অতনু গোস্বামী
ট্রেনটা নামিয়ে চলে গেছে কিছুক্ষণ। ফুট ওভারব্রিজের রেলিঙের ফাঁকে নিকষ কালো আকাশে লটকে আছে একটা চাঁদ, ‘রক্তাক্ত আত্মার মতো স্থির’। অচঞ্চল। ফেরার ট্রেন থেকে নামার পর তাড়া থাকে না সেরকম। শালপাতায় ঘুগনি, শিঙাড়া। মৃত শরীরের হিম নিয়ে হলুদ আলোর চৌকো কাঁচের বাক্সবন্দি। তাই সই। চেনা হাসিমুখ কাঁপা হাতে এগিয়ে দেয়। ‘বাড়িতে সব কেমন?’ প্রত্যুত্তরেও সেই হাসি, তবে একটু পাণ্ডুর। কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ি বাঁধানো কৃষ্ণচূড়ার নীচে। আরও কয়েকটা লোকাল চলে যায় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে। কিছু অনুগত আত্মঘাতী স্মৃতিও ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেলের সঙ্গে মিলিয়ে যায়…
প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই চোখ যায় চাঁদটার দিকে। আমার সখ্যতা সাউথ ইস্টার্নের সঙ্গে। হাওড়া থেকে ১৯ স্টেশান পর নামতে হবে। কর গুনে মুখস্থ করিয়েছিল দাদু। দাদুর কর গোনার অবশ্য ক্ষমতা ছিল না শেষটায়। আঙুল তুলে দেখিয়েছিল পাঁচ। তদ্দিনে বুঝে গেছি কোন স্টেশানে নামতে হবে আসলে আমরা কেউই জানি না। মনে করতে পারি না দাদু কোন স্টেশানে নেমে গেল। “লেট দেয়ার বি স্পেসেস ইন ইওর টুগেদারনেস।” আশৈশব চেনা স্টেশানের সঙ্গে আত্মীয়তার স্পেসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একখণ্ড চাঁদ। রিক্ততার দোসর। দাদুর সঙ্গে খসে পড়া আত্মীয়তা ততক্ষণে রক্তাভ করে তুলেছে চাঁদটাকে। মোহ কাটিয়ে চড়াই ভাঙতে থাকি ফুট ওভারব্রিজের।
দুপুরের কামরাগুলো ভীষণ ফাঁকা। এইসব কামরার নীরবতা যেন খাঁচায় ভরা দাম্পত্যের শীতলতা থেকে ধার করে আনা। ভোঁতা বিষণ্ণতা ধেয়ে আসে ভেজা ক্যাম্বিস বলের মত। পাঁজরে এসে লাগে। আনুষঙ্গিক চোট আঘাত নিয়ে চেপে বসে থাকে জানলার সিটে। এলোমেলো হাওয়া ছুঁয়ে যায়। মুখোমুখি বসে দুটো শরীর। হপ্তার পর হপ্তা কাটে, মাসের পর মাস। ট্রেন পেরিয়ে যায় ভিড় স্টেশান, কোলাহল ধরে আসে। শুভাকাঙ্ক্ষীরা হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে পড়ে। তখনও দুজোড়া উদাসীন চোখ একে অপরের দিকে তাকিয়ে। কাকবন্ধ্যা দৃষ্টি, সবই পড়া বা কিছুই পড়া নয়। প্রেডিক্টেবল। কেউ বলে না এই পথ যদি না শেষ হয়। অনন্তকাল ধরে অভাব অভিযোগ চালাতেও তারা রাজি নয়। তারা জানে তাদের স্টেশান প্রিডেস্টিন্ড। আমি তখনও পড়িনি, “মাধুকরী”। জানি না পৃথু রুষার দাম্পত্য ‘ইনকরিজিবল’। উচ্চাকাঙ্ক্ষী রুষা “আডোলেসেন্ট ছেলেমানুষ, কাণ্ডজ্ঞানহীন ড্রিমার” পৃথুকে লেখে তার নামে চৌপট্টিতে মনুমেন্ট বানানো যায়, তার সঙ্গে ঘর করা যায় না, “লেট আস পার্ট উইথ গ্রেস, উইথ অ্যা টিয়ারফুল স্মাইল।” পৃথু ভাবে রুষাকে উপহার দেবে গিব্রান— “লাভ ওয়ান আন্যাদার বাট মেক নট/ আ বন্ড অফ লাভ/ লেট ইট রাদার বি অ্যা মুভিং সি বিটুইন দ্য শোরস অফ ইয়োর সোলস।”
ভেঙে যাওয়া দাম্পত্যের দুঃস্বপ্নের মাঝে শুনি অ্যানাউন্সমেন্ট। পনেরো নম্বরে আসে লোকাল। দ্বিপ্রাহরিক নৈঃশব্দ্য সাঁতরে এগিয়ে যাই ট্রেনের দিকে। ‘আরে এইতো টিকিয়াপাড়ার আগের সিগন্যালটাই দাঁড়ালি, আবার কেনো!’ -চারঅক্ষুরে বিরক্তি ব্যস্ততার সঙ্গে মিশে নেই কোথাও। উল্টোদিকের সিটে মেঘ ভাঙা নরম রোদ এসে পড়ে। ভ্রূপল্লবের ওঠানামা ডুবতে থাকে দীঘল চোখের সলজ্জতায়। চোখ আটকে যায় থুতনির তিলে। পিউদির মুখ ভেসে আসে। স্কুলের সিনিয়র। তিলের গভীরতায় ঝাঁপ দিয়ে বেঘোরে সলিলসমাধি হয়েছে কত যৌবনের। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন আর কি। পিউদির সঙ্গে আমার ছিল মামুলি কিছু কথা, নীরবতাই ছিল বেশি। সেসব দুপুরে পূর্বাভাস আসত না আবহাওয়া দপ্তর থাকে। উধাও হয়ে যাওয়া যেত হাত ধরে, উঠে পড়া যেত কোনও দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে। সেসব ঘটেনি কিছুই। বার উঁচিয়ে যাওয়া ফ্রিকিক, একটা আখতারি রান আপ আর হাতে গোনা কটা কভার ড্রাইভ। কিছুই চোখে পড়েনি পিউদির। যেদিন উল্টোদিকে কেউ বসে না। সেদিন কানের সামনে কেউ বলে যায়, আসিড অ্যাটাক। চাপা রাক্ষুসে স্বর। ট্রেনটা একটা ব্রিজের ওপর উঠল, থর থর করে কাঁপছে। আমার পা অবশ। মাঠের মধ্যে বসে পড়ি হাঠু মুড়ে। লাল হুটার জ্বালিয়ে একটা আম্বুলেন্স ছুটে যাচ্ছে, ঝলসে যাওয়া মুখ। অন্ধকার করে আসে, আমি চোখ বন্ধ করে নিই। ‘কিছু বলবেন? আপনার কি শরীর খারাপ করছে?’ উল্টোদিক থেকে উঠে আসেন দীঘল চোখ। সম্বিৎ ফেরে। ‘না, না, আমি ঠিক আছি’। উঠে পড়ি সিট ছেড়ে। এগোতে থাকি ট্রেনের গেটের দিকে। আবার পা অবশ। ট্রেন নয়, লাল হুটার মাথায় আম্বুলেন্স ছুটে চলেছে রক্তাভ পশ্চিম আকাশের দিকে। “… অস্তরবির সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে। গাইতে বসে কন্ঠ ছিঁড়ে আসবে যখন কান্না, বলবে সবাই সেই যে পথিক, তাঁর শেখানো গান না?” পিউদি গাইতে থাকে।
“মাধুকরী”র কথা বলছিলাম। পৃথু ঘোষকে কবিতা শোনাতে আসত গিরিশদা। আমার কবিতা শুনতে ইচ্ছে হলে নেমে পড়ি। নারায়ণ পাকুড়িয়া মুরাইল। দু নম্বর প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষের একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসে শুভদীপদা। আজ অব্দি তাকে অন্য কোথাও বসতে দেখিনি। সে বসা আবহমানকালের। ট্রেন থেকে নামতে দেখলে সে জানায় সাদর সম্ভাষণ ঠিক যেভাবে গিরিশদা নিজের বাড়িতে অভ্যর্থনা করত পৃথুকে। দৃষ্টিতে যদিও অপেক্ষা থাকে না। মেঘলা দিনের ছেঁড়া ছেঁড়া রোদের মতো বিষণ্ণতা। ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের বাড়িতেই গজিয়ে ওঠা গাছপালার মতো তার বয়স। অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু সত্য। নিঃসঙ্গতা বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে চরের মতো জেগে থাকে। আমার মত কেউ কেউ আসে। মাঝেমাঝে। ‘অনেকদিন পর এলি!’ আমি অজুহাত হাতড়াই। “তোমাকে বলেছিলাম, যত দেরী হোক, আবার আমি ফিরে আসব। ফিরে আসব তল আঁধারি অশ্বত্থগাছটাকে বাঁয়ে রেখে/ ঝলোডাঙ্গার বিল পেরিয়ে/ হলুদ ফুলের মাঠের ওপর দিয়ে/ আবার আমি ফিরে আসব।” শুভদীপদার গলা স্বগোতক্তির মতো শোনায়। স্টেশানের পেছনে তখন দিগন্তজোড়া গোধূলি। জন্মান্তরের ছায়া পড়ে শুভদীপদার মুখে। স্টেশানের লালঘড়ির ভাবি মিনিটকে দেখি থমকে দাঁড়িয়ে। নিভে যাওয়া দিনের কোল ঘেঁষে সিল্যুয়েটের মতো বসে থাকে সে। লতা গজিয়েছে ওভারব্রিজে। স্টেশানজোড়া দীর্ঘশ্বাস। অনন্তকাল বাঁধে সম্মোহনে। এই স্টেশানের মাস্টার যেন সে-ই।
ফাঁকা ট্রেনের নিস্তব্ধতা যেমন বাঙময়, আগলহীন; ভিড়ের ভাষা ততটাই দুর্বোধ্য, বদ্ধ। কিছু কিছু দিন আসে এড়ানো যায় না, হুড়মুড়িয়ে উঠে আসে ভিড়। পরিসর ছোট হয়। ফাঁকা ট্রেনে এক ধরনের সুবিধে থাকে নিজের কথা যেন সামনের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। পাহাড় ঘেরা উপত্যকার মতো। একোস। ভিড়ের মধ্যে চিন্তা নিজের থাকেনা। পাশের আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে, কখনও ব্যাক্তিগত চিন্তা, চোখে ধরা পরে অন্য কারুর। থট রিডার। আবার এই যেমন ভাবছি প্রেমিকার কথা, পরশুদিনের খুনসুটিতে অস্ফুট হাসি লুটোপুটি করছে সারা মুখ জুড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠেছে ফোন। পাশের মোটা কাঁচ আটকানো কুতকুতে চোখে জিজ্ঞাসা। খানিক অন্যমনস্কে বলে ফেলছি কিছু ‘বেফাঁস’ কথা, অমনি উল্টোদিকের অফিসফেরত, পর্দার আড়ালে দৃষ্টি হানছে অন্দরমহলে। গোপনীয়তা খসে পড়ছে টুপ করে, খুচরো পয়সার মতো। তখন চোখ বুঝে দৃষ্টি ফেরাই ভেতরে। এক দল মুখর অথচ দুর্বোধ্য কথার মধ্যে বসে ভাবতে থাকি জানলার পাশে মুখোমুখি বসে থাকা সেই দম্পতির কথা, যাদের কথা ফুরিয়েছে একেবারেই। মনে পড়ে সেই অচেনা যুবতীর কথা। যার মুখের আদল এক লহমায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছিলো সেই রাজকন্যার কাছে যার হাসির জন্যে এককালে জান লড়িয়ে দিত একদল ‘সদ্যজাত যুবক’। স্মৃতির জ্বরে পুড়তে থাকা দুপুরে অচেনা সেই সহযাত্রী ছিল ভীষণ চেনা বনস্পতির ছায়া। সম্বিৎ ফেরে হকারের ডাকে।
চোখ মেলি জানলার বাইরে। মুখর শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। সূর্য তখন অবরোহনে। সান্ধ্য রেওয়াজে গলা সাধার জন্যে তৈরি হচ্ছে নিভে যাওয়া দিন। মদির বাতাস চোখে মুখে রাখছে আলতো হাত। ট্রেন পেরোচ্ছে প্রায়ান্ধকার এক স্টেশান। মাঠ ঘাট জুড়ে নামছে গোধুলি, কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে এক সিল্যুয়েট। সেই বসা আবহমানকালের। অবিকল শুভদীপদা। এ স্টেশানের কি নাম দেব, হৃদয়পুর?