প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রসঙ্গ: সিজন এক, পর্ব ষোল
বিচ বিচ মে
আংটিটার পেছনে তে এত গল্প রয়েছে, তা কি ডাকুদা বা বেগুনিবাবু জানে? অনেকেই মনে করতে পারবেন না এরা কারা। এদের দিয়েই গল্প শুরু হয়েছিল। বনির কাছে একদিন আচমকাই এসে পড়ে আকাশি রঙের আংটিটা। কীভাবে? সে পরে বলা যাবেখন। বনি নিজেও জানে না এই আংটির উৎস। সে ওমানকে চেনে না। আদিনাথের খোঁজ জানে না। নামও জানে না। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে? জানে না বনি। শুধু ডাকুদা জানে বনির কাছে আছে জহরত। ডাকুদা বলেছে বেগুনিবাবুকে। এখন বনি ফেঁসে গেছে। তাকে ডাকুদার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। ডাকুদা তাকে নিয়ে যাবে বেগুনিবাবুর কাছে। বনি কী করবে এখন? বনি, ডাকুদা, বেগুনিবাবু— এদের বিস্তারিত পরিচয়ই বা কী? সে গল্পে আসছি। তবে মাঝে আরও একটা গল্প বলা দরকার।
সাতের দশকে নকশাল অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে কীভাবে আংটিটা জড়িয়ে ছিল, তা পাঠক জানেন এতক্ষণে। তারা এ-ও জানেন, এই আংটি আসলে এক ময়ালের পেট থেকে এসে পড়েছিল কাফ্রি কিশোর ওমানের হাতে। তারপর কীভাবে উনিশ শতকের কলকাতা ঘুরে, নীলবিদ্রোহের আগুন ছুঁয়ে সে আংটি সত্যেনের হাত ঘুরে আদিনাথের হাতে এসে পড়েছিল তা পাঠক জানেন। ওমানের বংশধর ছিল মোহন। ইন্দ্রকমল সিংহের হাত থেকে সে আংটি উঠে এসেছিল তার হাতে। জেমসনের সাহায্যে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে জমিদার পরিবারের মিথ্যের কাছে মাথা নোয়াল ওমানের পরিবার। আদিনাথ, নকশাল আদিনাথ, বিপ্লবী আদিনাথ, সেই মিথ্যেকে ব্যবহার করল। কেন? না সে মোহন-সত্যেনদের শ্রেণিকে মুক্তি দেবে। সেই আন্দোলনে সত্যেনের বিশ্বস্ততা তো কাজে লাগাতেই হত দলছুট রেনিগেড আদিনাথকে। সে যে তার কমরেডদের চেয়ে বেশি ভরসা করত সত্যেনকে।
কিন্তু এসবের মাঝে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল এই আংটিকে কেন্দ্র করে। সেই ঘটনা গড়িয়েছিল তিনটি দশকজুড়ে।
হেটফুল এইট
জন মাহাতো। পশ্চিম মেদিনীপুরের সদর হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এই ঠায় রোদের মধ্যে।
নিয়তি! নিয়তি!
আজ হয়তো একটু ভালমন্দ খাওয়া হত। দুটো পয়সা উপরি হত। নিজেকেই দোষ দিচ্ছে জন। অন্যের উপকার করার শখ তার আর গেল না।
হঠাৎ সে দেখতে পেল ফাদার আসছেন। আর সঙ্গে ওটা কে? দারোগাবাবু? নতুন দারোগা ইনি। আগে তো দেখেনি একে জন। শহরের বাবু। তবে এদেশি যে সেটা বোঝা যায় দেখে।
হন্তদন্ত হয়ে দুজনেই এগিয়ে এল জনের দিকে।
‘হোয়্যার ইজ দ্য গার্ল?’ ইংরেজিতে প্রশ্ন ছুড়ে দিল তরতাজা দারোগা।
ফাদার তাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল। নরেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েটা বেঁচে আছে?’
‘অ্যালাইভ অর ডেড… ওকে আমার চাই! বেঁচে থাকলে বেটার। শি ক্যান প্রোভাইড ইনফরমেশন।’ দারোগা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল।
ফাদার নরেনের দিকে তাকিয়েছিল। মাথা নিচু করে একটু হেসে দারোগার দিকে ফিরল তারপর।
ফাদারের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। রীতিমতো সুপুরুষ। চোখের নীল মণি দুটো যেমন সুন্দর, তেমনই তীক্ষ্ণ হতে জানে প্রয়োজনে।
‘আ পার্সন’স লাইফ অনলি ম্যাটারস টু ইউ, হোয়েন ইউ ক্যান টেক অ্যাডভান্টেজ অফ হার লিভিং! তাই তো, অফিসার?’
ঠান্ডা, শান্ত গলায় বললেন ফাদার।
দারোগার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল এতক্ষণ। এবার মুখটা লাল হয়ে গেল ভয়াবহ রাগে। গনগনে মুখে কেটে কেটে বলল দারোগা, ‘ফাদার লুইস, শি ইজ আ নটোরিয়াস ক্রিমিনাল। শি ইজ ওয়ান্টেড ইন আওয়ার লিস্ট। আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না, হাউ ডাজ হার লাইফ ম্যাটার টু ইউ?’
‘এভরিওয়ান’স লাইফ ম্যাটারস টু মি অফিসার।’ মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বলল ফাদার লুইস।
দারোগা ধৈর্য হারাল।
‘ড্যাম উইথ ইওর হিউম্যানিটারিয়ান ফিলজফি। আমার কাছে এসব বুলশিটের জন্য কোনও সময় নেই। লালবাজার থেকে টেলিগ্রাম এসেছে কালকেই। কমিশনার রেগুলার খোঁজ নিচ্ছেন। দ্য ম্যাটার ইজ গ্রেভ। শি ইজ নট ইওর গড’স ডিসিপিল ফাদার!’
হো হো করে হেসে উঠল ফাদার লুইস। ‘আই নেভার টোল্ড দ্যাট অফিসার। লেট’স কন্সিডার আমি নরেনকে এটা জিজ্ঞেস করছি আপনারই সুবিধের জন্য। শুধুশুধু পেশেন্স লুজ করবেন না।’
নরেনের দিকে আবার ফিরল ফাদার লুইস। ‘মেয়েটা কেমন আছে?’ ধীরে প্রশ্ন করল।
‘বেঁচে আছে ফাদার। গুলি লেগেছে।’
‘ইয়েস ইয়েস। একটা এনকাউন্টার হয়েছে। সেখান থেকে এসকেপ করেছে। হোয়্যার ইজ শি?’
‘আপনি কি শিওর এই মেয়েটাই সেই অ্যাবস্কন্ডিং রেবেল?’ ফাদার প্রশ্ন করল।
‘রেবেল?’ হেসে উঠলেন দারোগা। ‘শি ইজ আ লুম্পেন। এনিওয়ে, আমাদের কনস্টেবলকে যা জবানি দিয়েছে, তা থেকে আমি শিওর। কিন্তু আইডেন্টিফিকেশনের জন্য একবার দেখতে হবে আমাকে।’ এবার জনের দিকে চোখ সরু করে তাকাল দারোগা। ‘নাম বলেছিল? মেয়েছেলেটা?’
জন মাথা নাড়ল।
‘তোকে জেরা করব আমি। পালাবি না এখান থেকে। সময় মতো এত্তেলা দেব,’ দারোগা বলল জনকে।
‘ওকে তুইতোকারি করবেন না অফিসার।’ নরেনের হয়ে মুখ খুলল ফাদার। বেশ ধারলো গলায়। ‘হি ইজ এডুকেটেড এনাফ।’
‘তাও কাঠ কাটে?’ বিশ্রীভাবে হেসে উঠল দারোগা। ‘যাক গে, একবার এনকোয়ারি করতেই হবে ওকে।’
‘ও তো ওর জবানবন্দি দিয়েছে। আবার হেকল করবেন ওকে?’
‘হেকল করব কেন?’ খেঁকিয়ে উঠল দারোগা। ‘আপনাকে রিকোয়েস্ট, আমাদের রুটিন কাজ আটকে রেখে ট্রাবল ইনভাইট করবেন না।’
দারোগা আর কথা বাড়াল না। গটগট করে ঢুকে গেল হাসপাতালের ভেতরে।
একটু চিন্তিত দেখাল ফাদারকে। জনকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করবে ওরা?
এতক্ষণের উত্তপ্ত বাক্যালাপের নীরব দর্শক জন এবার মুখ খুলল।
‘আমাকে কি জেলে পুরবে?’
ফাদার হেসে বলল, ‘কেন জন? তুমি ডাকাত না খুনে?’
জনের কাঁধে হাত রাখল ফাদার লুইস।
জনের মাথায় ধাক্কা খাচ্ছে দারোগার প্রশ্নটা, ‘তাও কাঠ কাটে?’
না, এমনিতে সে কাঠ কাটে না। কিন্তু অন্য আরও নানা কাজ করে।
আজ সকালে কিছু অতিথি এসেছে হোমে। এই শীতে সন্ধে বা রাতের দিকে তাদের মতো সাহেবরাও আগুন পোহায়, তবে ঘরের ভেতর বসে। ঘরের দেওয়ালে একটা খোপ করা। সেখানে কাঠ জ্বালিয়ে বন্দোবস্ত হয়। সেই বন্দোবস্তের জন্যই জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়েছিল নরেন, ওরফে জন মাহাতো।
কাজ সেরে ফেরার পথে অভ্যেসবশত সে দু দণ্ড বিশ্রাম নেবে বলে বসে অশ্বত্থগাছটার নীচে। বিড়ি ধরাবে বলে।
ওইটুকু নিজের সময় জনের। ওইটুকু তার অতীতচারণের অবসর। ওইটুকু তার বর্তমান সম্পর্কে চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি।
ওইটুকু সময় সে জন নয়, নরেন মাহাতো।
তার দেশ-গাঁয়ের স্মৃতি। তার শৈশবের স্মৃতি। তার বন্ধুদের স্মৃতি।
যে বন্ধুরা তাকে আর বন্ধু ভাবে না।
বিরসা মুন্ডার নাম আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। বিরসা ভগবানকে সবাই মাথায় করে রাখত। চার্চে নিয়ে গিয়ে তাদের লোকজনদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছিল যখন, তখন থেকেই তার সমাজের লোকজন মিশনারির বাবুদের শত্রু ভেবে নিয়েছে। কিন্তু বিরসা ভগবান নরেনের ভগবান হলেন না। নরেন খ্রিস্টান হল তার বাবার ইচ্ছেয়। আর গোটা সমাজের কাছে সে হয়ে গেল দুশমন।
তখন ফাদার ছিলেন অন্য একজন। তিনিই বাইবেল পড়িয়েছেন নরেনকে। নরেনের কথাবার্তা মেজেঘষে শহুরে করেছেন। নরেন ইংরেজিও জানে। লিখতেপড়তে জানে।
শুধু সে এখনও জানে না ঠিক করে, বিরসা ভগবান কে? সে অন্য ভগবানকে চিনেছে ছোট থেকে? সেই ভগবান কি তার ভগবান?
এই যে নতুন ফাদার, ফাদার লুইস। সে অন্যরকম। আগের ফাদার ছিল কড়া। আবার স্নেহপ্রবণও। কিন্তু একুশ বছরের নরেন ওরফে জনের প্রতি স্নেহ কতটা আছে লুইসের, তা নরেন জানে না। নরেনকে এই ফাদারও বাইবেল পড়ায়। কিন্তু, নরেন বা নরেনদের দিয়ে কাঠ কাটানো, বাগান করানো, জঙ্গল সাফ করা— এসব কাজই বেশি করায় ফাদার। মাঝেমধ্যে নিজেও হাত লাগায় ওদের সঙ্গে। পড়াশোনা নিয়ে বেশি কথা বললে ম্লান হেসে এড়িয়ে যায় ফাদার। একদিন বাগান করার সময় দুম করে নরেনকে নরেন নামেই ডেকে ফেলল ফাদার লুইস।
‘এটাই তো তোমার আসল নাম, তাই না? আচ্ছা, তুমি বাইবেল কেন পড়ছ নরেন? তোমাদের নিজেদের হিস্ট্রি কেন পড়ো না তোমরা?’
নরেন ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে গিয়েছিল প্রশ্নটা শুনে।
উত্তরের অপেক্ষা না করে ম্লান হাসি হেসে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল ফাদার।
ফাদার লুইসকে নরেন বোঝে না।
এটুকু বোঝে, তাকে ফাদারের আশ্রয়েই থাকতে হবে। তার বন্ধুরা কেউ তাকে ফিরিয়ে নেবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে বিড়িটুকু পায়ের তলায় পিষল নরেন।
তার কুঠার কাঁধে সবে দু পা এগিয়েছে নরেন। হঠাৎ যেন তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কী একটা বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল চাপ চাপ রক্ত জমে জঙ্গলের মাটিতে।
রক্তের দাগ অনুসরণ করে চলতে শুরু করল নরেন।
কোনওভাবে রক্তের দাগ দুটো সমান্তরাল রেখা তৈরি করেছে। যার মানে দাঁড়ায়, রক্ত যেখান থেকে নির্গত হচ্ছে, অর্থাৎ কোনও জীবিত বা মৃত প্রাণীর দেহ— সেটিকে এই পথ ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জন্তুজানোয়ার হলে মাটিতে না ছুঁইয়েও একটা আস্ত প্রাণী টেনে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু এটা মানুষের কাজ বলেই মনে হচ্ছে। আর যা টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা-ও, খুব সম্ভবত, মানুষ।
বিস্ময় এবং আতঙ্কে অনুভব করল নরেন, রক্তের দাগ নেহাতই টাটকা!
কাছেই একটা শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ যাচ্ছে।
অর্থাৎ, যে বা যা এই দেহটাকে টেনে নিয়ে গেছে এই পথ দিয়ে, সে এখনও তার কাজ শেষ করেনি।
লাশটা এখনও টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!
কুঠারটা হাতে শক্ত করে ধরল নরেন।
সঙ্গে সঙ্গে খসখস আওয়াজটা দ্রুত হল।
কুঠারটা বাগিয়ে ধরে এগোতে গেল নরেন।
এবং অনুভব করল পায়ের শব্দটা দ্রুত এদিকেই আসছে।
কুঠারের বাঁটে নরেনের হাত শক্ত হয়ে চেপে বসল।
নরেন আবিষ্কার করল ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছে।
সামনের ঝোপটা নড়ে উঠতেই কুঠারটাকে শূন্যে বাগিয়ে ধরল নরেন, আর ঝোড়ো হাওয়ার মতো মানুষসমান একটা ছায়া যেন কুঠারসমেত নরেনকে সজোরে মাটিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
ধাতস্থ হতে একটু সময় নিল নরেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠল। কুঠারটা কোথায় ছিটকে পড়েছে…
আঁ… আঁ… আঁ…
একটা তীব্র গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে।
যেদিক থেকে ছায়ামূর্তিটা ধেয়ে এল, সেদিক থেকেই।
রক্তের দাগটা যে ঝোপের দিকে এগিয়েছে মাটিতে ঘষা খেয়ে… সেই দিকেই কেউ গোঙাচ্ছে।
নরেন কুঠারের চিন্তা ছেড়ে এগিয়ে গেল সেই ঝোপটার দিকে।
ঝোপটা অবধি পৌঁছে ওর চক্ষু চড়কগাছ।
একটি মেয়ে। বয়স আন্দাজ চব্বিশ-পঁচিশ। পরনের শাড়িটা আলুথালুভাবে জড়ানো শরীরে।
তার ঘাড়ের পাশ থেকে একটানা রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। নরেন একটু ঝুঁকে দেখল, ঘাড়ের নীচে, পিঠের ওপর একটা বিশ্রী ঘা। নরেনের আনাড়ি চোখেও মনে হল, গুলির জখম।
নরেন আরও একটু ঝুঁকল মুখটা দেখবে বলে।
সঙ্গে সঙ্গে মুখে, চোখের নীচে, একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল নরেন। এবং একই সঙ্গে চোয়ালে। আঘাতের জায়গাটা আন্দাজ করে সেখানে হাত দিল নরেন। আলগা রক্ত টের পেল সে।
বিস্ময়ে নরেন মেয়েটির দিকে তাকাল। এবার তার মুখ দেখতে পাচ্ছে নরেন। নরম মুখ। হিংস্রতায় ডগমগ করছে এখন। চোখের দৃষ্টি দেখে বাঘও ভয় পেত। আর তার হাতের নখ ছুরির মতো ধারালো। রাক্ষুসে ঢঙে সেই নখগুলো সে বাড়িয়ে রেখেছে নরেনের দিকে।
নরেন দু কদম পিছিয়ে এসে মুখ খুলল।
‘আমার কোনও বদ মতলব নেই। কাঠ কাটতে এসেছিলাম। রক্ত দেখে…’
নরেনের পুরো কথা শোনার অপেক্ষা না করেই মেয়েটা ঢলে পড়ল মাটিতে আবার।
মরে গেল?
মেয়েটার দিকে আবার এগোতে গিয়ে নরেন মনে করল তার মুখে সদ্য জখমের কথা। দূর থেকে আগে ভয় দেখাতে হবে। বুঝিয়ে বলতে হবে তারপর। তবে তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে হাসপাতালে।
আশপাশে খুঁজে খুঁজে কুঠারটা বের করল নরেন। একটা ঝোপের ভেতরে আটকে গিয়েছিল কুঠারটা।
কুঠারটা নিয়ে মেয়েটার কাছে এসে চমকে গেল নরেন।
এ কী! কোথায় গেল মেয়েটা?
হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল নরেন। এবং কীসে একটা হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল নরেন। হাতে চেপে ধরল কুঠারটা।
আবারও সেই হিংস্র চোখ। কিন্তু এখন অনেক দুর্বল।
নরেন বুঝল মেয়েটাই পায়ের এক ঝটকায় ফেলে দিয়েছে নরেনকে।
কিন্তু আর এই প্রতিরোধ বজায় রাখল না মেয়েটা। সে এবার সত্যিই জ্ঞান হারাল।
মেয়েটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলল নরেন। ডানহাতে শক্ত করে ধরা রইল কুঠার।
সময়টা বিশ শতকের শুরুর দিক। দেশজুড়ে মাঝেমধ্যেই আগুন জ্বলে উঠছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। খোদ কলকাতায় ইংরেজরা সন্ত্রস্ত। কখন কী হয়! কয়েকবছর আগেই আলিপুর বোমার মামলা দেখিয়ে দিয়েছে নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই সাহেবদের।
আপাতত পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে একটি ঘরে হ্যারিকেনের পাশে বসে রয়েছে পুরুলিয়া সদরের নতুন দারোগা অবনীমোহন ঘোষ আর ম্যাজিস্ট্রেট মহেশচন্দ্র সেন। অবনীমোহন তিরিশ ছুঁই ছুঁই। মহেশ সেন পঞ্চাশোর্ধ। ডাক্তার ঘনশ্যাম সরকার ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে। খাটে শুয়ে বছর চব্বিশের মেয়েটি।
মহেশ সেন প্রথম কথা বলল।
‘মিশনারির ছেলেটাকে ক্রস করেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার। হার্মলেস। ডাউট করার মতো কিছু নেই,’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল অবনীমোহন।
‘হুমম।’ গম্ভীর গলায় বলল মহেশ সেন। এবার ঘনশ্যাম সরকারের দিকে ফিরল মহেশ সেন।
‘মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে ডাক্তারবাবু। ওকে নিয়ে অনেকটা জার্নি করতে হবে।’
অবনীমোহন উৎসুক হল।
‘জার্নি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায় নিয়ে যাবেন স্যার ওকে?’
‘কলকাতা।’
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালেন মহেশ সেন।
এরপর আগামী সংখ্যায়