সুমেরু থেকে অসম— করোনাকালে পরিবেশ-কথা

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


লেখক প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

 

যখন করোনার আবহে লকডাউন শুরু হল প্রথম, আমরা— পরিবেশ-‘বাদী’রা (পরিবেশ-‘বিদ’ নই) একেকজন রীতিমতো উল্লসিত হয়ে পড়েছিলাম। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে তখন রমরমিয়ে একেকটা উচ্ছাসের খবর ছড়িয়ে পড়ছে। ভেনিসের খালগুলিতে জল নাকি একেবারে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে পড়ায় তাতে নাকি রীতিমতো মাছ ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে। দুএকটি ডলফিনও নাকি সেই পরিষ্কার জলে সাঁতার কেটে ভেসে আসতে পেরেছে। ভিতরকণিকার সমুদ্রসৈকতে কত কোটি অলিভ রিডলে কচ্ছপ যেন ঝাঁক বেঁধে কত সহস্র কোটি ডিম পেড়ে রেখে গেছে। মেরিনড্রাইভের সমুদ্রে শুধু ডলফিন কেন, তিমি মাছ কিংবা নিদেনপক্ষে দু-একটি আস্ত অক্টোপাসও নিশ্চয় ভেসে আসতে পেরেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। খানিকটা ব্যঙ্গ করেই বললাম, অপরাধ নেবেন না। কিন্তু আজ আমার মনে পড়ছে, যেদিন আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে পঞ্জাবের জলন্ধর শহর থেকে অনেক দূরের শিবালিক হিমালয়কে দেখা গিয়েছিল, এক বান্ধবীকে অত্যুৎসাহে সেই খবরটা জানাতে গিয়ে কড়া ধমক খেয়েছিলাম। তার বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িতেই একজন সেদিন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।

আসলে, সবকিছুই সাময়িক। সমস্ত কিছুই। এমনকি করোনাও। কাজেই, করোনার আবহে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, পৃথিবী তার অসুখ সারিয়েছে— এমন একেকটা চিন্তায় সুখবিলাস করাটা বোধহয় উচিত হবে না। কেন উচিত হবে না? কিছু তথ্য দিয়ে বরং সত্যিটাকে যাচাই করে নিই চলুন। বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় সদ্যোপ্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে যে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের প্রভাবে পৃথিবীতে কার্বন-নিঃসরণ অনেকটাই কমতে পেরেছে, এ-কথা ঠিক। একেবারে সংখ্যার হিসেবে গেলে দেখা যাচ্ছে যে, এপ্রিল মাস অবধি পৃথিবীতে ২০২০ সালে, ২০১৯-এর তুলনায় ১৭ শতাংশ কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হয়েছে। তথ্যটিকে যদি আরেকটু ব্যাখ্যা করি— ২০১৯ সালে যেখানে গড়ে দিনপ্রতি ১০০ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হত, এপ্রিল ২০২০-তে সেই গড় নেমে দাঁড়িয়েছে দিনপ্রতি ৮৩ মিলিয়ন টনে। জায়গায় জায়গায়, দেশ-বিশেষে এই কমার পরিমাণ ২৬ শতাংশ অবধিও পরিলক্ষিত হয়েছে। গবেষকেরা তাঁদের পূর্বাভাসে জানাচ্ছেন যে, করোনা যদি বছরের মাঝামাঝি— অর্থাৎ আগামী দু-একমাসেও বিদায় নেয়, তাহলেও ২০২০-র শেষে গিয়ে ২০১৯-এর তুলনায় পৃথিবীতে ৪ শতাংশ কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হবে। আর করোনার জের যদি বছরের শেষ অবধি চলে, সেক্ষেত্রে ২০২০-র শেষে গিয়ে ২০১৯-এর তুলনায় পৃথিবীতে ৭ শতাংশ কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হবে। এই হ্রাস পাওয়ার হার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে দেখলে— সর্বোচ্চ। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কার্বন-নিঃসরণে এতখানি পতন পৃথিবী দেখেনি। শেষবার, ২০০৮-০৯-এ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০০৯ সালে ২০০৮-এর তুলনায় ১.৪ শতাংশ কার্বন-নিঃসরণ কমতে পেরেছিল। আর ঠিক তার পরের বছরই, মন্দার প্রকোপ একবার কাটতে শুরু করতেই, ২০১০ সালে, ২০০৯ সালের তুলনায় আবার ৫.১ শতাংশ বেশি কার্বন-নিঃসরণ পরিলক্ষিত হয়েছিল।

সমস্যাটা এইখানেই। আজকের পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে কার্বন-নিঃসরণ। কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দার চাপ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি যে সমস্ত আর্থিক প্যাকেজ বা পরিকল্পনা নেবার কথা ভাবছে, বা নিতে চলেছে— তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। আন্দাজ করা হচ্ছে যে, একবার কোভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হলে প্রাক-কোভিড সময়ের উৎপাদন ক্ষমতায় ফিরে যেতে পৃথিবীর লাগবে মোটে ছয় থেকে বারো সপ্তাহ। শুধু তাই নয়— ২০২০-তে কার্বন-নিঃসরণের হার ৪ শতাংশ বা ৭ শতাংশ কমলেও তাতে বড় রকমের স্বস্তির কোনও কারণ নেই। বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকাতে প্যারিস পরিবেশচুক্তি থেকে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছিল, (এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পরিবেশ পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ সংস্থা বা আইপিসিসি যে সূত্র বেঁধে দিয়েছিল), তাতে দেখা যাচ্ছে যে— বিশ্ব উষ্ণায়নকে ঠেকাতে গেলে শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে পৃথিবীর যে গড় তাপমাত্রা ছিল, কোনওভাবেই বর্তমান পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাকে সেই মানের ওপরে ১.৫ ডিগ্রির চাইতে বেশি আর বাড়তে দেওয়া চলবে না। ইতিমধ্যেই আমরা সেই মানের প্রায় ১ ডিগ্রি ওপরে পৌঁছিয়ে গেছি। কাজেই, হাতে আর ০.৫ ডিগ্রি মাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। আর তার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি খরার মধ্যে, অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাতের মধ্যে, অকল্পনীয় ঘূর্ণিঝড়গুলির মাধ্যমে।

কীভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিকে প্রভাবিত করে? খুব সহজ একটা উদাহরণের মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দেওয়া যায়। বিশ্ব উষ্ণায়ন হলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলবে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়বে, আর এর ফলে বাড়বে ঝড়ের সময়ে ধেয়ে আসা স্টর্ম সার্জ। জোয়ারের সময়ে যে স্বাভাবিক জলস্তর বৃদ্ধি ঘটে, ঝড়ের কারণে তারও ওপরে যে বৃদ্ধি তাকেই ভূগোলের পরিভাষাতে স্টর্ম সার্জ বলা হয়ে থাকে। এই স্টর্ম সার্জ যত বেশি হবে, তত বেশি করে নীচু জমির এলাকাগুলি সমুদ্রের জলের তলায় চলে যাবে। তার ফলে, সমুদ্রের লবণাক্ত জল ঢুকে পড়বার কারণে চাষজমিগুলি দীর্ঘমেয়াদে নষ্ট হয়ে যাবে। কতটা দীর্ঘমেয়াদি এই প্রভাব? ২০০৯ সালে আয়লার প্রভাবে যে সমস্ত জমি লবণাক্ত জলে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল, সেগুলিতে এখনও দুবছর কি একবছরও সম্পূর্ণ হয়নি আবার নতুন করে চাষ শুরু করার। কিছু জমি এখনও অনাবাদী পড়ে রয়েছে। সেই সমস্ত জায়গাতে আমফানের পর এখন আবারও, আরও ঘন হয়ে নেমে এসেছে অন্ধকার। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে ঝড়গুলির শক্তি বাড়ছে, বাড়ছে তাদের সর্বোচ্চ গতিবেগ। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন আগে প্রতি ১০০ বছরে মাত্র একবার যে সর্বোচ্চ শক্তির ঝড় তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এখন প্রতি ১০ বছরেই একবার করে সেই তীব্রতার ঝড় তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।

এখন, ২০২০-তে কার্বন-নিঃসরণের হার ৪% বা ৭% কমলেও তাতে বড় রকমের স্বস্তির কোনও কারণ নেই। কেন? তার উত্তর হচ্ছে, শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের গড় তাপমাত্রার থেকে বর্তমান পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাকে যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসও নীচে বেঁধে রাখতে হয় তাহলে, আগামী অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর ক্রমান্বয়ে কার্বন-নিঃসরণকে প্রতি বছরে ২.৭ শতাংশ হারে কমিয়ে আনতে হবে। আর যদি ১.৫ ডিগ্রির মাপকাঠিকে মেনে চলতে হয় তাহলে, আগামী অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর ক্রমান্বয়ে কার্বন-নিঃসরণকে প্রতি বছরে ৭.৬ শতাংশ হারে কমিয়ে আনতে হবে। আমরা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। পরিবেশ নীতি নিয়ে কোনও বড় রকমের পরিবর্তন কিন্তু আমাদের চোখে পড়ছে না। বরং কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে, কিভাবে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে ‘ঘুরে দাঁড়াব’ সেইটিই আমাদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর্থিক প্রগতি নিশ্চয় প্রয়োজন, কিন্তু পরিবেশের বিনিময়ে নয়। একথাটি বারবার বলেও আমাদের নমস্য রাষ্ট্রনায়কদেরকে সচেতন করা যাচ্ছে না। অবশ্য কোভিড-সময়েও একেকজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন ‘কেন মাস্ক পরব!’ বলে জনসমক্ষে হাত-পা ছড়িয়ে অভিমানে গাল বা ঠোঁট ফোলান, তখন সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দের থেকে জনস্বাস্থ্য অথবা পরিবেশ-সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে বুদ্ধিমান কোনও কিছু আশা করাটাই বোধহয় অবান্তর।

মুনাফার লোভে কতখানি নীচে নামতে পারে একেকজন? কোভিড-পরবর্তী সময়ের কথা দূরে থাকুক, এই কোভিড-সময়েও যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর সুমেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে একটি ভয়াবহ পরিবেশ-বিপর্যয় ঘটে যেতে পেরেছে, সেই সম্পর্কেই বা আজ কতজন ওয়াকিবহাল? কতগুলি খবরের চ্যানেলে অথবা খবরের কাগজের পাতায় সেই সংক্রান্ত খবর শিরোনামে এসেছে? গত ৩ জুন ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন রুশ সরকার, রাশিয়ার সুমেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছে। সুমেরুবৃত্তে অবস্থিত নরিলস্ক নামক একটি জায়গাতে, ‘নরিলস্ক নিকেল’ নামের রাশিয়ার একটি সুবৃহৎ খনন-কোম্পানির আওতায় থাকা একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। যার ফলে প্রায় কুড়ি হাজার টন খনিজ তেল সুমেরুবৃত্তের দিকে বয়ে যাওয়া আমবরনায়া নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম খবর পাওয়ার সময়েই, এই নদীটির প্রায় সতেরো কিলোমিটার দীর্ঘ একটি অববাহিকা অংশ জুড়ে এই তেল ছড়িয়ে পড়েছিল। আকাশ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, নদীর সর্পিল রেখাটি নীলাভর পরিবর্তে রক্তবর্ণ হয়ে ফুটে উঠেছে। এর কারণ হল ২৯ মে থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেল বেরিয়ে যেতে শুরু করলেও, মস্কোয় সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের কাছে সেই খবর পৌঁছোতে প্রায় দুই থেকে তিন দিন সময় লেগে গিয়েছিল, এবং তার পরেপরেই রাষ্ট্র জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ওয়াকিবহালজনেরা কি খানিকটা অদ্ভুতভাবে হলেও চেরনোবিলের সময়কার ঘটনাপ্রবাহের মিল পাচ্ছেন? সেই এক দেরি করে খবর পৌঁছোনো। সেই একইরকমভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিককে বলির পাঁঠা বানানোর প্রয়াস। কিন্তু, সংখ্যার হিসেব এটাই বলছে যে— রাশিয়ার ইতিহাসে এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম অয়েল-স্পিল বা খনিজ তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা। দীর্ঘ এই আমবরনায়া নদী অববাহিকায় যে দূর্মূল্য জীববৈচিত্র রয়েছে, কেবল নদীর মাছ বা জলজ বস্তু নয়— মনে রাখতে হবে দুপাশের সুমেরুবৃত্তীয় বনাঞ্চলের কথাও— সেই বিপুল বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির দায়িত্ব কার উপরে বর্তাবে? শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিকটবর্তী পিয়াসিনো হ্রদেরও একটি বড় অংশে এই তেল ছড়িয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে এই পিয়াসিনো হ্রদ থেকেই নির্গত হয়েছে পিয়াসিনো নদী। আমবরনায়া এবং পিয়াসিনো, দুটি নদীই শেষ অবধি সুমেরু মহাসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই দূষিত তেল যদি কোনওভাবে সুমেরু মহাসাগরকেও কলুষিত করতে সক্ষম হয়, ভেবে দেখুন কি বিপুল এবং আশ্চর্য একটি বাস্তুতন্ত্রকে আমরা আঘাত করলাম। বিশেষজ্ঞেরা মত পোষণ করেছেন যে, এই সুবৃহৎ অয়েল-স্পিলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, অর্থাৎ কিনা ছড়িয়ে পড়া তেলকে সম্পূর্ণ ছেঁকে তুলতে, অথবা কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্ত অঞ্চলকে দূষণমুক্ত করতে পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

কিছুদিন আগে, আমাদের দেশেও অসমের বাঘজান তৈলকূপে ভয়াবহ একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এখানেও, ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ আগেই নির্দিষ্ট তৈলকূপটি থেকে ক্রমাগত গ্যাস নির্গত হবার একাধিক অভিযোগ জমা পড়লেও, স্থানীয় প্রশাসন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটি কোনওরকম ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করে। অগ্নিকাণ্ড শুরু হলে বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনতে হয়। বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বন্যজন্তুদেরও প্রভূত ক্ষতি হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। ঘটনার পরে, সমাজকর্মী এবং পরিবেশ আন্দোলনকারীরা ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে এই মর্মে মামলা করেন যে একটি জাতীয় উদ্যানের (ডিব্রু সইকিয়া জাতীয় উদ্যান) মাঝে অবস্থান করা সত্ত্বেও কীভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাটি (যেটি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানও বটে) ওই তৈলক্ষেত্রে খননকার্য চালাবার পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছিল? আদালত সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে সংস্থাটিকে আপাতত ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ২৫ কোটি টাকা আদালতে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে। পরিবেশের ক্ষতিকে কি এভাবে আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে মেটানো যায়?

যে দুটি উদাহরণ দিলাম তাতেই বোধকরি স্পষ্ট যে, পরিবেশ সংক্রান্ত একেকটি জরুরি অবস্থাতেও আমাদের রাষ্ট্র বা বেসরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ববোধ কতখানি সীমিত, কতখানি অবিবেচক। সেখানে, বছরে দশমিকের হিসেবে কতটুকুনিই বা গড় তাপমাত্রা বাড়ল, তার ফলে সমুদ্রের জলস্তর কতখানিই বা উঠল অথবা নামল— আর তার ফলে কতগুলি গরীব মানুষের ঘরই বা ভেসে গেল, অথবা জমি নষ্ট হল— তাতে আর এই সমস্ত সাদা কলারের মানুষগুলোর কীই বা এসে যায় বলুন। অনেক দেশেই— ভারতের অনেকগুলি রাজ্যেও, এর মধ্যেই— লকডাউন পরবর্তী সময়ে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র দোহাই দিয়ে শ্রম-আইন যথেচ্ছ শিথিল করা হচ্ছে। আরও বেশি কাজ, আরও বেশি শ্রমদিবস— ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার, অথবা পরিবেশ নীতিতে কোনও বড়সড় বদল আনা তো দূরে থাক, একেকজন কেবল বিশ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল করে অথবা তাতে ট্যাক্স বসিয়েই খালাস। পরিকল্পনা যেন কেবল ‘পরিকল্পনা’র জন্যই। সেগুলির গুণমান বিচারে, উৎকর্ষ বিচারে ধেয়ান নেই কারও।

কার্বন-নিঃসরণের সঙ্গে সুমেরুবৃত্তের অয়েল-স্পিলের ঘটনাটির সম্পর্ক কোথায়, জানতে চান? বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই বিপুল পরিমাণ তেলের যে ভাঁড়ারটি অথবা ট্যাঙ্কটি ছিল, সেটি বসানো ছিল একটি পার্মাফ্রস্টের জমিতে। এই পার্মাফ্রস্ট অর্থে চিরতুষার অথবা চিরকঠিন তুষার-ভূমি, যা মেরু অঞ্চলগুলিতে দেখা যায়— এবং এই পার্মাফ্রস্ট বছরের কোনও সময়েই গলে না। সেই কারণেই এমন নামে ডাকা হয় তাকে। কিন্তু, এবছর— কার্বন-নিঃসরণ যতই কমে থাকুক, সুমেরুবৃত্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা রেকর্ড ছুঁয়েছে। বৃদ্ধির হার এতটাই যে, পার্মাফ্রস্টের জমিও গলতে শুরু করেছে, আর সেই গলে যাওয়ার কারণেই তেলের ট্যাঙ্কটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে এই বিপর্যয়। বিশ্ব উষ্ণায়ন হচ্ছে, এখনও হচ্ছে, আজও হচ্ছে। কার্বন-নিঃসরণকে দীর্ঘমেয়াদে, সফলতার সঙ্গে রোখা না গেলে ধ্বংস অনিবার্য।

ফুটনোট: শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সুমেরুবৃত্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে, চলতি জুন মাসেই। উল্লেখ্য, যে স্থানটিতে এই উষ্ণতাকে রেকর্ড করা হয়েছে— গড়ে তার শীতকালীন তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা দাঁড়ায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃদ্ধির হার প্রায় ১০০%। বিশ্ব উষ্ণায়নকে রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে সত্যিটাকে যে এবার সত্যি সত্যিই স্বীকার করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রনায়কেরা কি শুনছেন!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...