এডওয়ার্ড কলস্টন, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার— ইতিহাসকে পালটানোর সময়

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


লেখক প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

 

১১ই অক্টোবর, ১৭২১— ইংল্যান্ডের মর্টলেকে মারা যান এডওয়ার্ড কলস্টন। উইকিপিডিয়াতে দেখলে দেখা যাবে, তাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে “তিনি ছিলেন একজন ইংরেজ বণিক, দাস-ব্যবসায়ী, টোরি পার্টির হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যপদ পেয়েছিলেন এবং একজন মানবপ্রেমিক।” একজন দাসব্যবসায়ী কীভাবে মানবপ্রেমিক হতে পারেন, আমার জানা নেই। আধুনিক ইংল্যান্ডে তাঁর মৃত্যুর প্রায় ১৭৫ বছর পর, ১৮৯৫ সালে ব্রিস্টল শহরে, যা কিনা কলস্টনের জন্মস্থান, সেখানে তাঁর একটি ব্রোঞ্জমূর্তি প্রতিস্থাপিত হয়। উইকিপিডিয়া আরও বলছে, প্রথমে মদ, ফল এবং কাপড়ের ব্যবসায় হাত পাকালেও, ১৬৮০ সাল থেকে তিনি ক্রমশ রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন। প্রসঙ্গত তদানীন্তন ইংল্যান্ডে আফ্রিকান ক্রীতদাস কেনাবেচায় এই রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কলস্টনের জন্মস্থান ব্রিস্টলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সৌধের সঙ্গে এতদিন তাঁর নাম জড়িয়েছিল। তবে সেগুলির মেয়াদ যে আর কতদিন, সত্যিই সঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। জনৈক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ভদ্রলোক, ট্যুইটারে সম্প্রতি লিখেছেন যে— জর্জ ফ্লয়েডকে ঠিক যে কারণে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছিল, এবং যে নিগ্রহ শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়— সেই একই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে ভদ্রলোক নিজেও একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। ভদ্রলোকের কথায়, “তার পর আমার সঙ্গে যা হয়েছিল, সেসব এখন আমার কাছে ডিনার-পার্টিতে গল্প করে বলবার মতো বিষয়।”

…“দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান”— একনায়কদের শেষটা কখনও সুন্দর হয় না। আবার হয়তো বা হয়ও। ইতিহাসে বড় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে দাঁড়ায় একেকটা সময়। তখন কেবল অপেক্ষাটুকু ছাড়া আর সবকিছুই অবান্তর…

আজ, তাঁর মৃত্যুর ৩০০ বছর পর— ৭ই জুন, ২০২০তে ব্রিস্টল শহরে এডওয়ার্ড কলস্টনের ব্রোঞ্জমূর্তিটিকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে মূর্তিটিকে ব্রিস্টল শহরের উপকণ্ঠে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে। ইতিহাসের কি অদ্ভুত খেয়াল। এমনটা বলার কারণ, এডওয়ার্ড কলস্টনের দাসব্যবসার জাহাজগুলিতে যে সমস্ত দাসেদের মৃত্যু হত— অনাহারে, অপুষ্টিতে, যন্ত্রণায়— তাদের দেহগুলিকেও সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত, হাঙরদের খাদ্য হিসেবে। আজ ৩০০ বছর পেরিয়ে, এডওয়ার্ডেরও শেষ আশ্রয় জুটল সমুদ্রগর্ভে, যে ব্রিস্টল বন্দর থেকে একদিন তাঁর বাণিজ্য-জাহাজগুলি রওনা হত আমেরিকার উদ্দেশ্যে। পথে ঘুরে যেত আফ্রিকায়। তিনধাপে সম্পন্ন হত এমন একেকটি বাণিজ্য-অভিযান।

ইওরোপ থেকে জাহাজ নিয়ে এডওয়ার্ড কলস্টনের মতো শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীরা হাজির হতেন আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দরে। গায়ের জোরে জাহাজে তুলে নিতেন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের। জাহাজের খোলে, ধরা যাক যেখানে খুব ঠাসাঠাসি করে ৩০০ জন মানুষ থাকতে পারে, সেই অন্ধকূপে ঠেলে দিতেন ৬০০ জনেরও বেশি হতভাগ্যকে। যাতে তারা কোনওভাবেই পালাতে না পারে, লোহার শিকল দিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখা হত। ৩০০ বা ৬০০ জনের গল্পটা, আন্দাজে বানিয়ে বলছি না। ১৭৮৮ সালে ডলবেন আইন অনুসারে প্রথম জাহাজের মাপ বিচার করে তাতে কতজন দাস নিয়ে যাওয়া যাবে এই বিষয়ে একটি সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার রীতি চালু হয়। তার আগে অবধি দেখা যাচ্ছে যে ব্রুকস বলে একটি জাহাজে, যার অনুমোদিত দাসসংখ্যা ছিলো ২৯৫— তারা ৬০৯ জন ক্রীতদাসকে সেই অন্ধকূপে ঠেসে পাচার করেছিল।

ইওরোপ থেকে আফ্রিকায় এসে দাস সংগ্রহ করবার পরে, এই জাহাজগুলি পাড়ি দিত আমেরিকায়। সমুদ্রের আবহাওয়ার উপরে নির্ভর করে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় পাড়ি দিতে সময় লাগত ৬-৮ সপ্তাহ, কখনও কখনও তা বেড়ে দাঁড়াত ১২ থেকে ১৩ সপ্তাহেও। খোলের অন্ধকূপে বন্দি ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীদের কপালে জুটত অকথ্য নির্যাতন। রোগের প্রকোপে, অত্যাচারে এমনকি আত্মহত্যা করেও, বন্দি দাসেদের অন্তত ১০ থেকে ২০ শতাংশই মৃত্যুবরণ করত। সংখ্যার হিসেবে দেখা যাচ্ছে, কেবল ব্রিস্টল থেকে পাড়ি দেওয়া জাহাজগুলিকে যদি ধরা হয়— অন্ততপক্ষে দশ থেকে কুড়ি লক্ষ কালো মানুষ স্রেফ সেই জাহাজগুলির খোলেই দমবন্ধ হয়ে, অত্যাচারিত হয়ে সেইসময়ে মারা গেছেন, এই দাসব্যবসার কারণে। একা এডওয়ার্ড কলস্টনের জাহাজেই অন্তত ৮৪০০০ জন আফ্রিকান ক্রীতদাসকে পাচার করা হয়েছিল, যার মধ্যে অন্তত ১৯০০০ জনের জাহাজের খোলেই মৃত্যু হয়। লজ্জার মাথা খেয়ে তাঁর মূর্তিই এতদিন শোভা পেয়ে আসছিল আধুনিক ব্রিস্টল শহরে। জর্জ ফ্লয়েডের কাছে ব্রিস্টলবাসীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

আমেরিকা থেকে যখন জাহাজগুলি আবার ইওরোপে ফিরে আসত, তাতেও দু চারটি পড়ে থাকা অবিক্রীত কালো ক্রীতদাসকে ব্যবসায়ীরা ফিরিয়ে আনতেন ইংল্যান্ডে দ্রষ্টব্য হিসেবে। ব্রিস্টল শহরে, এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তিটি যেখানে বসানো হয়েছিল, তার কিছু দূরেই একটি ছোট ফুট-ওভারব্রিজ রয়েছে। যার নাম পেরো’জ ব্রিজ। এই পেরো জোন্স এমনই একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস, যাঁকে ইওরোপে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ১৭৯৯তে, ৪৫ বছর বয়সে ক্রীতদাস হিসেবেই তিনি ব্রিস্টলে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০ বছর পর, ১৯৯৯ সালে ব্রিস্টলের সেই ফুট-ওভারব্রিজটিকে এই পেরো জোন্সের নামেই নামকরণ করা হয়।

শহরবাসীদের আন্দোলনের ফলেই ২০১৭তে ব্রিস্টলের কলস্টন মিউজিক হলের নাম পালটাতে প্রশাসন বাধ্য হয়। আর আজ, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরবর্তীতে কলস্টনের কলঙ্কের মূর্তিটিকেও শহর থেকে বিদায় করা গেল। আমেরিকার একাধিক শহরেও কনফেডারেট নেতাদের মূর্তি, কনফেডারেট সৌধগুলিকে ভেঙে ফেলার দাবি উঠতে শুরু করেছে। একাধিক সৌধ, মূর্তিকে ইতিমধ্যেই ভেঙে ফেলা হয়েছে— অথবা তাদের বিকৃত করা হয়েছে। ১৮৬১তে আমেরিকান সিভিল ওয়ার শুরু সময়ে আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রেসিডেন্সিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই কনফেডারেটদের নেতা আলেকজান্ডার স্টিফেন্স বলেছিলেন, “এটা সবচেয়ে সত্যি যে নিগ্রোরা কখনই শ্বেতাঙ্গদের সমান হতে পারে না। শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের পায়ের তলায় দাস হিসেবে থাকাটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ও সাধারণ।”

এটা ভাবতেই আজ আশ্চর্য লাগে যে, ১৬৮০, ১৭৮৮, ১৮৬১, ১৮৯৫— এতকিছুর পরেও, আজ ২০২০তে আধুনিক সভ্য পৃথিবীতেও এমন একেকজনের মূর্তি, ‘মানবপ্রেমিক’ হিসেবে আধুনিক শহরগুলিতে শোভা পাচ্ছে। কেউ কেউ এমনটাও বলছেন যে, মূর্তি ভাঙাটা ঠিক হচ্ছে না— ইতিহাসকে ইতিহাসের মতোই থাকতে দেওয়া উচিত। তাঁদেরকে বলি, হেনরি দুঁদার কথা জানতে চান? প্রথম মেলভিল ভাইকাউন্ট এই হেনরি দুঁদা, জন্ম ১৭৪২, মৃত্যু ১৮১১— আজীবন দাসব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় দাসেদের সপক্ষে অথবা দাসেদের অবস্থার উন্নতিকল্পে যে কটি আইন আনবার চেষ্টা করা হয়েছিল, তিনি প্রতিটির সরবে বিরোধিতা করেন। আজ কলস্টনের মূর্তি ভাঙার জমায়েত থেকেই দাবি উঠেছে এডিনবার্গ শহরের সেন্ট এ্যান্ড্রুজ স্কোয়ারে সংরক্ষিত ১৫০ ফুট উঁচু ভাইকাউন্ট মেলভিল হেনরি দুঁদার মূর্তিটিকেও অবিলম্বে সরিয়ে ফেলতে হবে। ইতিহাসের ওপরে আঘাত?

তাহলে জেনে রাখুন, এতদিনের ইতিহাসে এই হেনরি দুঁদাই ব্রিটেনের শেষ রাজনীতিক যিনি কিনা পদে থাকাকালীন ১৮০৬ সালে পদ থেকে ইমপিচড বা বহিষ্কৃত হন। দাসব্যবসা নয়, তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল— এবং ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা আর্থিক দুর্নীতির মতো মারাত্মক অভিযোগে ইমপিচড হওয়া সত্ত্বেও, যাঁর মূর্তি আজ ১৫০ ফুট উচ্চতায় এডিনবার্গের মতো একটি আধুনিক শহরের কেন্দ্রস্থলে শোভা পাচ্ছে। এরপরেও ইতিহাসের দোহাই? নাকি ইতিহাসের কলঙ্ক? এই ইতিহাসকে কি আজ সত্যি-সত্যিই একেবারে মুছে দেওয়া উচিত নয়? অন্তত মানবতার সম্মানে।

গত কয়েক সপ্তাহে পৃথিবীর ইতিহাস পালটাতে শুরু করেছে। বর্ণবিদ্বেষের যে কতখানি প্রকট রূপ আজও, এখনও আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা স্তরে প্রত্যেকটা ইঙ্গিতে থেকে যেতে পেরেছে— থেকে যাচ্ছে, আমরা ধারণাও করতে পারি না। আশার কথা এটাই যে, মানুষ পথে নেমেছে। করোনার মহামারিকে মাথায় রেখে এটা নিশ্চয়ই বলা উচিত যে— এমন কোনও কার্যকলাপকে সমর্থন করা যায় না, যা নিজের অথবা অপরের স্বাস্থ্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার এটাও সত্যি যে, আজ এই বিপুল জনতা যদি পথে এসে না দাঁড়াত— এডওয়ার্ড কলস্টন অথবা হেনরি দুঁদার মতো মানুষদের কলঙ্ক এতদিনেও বোধহয় আমাদের অনেকের কাছেই অজানা থেকে যেত। তাঁরা ‘মানবপ্রেমিক’ হিসেবেই শোভা পেতেন। অথবা আমরা হয়তো আরওই জানতে পারতাম না যে— আমাদের ভিতরেও একেকজন, খাস আমেরিকার সভ্য মানুষদের ভিতরেও একেকজন— এই ২০২০তে, একবিংশ শতাব্দীতে তাঁদের একেকজনের অন্তরে— কতখানি যত্নের সঙ্গে, কতখানি ঘৃণার সঙ্গে বর্ণবিদ্বেষের পাপ-ধারণাকে লালন করে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ইতিহাসকে তাই নতুন করে লেখবার সময় এসেছে।

এতদিনকার যে পাপ, সেই পাপস্খালনের জন্যও সময় প্রয়োজন। কিন্তু, আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে— আর কোনওদিন যেন কারওকে— সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে— ‘আই কান্ট ব্রিথ’ বলতে বলতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে না হয়। প্রসঙ্গত, হয়তো অনেকেই জানেন— যে কেবল জর্জ ফ্লয়েডই নন, ২০১৪ সালের জুলাইতে ঠিক একইরকমভাবে নিউইয়র্ক পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুর আগের মুহূর্তে কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গার্নারেরও শেষ উক্তিটি ছিল— “আই কান্ট ব্রিথ।” এই পৃথিবীতে আজ মানুষের শ্বাস নেবারও অধিকার নেই। তাই কেবল বোধহয় গণপিটুনি আর অনার কিলিংয়ের একেকটা ঘটনাতেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে বেঁচে থাকছে আমাদের মতো একেকটি দেশের ‘অচ্ছে দিনের ভবিষ্যৎ’।

আমিও গান গাই, আমেরিকা— আমিও,

আমি তোমাদের কৃষ্ণাঙ্গ ভাই,
আমাকে তোমরা রান্নাঘরে পাঠিয়ে দাও,
বাড়িতে লোক আসে যখন,
কিন্তু তবুও আমি হাসি,
পেটপুরে খাই,
আরও শক্তিশালী হয়ে বেড়ে উঠি,

কাল যখন, অতিথিরা আসবেন আবার,
আমি কিন্তু রান্নাঘরে থাকব না,
রোজকার টেবিলে সবাইকার সাথেই,
খেতে দিতে হবে, আমাকেও,

আর সবাই তখন দেখবে,
আমিও সুন্দর, লজ্জিত হবে সবাই,

আমিও তো গান গাই, আমেরিকা— আমিও..

[‘আই টু সিং আমেরিকা’, ল্যাংস্টন হিউজ (১৯০২-১৯৬৭); তর্জমা বর্তমান লেখকের]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...