অন্তেবাসী — ১৪তম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

একটা শব্দ। ঘুঙুরের হতে পারে আবার নাও পারে। তবে কীসের শব্দ বোধগম্যের বাইরেই ছিল তা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর শব্দটা যেন লাফাচ্ছে— এতেই বোঝা যাচ্ছে ছটফট করছে শব্দটা। যদি শব্দের লম্ফঝম্প অতিমাত্রায় হত তাহলে তো সকলের জেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু এমনই মৃদুলয়ে শব্দটা উঠে একসময় মিলিয়েও গেল। তারপর যেদিকেই তাকাই না কেন ঘরের আবছা আলোর মধ্যে ঠান্ডা বাতাসের চলাফেরা স্পষ্ট দেখতে দেখতে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

কিন্তু ঘুম ভেঙে উঠলেই প্রতিদিনকার পরিচিত জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করত। বোনকে দেখে রাখা থেকে শুরু করে কিছু কিছু হোমটাস্কও করতে হত। ওই একপাতা বাংলা হাতের লেখা, শূন্যস্থান পূরণ। মা মাঝেমধ্যে প্রচলিত শব্দের বাইরে শূন্যস্থানের জন্য বেছে নিত। যেমন ‘স’-এর পরে শূন্যস্থান, তারপর ‘র’। আমি সেখানে ‘হ’ বসিয়ে ‘সহর’ লিখেছিলাম। মা ‘হ’ কেটে ‘ফ’ করে দিয়ে মুখে বলেছিল শহর বানান তালব্য ‘শ’ দিয়ে হয়। আমার চোখমুখই বলে দিচ্ছিল এই শব্দটির অর্থ আমার জানা নেই। মাই বলে সফর মানে দেশভ্রমণ। এই যে আমরা দার্জিলিং যাব নানমাসির ওখানে, সেটাকে বলে দার্জিলিং সফর।

ও-নেগেটিভ নানমাসি তো থাকেন কোনও গির্জাতে। সেখানে কি গতরাতে ঘণ্টা বেজে উঠেছিল বলেই সেই ধ্বনি লাফাতে লাফাতে চলে এসেছিল এতদূর? যেহেতু পাহাড়ি পথ চড়াই-উৎরাই তো থাকবেই। কেন জানি না সেদিন মনেই হয়নি ভোকাট্টা ঘুড়ির মতন লাট খেতে খেতে শব্দের আসার কথা! কিন্তু তা হয়নি। শব্দটি কখনও হেঁটে, কখনও গড়িয়েই এসেছিল। একটা শব্দ যেন আরেকটির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। আর সেজন্যই নিস্তব্ধ ছিল চতুর্দিক।

–আমরা কবে যাব?

প্রশ্নের উত্তর পাইনি সেদিন। মা যে কখন উঠে গেছে বুঝতেই পারিনি। শুধু সফরের ‘ফ’ খাতার ওপর জ্বলজ্বল করছে।

অর্থাৎ পড়া শেষ, এবার যে নির্দিষ্ট কাজ অপেক্ষা করছে তা আমাকে করে যেতে হবে। বোন যাতে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের বর্গক্ষেত্রের বাইরে চলে না যায়। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রফলের ভিতরেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই কাজটি করা ভীষণ দুরূহ ছিল সেই বয়সে। তথাপি কাজটা করতাম চরম একাগ্রতায়। কেননা আমার পরের ভাইটি নেই– একেবারে শিশু অবস্থাতে বাতাসের রূপ ধরে অশুভ শক্তি তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বোনের জন্মের পর মা নাকি বিশ্বাসই করতে চায়নি ছেলে না মেয়ে হয়েছে– তাহলে ও ফিরল না! তারপর কাউকে উদ্দেশ করে নয়, ফিসফিস করে বলেছিল– এখনও বন্দি করে রেখেছে। তবে ও একদিন মুক্তি পেয়ে ফিরেও আসবে।

এ-কথা মনে পড়লেই বিছানার মধ্যেই একটা কাল্পনিক বৃত্ত তৈরি করে তার মধ্যে বোনকে স্বাধীনতা দিতাম হামাগুড়ি দেওয়ার। বোন কি সেই বৃত্তের মধ্যে ঘড়ির কাঁটার অনুসারে ঘুরত না বিপরীতে? তা মনে না থাকা সত্ত্বেও এখন বুঝতে পারি ঘুরন্ত বোনই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। এবং তা ঘূর্ণায়মান বিশ্বের স্থির বিন্দু। যেন ঘড়ির ভিতরে আটকে থাকা একজন।

তখনই প্রশ্ন ওঠে নিজেও কি এভাবে ঘুরতাম? এসব জানার কথা নয়। এ প্রশ্নের উত্তর যাঁরা দিতে পারতেন তারা আর নেই। তবে একটু বড় হয়ে আমার এক সাধক মামার সঙ্গে গিয়েছিলাম বালুরঘাটে সাহেবকাছারির হাটখোলায়। প্রথমে বিষয়টা ছিল একজন সাধক যাচ্ছেন আর এক সাধকের সাক্ষাৎ করতে। নিজে অবশ্য জানতাম না সেদিন সাধক মামা কোন দেবতার উপাসক। তিনি গত হওয়ার পরও কেউ জানতে পারেনি কোন সে দেবতা। কিন্তু হাটখোলায় এক বৃত্ত তৈরি করে তার মধ্যবিন্দুতে সেই সাধক লম্বা একটা দণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আর বৃত্তের সীমানা বরাবর শহুরে পাগল, আশপাশের গ্রামের পাগলরা। তাদের সাধক হুকুম দিলেই দৌঁড় শুরু করে দিত। বাড়ির লোকেরা এদের উপর নজর রাখার জন্য এদের পেছনে একপ্রকার ছুটত। বেচাল হলেই যেন বৃত্ত ভেঙে যাবে— তা হওয়ার অর্থই হল সব ভন্ডুল।

প্রথমে পাগলগুলো দৌড় শুরু করত ঘড়ির কাটা অনুযায়ী। সাধক মামার ভাষায় যা কিনা ক্লকওয়াইজ। এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎই নাকি বিন্দুতে দাঁড়ানো সাধক নির্দেশ দেবে অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরবার। সেই সময়টাই নাকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার সাধক মামা সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি পর্যন্ত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন। সেই মুহূর্ত আসলেই চিৎকার করে উঠতেন “এবারে শুরু হয়ে গেল অস্তিত্বের মহাপ্রলয়!”

সাধক মামার বিশ্বাস বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা সাধক আর সে নিজে ছাড়া কেউ জানে না পাগল যদি একবার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সে হয়ে ওঠে একজন মহাসাধক।

কিছুদিন পর সাধক মামাই জানিয়েছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই এক পাগল নাকি ছুটে গিয়ে বিন্দুতে দাঁড়ানো সাধককে গলা টিপে হত্যা করেছে।

এরপর সেই সাধক মামা বেশ কিছুদিনের জন্য মৌনব্রত নিয়েছিলেন। তা কতদিনের জন্য জানা নেই, কেননা তার মধ্যে আমরা বালুরঘাট থেকে চলে যাই। যখন আবার ফিরে আসি তখন তাঁকে একটি স্থানীয় ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়কারী সকল কর্মচারী হিসেবে পাই। তখন উনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন ‘অস্তিত্বের দেবতা’ কে জানাবার জন্য সময়ই খুঁজে পাননি।

অবশ্য সেসময় অস্তিত্ব কী বুঝতাম না। পরে বুঝেছি মানুষ নাকি ব্যস্ত অস্তিত্বের সন্ধানে। ততদিনে বুঝে গেছি এ ধরনের কোনও কিছুই খুঁজি না। যা খুঁজি তা হল বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা। তা কিন্তু একেবারে নির্ভেজাল বস্তুজীবন। সেই অভিজ্ঞতা অন্তর্গত অস্তিত্বের এবং বাস্তবের যুগলবন্দিতে অনুরণিত হয়ে পৌঁছে দেয় বেঁচে থাকার আনন্দে।

 

বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন কিছু একটা ছুড়ে ফেলে দিল। সেই শব্দেই বোনেরও বৃত্তের মধ্যে ঘূর্ণন প্রক্রিয়া থেমে গেল। শব্দটার পা টেনে টেনে চলার মধ্যেই মেজ মাসির হুঙ্কার— স্কুলে যাবি না মানে?

একসময় এই প্রশ্নটা মিহি বিলাপে পরিণত হয়ে দাঁড়ায়— সবই আমার কপাল!

ওই শব্দগুলো যেন কুণ্ডলি পাকানো স্প্রিঙের মতন ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে বাতিল পুতুলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। এ যেন এক নৈঃশব্দের গোলকধাঁধা।

টের পাচ্ছি বাড়ির ভিতরে চলাফেরার শব্দ। কেউ যখন কথা বলছে তা এতটাই ফিসফিসিয়ে যে মনে হতেই পারে বাতাসের শ্বাস উঠে গেছে আবার। তবে কি বেলুদির আবার শরীর খারাপ হল?

আমি শুধু এ-ঘর থেকে বাড়ির ভেতরে যাবার দরজায় ঝুলানো পর্দার দিকে নজর রাখছিলাম। যদিও পর্দার নিচে আলোর ফোটা ঝরে পড়ছে, কিন্তু পর্দার বাদবাকি অংশ অন্ধকার– ভয় করছিল। বোনকে আঁকড়ে ধরে সাহস খুঁজছিলাম।

ডাউন ট্রেন চলে গেছে অনেকক্ষণ। নিশ্চয়ই ভোঁ দিয়েছিল, শুনিনি। কিন্তু মেসোমশাই বাড়ি ফিরে আসতেই সবকিছু অন্যরকম হয়ে যায়। বাইরের রোদ, নীল আকাশ সবমিলিয়ে বুঝিয়ে দেয় আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে বাড়িটা। হলও তাই। মেসোমশাই ভিতরে ঢুকেই ‘ডলিরানি’ বলে ডাক দিয়ে ‘কী হয়েছে?’ বলতেই– ‘স্কুলে যাওয়া নিয়ে গন্ডগোল!’

–ও তাই! যেতে হবে স্কুলে। কাল তো হবে না। নান আসবেন বেলুকে দেখতে। পরশু হবে না, ওরা দার্জিলিং যাবে। ফিরে আসার পর স্কুলে যাবে।

ওরা মানে যে আমরা সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না। কিন্তু ডলিদি যখন বলে উঠল সেও যাবে, তখনই মেজমাসি হুঙ্কার দিয়ে ওঠে “না!”

মেসোমশাইয়ের এ বিষয়ে সমর্থন আছে চুপ করে থাকাতেই বোঝা যায়। কিন্তু মুখে বলে ‘মা তো একা দিদিকে সামলাতে পারবে না।’

আসলে মেজমাসি তার সংস্কার থেকেই যে কথাটা বলছে তা কিন্তু বুঝে গিয়েছিলাম সেদিন। মেজমাসি কিছুতেই গির্জাতে মেয়েকে রাত্রিবাস করতে দেবে না।

দার্জিলিং মানে মার কাছে সূর্যোদয় আর আমার কাছে ঘুম স্টেশন। এক আশ্চর্য রেলপথ!

পরবর্তীতে সেই রেলপথের যাত্রা নিয়ে যত ভেবেছি ততবারই মনে হয়েছে যেকোনও গোলকধাঁধার একটা বেরুবার পথ থাকেই। তা খুঁজে নিতে হয়। খুঁজে না পেলে তুমি সেখানেই আটকে যাবে।

এই আটকে যাওয়ার অর্থই হল বিশ্বের মহাসঙ্গীত থেকে দূরে সরে যাওয়া। তার ছন্দ নিজের শরীরের ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে না পারার আতঙ্ক। কেননা একা হয়ে যাওয়ার ভয়। সম্পূর্ণ একা!

 

আবার আগামী সংখ্যায়

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...