শতাব্দী দাশ
লেখক প্রাবন্ধিক, গদ্যকার। পেশায় শিক্ষক
কয়েক বছর আগে এক পরিচিত, আত্মীয়সম রাজদ্রোহীর শুনানিতে যখন রোজ যেতাম কোর্টে, তখন আমার চার বছরের মেয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিল ভাল-মন্দ বাইনারি বিষয়ে। যথা—
একজন ভাল মানুষ। সে মানুষের ভাল করতে গেল। তাকে পুলিশে ধরল কেন?
পুলিশ কি তবে মন্দদের ধরে না, ভালদের ধরে?
পুলিশ কি তবে নিজেই খারাপ?
যে পুলিশকে ভালমানুষ ধরে আনতে বলে, সে কে?
আচ্ছা, তাহলে ভাল কাজ করলেও ফল খারাপ হতে পারে?
খারাপ কাজ করলেও হতে পারে ভাল ফল?
তবে যে এতদিন জানতাম, যে ভাল, তার ভালই হয়! তাহলে কি ভাল আসলে খারাপ? খারাপ ভাল?
কার চোখে ‘খারাপ’? কার কাছে ‘ভাল’?
ছোট মগজের জন্য খুব সহজবোধ্য হত না এর উত্তরমালা। আবার এইসব ভীষণ কঠিন প্রশ্নই মানুষকে পরিণত করে।
জীবনের প্রথম বছরগুলিতে শিশুর কাছে তাই ‘ভাল’, যা তাকে পুরস্কার এনে দেয়। যেমন, ‘ভাল’ হয়ে থাকলে মা আইসক্রিম খাওয়াবে। ‘ভাল’ তা-ও, যা করলে শাস্তি এড়ানো যায়। হোমওয়ার্ক করা ভাল, কারণ না করলে ম্যাম শাস্তি দেবে।
দ্বিতীয় ধাপে পারিবারিক শুধু নয়, সমাজ, আইন, রাষ্ট্রনির্ধারিত নৈতিকতা মুখ্য হয়ে ওঠে।
তৃতীয় ধাপে, হয়ত, হয়ত সে প্রশ্ন করতে শেখে দ্বিতীয় ধাপের সেইসব প্রথাগত নীতিবোধকে। সবাই নয়। কিন্তু কেউ কেউ তা করে। সেসব আঠারো-উনিশের কাজ। বলেছিলেন কোহলবার্গ। বস্তুত, এইসবই বলেছিলেন কোহলবার্গ নামক এক মনস্তাত্বিক, ‘স্টেজেস অফ মরাল ডেভলাপমেন্ট’ সূত্রায়িত করতে গিয়ে।
কিন্তু রাষ্ট্রের এমনই লীলা যে, চারবছরের শিশুকেও স্টেপজাম্প করে তৃতীয় ধাপের প্রশ্ন সলভ করার চেষ্টা করতে হচ্ছিল। রাষ্ট্র যদি সংবিধান অনুযায়ী নিজের গণতান্ত্রিক ন্যায়ের আদর্শ মেনে চলত, তবে শিশুর যেমন সুবিধা হত তাকে বিশ্বাস করতে, তেমনই সুবিধা হয় সাধারণ দেশবাসীর, যারা আসলেই রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে চায়, তাকে অভিভাবক ভাবতে চায়, ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা ভাবতে চায়। কিন্তু তেমনটা সচরাচর ঘটে না।
আজ সেই মেয়ের বয়স আরও চার বছর বেড়েছে। সে নিজেই দেখেছে, রাষ্ট্র হতে পারে নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। তেমন উদাহরণ এখন আরও সহজলভ্য।
সে, আমি, আপনি, আমরা সবাই আরও অনেক কিছু দেখেছি। আমরা দেখেছি ও জেনেছি, এ দেশে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ একটি জীবন বাঁচতে গেলে সবার আগে ত্যাগ করতে হবে ভয়।
জেলের ভয়।
ইউএপিএ-র ভয়।
মৃত্যুভয়।
সে, আমি, আপনি, সবাই চাক্ষুষ করেছি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের ভয় এমনিতেই অন্তর্হিত হয়।
আর জেনেছি, পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলে সনাতনী মাতৃত্বও তার ভোল বদলায়। আমরা এমন এক সময়কে অবলোকন করেছি, যখন শাহিনবাগের শৈত্য উপেক্ষা করে ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছেন অশীতিপর বৃদ্ধা মা। কিংবা কুড়ি দিনের শিশু কোলে তরুণী মা।
পাভেল ভ্লাসফের মা পেলাগেয়া নিলভনাকে প্রায় সকলেই আমরা চিনতাম। অন্তঃপুরবাসিনী মায়ের পতাকা কাঁধে তুলে নেওয়ার গল্প গোর্কিতে পড়েছিলাম। আর স্বচক্ষে দেখতে পেলাম রোহিত ভেমুলার মা রাধিকা ভেমুলাকে। নাজিব আহমেদের মা ফতিমা নাফিসাকে। মাতৃত্বকে যদি একটা বিমূর্ত ধারণা ধরা হয়, তবে তার মূল উপাদান নিশ্চয় সন্তানকে রক্ষা করার, সন্তানকে ন্যায় এনে দেওয়ার উদগ্র রোখ৷ সেই জেদই এই মায়েদের পথে নামিয়েছিল। ‘মাতৃত্ব’ নামক ব্যক্তিগত বা পার্সোনাল ভূমিকাটি পলিটিকাল হয়ে গেছিল এইভাবে। চোখের সামনে। সেই মায়েদের শক্তি সফুরা জারগারের মধ্যেও পুঞ্জীভূত হয়েছে। না। ঐশী কোনও ম্যাজিক নেই এতে। সময়ের দাবিতেই তা ঘটেছে। গর্ভবতী সফুরা জারগার, যে তিহার জেলে বন্দি আছে আজ দু মাস।
করোনা অতিমারি এবং দীর্ঘদিনের লকডাউনের মধ্যেই কী অবলীলায় এদেশে চলছে রাষ্ট্রীয় এবং পুলিশি সন্ত্রাস! মারি-ও রাষ্ট্রের প্রতিশোধস্পৃহাকে মারতে পারেনি। লকডাউনের মধ্যেই একের পর এক সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী আন্দোলনকারীদের ইউএপিএ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইনে গ্রেপ্তার চলেছে।
তার চেয়েও বড় কথা, গত ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের গণহত্যায় বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ভূমিকাকে আড়াল করার জন্য, একের পর এক এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীকেই ‘দিল্লির দাঙ্গাকারী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ‘দ্যাখ কেমন লাগে’ সহযোগে রাষ্ট্রের অট্টহাস্য।
মিরান হায়দার, সফুরা জারগার, আসিফ ইকবাল তানহা, গুলফিশা, আমির মিনটোই, শিফা-উর-রহমান, নাতাশা, দেবাঙ্গনারা গ্রেপ্তার হচ্ছে, অথচ দাঙ্গাকারী হিন্দুত্ববাদীরা অধরাই থেকে যাচ্ছে। ঠিক একইভাবে ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁও-র ঘটনার পর দলিতদের ত্রাস মিলিন্দ একবতে বা সম্ভাজি ভিদে গুরুজি সহজেই ছাড় পেয়ে গেছিল, কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেই ঘটনার নিন্দা করা সমাজকর্মী এবং মানবাধিকারকর্মীরা।
যখন গ্রেপ্তার হয়েছিল সাতাশ বছরের এমফিলের ছাত্রী সফুরা জারগার, তখন সে ছিল চোদ্দ সপ্তাহের অন্তঃসত্তা। আজ সে একুশ বা বাইশ সপ্তাহের পোয়াতি।
সফুরার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন। সফুরার পলিসিস্টিক ওভারি। সফুরার পুষ্টিতে ঘাটতি। সফুরার হাই ব্লাড প্রেসার। সফুরার কোভিড-সংক্রমণ সম্ভাবনা।
কিছুই টলাতে পারেনি আদালতকে। অভিযোগ, সে অ্যান্টি-সিএএ-অ্যান্টি-এনআরসি প্রতিবাদের মুখ ছিল। সে প্রতিবাদ কি জরুরি ছিল না তার আগামীর সন্তানের জন্যও?
জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশনের কাছে নাকি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিল মেয়েটি। সফুরা, জামিয়ার ছাত্রছাত্রীদের কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য। সে বক্তৃতায় এমনই আগুন যে নাকি তা থেকেই বেধেছিল দিল্লির দাঙ্গা! সত্যি? এনআরসি-বিরোধিতা মানে দাঙ্গায় উস্কানি? সিএএ-তে স্পষ্টই বলা আছে, নিজেকে নাগরিক প্রমাণ না করতে পারা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান মানুষ নাগরিকত্ব পাবেন, কিন্তু মুসলিমদের কোনও উল্লেখ নেই। সেই অসাংবিধানিক আইনের বিরোধিতাই তাহলে ‘দাঙ্গায় উস্কানি’?
তা-ও যদি হয়, তবে ‘গোলি মারো সালোকো’ উক্তি-খ্যাত অনুরাগ ঠাকুর কেন বহাল তবিয়তে? কেন দাঙ্গায় বন্দুক সাপ্লায়ারের জামিন হয়ে যায় আর গর্ভবতী সফুরার জামিন হয় না? কেন তাহির হুসেইনের বাড়ি থেকে কত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, তা অপ্রাসঙ্গিকভাবে উল্লিখিত হয় সফুরার জামিনের শুনানিতে, যেখানে সে দুটি আলাদা এফআইআর থেকে উদ্ভূত আলাদা মামলা?
১৩ এপ্রিল সফুরার প্রথম জামিন শুনানির দিন তদন্তকারী অফিসার বললেন “suspicion of involvement of the accused in anti-national activities”-এর কথা। কিন্তু বেইল তাও হল। সঙ্গে সঙ্গে, সেদিনই নতুন এফআইআর তৈরি হল। এবার ইউএপিএ-র চার্জ দেওয়া হল তাকে, যাতে সে জেল থেকে বেরোতে না পারে।
১৮ই এপ্রিল তার উকিল বললেন, প্রাথমিকভাবে ইউএপিএর এফআইআর-এ সফুরার নামও ছিল না। বিচারক তদন্তকারী অফিসারের কাছে জবাবদিহি চাইলেন।
২০ তারিখের পরবর্তী শুনানিতে বলা হল, হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে তাকে জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বটে, কিন্তু পরে স্পেশাল সেল তার বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ইউএপিএ ধারায় দিয়েছে।
এইমস বা সফদরগঞ্জে চিকিৎসার আর্জিও নাকচ হল সফুরার। অন্যদিকে শুরু হল আইটি সেলের অপপ্রচার। সফুরা নাকি বিবাহিত নয়। তার সন্তান নাকি ‘অবৈধ’। আবারও নারীকে লাঞ্ছিত করর শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে বিবেচিত হল তার চরিত্রে কালিমা লেপন। সফুরার বিবাহিত জীবনসঙ্গীকে জনতার দরবারে জানাতে হল বিয়ের সাল তারিখ, দিতে হল বিয়ের ফটো। অথচ, রাজদ্রোহী সফুরা বিবাহিত, না অবিবাহিত অন্তঃসত্তা, তা কোনওভাবেই প্রাসঙ্গিক ছিল না তার তথাকথিত ‘রাজদ্রোহের’ বিচারকালে।
সফুরার বোন জানায়, ইউটিআই ও পিসিওএস-এ ক্লিষ্ট সফুরা উদ্বিগ্ন বাবামাকে বলে, সে ভালো আছে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে আর কীই বা জানাতে পারে সে? সফুরার বোন, সফুরার বর… তারা এখনও দেশের আইন-আদালতে আস্থা রাখছে, রাষ্ট্রে আস্থা রাখছে। রাষ্ট্র কি সফুরা আর তার আগামী সন্তানের দায়িত্ব নিচ্ছে? সন্তান ও মায়ের কোনও ক্ষতি হবে না রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়, এ কথা হলফ করে বলতে পারে কি প্রশাসন?
সফুরার বিরুদ্ধে ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ’ বলতে আছে কিছু হোয়াটস্যাপ স্ক্রিনশট। সেখানে রাস্তা ব্লক করা ছাড়া আর কোনও বে-আইনি কাজের উল্লেখ নেই। রাস্তা ব্লক করা কি এতটাই সাংঘাতিক এক জঙ্গি কার্যকলাপ? ইউএপিএ একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ আইন। সেখানে উগ্রবাদী, নাশকতামূলক ও ‘আনলফুল’ মানে বে-আইনি কার্যকলাপকে এক ব্র্যাকেটে ফেলা হয়েছে। প্রকৃতি অনুযায়ী সফুরার কাজ কোনও জঙ্গি কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে না৷ সাধারণত জঙ্গি হিসেবে প্রমাণিত ব্যক্তিদের জামিন হয় না, কিন্তু স্রেফ ‘আনলফুল’ কাজ করলে জামিন হতেই পারে। তাহলে? জামিন পেলে সফুরা পালিয়ে যাবে অসুস্থ ও অন্তঃসত্তা অবস্থায় এবং কোনও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শহরের ক্ষতি করবে, এ সম্ভাবনা ঠিক কতটা?
সফুরার জামিন-হীনতা সমস্ত আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে। সফুরার জামিন পাওয়ার অধিকারকে সমর্থন করেছে ইউনাইটেড স্টেটসের আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশনও। তারা উল্লেখ করেছে International Covenant for Civil and Political Rights (ICCPR)-এর কথা, যা বলে, শুধুমাত্র পালানোর সম্ভাবনা থাকলে বা সাক্ষ্যপ্রমাণ করর লোপাট করার সম্ভাবনা থাকলেই জামিন বাতিল হতে পারে, অন্যথায় নয়।
তারা হাই ব্লাডপ্রেশারের এক অন্তঃসত্তার জেলে সম্ভাব্য বিপদের কথাও বলেছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে ‘The United Nations Rules for the Treatment of Women Prisoners and Non-Custodial Measures for Women Offenders ‘-এর, যেখানে বলা আছে, “non-custodial means should be preferred for pregnant women during the pre-trial phase wherever that is possible or appropriate.”
এতদসত্ত্বেও, ৪ঠা জুন, সফুরার শেষ জামিন শুনানিটি তাৎপর্যপূর্ণ। দুই দিন ধরে আট ঘণ্টা শুনানি হওয়ার পর, আইনের পরিভাষায় নয়, পাতিয়ালা কোর্টে বিচারক ধর্মেন্দ্র রানা কথা বলেছেন সাহিত্যের ভাষায়, অলঙ্কারে—
“… When you choose to play with embers you cannot blame the wind to have carried the spark a bit too far and spread the fire.”
বিচারককে কেন আইনের ভাষায় কথা না বলে সাহিত্য করতে হয় আদালতে? মামলার কোন দুর্বলতা ঢাকতে?
সফুরা জারগার। আগামীর মা। হাঁসফাঁস করে তিহার জেলে। তার দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার৷
তার হাই ব্লাডপ্রেসার, পিসিওএস, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, কোভিড সম্ভাবনা। তাই আমাদের সাংস্কৃতিক মাতৃবন্দনার ভেক খসে পড়ে।
সফুরা জারগার বিবাহিত না অবিবাহিত, তা নিয়ে মিম জমে ওঠে। মুসলিমবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষ গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়ায় সফুরার গারদের বাইরে আর হাসাহাসি করে। দেশের মাতৃ-শ্রদ্ধার ভড়ং ধ্বসে যায়।
বিচারক বলেন, আগুন নিয়ে খেলতে গেলে, হাওয়ায় আগুন ছড়াবেই। তখন হাওয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেশ তো। সে আগুনের উত্তরাধিকার যদি বহন করে সফুরা বা আমার বা আপনার সন্তান, তবে কি তাদের দেশদ্রোহী বলবেন ধর্মাবতার?