অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার
স্মার্টফোন না পেয়ে আত্মহননের খবর আমাদের জানা। গ্যাজেট না পাওয়ার ক্ষোভে প্রিয়জনদের খুন করার ঘটনাও অজানা নয়। এই ধরনের খবরে আমাদের চোখ ব্যবহৃত হতে শিখে গিয়েছে সেই কবেই। দেবিকাও মরেছে স্মার্টফোনের জন্য। তবে ফোনকে ঘিরে গেম খেলা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া জড়ানো জীবন যাপনের জন্য নয়। চোদ্দ বছরের জীবনটা শেষ হল পড়াশোনা করার সুযোগ না পেয়ে। দেবিকা বুঝে গিয়েছিল, স্ক্রিনে বেঁচে না থাকতে পারলে শেখার ইচ্ছেটাও দিকশূন্যপুরে ভাসিয়ে দিতে হয়।
কেরলের মল্লপুরম জেলার দেবিকা বালাকৃষ্ণন। ক্লাস নাইন। সে রাজ্যের পরিকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তর তিরিশে জুন থেকে চালু করেছিল এক বিশেষ প্রকল্প— ফার্স্ট বেল। লকডাউনের জেরে স্কুলে নিয়মিত পঠনপাঠন বন্ধ। তাই প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাজ্যের তরফ থেকে উপহার দেওয়া হয়েছিল প্রতিদিন আধঘণ্টা করে অনলাইন ক্লাস। সেই ক্লাসের সম্প্রচার হচ্ছিল মোবাইল ও টেলিভিশনে। পয়লা জুন, বাড়ি থেকে দুশো মিটার দূরে যেখানে দেবিকার ঝলসানো দেহটা পাওয়া যায়, তার পাশেই, কেরোসিনের বোতলের সঙ্গে মিলেছিল একটা চিরকুট। তাতে লেখা ছিল, আমি চলে যাচ্ছি। দেবিকার হতভাগ্য বাবা, অসুস্থ, কর্মহীন বাবা, মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলেন টাকা না থাকার কথা। বলছিলেন, বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মেয়েকে স্মার্টফোন কিনে না দিতে পারার অপারগতার কথা। বাড়ির টিভিটাও তো অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে কত দিন। সারাতে টাকা লাগে। সেটাও তাঁর ছিল না। টিভিটাও যদি তাঁর মতো কর্মহীন হয়ে না থাকত, তরতাজা মেয়েটাকে হয়তো ওই চিরকুট লিখতে হত না কোনও দিন।
ব্ল্যাকবোর্ড আর চক ডাস্টারের চিরাচরিত জায়গায় ধারালো আঁচড় মেরে তা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে স্ক্রিন দুনিয়া। মোবাইল-কম্পিউটার-টেলিভিশন। ষোল আনার মধ্যে বারো আনাই অবশ্য প্রথম দুটো গ্যাজেটের। লকডাউনের নেই-রাজ্যে খবরের কাগজের পাতাগুলোও যখন ক্রমশ বিজ্ঞাপনশূন্য হয়ে যাচ্ছিল প্রথম দিকে, তখন ঝোড়ো হাওয়ার মতো এসেছিল অনলাইন কোচিং সেন্টারের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন। হাতে ট্যাবলেট এবং ওই ট্যাবলেটে কোচিং সেন্টারের অ্যাপ ভরে কোনও সম্ভ্রান্ত কিশোর কিংবা কিশোরীর নিশ্চিন্ত মুখের ছবি আমরা দেখেছি প্রথম পাতায়, সকালবেলায়। দিনের পর দিন। ওই কিশোর কিশোরীরা তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে ভি দেখায়। একটি বিখ্যাত অনলাইন টিউটোরিয়ালের সিইও তো গর্বের সঙ্গে জানিয়েই দিয়েছিলেন যে ব্যবসার খাতা খোলার পর সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি তিনি দেখেছেন এই লকডাউন জমানায়। এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এমন প্রত্যেক কর্তার মুখেই দৈব হাসি ফুটেছে। পৌষমাসের হাসি। রেভিনিউয়ের সংজ্ঞায় নিত্যনতুন রং লাগিয়েছে এই বদ্ধ, বন্ধ সময়। এই স্থবির বাজারে কয়েকটি সংস্থা আবার বিদেশ থেকে মোটা অঙ্কের ফান্ডিং পেয়েছে। কর্তারা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, করোনাভীতি যত বাড়বে, অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলমুখো করতে যত ভয় পাবেন, তাঁরা ঠিক ততটাই ফুলে ফেঁপে উঠবেন।
শিক্ষা থেমে থাকলে তো একটা গোটা প্রজন্মই পিছিয়ে পড়ে। বেসরকারি ক্ষেত্রের পাশাপাশি অনলাইনে শিক্ষাদানে সরকারি উদ্যোগও এখন চোখে পড়ার মতো। ক্লাস নেওয়া হচ্ছে মূলত মোবাইল পর্দায়। আছে টেলিভিশন চ্যানেলও। সরকার হয়তো ক্লাস নেয় দায়বদ্ধতা থেকে। এই সুযোগে বেশ কিছু বেসরকারি চ্যানেলও পর্দায় ক্লাস নেওয়া সম্প্রচার করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা বুঝেছে, এমন অনুষ্ঠান করা হলে অমুক সহায়িকা ও তমুক সাজেশনের বিজ্ঞাপনও মেলে পর্যাপ্ত। কবীর সুমনের গানে ছিল, ‘টাকাটাই শেষ কথা, বাকি সব বাতুলতা, টাকা কথা রাখে।’ বিজ্ঞাপন যোগাড় না হলে যে চাকরিটিও থাকবে না।
২০১৭-১৮ সালে করা একটি জাতীয় সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, শহরে বসবাসকারী ২৩.৪ শতাংশ পরিবারের কাছে একটি নিজস্ব কম্পিউটার আছে। এই কম্পিউটারগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ আছে মাত্র ৪২ শতাংশের। আর গ্রামে এই হার যথাক্রমে ৪.৪ এবং ১৪.৯ শতাংশ। ইউনেসকোর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, স্কুলজীবনের পরিধির মধ্যে আছে ভারতবর্ষের প্রায় ৩২ কোটি ছাত্রছাত্রী। এবারে উপরের শতাংশ দিয়ে এই ৩২ কোটিকে গুণ করলে সংখ্যাটা যে আসলে কত সীমিত তা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। ডিজিটাল ডিভাইড বলে যে শব্দবন্ধটা নিয়ে চর্চা হয় আজকাল, এই পরিপ্রেক্ষিতে এর চেয়ে বেশি জ্বলন্ত কেস স্টাডি সম্ভবত আর পাওয়া যাবে না। আবার ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল (বার্ক) বলছে, দেশে টিভি আছে ৬৬ শতাংশ পরিবারের। অর্থাৎ ১০০টি বাড়ির মধ্যে ৩৪টি বাড়িতে টিভি নেই আজও। দেশে পঞ্চাশ কোটি মানুষের কাছে ম্মার্টফোন থাকলেও স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এর পরিমাণ মাত্র ২২ শতাংশ। আর স্মার্টফোন ব্যবহার করেন যাঁরা, তাঁদের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ট্যাবলেট ব্যবহারে সড়গড়। অনলাইন শিক্ষা প্রসারের মূল তিনটি মাধ্যমের ব্যবহারের গতিপথটা যত বেশি করে বোঝার চেষ্টা করা যায়, অস্বস্তির ফাটলটাও গাঢ় হতে থাকে আরও। ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের উপকারিতা আসলে ঠিক কতটা, তা নিয়ে শিক্ষাবিদরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছেন ইতিমধ্যেই। এক দল সাধ্যের মধ্যে সাধপূরণের কথা বলছেন। অন্য দলের দাবি, ভারতের মতো দেশে সাধ্য কথাটাই যখন এতটা আপেক্ষিক, তখন সাধপূরণ তো দূর অস্ত্। পোলিও রবিবারে দু ফোঁটা ড্রপ মুখে দেওয়ানো থেকে একটি শিশুও বাদ পড়ে গেলে যেমন পুরো প্রকল্পটাই ফিকে হয়ে যায়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম খাটে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বাহারি পরিকল্পনা করার থেকেও যেটা বেশি জরুরি, তা হল ওই মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ও নেওয়ার পরিকাঠামোটা আমাদের দেশে কতটা মজবুত তা পরখ করা। স্কুলপড়ুয়াদের ৭৮ শতাংশের কাছেই যদি মোবাইল ফোন না থাকে, তা হলে এই পদ্ধতিতে শিক্ষাদান আখেরে কত জন ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছয়? তার্কিকরা বলতে পারেন, কেন, বাড়িতে মা-বাবার মোবাইল আছে তো। সেগুলো ব্যবহার করলেই তো হয়। লকডাউনকালে যে মা-বাবারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করেছেন, তাঁদের ফোন পড়াশোনার কাজে বাচ্চারা ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে কতটা? যদি পেয়েও থাকে, এ-বারে? আনলক ওয়ানে তো বাবা-মায়েরা কাজে যোগ দিয়েছেন। সিনিয়র ম্যানেজার বাবার পাশাপাশি দিনমজুর বাবাও তো আছেন এ দেশে। বরং দ্বিতীয় পক্ষের সংখ্যাই বেশি। তাঁদের ছেলেমেয়েরা কী করবে এ-বারে? শহরাঞ্চলে ইন্টারনেটের স্পিড নিয়ে আমরা যারা গর্ব করি, তারা কোনওদিনই বোঝার চেষ্টা করি না গ্রামে সেই স্পিড কত। ভাবি না, নিজের ফোরজি ফোন থাকলেও আমার পাশেরজনের তা নাও থাকতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির কারবারিরা স্পষ্ট বলেন, ফোরজি কানেক্টিভিটি না থাকলে অনলাইন ক্লাসরুম মোবাইলের পর্দায় প্রথম যুগের চলচ্চিত্রের ক্ষয়ে যাওয়া প্রিন্টের মতো ঝাপসা দেখাবে। ইন্টারনেটের স্পিডে যদি জোয়ারভাটা খেলে, একইরকম অভিজ্ঞতা হবে ছবির রেজলিউশনেও। ছবি স্পষ্ট না হলে অনলাইন ক্লাসরুমে দেখানো গ্রাফিক্স ও অ্যানিমেশন হায়ারোগ্রিফিক লিপির মতো দুর্বোধ্য ঠেকবে ছাত্রদের কাছে। শিক্ষকের গলার আওয়াজ আসবে রোবোটিক ভয়েসের মতো, কেটে কেটে। এই নড়বড়ে পরিকাঠামো মেরামত করার জন্য আমরা এগিয়েছি কত দূর? মনের কুঠুরিতে এগোনোর সদিচ্ছাই বা রেখেছি কতটুকু? উত্তর মেলে না।
দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত বহুতল। বাইশ তলার ছাদের উপরে সুইমিং পুলের ধারে লাগানো চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেই চোখে পড়ে চারপাশের বস্তি। ‘আমাদের এই কমপ্লেক্সটা আসলে পার্থেনিয়ামের জঙ্গলে পদ্মফুলের মতো জানিস’, বলছিলেন এক আত্মীয়া। ফোন ছাড়ার আগে তাঁর মনে হল, আসল ‘রগড়’টাই তো বলা হয়নি আমাকে। জানলাম, ওনার মেয়ের দশটা থেকে পাঁচটা রেগুলার স্কুল চলছে অ্যাপল ম্যাকবুকে। ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনার খুব চাপ। বাড়িতে যে ঠিকে ঝি আছে, তার মেয়েরও ক্লাস সিক্স। ‘ঝি-টা আমায় বলল, দিদি, পুজোর বোনাস চাইব না, একটা তিরিশ জিবি-র ডেটা প্যাক ভরিয়ে দেবে গো আমার ফোনে? আদর্শ ইস্কুলের অঙ্ক দিদিমণি বলেছে মোবাইলে পড়াবে। মেয়েটা খুব মুষড়ে পড়েছে গো।’ এটা বলেই আত্মীয়া প্রবল হাসতে শুরু করলেন, হিড়িম্বার মতো।
মল্লপুরমের দেবিকা আরও অনেক কিছু লিখতে পারত ওই একলা চিরকুটে। লেখেনি।
এই বিষয়ে লেখার কথা ভাবছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। কিন্তু আপনার লেখাটা পড়ে মনে হল তার আর দরকার নেই। আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালো করে আমার কথাগুলো বলে দিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
প্রতিদিন অনলাইন ক্লাস নিতে তাই, আর মনে পড়ে সেই মেয়েগুলোর কথা যারা এখন স্কুলের ছাত্রী হয়েও পড়াশোনার অধিকারী নয়। ক্লাসের দরজা বন্ধ তাদের জন্য। পড়াতে পড়াতেই এই ব্যবস্থার অসারত্ব অনুভব করি প্রতিদিন। আপনার লেখাটিতে আমার সব কষ্ট সব ক্ষোভ খুঁজে পেলাম। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আপনি এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা যে কেমন করে দুটো শ্রেণী তৈরি করেছে সেটা তুলে ধরেছেন। আরো লিখুন।
অতি দরকারি লেখা। একবারে পড়িয়ে নেবার মত ভাষা।
ভালো লেখা কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও আসা উচিৎ ছিল