মৃণাল চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
১২
বাজারের ঠিক মাঝখানে একজন মানুষ একটা টুলে বসে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। মন্থর সুর। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে যেন আঁচ পাওয়া যাচ্ছে কোনও এক দেশের যেখানে অনেক নদী আছে। সেই নদীতে পুরনো নৌকো চলে। পাল তোলা নৌকো। একজন দাঁড় ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর দুজন নৌকো বায়। যে লোকটা দাঁড়ী তার মাথায় রঙিন টুপি আর পরনে নীল লুঙ্গি। খালি গা লোকটার।
নাও চলেছে তীর ঘেঁষে। ছোট ছোট গ্রাম। বাচ্চারা ছুটছে নদীর ধারে। মেয়েরা কাপড় কাচছে, বাসন ধুচ্ছে। শুধু একটা মেয়ে একা বসে আছে এক বাঁধানো ঘাটে। গানটা তাকে নিয়ে।
–আপনি কি ওই গ্রাম থেকে আসছেন যেখানে মেয়েটা ঘাটের ধারে বসে আছে?
–না। আমি ওই গ্রামে ফিরব। এখান থেকে ফিরব মেলা শেষ হলে।
মৃদু গলায় বলল মানুষটা। ঠোঁটের কোণায় অল্প হাসি।
–আপনি কোথায় ফিরবেন?
এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি আগে। কোথায় ফিরব আমি? নিশ্চই শিলিগুড়িতে। কিন্তু ও তো সেই ফেরার কথা বলছে না।
–জানি না। এখানেই থেকে যেতে পারি।
আমি খুব এলোমেলো ভঙ্গিতে বললাম। লোকটা হাসল। নতুন সুর লাগানোর আগে হালকা গলায় বলল,
–এখানে? সুর খুঁজতে খুঁজতে যেন লোকটা বলল— তাও হয়।
আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন সুর লাগাল বাঁশিতে। এবারের সুরে মন মুচড়ে দেওয়া কান্না। কোথায় সেই ঘাট আর কোথায় সেই ফেরা আর কোথায় সেই মেয়ে? শুধু নদীর জলে পার ঘেঁষে চলার সুর শুনতে শুনতে আমি ওকে ছেড়ে এগিয়ে চললাম। খুব সাজানো দোকানপাট নেই এখানে। মেঠো রাস্তার মধ্যে যে যেখানে ইচ্ছে দোকান দিয়েছে। হ্যারিকেন আর হ্যাজাক জ্বলছে বিভিন্ন দোকানে। কোথায় থাকব তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না। পরের দোকানে দুজন পুরুষ-মহিলা বসে ছিলেন। চল্লিশের আশপাশের পুরুষ, মহিলা বেশ ছোট, মেয়েটা বললেই হয়। মাথায় আধখানা ঘোমটা, ম্লান মুখ চকচক করছে আলোয় আর বাতাসের জলকণায়। ক্লান্ত সুন্দর হয়ে নকশা তুলছেন একটা কাপড়ে। আধখানা কৃষ্ণের মুখ ফুটেছে সবে। কে যেন কবে যেন কারা এসব করত আমার জীবনে। কোচবিহারের বাড়িতে কি? নাকি তারও আগে? অন্যরকম করে শাড়ি পরেছে মেয়েটা। ভদ্রলোক ক্লান্ত কিন্তু মুখে হাসি। চুপ করে বসে আছেন। আশপাশে নানান ছবি। যাকে আগে সিনারি বলত। নদীতে সূর্য ডুবছে, মায়ের কোলে শিশু, শকুন্তলা-দুষ্যন্ত, সব জল রঙে আঁকা।
–এসব আপনি এঁকেছেন?
–হ্যাঁ। আর পেছনের ওই ছবিটা আমার স্ত্রী।
মেয়েটা অল্প হেসে নমস্কার করে কথা শুনতে থাকল। তাজমহলের ছবি, চাঁদের আলোয়। ওপরে গোল গোল করে লেখা: তাজমহলের মর্মর গাঁথা কবির অশ্রুজলে।
আমার ছবি বা অন্য কিছু কেনার ইচ্ছে ছিল না। ওদেরও তেমন তাগিদ নেই বিক্রি করার। নদীতে জল বাড়ার শব্দ পেলাম। বাজারের মৃদু গুনগুনকে ছাপিয়ে উঠেছিল নদীর স্রোতের শব্দ। ওপারের দুনিয়ায় কোনও শব্দবদল হয়নি।
–এখানে কিন্তু তেমন ঠান্ডা লাগছে না। নদীর এত কাছে অথচ…
ওরা একে অন্যের তাকিয়ে হাসল। মেয়েটা মুখে হাসি রেখেই বলল,
–এত কাছে! না, তত কাছে না।
এর মধ্যেও নিশ্চই কোন প্যাঁচ আছে। কিন্তু আমার কৌতূহল বাড়ছিল।
–একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ম্লান পুরুষটি দুরের দিকে চেয়ে বলল,
–আমরা ঠিক বোঝাতে পারব না। আপনাদের গাইড অনেক ভাল বলতে পারবেন। তবে আমরা অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি, এখন এখানে কোনও নদী নেই।
–আমরা নদীর জলের শব্দ বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কাজ থেকে মুখ তুলে বলল।
–কিন্তু নদীটা পার হয়েই তো আমরা এলাম।
লোকটা একটা শ্বাস ছাড়ল। পাশের মেয়েটা ফুল ফুল ডিজাইন বানাতে আরম্ভ করল সাদা রুমালে। আমি বুঝলাম।
এগিয়ে যেতে গিয়ে মনে হল, আমি কেঠো যুক্তি খুঁজে ভুল করছি। এই আসাটাই তো অলীক। সময়ের ঝটকা এড়িয়ে এই জায়গাটায় ঢুকে পড়াই তো আমার গল্পের মাঝখান। কারণ খুঁজছি কেন? ভাবলাম পুল্টুশকে একবার জিগ্যেস করি। কিন্তু ও বড্ড বকবে।
পাশেই একটা কফি স্টলে কয়েকজন যুবক-যুবতী চা কফি বিক্রি করছিল। তাদের দেখে এখনকার ছেলেমেয়েদের মতই লাগল। কিন্তু আমি আর কোনও প্রশ্ন করব না। কফি চাইলাম। ওরা নিজেদের মধ্যে স্লো মোশানে হাসিঠাট্টা করতে করতে কফি বানিয়ে দিল। একটা প্রশ্ন মাথায় এল। আমি যেমন ওদের স্লোমো-তে দেখছি, ওরাও কি আমায় একইরকমে দেখছে? নাকি মনে হচ্ছে একটা লোক খালি দৌড়ে চলেছে?
আমি চিনি বারণ করতে ভুলে গেছিলাম। বেশ ভাল কফি। টাকা বাড়িয়ে দিতে ওরা হাসল।
–ওই টাকা আমরা নিতে পারব না। আপনাদের গাইড সব দিয়ে দেবেন।
আমাদের দলের পাঁচ-ছজন কফি খেতে আসছিল। ওরা বেশ একটা বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। আর আমি একা চলেছি উজবুক বরাবরের মত। একটা লোক ওদের মধ্যে থেকে ডাকল,
–কেমন দেখছেন চারপাশ?
নদীর আওয়াজ ছাপিয়ে সে-প্রশ্ন দেরিতে পৌঁছল আমার কাছে। এগিয়ে গেলাম।
–যা দেখছি অবাক হয়ে যাচ্ছি।
–কেন? অবাক হচ্ছেন কেন?
আগের দুজন নয়, এবার প্রশ্ন করল আর একটি মহিলা। আগে খেয়াল করিনি ঠিক করে। তিরিশের কোঠায় বয়েস। ভাল দেখতে আর একটা ব্যক্তিত্বের চটকদারি আছে। একেই তো আমি খুঁজছি এতদিন ধরে। আমি ওর ব্যক্তিত্বের পুরোহিত হতে চাই। জীবনসর্বস্বধন এর পায়ে সঁপে দিয়ে আমি মুক্ত হতে চাই।
–বুঝতে পারছি না কিছু। ওরা বলল নদীটা নেই!
–ওরা তো বলবেই। আচ্ছা, আপনার শরীর ঠিক আছে তো? এখানে তো কেউ অবাক হয় না।
যে লোকটা আমাকে ডেকেছিল সে বলল।
–গাইড ভাল ব্রিফিং দেননি।
ওরা এই আলোচনা করতে করতে কফিশপের দিকে এগোতে লাগল। আমিও গেলাম ওদের সঙ্গে। এটা সত্যি কথা যে এরা আমার চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখে। তাই কোনও এক সময় থেকে অবাক হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, বা কোনওভাবে বন্ধ করানো হয়েছে। কিন্তু আমি তো ব্যোমকে যাচ্ছি। এবং তাতে একজনের মনে হচ্ছে যে আমার শরীর খারাপ!
ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। সেই মহিলা নিচু গলায় কথা বলছিল একটা লোকের সঙ্গে। আমার ঝাঁট জ্বলে গেল স্লো মোশানে। কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে? পাশের একটা লোক বলল, সত্যি আপনি অবাক হচ্ছিলেন? নাকি ঠাট্টা করছিলেন?
–না না, ঠাট্টা করছিলাম না। দেখি, কফি খেলে হয়ত মাথা কাজ করবে।– কথা্টা আমি খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বললাম।
–উনি আসলে একা আসেননি।
কফিশপের মেয়েটা আমাকে দেখিয়ে ওদের বলল। অল্প হাসি নিয়ে কথাটা বলে আবার কফি দিতে শুরু করল। কফির কাপ হাতে ওরা একটুও অবাক হল না। একজন বলল,
–ও। শুনেছিলাম এখানে সবাই একাই আসে।
–কিন্তু ওনার সঙ্গে অন্য লোক আছে।
একটা লোক মাঠে বসে ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। সে কথাটা বলল। আমার মনে হল দূরে যে লোকটা বিনবিনে বন্দুক থেকে মন্দ লয়ে গুলি ছুঁড়ে বেলুন ফাটাচ্ছে, সেও কিছু জানে আমার ব্যাপারে।
–আপনি কি প্রথমবার এলেন?
প্রশ্নটা মহিলাকেই করে ফেলি। উনি অল্প হেসে বললেন,
–বার বার আসা যায়? আমার মনে হয় না।
এতক্ষণে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। আমার এখানে আসার কৌতূহল ছিল। খুব ছিল। কিন্তু এদের কাছে এটা একটা মহাযাত্রা। ওরা খুব ভাল আছে। আনন্দ করছে। এখানেই আমি আলাদা হয়ে গেছি। এই ব্যবধান ঘুচবে না।
–আপনার সঙ্গে কে আছে?
মহিলা জিগ্যেস করলেন। সত্যিটা এবার বলতেই হবে। একটাই সুবিধে, কেউ অবাক হবে না। আমি পুল্টুশের কথা একান্তে ওঁকে বলেই ফেললাম। উনি খুব বুঝদারের ভঙ্গিতে বললেন,
–একটা দ্বিতীয় সত্তা আর কি। বিবেক টাইপের।
–ওইরকমই ধরে নিন। কিন্তু ওর কাছ থেকে ছাড়ান পেতে গেলে আমার একটাই রাস্তা: একটা বিয়ে করা। সেই ব্যাপারেই এদিক সেদিক যাই আর কি।
জানি এতে পুল্টুশ খচবে। কিন্তু মহিলাকে খবরটা জানিয়ে একটু হাল্কা হতে চাইছিলাম। মহিলাও ডাক্তারের মত মুখ করে শুনলেন। যেন এর পরেই সকালে খালি পেটে পেন্টাপ্রাজোল খেতে বলবেন।
–কিন্তু এখানে আপনার সে সমস্যা মিটবে কি?
বাকি দলের চেয়ে আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। রসিক ঘোষের মিষ্টির দোকানে সন্তোষ পাল বসেছিলেন বাকি দুজন গাইডের সঙ্গে। হাত নেড়ে হাসলেন। আমিও হাসলাম, কিন্তু মহিলাকে অন্য দিক দেখিয়ে তার সঙ্গেই এগোলাম। আমার মন বলছিল, মিটবে মিটবে। শুধু তোমার সঙ্গেই মিটবে সব। যত নেবে তুমি না না না পাবে শেষ। তবে তুমি না গ্রহণ করলেও আমায় তো থেমে থাকলে চলবে না। একটা বিয়ে করার জন্যে আমি অতীত বর্তমান এমনকি ভবিষ্যতের দুনিয়ায় যাতায়াত করব সব সময়।
–জানি না। কিন্তু থামলে তো চলবে না। পুল্টুশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। একজন কাইন্ডহার্টেড, সেনসিটিভ মহিলা…
পেটের মধ্যে একটা গোঁতলানো ব্যাপার হল। পুল্টুশ খচেছে।
–আপনার মিশনটা আলাদা। আমরা বাকিরা অন্য কারণে এসেছি।
কেন জানি না আকাশের দিকে চোখ গেল। একদম অন্ধকার। নদীর জলে আরও টান লেগেছে। কাছে দূরে মনিহারি দোকান, একজন বসে হাত দেখছে। কেউ সং সেজে দাঁড়িয়ে আছে। বিচিত্র জায়গা। মাত্র তেরোজন লোকের জন্যে এই ম্লান মেলা। আমি মহিলাকে জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম, কোন কারণে? দরকার হল না। বাকিরা এসে গিয়েছিল। মহিলা তাদের একবার দেখে মৃদু গলাতেই বললেন,
–আমরা এখানে থাকতে এসেছি। সম্ভব হলে আর ফিরব না।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)