশ্চিত করিতে হইলে, আর আছে মনীষীর দেখানো পথ। পৃথিবীর ক্রমমুক্তির পথ। এই পথ অনুসরণ করিয়া একশত বৎসর পূর্বে যে মহান মানুষটি দুনিয়ার বক্ষে প্রথম শোষিতদের দ্বারা শাসিত একটি দেশের প্রবর্তন করিয়াছিলেন, সেই রুশদেশের কমরেড লেনিনের সার্ধশতবর্ষে আমরা সীমিত উপাচারে তাঁহাকে স্মরণ করিতেছি। এই বিশ্বজোড়া অতিমারির অনিশ্চয়তার বৃত্তের ভিতর দাঁড়াইয়া আমরা স্মরণ করিতেছি সেই মহামতি লেনিনকে, যাঁহার উদ্যোগে বিশ্বে প্রথমবার জনস্বাস্থ্য নামক ব্যবস্থাটির পত্তন হয়, যে ব্যবস্থার খরচ জোগাইবার দায়িত্ব ছিল দেশেরই। জুন সংখ্যার রিজার্ভড বগি— লেনিন ১৫০-তে লিখিলেন নীলোৎপল বসু, অশোক মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সৌভিক ঘোষাল, অহনা গাঙ্গুলি এবং উর্বা চৌধুরী। তৎসহ অনুবাদ করিয়া পুনর্মুদ্রণ করা হইল লেনিন-স্মরণে ফিদেল কাস্ত্রোর একটি রচনা এবং তারিক আলির একটি সাক্ষাৎকার।
এই মাসের স্মরণ বিভাগটির প্রসঙ্গে বলিব। গত মে মাসে আমরা হারাইয়াছি অধ্যাপক হরি বাসুদেবন, সাহিত্যিক দেবেশ রায়, বঙ্গবিদ্যাচর্চার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আনিসুজ্জামান, কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ও কবি শম্ভু রক্ষিতকে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইঁহাদের কথা স্মরণ করিলেন অধিকারীজন।
অধ্যাপক বাসুদেবনের শেষতম রচনাটি অনুবাদপূর্বক ‘বিশেষ নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার’ বিভাগে প্রকাশিত হইল। তৎসহ রহিল প্রবীর মুখোপাধ্যায় অনূদিত নোম চমস্কির একটি সাক্ষাৎকার। ইহা ব্যতীত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে রহিল জয়ন্ত বসুর একটি নিবন্ধ।
বলাই বাহুল্য, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, ফোটোফিচার, অনুবাদ সাহিত্য, অণুগল্প, ধারাবাহিক ইত্যাদি অন্যান্য বিভাগগুলি যথানিয়মে প্রকাশিত হইল। রহিল মেল ট্রেনের তিনটি বিশেষ কামরা—স্টিম ইঞ্জিন, ডিসট্যান্ট সিগনাল এবং ভালো খবর। সঙ্গে রহিল বইপত্রের সংবাদবাহী হুইলার্স স্টল।
সাথী লেনিনকে রক্তিম অভিবাদন!
করোনা- পরবর্তী বিশ্বে আমার ধারণা, এ ব্যবধান দুস্তরতর হইবে, কেন না, পুঁজিকে এখন স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ও পরিষেবার নিরিখেও দেখিতে হইবে।