অথৈ জলে ভারত, হালে মাঝি নেই, আছে ছলনাময়

প্রতাপ ভানু মেহতা

 


সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর প্রাক্তন সভাপতির নিবন্ধটি “Where’s the leader?” শিরোনামে ৬ই জুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য রইল তার বাংলা ভাষান্তর। তর্জমা করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।

 

 

 

ভারতীয় প্রজাতন্ত্র এখন নেতৃত্বের সঙ্কটে ভুগছে। লক্ষ কোটি ভারতীয়দের আর্থিক দুর্গতি প্রকট। অতি কষ্টে যতটুকু দারিদ্র এত দিনে হ্রাস করা গেছিল, তা এখন বিশ বাঁও জলে। কোভিড অতিমারি এখনও তার চূড়ায় পৌঁছায়নি। গত কয়েক সপ্তাহে যা ঘটেছে, তার ভিত্তিতে এটুকু বলা যায়, যতটুকু প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ছিল, আমরা তার ধারেকাছেও নেই। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। এই মুহূর্তে সামরিক বাতাবরণও ক্রমশ প্রতিকূল হচ্ছে। চিন যে যুক্তির বলে ভারতকে তার নিজের জায়গা বোঝাতে চাইছে, কেউ জানে না তার শেষ কোথায়। স্পষ্টতই, ভারতের প্রত্যয় কতটা, তার পরীক্ষা নিচ্ছে চিন। এবং বর্তমানে ভারতের লক্ষ্যের সারকথা হল, ঘরেতে অপদস্থ হওয়া থেকে কীভাবে বাঁচা যায়। নেপালও যে স্পর্ধা দেখাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় আমাদের ক্ষমতা এবং কূটনৈতিক ঔদ্ধত্য কমছে। চিন দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে বটে। তবে ভারতও তার নিজস্ব উপায়ে ক্রমশ তার শক্তির আকর্ষণীয়তা হারাচ্ছে, কারণ তার বৃদ্ধি স্তব্ধ হতে বসেছে এবং তার গণতন্ত্রও আর তেমন উদাহরণযোগ্য নয়।

এই সঙ্কটগুলির মোকাবিলা করা সহজ নয়। কিন্তু তা আরও দুরূহ হয়েছে কারণ ভারতের শীর্ষস্থানে নেতৃত্বের অভাব। ভারতের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি এটাই যে সঙ্কট গভীরতর হলেও তা স্বীকার করা হয় না। সরকার সম্পূর্ণ সচেতন যে সঙ্কটের কোনও উপাদানের অস্তিত্ব যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে ভারত যে একজন শক্তসমর্থ নেতৃত্বের দ্বারা চালিত হয়ে নিজের ভবিতব্যের রূপ দেখবে— বৈধকরণের এই অতিকথার বেলুনটি তাহলে চুপসে যাবে। সোজাসাপটা কথাটা হল সাম্প্রতিক ইতিহাসে আজকের মতো এমন সময় কখনও আসেনি যখন নেতৃত্বের অভাবে ভারত এতটা বিধুর হয়েছে।

এর নির্দিষ্ট চিহ্ন হল এই সত্যিটা যে, সরকারের যাবতীয় শক্তি এখন প্রচার, মনোযোগভঙ্গ এবং দমনপদ্ধতির মাধ্যমে নেতার অতিকথাকে সংরক্ষণ করবার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হচ্ছে। চিন্তার সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন নেতাকেই করতে হয়। কিন্তু একজন শাসকের শাসন কায়েম রাখবার জন্য প্রচারমাত্রাকে শাসকের প্রকৃত ক্ষমতার বিপরীত অনুপাতে চালিয়ে যাওয়াটাই হয়তো যে কোনও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে একটি একটি বিচক্ষণ পথ। এই সরকার নেহেরুকে একজন অভিজাত বলে খারিজ করে দেয়। কিন্তু নেহেরু সেই অর্থে একজন প্রকৃত গণতান্ত্রিক ছিলেন, যার গুরুত্ব সর্বাধিক। তিনি কখনও মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে সন্দেহ করতেন না। নিজের কাজকে ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজনীয়তা এবং তার যুক্তিগুলিকেও তিনি ভুল বা ঠিক সাব্যস্ত করবার জন্য সবার সামনে রাখতেন। মোদি, যিনি নাকি মানুষদেরই মধ্যে থেকে উঠে আসা বলে এখন প্রতিপন্ন করেন, তিনি মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মানুষদের জন্য নয়। সবসময়ে এই পদ্ধতিতে কথা বলবার দরুন ওনাকে প্রশ্ন করা যায় না। তিনি গণতান্ত্রিক কথোপকথনের ঊর্ধ্বে, সাধারণ মানুষের যুক্তিবোধের ঊর্ধ্বে— তাদের অংশ নন। এই শাসক, এবং আমরা অনেকেই মনমোহন সিংকে তাঁর এড়িয়ে যাওয়া নীরবতা পালনের জন্য সমালোচনা করেছি, বিশেষ করে যখন জীর্ণ ইউপিএ-র মধ্যে দিয়ে এক ধনতান্ত্রিকতার উদ্ভব ঘটছিল। কিন্তু তর্কসাপেক্ষে হলেও বলতে হয় গত তিন দশকে ভারত আজকের মতো এমন সঙ্কট কখনও দেখেনি। সংক্ষিপ্ত কিছু আদ্যাক্ষর এবং অভিব্যক্তিহীন পর্ব ব্যতিরেকে আপনার কি সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন কোনও বক্তৃতা মনে পড়ে, যা সত্যিই আমাদের রাষ্ট্রকে উদ্দীপ্ত করেছে, সংহত করেছে এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তিবত্তার সাহায্যে বিষয় উপস্থাপনার মাধ্যমে এক ভবিষ্যরূপের ইঙ্গিত দিয়েছে? এই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকৃত এবং এড়িয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে ক্রমবর্ধিত নীরবতার ভার অন্য যে কোনও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি।

এই সমালোচনার ঝটিকা জবাবে অনেক সময়ে বলা হয়েছে এই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার এবং অবজ্ঞার পাত্র হন। এই অভিযোগে সত্যতা আছে। তবে বারবার এই যুক্তিজাল খাটিয়ে ওনার স্বার্থরক্ষার জন্য যদি বর্ম সাজাতে হয়, তাহলে তা নেতৃত্বের অভাবকে তুলে ধরে। ছয় বছর ধরে ঐতিহাসিক জনাদেশবলে, বাস্তবিক কোনও বিরোধিতার সম্মুখীন না হওয়া প্রধানমন্ত্রী যদি নিজেকে অবহেলার শিকার সাজিয়ে লোকসমক্ষে আসেন, তাহলে তা গভীর এক অসুরক্ষার চিহ্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়, যা নেতৃমনস্কতার সঙ্গে বেমানান। নতুবা একধরনের ছল, যা অবজ্ঞাসূচকভাবে অল্পমাত্রায় নিজেকে অপরাধী প্রতিপন্ন করে ভালোমানুষির অভিনয়ের মাধ্যমে কঠিন প্রশ্নগুলি আটকে দেয়। অর্থনীতি কীভাবে চালাব, প্রশ্ন করবে না। ভারতের সীমান্তকে আরও সুরক্ষিত করবার জন্য কৌশলগত উৎকর্ষ নিয়ে প্রশ্ন করবে না।

তবে আরও গভীরতায় গেলে আপনি ভাবতে পারেন সঙ্কট যেমন ব্যাপক আকার নিয়েছে, তাতে প্রকৃত নেতৃত্বের প্রথম কাজ হবে দেশকে সংহত করা। অথচ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অতিমারির আগে থেকে চলে আসা সাম্প্রদায়িকতা এবং কর্তৃত্ববাদকে কাজে লাগিয়ে বিভেদ সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত। সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের এই দুই উপায়ে যেভাবে অতিষ্ঠ করা চলছে, তা এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। যে আদর্শবাদী তরুণ ছাত্রছাত্রীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত ক্ষিপ্ত হয়ে, অতিমারির মধ্যেও এই সরকারের জন্য তাদের নিয়ন্ত্রণ করাটা বেশি জরুরি হয়ে উঠছে। সমাজে যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াক, তাতে পরোয়া নেই। আব্রাহাম লিঙ্কন বলতেন, প্রকৃত নেতা ভালভাবেই জানেন ঘর আলাদা হলে বাড়ি দাঁড়তে পারে না। আমাদের নেতা ভাগাভাগির প্রাসাদেই অবস্থান করেন।

এমনকি, অতিমারির সময়েও প্রধানমন্ত্রী দেশটাকে সংহত করতে পারলেন না। রাষ্ট্রের যাবতীয় শক্তি দিয়ে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার বদলে আমরা অদ্ভুত একটা ভাগাভাগির খেলায় মাতলাম। সবাই বুঝতে পেরেছেন অতিমারি অত্যন্ত কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। অধিকাংশ নাগরিকই এর মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য যতদূর হাত বারিয়ে দেওয়া সম্ভব, তা প্রসারিত করতে তৈরি ছিলেন। কিন্তু উল্টে আমরা কোভিড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটিকে বাধাহীনভাবে পতিত হতে দেখলাম। এর মূলে রয়েছে মানুষের ধারণাগুলিকে নিজের ইচ্ছেমত চালিত করবার এই সংস্কৃতি, যা শীর্ষে বসে থাকা অসুরক্ষিত নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন। তাই চ্যালঞ্জের গভীরতা সম্যক উপলব্ধি করার বদলে গুজরাট, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ সহ বহু রাজ্য বাস্তবের মুখোমুখি না হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পথ অনুসরণ করে নিজেদের ভাবপ্রতিমা সামলেছেন। লক্ষণ পরীক্ষা আটকে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন অন্য রাজ্যদের থেকে আমার রাজ্য ভালো আছে। আপনি হয়তো বা ভেবেছিলেন, ইতিমধ্যে বিনামূল্যে জনসাধারণের লক্ষণ পরীক্ষা চালু হয়ে যাবে, পরীক্ষার জন্য দাবী করা যাবে। রেশনের মতো পরিমিত সংখ্যায় বিতরণ করে নয়। বিজয় রুপানি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো রাজ্য নেতাদের দিকেও আঙুল তোলা উচিত, কেননা ওনারাও প্রধানমন্ত্রীর রীতি মেনেই কাজ করেছেন।

নেতৃত্বের সংস্কৃতি যে কতটা পাল্টে গেছে তা আপনি না ভেবে পারবেন না। আজ তা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে আগেকার দিনে নেতৃত্বের থেকে যা কিছু আশা করতেন মানুষ, আজ তা নেই। নেতৃত্বকে খাটো করতে করতে প্রধানমন্ত্রী আজ তাকে কোথায় টেনে এনে ফেলেছেন? বাস্তবের সামনাসামনি দাঁড়ানোর পরিবর্তে তা নস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। সমালোচনাকে উৎসাহ না দিয়ে তা দমন করা হচ্ছে। কৃতিত্ব নাও কিন্তু দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাও। সহমর্মিতাকে আপন করে না নিয়ে একধরনের ক্রুরতার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশিত করো। এবং রাষ্ট্রকে চ্যলেঞ্জের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত না করে, অনবরত তাকে বিভাজনের ফাঁদে ফেলো।

সমর্থকদের মনে প্রধানমন্ত্রী গভীর তোষণ উদ্রেক করেন। তবে ইতিমধ্যে এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত, যে তোষণই ওনাকে করা হোক না কেন, তা উনি নেতৃত্বদানের কারণে পাচ্ছেন না। ওনার নেতৃত্ব বলে কিছু আর নেই। সেই জায়গাটিতে মায়ার এক রাজনীতি স্থাপন করা হয়েছে। ভারত এখন অথৈ জলে গিয়ে পড়েছে, হালে মাঝি নেই, আছে ছলনাময়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...