হিশাম বুস্তানি
তর্জমা: অমর মিত্র
হিশাম বুস্তানির জন্ম ১৯৭৫ সালে। জর্ডনের কবি এবং ছোটগল্পের শিল্পী। তিনি সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। আরবি ভাষায় লেখেন। ওই দেশের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত। এই গল্পটি ইংরেজি থেকে অনূদিত। তাঁর কবিতা এবং গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তাঁর সঙ্গে অনুবাদকের পরিচয় ও বন্ধুতা হয়েছিল কাজাখস্থানে এশীয় লেখক সম্মেলনে। বাংলায় গল্পটির নাম অনুবাদকের দেওয়া।
পেশাদার এক খুনি তোমার মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে। থেঁতলে যাওয়া মাথা থেকে রক্ত বেরিয়েই আসছে। বন্ধ হচ্ছে না।
তোমার মস্তিষ্কের শ্বেত পদার্থ ঐ ক্ষতস্থান দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে এসে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরছিল।
এসো, আমার পাশে ঘুমাও, আমি তোমার দেহের সেইসব কালসিটের দাগ যা লোহার রড দিয়ে আঘাত করে হয়েছে, তা মুছে দেব। কালাশিনকভ বুলেটে তোমার চোখে যে দুটি গহ্বর তৈরি হয়েছে, তা বুজিয়ে দেব আমি। আমি আমার দেহের মাংস দিয়ে একটি বালিশ তৈরি করে দেব তোমার ক্লান্ত এবং বিক্ষত দেহের জন্য।
আমি কি বধির, অথবা আমি তোমার আর্তনাদ শুনতে পাইনি? তুমি হয়ত সেই আর্তনাদ গিলে নিয়েছ। তুমি হয়ত তোমার জিভও গিলে নিয়েছ। আমাকে বলতেই পারো, তুমিই নিজেকে ঐ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নিয়ে গেছ। তুমি আমাকে বলতে পারো তুমি হাড় মড়মড় শব্দ শুনতে পাচ্ছিলে না, একটার পর একটা হাড় মটমট করে ভেঙে যাচ্ছিল। তুমি আমাকে বলো, তুমি সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাওনি, “ওর মাথায়…”।
এই পৃথিবীটি এখন ক্রীতদাস এক ঈশ্বরের সৃষ্ট কতগুলি গলিত পতিত প্রাণীর দখলে চলে গেছে। ঈশ্বর যে কিনা আর এক ক্রীতদাস ঈশ্বরের ক্রীতদাস, এবং এইভাবে চলতে থাকে দাসত্বের শৃঙ্খল, ক্রমাগত সীমাহীন দাসত্বে পরিণত হয়, হয়ে যায়, যায়। সীমাহীনতায় যেতে, হ্যাঁ, এর একটি শেষ আছে, এক অন্তিমে থামতে হবে: আমি আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত আমার দাঁতের পাটির উপর রেখে ক্রমাগত চাপ দিতে দিতে বিস্ফারিত হয়ে যাব, এবং একটি শীতল, নীল কলোসাসের মতো বৃহৎ হয়ে পায়ের নিচের সমস্ত দূষিত, গলিত সত্তাকে পিষে দিতে থাকব। আমার দৃষ্টির পরিধির ভিতরে, অ্যাসিডের প্রতিটি বিন্দু পায়ের নিচে মুছে দেব। তোমরা সকলে তার ভিতরে মিশে যাবে। বাষ্প হয়ে যাবে।
তোমাদের মৃত্যুকে মুখরিত করতে আমি একটি গ্লাস তুলে ধরব, উল্লাস। আমি নিঃসঙ্গ হয়ে একটি শূন্য গ্রহে বসে থাকব, যে গ্রহ আমার মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সেই মৃত্যু কখনওই এসে পৌঁছবে না।
জীবন একটি গ্রাফিক নভেল নয়। ঔপন্যাসিক আমার জন্য কিংবা তোমার জন্য অন্য কোনও ভবিষ্যৎ খুঁজে বের করতে পারবে না। এই খণ্ড খণ্ড দেহ আমার সামনে কোনও কাগজের উপর রাসায়নিকে সংরক্ষণ করে রাখা নেই যে জীবন্ত করে তোলা হবে যখন প্রয়োজন হবে। তারপরে ধুলোয় ভরা কোনও তাকে ফেরত রাখা হবে পঠনের শেষে যেমন হয়।
আমার সামনে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হচ্ছে না। যে ইটের খণ্ড তোমার মাথাকে চূর্ণ করেছে (হাড় ভেঙে ফেলা ইট, ইট ভেঙে ফেলা হাড়) তা আমার মাথার চারপাশে ঘুরছে— দ্রুত ঘুরছে, ধীরে ঘুরছে, বিপরীতে ঘুরছে। আমি মোচড় দিতে, ঝাঁকুনি দিয়ে বিছানায় একটি দেহ যেমন ঘুরে যায়, তেমনি যেতেই একটি লোহার দণ্ডের ঘা লাগে এবং ইটের আঘাতে বিক্ষত মুণ্ডের মতো বিস্ফোরিত হয়ে যায়।
হত্যাকারীর মুখমণ্ডলে আলো
বত্রিশ বছর বয়স আমার। আমি বিবাহিত। আমার তিনটি সন্তান, দুই কন্যা এবং এক পুত্র। আমি আমার গ্রামের বাড়ির বাগানের যত্ন নিই। প্রতি সন্ধ্যায় দেখতে গিয়ে আমি আমার মায়ের হাতে চুম্বন করি। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, বলেন, “ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন পুত্র।” স্ত্রীর সঙ্গে সপ্তাহে তিনবার আমি মিলিত হই। মাঝেমধ্যে আমি তার সঙ্গে তর্ক করি। কিন্তু আমি তাকে রেগে থাকতে দিই না দুদিনের বেশি। তার পছন্দের মিষ্টি কিনে এনে মানভঞ্জন করি।
আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। নিয়মিত মাসমাইনে, স্বাস্থ্যবিমা, নানা সুবিধা এবং সম্মান এসেছিল। আমি আমার জীবনে কখনও যুদ্ধে যাইনি। আমার জন্মের পর থেকে সীমান্ত শান্ত। বহু বছরের জন্য শান্ত ছিল। একমাত্র যে যুদ্ধ আমি দেখেছি তা অন্তর্গত। একটি ক্যান্সার-টিউমারকে অপসারণ করার যুদ্ধ, সেই প্যারাসাইট যা কিনা তার ক্রমাগত ভক্ষণ বন্ধ করে না, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধ যা আমাদের সমাজকে আমরা ও তাহারা, দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। এইগুলি অসুখ। এবং আমরাই এই অসুখের নিরাময় সম্ভব করতে পারি।
এলাকাটিকে যখন পরিষ্কার করা হচ্ছিল, তারা যুবকটিকে ধরে ফেলে একটি গুদামঘরে। সে ছিল তাদের ভিতরে একজন, সে তার অস্ত্র লুকিয়ে রাখছিল। আমার পক্ষের এক যুবক একটি লোহার রড দুহাতে ধরে তা ঘুরাতে থাকে বনবন করে। সেই যুবকটি দুহাত দিয়ে মাথা ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুচড়ে যেতে থাকে। সে আর্তনাদ করেনি। শান্ত গলায় সে অনুনয় করে আমাদের কাছে, দয়া করো, থামো। স্নায়ুতে চাপ পড়ছিল!
দু মিনিট কিংবা তার সামান্য কিছু বেশি সময় ধরে আঘাত চলতে থাকে, আমার অত মনে নেই। আমি তখন একটি ইট তুলে নিয়ে সেই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি যখন তার মাথাটি দু হাতের আড়াল থেকে মুক্ত হবে আর আমি ইটটি তার রক্তাক্ত মাথার উপরে ফেলে দেব। তখন সেই দেহটির মোচড়ানো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সে নিথর হয়ে যায়, কিন্তু লোহার রডটি ঘোরাতেই থাকে আমার প্রতিনিধি যুবকটি তখনও। আমি আর একটি ইট তুলে নিয়ে তার মাথায় আবার আঘাত করলাম। ইট এবং তার মাথা, দুইই চূর্ণ হয়ে গেল। একজন এসে তাকে গুলি করল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি স্বাধীনতা চাও?”
“আচ্ছা, তুমি এখন স্বাধীন।”
সে উত্তর দিল না। মৃত্যুর পরও সে উদ্ধত ছিল তেমনি।
মৃতের মুখের উপর আলো
আমি আগাগোড়াই শীর্ণকায়। আমার বন্ধুরা এই নিয়ে মজা করত, কখনও আমার মা-ও। আমি খেতাম অনেক। বারবার খেতাম, কিন্তু ওজন বাড়ত না। আমি ওইভাবেই বড় হয়েছি, ওইরকম ছিলাম, ছায়ার মতো প্রায় যতদিন না তারা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে তাদের কাজ শুরু করে। আমরা পরস্পর ফিসফিস করে কথা বললেও তারা গর্জন করে আমাদের আতঙ্কিত করত। যখন সৈন্যরা এল, প্রতিবাদীরা গুনগুন করতে লাগল, “সেনাবাহিনী মার্চ শান্তির জন্য টহলে নেমেছে।” কিন্তু তাদের উপর বুলেট বর্ষিত হতে থাকে।
যখন আমার প্রতিবেশীর পুত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল, আমি সেখানে ছিলাম। রাস্তার মাঝখানে সে পড়ে থাকল তিন ঘন্টার মতো। রক্তস্রোত বেরিয়ে আসছিল তার গুলিবিদ্ধ দেহ থেকে। যদি কেউ তার কাছাকাছি যেতে চাইত, তার কপালে একটি বুলেটই ছিল। এইভাবেই দুজন নিহত হয়েছিল। কপালে বুলেট বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তৃতীয় কেউ ছিল না সেখানে।
ওই ঘটনার পর কেউই আর বীরত্ব দেখাতে যায়নি। আমরা দেখছিলাম রক্তের পুকুর ক্রমশ গড়ে উঠছে। তার আর্তনাদ ক্রমশ আবছা হয়ে আসে যতক্ষণ না সে নিথর হয়ে যায়। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করব। লড়াই।
নতুন এই পথে আমি অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষ, ঠগ এবং আরও অনেক মানুষ যারা আমার মতো অপমানিত ও তিক্ত জীবন যাপন করছে, তাদের দেখেছি। শীর্ণকায় মানুষ যারা তাদের মায়ের কোল থেকে উঠে এসেছিল, তাদের দেখেছি।
এটা আমার কাছে কিছুই না। গলা অবধি ডুবে আছি যখন, ভিজে যাওয়া আমার কাছে কিছুই না। সেনাবাহিনীর একটি রাইফেল আমি চুরি করতে পেরেছিলাম, সেইটি আমার সঙ্গে রয়েছে। যখন আমি রাইফেলে গুলি ভরেছিলাম, আমার শরীর আচমকা বিস্ফারিত হয়েছিল। আমি হেঁটে যেতাম যখন মানুষ টের পেত। আমি অনুভব করতাম, পৃথিবী সামান্য কেঁপে উঠল আমার দৃপ্ত পদক্ষেপে। কিন্তু যখন ওরা একটি শূন্য গুদাম ঘরটিতে আমাকে ধরে ফেলল, আমি আবার সেই শীর্ণকায় বালক হয়ে গিয়েছিলাম, সেই বালক যাকে নিয়ে তার বন্ধুরা উপহাস করত। সেই লাজুক, মুখচোরা বালক যে কিনা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকত মাটির দিকে।
আমি ওদের কাউকে চিনতাম না। ওরাও আমাকে চিনত না। কিন্তু ওরা লোহার রড দিয়ে আমাকে মারল এমন যেন আমি ওদের মাকে ধর্ষণ করেছি।
ওদের মা, স্বাধীনতা।
আমার মা, স্বাধীনতা।
মায়ের ধর্ষণ, স্বাধীনতা।
ওরা মারতেই লাগল। আমার এক মা ছিল, যে আমাকে খাওয়াতে চাইত যাতে আমার ওজন বাড়ে। মা চাইত আমাকে বিয়ে দিতে, যাতে মা তার নাতি-নাতনির ঠাকুমা হয়ে যেতে পারে। ওরা আঘাত করে যেতেই লাগল। লোহার রড হাতে মানুষ আমার হাড় ভেঙে দিয়েছিল, আমার হাড়ের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল হিম স্রোত। ওরা আঘাত করেই যাচ্ছিল।
ভয়ানক যন্ত্রণায়ও আমি আর্তনাদ করিনি। মনে করুন, আমি আবার শীর্ণকায়, আমি আবার সেই দিনে ফিরে এসেছি যখন আমরা ফিসফিস শব্দকেও ভয় পেতাম, এমন কি নিজেদের ভিতর ফিসফিসও। এখন সব কিছুই সুন্দর। কোনও অভিযোগ নেই। আমি আর্তনাদ করছি না। যন্ত্রণায় নিঃশব্দে ফেটে পড়ছি।
আমার পিঠে একটি মুষ্ঠাঘাত পড়েছিল যে তা আমি ভালোই মনে করতে পারি। সেই আকস্মিক আঘাত আমার হাত দুটিকে সরিয়ে দিল মাথা থেকে। তারপর। মস্ত এক কংক্রিট বুট যেন নেমে এল বজ্রপাতের ঝলকে, গতিতে। পাথরের বজ্রপাত, তারপর আমি কিছুই মনে করতে পারলাম না। আমি আর নেই।
ডাঃ ম্যানহাটানের ডায়েরির শেষ পাতা
আমার ভুল হয়েছিল। আমি, সেই ঠান্ডা মাথার মানুষটির কোনও ভুল হয়নি। আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল যখন আমি রোরচাককে হত্যা করি। সে ছিল আমার বিবেক। আমার শান্ত মনের বিবেক। আমার সত্তার পরমাণুগুলি সন্নিবদ্ধ হয়েছিল কোয়ান্টাম ফিজিক্স অনুসারে। পরিকল্পনাগুলির কঠোরতা সত্ত্বেও আমার মন পৃথিবীটিকে এর ভিতরেই ধরে রেখেছিল। সেই মন পরিকল্পনায় স্থির ছিল যতক্ষণ না সমস্ত কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনায়, ব্যাহত হতে থাকে। তারপর সব কিছুই যেন সোফার এক ধারে রেখে আমি চলে এসেছিলাম। সেই পৃথিবীই আমি। আমার শয়তান সত্তা। সেই সত্তাকে আমি কখনওই দেখতে চাইনি যতক্ষণ না সেই হত্যাকাণ্ডের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে: ঠিক এই বছরের শেষ দিনের রাত বারোটা, সামনের বছরের প্রথম দিন। আমি সেই মস্ত পাথরটিকে ছুড়ে দিয়ে নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে, নক্ষত্রদের বিস্ফোরণের ভিতর অনিঃশেষ অনিদ্রায় ডুবে গিয়েছিলাম।