হিন্দোল ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
একজন লোক ধরা যাক যেমন কথা বলে কাঁদে, তেমন কথা বলেই হাসে, তেমন ভাবেই হেমন্তে তাঁর অনুভূতিমালার কথা বলেন, আবার তেমন ভাবেই ঝড়বৃষ্টির সময়ে তাঁর কথাবার্তা চলে, এ কি সম্ভব? সম্ভব না। স্বাভাবিক ভাবেই সম্ভব না, কারণ কথা বলার বা ভাষার মৌলিক ভিত্তিই হল তা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে এবং ভিন্ন ভিন্ন মনের অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। আর সে কারণেই ভাষা বিষয়টি এত জীবন্ত, এত বৈচিত্রপূর্ণ। কেন হঠাৎ বলতে শুরু করলাম, তা অবশ্যই মনে হচ্ছে আপনাদের, যাঁরা পড়ছেন। যেহেতু বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার মতো এক অসম্ভব কাজটি করার চেষ্টা করি, তাই, শুরু থেকেই নানা স্কুলিং-এর অগ্রজ, সমকালীন এবং পরবর্তীকালীন বেশ কিছু কবি এবং লেখকের চাপিয়ে দেওয়া ভাবনার সম্মুখীন হতেই হয়। আর যেহেতু এই সব ভাবনাগুলি অনেকটা ব্যাটনের মতো, তাই একজনের কাছ থেকে আরেকজন নিয়ে একটা গুরুবাদী ঐতিহ্যের সৃষ্টি করে এই বাংলা ভাষায়। আর সেই গুরুবাদী বচনের একটি হল, একটি নির্দিষ্ট ভাষা তৈরি করতেই হবে একজন কবির। হতেই পারে কোনও কোনও কবি এই নির্দিষ্ট ভাষা গড়ে তুললেন আবার এও হতে পারে, কোনও কোনও কবি স্রেফ নিজেকে ছেড়ে দিলেন, আত্মসমর্পণ করলেন অনুভূতিমালার প্রবাহের কাছে। কারণ একটি সৃষ্টিকে সম্পাদনা করার বিষয়টি বুঝতে পারি, কিন্তু নিজস্ব অনুভূতিমালাকে সম্পাদনা করার বিষয়টি বুঝতে পারি না। আমার যদি প্রবল বৃষ্টির মধ্যে মন্দাক্রান্তা ছন্দে কোনও কবিতাগুচ্ছ আসে, নিজে থেকেই আসে, তবে কি সেখানে আমার সিগনেচারের অপেক্ষায় আমি বসে থাকব? লিখব না? কবি তো স্বয়ং প্রকৃতির মতো। প্রকৃতির কাছ থেকে অসম্পাদিত, অনিঃশেষ, মাঝপথে শুরু হয়ে মাঝপথে শেষ হয়ে যাওয়া অনুভূতিমালাকে ভাষা দিচ্ছেন তিনি। ফলে, আমার মনে হয়, ভাষাও একপ্রকার আঙ্গিকমাত্র, যা, জায়মান, নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং অপ্রত্যাশিত। ইংরিজিতে যাকে বলে আনপ্রেডিক্টেবল। একজন শিল্পী বা একজন কবি যদি ভাষাব্যবহারে প্রেডিক্টেবল হয়ে পড়েন, তবে তো তিনি মৃত। তবে তো তিনি একটা নির্দিষ্টি প্রোগ্রামিং-এ সাজানো হার্ড ডিস্ক মাত্র, যেখানে অনুভূতিমালার তথ্য ঢুকে বেরিয়ে আসছে চেনা আকৃতির সুন্দর সুন্দর কবিতায়।
এইখানে এসে আমি ধাক্কা খাই এইসব ভাবনাগুলির কাছে। আমার কিছুতেই মনে হয় না, আমার প্রধান দায়িত্ব আমার নির্দিষ্ট একটি সিগনেচার তৈরি করা। আমি কে ভাই? যদি বা আমি নিজের জন্য একটা সিগনেচার ভাষা তৈরিও করি, তাহলেও যদি সেই শিল্পে, সেই কাব্যে বলার মতো কিছু না থাকে, দেওয়ার মতো কিছু না থাকে, তাহলে তো তা থাকবেও না। সেখানে শুধু পড়ে থাকবে যোগব্যায়ামের মতো নিজেকে নিয়ে মারপ্যাঁচ কষা ‘আমি’। আমার কবিতা থেকে তখন হালুম হালুম করবে শুধু আমার ফসিল। গোঁ গোঁ করবে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়া কফিন। ভাষার কঙ্কালের মতো হাহাকারের মতো শব্দ করবে হাওয়া, যা প্রাণ নয়। পরবর্তীকালের পাঠক বুঝবে, এই লেখক নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এতটাই ব্যস্ত ছিলেন, যে চোখ তুলে তাকাননি পর্যন্ত।
কবি পরিবর্তনশীল। তিনি সৈকতের মতো। নিজেকে বারবার ভাঙেন, গড়েন, ছেঁড়েন। ব্যক্তিত্ব কেবলমাত্র তাঁর ভাষা নয়। ব্যক্তিত্ব, ভাষার মাধ্যমে এক যোগসূত্র। যা তিনি তাঁর ভাবনায় রেখেছেন এক গোপন কুঠুরির মতো। তার হদিশ কেউ পাবেনা। সেই ব্যক্তিত্বের আঁচ পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই ব্যক্তিত্ব কোথায় বসে আছেন, তার কাছে কেউ পৌঁছতে পারবেন না। আন্দাজ করতে পারবেন শুধু। সেই ব্যক্তিত্ব বা পারসোনার রসায়নটি হয় তাঁর ভাষার কায়দায় নয়, সিনট্যাক্সের নির্দিষ্ট ছাঁচে নয়, বরং ভাবনার মধ্যে। কবির ব্যক্তিত্ব নিহিত থাকে একটি মৌলিক প্রশ্নের মধ্যে। আর সেই মৌলিক প্রশ্নটি হল, কেন আমি কবিতাই লিখছি! কবিতা না লিখে আমি যদি শেয়ারবাজারের ব্রোকার হতাম তবে তো ভাল থাকতাম। জীবনের যে যে বিষয়গুলি পেলে জীবনে আনন্দ পাওয়া যায়, তার অনেককিছুই তো পেলাম না। পাগলের মতো কবিতার দিকে ছুটে গেলাম। এই যে একজন কবি ছুটে চলেছেন, তাঁর নিজের কি বিরক্তি আসছে না? আসছে তো। রাতের নিভৃতিতে নিজের মনের মধ্যে প্রশ্ন আসছে, আমি কি সত্যিই কিছু লিখতে পারলাম যা সময়ের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে যাবে না? হারিয়ে যাবে না? আমার কবিতা পড়ে কি লোকে ‘আমার’ বলে চিহ্নিত করতে পারছেন? না কি হাজারো কবিতার ভিড়ের মধ্যে তা হারিয়ে যাচ্ছে? আমার কণ্ঠস্বর কি পাওয়া যাচ্ছে আমার লেখায়?
এইখানে এসেই তো আসল প্রশ্ন। তবে কি আমার লেখায় সেই কন্ঠস্বর আছে, যা অনেকের মধ্যে আমাকে বিশেষ বলে চিহ্নিত করতে পারে? কিন্তু এই কণ্ঠস্বর কি তবে শুধুই ভাষার ব্যবহারের অভিনবত্বে? না কি ভাষা ও ভাবনার অভিনব ব্যক্তিত্বে? আমি কীভাবে খুঁজছি, তার ধারাবাহিকতায়? আমি কেন খুঁজছি তার গভীর প্রশ্নে? না কি কেন কবিতা লেখা ছাড়া আমার ভাবনার আর অন্য কোনও আত্মপ্রকাশের উপায় সম্ভব ছিল না, সে সম্পর্কে নিজের কাছে স্পষ্টতায়?
প্রশ্ন হল, এত সব ভেবে কেউ আত্মব্যক্তিত্ব স্থাপন করতে পারে না লেখায়। আত্মব্যক্তিত্ব, যাকে পারসোনা বলা যায়, তা লেখকের ভাবনার মধ্যে, দৃষ্টির মধ্যেই এবং ‘দর্শন’-এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। এই দেখা এবং ভাবার ভাষাটিই আসল। সেই ভাষাটিও একপ্রকার মাধ্যম, যা আদতে কী ভাবছি, কাকে ভাবছি এবং কেন ভাবছি, তার উপর নির্ভরশীল।
এ জন্যই ভাষা এতটা জায়মান। তাকে যদি একটা নির্দিষ্ট খাঁচায়, একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে, আমার আয়নার প্রতিফলনের মতো রুদ্ধ করে তুলতে যাই, তাহলে, আদৌ তা মনের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে তো? সে কি জীবন্ত হবে, না হবে একটি বোবা পুতুল?
এইখানে এসে মনটা থমকে যায়। মনে হয় কেউ ছোট ঘরে, অথবা কেউ বড় ঘরে বন্দী। কিন্তু বন্দী সকলেই।
(ক্রমশ)
খুব সুন্দর,,,,
ভালো লাগলো
অসম্ভব গভীরতা আছে লেখাটিতে….. এতো সহজ করে এমন ইন্টেন্স একটা স্পেস লেখার মধ্যে তৈরী করতে তুমিই পারো…