গৌরব দাস
লকডাউনের শুরু থেকেই গোটা দেশজুড়ে আকালের ছবিগুলো চোখের সামনে আসছিল। একদিকে অতিমারি আর অন্যদিকে কাজ হারিয়ে দেশের কোটি-কোটি মানুষের পেটের খিদে! চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতেই এতকিছু অবলীলায় খুব অসহায় লাগছিল।
কিছু একটা করার জন্য মনগুলো উশখুশ করছিল তখন থেকেই। তাই, মার্চের শেষ সপ্তাহে লকডাউনের একেবারে গোড়ার দিকে “নেমে তো পড়া যাক, কিছু একটা হবে নিশ্চয়” ভেবে নেমে পড়া। তখন যেহেতু সমাজে নতুন নাম ‘কোয়ারান্টাইন’ নিয়ে বিপুল চর্চা হচ্ছিল আর উল্টোদিকে মনের মধ্যে ‘সামাজিক দূরত্ব’-এর চাপিয়ে দেওয়া নির্দেশ অমান্য করে শারীরিক দূরত্বের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে বন্ধুবান্ধব চেনাপরিচিত যে যেখানে আছে তাদের একটা সংযুক্ত করে সামাজিক নৈকট্য গড়ে তোলার ইচ্ছে, তাই নাম দেওয়া হল ‘কোয়ারান্টাইনড স্টুডেন্ট ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’ বা QSYN।
ফেসবুকে নেটওয়ার্কের গ্রুপ খোলার সময় প্রথম তিন-চারজনের ধারণাতেও আসেনি যে কিছুদিনের মধ্যেই নেটওয়ার্কটাকে এভাবে এত মানুষ নিজের মনে করে বিস্তৃত করে তুলবেন। সঙ্গে আছে নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে পড়া মানুষদের কাজের বৈচিত্র্য। চমৎকার লাগার মতো ব্যাপার এটাই যে নেটওয়ার্কে সবমিলিয়ে এখন যারা যুক্ত তারা বেশিরভাগই এখনও কেউ কাউকে সাক্ষাতে দেখেননি। বিভিন্ন কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাধিক্য থাকলেও যুবসমাজের একটা অংশ, কিছু শ্রমিক, শিক্ষক, গবেষক, ডাক্তার, ইত্যাদি বিভিন্ন অংশের সমাবেশ ঘটেছে এই নেটওয়ার্কে। নেটওয়ার্কে থাকা মানুষদের একটা মানুষদের একটা কমন সুর নেটওয়ার্কের কাজ এগোতে এগোতেই তৈরি হয়েছে। তা হল এই নেটওয়ার্ক কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা এনজিও নয় এবং নেটওয়ার্কের সকলে সমস্ত রকম হিংসা, তা রাজনৈতিক হোক, ধর্মীয় হোক, জাতিগত হোক, জাতগত হোক আর যাই হোক, তার বিরুদ্ধে এবং মানুষে মানুষে সমস্ত সামাজিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে বৃহত্তর এক ঐক্যের পক্ষে।
লকডাউনের ফলে, এই নেটওয়ার্কের সমস্ত যোগাযোগই রাখতে হচ্ছিল ফোনে-ফোনে কিংবা সোশাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে। ন্যূনতম কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই, লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া বিপর্যয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজ কাজ নয়! লকডাউনে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় টাকাপয়সাও উঠে আসছিল ইন্টারনেটের মধ্য দিয়েই। কোথা কোথা থেকে যে মানুষ খবর পেয়ে টাকা দিয়েছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। প্রাথমিকভাবে শুধু টাকা দেওয়ার পর সারাক্ষণ এই বার্তাই বেশি এসেছে যে তারা গায়েগতরে কিছু করতে চান। এপ্রিলের মাঝের দিকে নেটওয়ার্কের কাজের খবর একটু চাউর হতেই এমন অনেক চেনা-অচেনা মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন যাদের মূল বক্তব্যই ছিল “ওসব পিএম কেয়ার সিএম কেয়ারে আর কোনও আস্থা রাখি না ভাই। অনেক দেকে ফেলেছি। দেখছি তোমরা নিজেরা মাঠে নেমে খেটেখুটে করছ, তাই তোমাদের দিচ্ছি। এরকম আর যাদের দেখব তাদের দেব। যেখানে দিয়ে সত্যিসত্যিই কাজ হবে সেখানে দেব।” বস্তুত, সামগ্রিকভাবে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি জন্মানো অবিশ্বাসের কারণে এই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় আমাদের মতো এরকম আরও নেটওয়ার্ক এতদিন মসৃণভাবে যে টেনে নিয়ে যেতে পারছে, সেটা স্বীকার করতেই হচ্ছে।
ধীরে ধীরে পশ্চিমবাংলার জেলায়-জেলায় বিভিন্ন এলাকায় সার্ভে করা শুরু হল। যে যার এলাকায় সাধ্যমতো এই কাজ শুরু করল। মোটামুটি একটা আন্দাজ বুঝে, বিভিন্ন এলাকায় প্রাথমিকভাবে রেশন দেওয়া শুরু করি আমরা। তারপর বুঝলাম, যাদের ঘরবাড়ি নেই কিংবা থাকলেও, রান্না করার জন্য গ্যাস কেনার মতো অবস্থাও নেই, তাদের হাতে শুকনো রেশন তুলে দেওয়াটা অর্থহীন! তাই ঠিক করলাম, রেশন দেওয়ার পাশাপাশি, লকডাউনে কলকাতা ও শহরতলির ফুটপাথবাসী মানুষদের জন্য রান্না-করা খাবার বিতরণ করব। নাম দি কমিউনিটি কিচেন, যদিও এই হেঁশেল গণহেঁশেল আদৌ হয়ে উঠবে কিনা সে নিয়ে সংশয় প্রথমদিকে অবশ্যই ছিল। কিন্তু এভাবেই শুরু…
কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজারের প্রায় ৫০০ জন ফুটপাথবাসীর মধ্যে রান্না-করা খাবার প্যাকেট করে বিতরণ করা হল কয়েক দিন। তারপর মনে হল, একটা স্থায়ী কিচেন চালু করে দিলে কেমন হয়! এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে, এভাবেই গড়ে ওঠে কলেজ স্ট্রিট, বরানগর জুট মিল ও বারাসাতের দক্ষিণপাড়া অঞ্চলের হেঁশেলগুলো। যত দিন এগোতে লাগল, তত বহু চেনা-অচেনা বন্ধু এগিয়ে আসতে থাকল। যারা শুরুতে বলছিল “গায়েগতরে করতে চাই”। ক্রমশ, পাহাড় থেকে সাগর, পশ্চিমবাংলার প্রায় প্রত্যেকটা জেলাতেই গড়ে উঠলো বিভিন্ন উদ্যোগ। পশ্চিম মেদিনীপুরের শবর উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম থেকে বীরভূমের আদিবাসী অধ্যুষিত মুসলিয়া গ্রাম, হুগলির বৈঁচি থেকে মালদার গঙ্গায় ভাঙনপ্রবণ গ্রাম, ভাঙড় থেকে হাবড়া, বাঁকুড়ার জঙ্গল ও শুশুনিয়া সংলগ্ন আদিবাসী গ্রাম থেকে পুরুলিয়ায় কুষ্ঠ রোগীদের বস্তি ‘মণিপুর’… সবমিলিয়ে গড়ে উঠল প্রায় ২৫টি হেঁশেল। যত দিন এগোল, হেঁশেলের প্রায় পুরো দায়িত্বটাই নিয়ে নিলেন এলাকার মানুষরাই। বাজার করা থেকে রান্নার জোগাড়যন্ত্র ও খাবার বিতরণ… হেঁশেলের সমস্ত ভারটাই তারা কাঁধে তুলে নিলেন। মনে পড়ে, সে সময় কলেজ স্ট্রিটের হেঁশেলের রান্নাবান্নার সমস্তটাই করতেন বন্ধ হয়ে যাওয়া এক হোটেলের কর্মচারী ও কাজ-হারানো শ্রমিকরা। খাবার বিতরণের পুরো ভারটাই নিয়েছিল, ফুটপাথবাসী তরুণ-তরুণী আজমীরা আর আকাশ! বাঁকুড়ার কাঞ্চনপুরের মানুষরা নিজেরা শুকনো কাঠ থেকে শুরু করে রান্নার তেলের জোগান দিলেন। মণিপুর বস্তির ভিক্ষুক কুষ্ঠরোগীরা এত মানুষের রান্নার কাটাকুটি জোগাড়ের কাজ যেরকম হাসিমুখে করছিলেন তাতে তারা যে রোজগারের অপমানের জ্বালা একটু হলেও ভুলে সম্মানিত বোধ করছিলেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল। মালদায় রোজার মাসে গ্রামের হিন্দু মুসলমান সকলে মিলে ঠিক করলেন রাতেই রান্না হবে। রান্না তারা নিজেরাই করছিলেন। এই লিস্ট আর বাড়াতে চাই না। সব না হলেও, বেশিরভাগ হেঁশেলগুলো পরিণত হচ্ছিল গণ-হেঁশেলে… এই দুর্দিনে আমাদের কাজ হয়ে দাঁড়াল, যাদের একটু বেশি আছে, তাদের থেকে নিয়ে, যাদের খুব কম আছে, তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া…
ইতিমধ্যেই, তখন গোটা দেশজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নামতে শুরু করেছে! ভুখা পেটে মাইলের পর মাইল পথ খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ফেরার টান! এভাবেই রাজপথে লুটিয়ে গেছে কত-কত শ্রমিকের দেহ, খিদের জ্বালায়, ট্রাকের ধাক্কায়, মালগাড়ির চাকায়, ক্লান্তিতে, অপুষ্টিতে… পশ্চিমবাংলার বাইরে, দিল্লি-মুম্বাই-হায়দ্রাবাদ সহ অন্যান্য কিছু শহরে আমাদের বন্ধুরা আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিল রেশন, শ্রমিক মহল্লার বাচ্চাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার। গোটা দিল্লি ঘুরে, বাংলার হাজার-হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে রেশন পৌঁছে দেওয়ার সময়, ওরা যখন বারবার বলছিল, “ঘরে ফেরবার একটা ব্যবস্থা করো,” তখন নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না! রাজ্যের বাইরের এই উদ্যোগে সবমিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গানা, অসম ও মধ্যপ্রদেশের প্রায় বারো হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের সাহায্য হয়েছে।
গ্রামবাংলার ছবিটা ছিল একটু অন্যরকম। লকডাউনের আগে, ফসল উঠেছিল ভালোই। তাই, আর যাই হোক, সেখানে দুবেলা পেটটুকু চলবে! হুগলির কিছু গ্রামাঞ্চলে আমাদের বন্ধুরা একটা ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানে যেহেতু শহর-মফঃস্বলের মতো হেঁশেল চালু করার প্রয়োজন নেই, তাই, গ্রামের মানুষদের সঞ্চয় থেকে তাদের ফসলের খাবার খানিক সংগ্রহ করে পৌঁছে দিয়েছিলাম মফঃস্বলের হেঁশেলগুলোয়। গ্রামের ঐ গরীব মানুষগুলো উজাড় করে দিয়েছেন। নিজেদের জমানো ফসল থেকে নিজেদেরটুকু রেখে বাকি সবটুকুই দিয়ে দিয়েছেন। আরামবাগ তারকেশ্বর ভাঙড়ের সবুজ ক্ষেত অধ্যুষিত অঞ্চলে চলল এই কাজ। বুঝতে শিখেছিলাম, আমরা আসলে কোনও ত্রাণ বা রিলিফের মহৎ কাজ করছি না। গরীব, মেহনতী মানুষরাই এই দুর্দিনে সংহতি পৌঁছে দিচ্ছেন শহরের কাজ-হারানো মানুষগুলোর কাছে। সারাক্ষণ এই ব্যবস্থায় শোষিত হয়ে চলা তাদের তো এটা হকের পাওনা। আমরা তো শুধু পৌঁছে দিচ্ছি মাত্র! এখনও অবধি লকডাউনের সময় আমরা ২৫টি গণহেঁশেলের মধ্যে দিয়ে প্রায় দুই লক্ষ মানুষের কাছে অন্তত একবেলার অন্ন তুলে দিতে পেরেছি। রেশন গেছে প্রায় পনেরো হাজার পরিবারের কাছে।
তারপর, এই আকালের মধ্যেই এল ভীষণ ঝড়! এতদিন খড়কুটোটুকু আঁকড়ে ধরে মানুষ টিকে ছিল, যে খড়কুটোর টানেই ভুখা পেটে মাইলের পর মাইল হেঁটে ওরা ফিরে এসেছিল… ‘আমফানে’ সেটুকুও ভেসে গেল! পূর্বাভাসের সময় থেকেই বিপদের প্রহর গুণছিলাম। আয়লার অভিজ্ঞতা আমাদের কারও কারও আগে থেকেই ছিল। যেভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হল তাতে প্রাথমিকভাবে আমরা গিয়েই উঠতে পারলাম না। অথচ কলকাতার অবস্থা দেখেই আমাদের উৎকণ্ঠা চরমে উঠল।
এখানে আমাদের নেটওয়ার্কে যুক্ত যাদবপুরের কিছু বন্ধুর উদ্যোগ ‘এডুকেশন ফর অল’ এগিয়ে না এলে খুব তাড়াতাড়ি কতটা করতে পারতাম তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তারা সুন্দরবন অঞ্চলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নিয়মিত সায়েন্স ক্যাম্প ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রেজেন্টেশন করায় ঝড় আসার আগে থেকেই তারা যোগাযোগ রাখছিল। এই স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক রাতারাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন… অতি দ্রুততায় তারা সার্ভে করে জানানোর পরেই কাজ শুরু হতে পেরেছে।
আমাদের নেটওয়ার্ক উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল অঞ্চলে কোণায় কোণায় পৌঁছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে মানুষের সব-হারানোর জ্বালা-যন্ত্রণা-ক্ষোভ! সুন্দরবন অঞ্চলে যেমন বুঝেছি নদীর ঠিক তীরবর্তী অঞ্চলের চেয়ে একটু ভেতরের দিকে সঙ্কট তীব্রতর। এখানে সাহায্যও পৌঁছায় কম, জমা জল বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও কম। দেখেছি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন তারাই যাদের ওপর লকডাউন সবচেয়ে খারাপ প্রভাব ফেলেছে।
QSYN-এরই উদ্যোগ ‘আমফান সুপার সাইক্লোন রেসপন্স’-এ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এসে জমা হয় কয়েক লক্ষ টাকা! হিঙ্গলগঞ্জ থেকে গঙ্গাসাগর, কাকদ্বীপ থেকে পাথরপ্রতিমা, গোসাবা থেকে সন্দেশখালি, মিনাখা থেকে বারাসাত, নন্দীগ্রাম থেকে জুনপুট… আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে, যেখানে যেখানে ডাক এসেছে, পৌঁছে গিয়েছি। গিয়ে যা দেখেছি, তা অকল্পনীয়! যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে যদি ১০০০টা QSYN-ও পৌঁছে যায়, তাতেও কুলোবে না কিছুই! তবুও দিনের শেষে যে জিনিসটা ভরসা দেয়, তা হল মানুষের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই, যে লড়াই তারা আজও সব-হারিয়েও চালিয়ে যাচ্ছেন…
আমফান পরবর্তীতে কাজ করতে গিয়ে আমাদেরও শাসক-বিরোধীর ত্রাণ রাজনীতির সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হল। স্বাধীনভাবে মানুষ কিছু করতে পারবে না যেন! হয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে দিতে হবে, না হলে এ পার্টির ব্যানারে দিতে হবে, তাতে ওপার্টির গোঁসা হলে তারা এপার্টির নামে মিথ্যা রটনা চালাবে… তাদের রেশন নিয়ে পারস্পরিক আকচাআকচি, দুর্নীতি আর তর্ক-বিতর্কের নামে নিউজ টাইমের প্রাইমটাইমে অশ্লীল তু তু ম্যায় ম্যায় না-হয় বাদই দিলাম। মানে সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! ভরসা পাওয়ার মতো ব্যাপার এটাই যে দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে স্থানীয় গ্রামবাসীরাই যেভাবে সামনে থেকে পঞ্চায়েত প্রধান থেকে এমএলএ এবং বিরোধী নেতাদের সেই রাজনীতির ‘চর্চা’ সামলে আমাদের ভালোবেসে জায়গা করে দিয়েছেন তা অভাবনীয়। আমফান বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে আমরা এখনও অবধি ১৪টা গণহেঁশেল চালাতে পারছি যাতে দৈনিক উপকৃত হচ্ছেন কমপক্ষে ৫০০০ মানুষ। ৭৫০০রও বেশি পরিবারকে ত্রিপল দিতে পেরেছি। রেশন পৌঁছে গেছে গেছে ১৪০০০এরও বেশি পরিবারের কাছে। এছাড়া মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ৪০০ জনের কাছে সোলার লাইট ও কিছু শিক্ষাসামগ্রী পৌঁছতে পেরেছি।
কিন্তু যা দেখছি তাতে লকডাউন আর আমফানের যৌথ প্রভাব সহজে মেটার নয়। যেভাবে সুন্দরবন অঞ্চলে জীবন জীবিকার সঙ্কট দেখা দিচ্ছে, আবার আমাদের প্যাকেজ ঘোষণা করনেওয়ালা তাবড় তাবড় নেতাদের নাকের ডগায় একটা বড় অনিচ্ছাকৃত পরিগমন (Forced Migration)-এর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তা সত্যিই শোচনীয়। সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে একটা ব্যাপক অংশ স্কুল-কলেজ ছাত্রছাত্রীর স্কুল-কলেজছুট হওয়ার। মহিলাদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে যেটুকু ছিটেফোঁটা অগ্রগতি হচ্ছিল সেটার ভবিষ্যতও বিশবাঁও জলে। পড়ার ইচ্ছে থাকলেও কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ঝড়ের সাময়িক প্রভাব হয়তো কাল মিলিয়ে যাবে কিন্তু এইসব চোখের আড়ালে তিলে তিলে একটা বড় অংশের মানুষকে গ্রাস করে নেবে। কিন্তু এটা হতে দেওয়া যায় না। ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। QSYN চেষ্টা করছে দ্রুত এইসমস্ত বিষয় নিয়ে কি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পার্থিব সম্পদের চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন পড়বে মানবিক সম্পদের।
একটা এতবড় রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকতেও তাদের উপস্থিতি নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। আমাদের মতো বিভিন্ন নেটওয়ার্ক সবমিলিয়ে যা করতে পারে তা কিছুই নয় রাষ্ট্রের সাধ্যের কাছে। প্রতিদিন মাঠে-ময়দানে কাজ করতে গিয়ে দিনের শেষে শেষবেলায় আসা কিছুজনকে সাহায্য করতে না-পারার যে যন্ত্রণা আমাদের হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার নগণ্য উপস্থিতি দেশের সঙ্গে তাচ্ছিল্য করার মতোই অশ্লীল ঠেকছে।
সঙ্গে আছে তাদের অস্বচ্ছতা। এটুকু বলতে পারি আমাদের মতো নেটওয়ার্কগুলোর অন্যতম গ্রহণযোগ্যতার কারণ স্বচ্ছতা। এটা এই প্রকাণ্ড কর্মকাণ্ডের কোনও টেকনিক্যাল বিষয় নয়। সাধারণ মানুষের হক আছে তাদের সাহায্য ঠিক করে মানুষের কাজে লাগছে কিনা সেটা বুঝে নেওয়ার। বিশ্বাস আর হকবোধের মিশেলই এই চলমান কর্মসূচির প্রাণভোমরা বলা যেতে পারে।
উল্লেখযোগ্য কিছু প্রান্তিক অংশে আমাদের পৌঁছনোর কথা শেষে বলব। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা LGBTQAI± মানুষজন, কাজহারানো নারী শ্রমিকদের মহল্লা, যৌনকর্মীদের একাংশ, পরিযায়ী শ্রমিকদের একাংশ, কুষ্ঠ এবং HIV+ রোগে আক্রান্ত মানুষদের একাংশ, শ্রমিক মহল্লা ও গ্রাম, বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিক, দার্জিলিংয়ে কাজ হারানো শেরপা ইত্যাদি। এগুলোর উল্লেখ করলাম কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা হল অধিকাংশ প্রান্তিক অংশ এখনও অন্ধকারেই থেকে গেছেন।
সবশেষে বলতে চাই, দিনের শেষে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, নিজেদের সবটুকু হারিয়ে সমস্ত অবসাদ-জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্য দিয়েও নানারকম পনির্মাণ-বিনির্মাণ-পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে সমাজপ্রক্রিয়া কীভাবে যেন প্রবাহিত হতে থাকে— এটা অভিজ্ঞতায়-অনুভবে বুঝতে পারা! সমাজ নিজের নিয়মেই সমস্ত সুবিধাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের পাশে দাঁড়ায়। অপেক্ষা শুধু সমাজের কোণায় কোণায় লুকিয়ে থাকা বেঁচে থাকার এই লড়াইগুলো একে-অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ার। আমাদের কাজ হল, একের সংহতি পৌঁছে দেওয়া অপরের কাছে। আমাদের কাজ হল, মিলিয়ে দেওয়ার, মিলে যাওয়ার…