ছটি কবিতা

সৌগত চট্টোপাধ্যায়ের ছটি কবিতা

সৌগত চট্টোপাধ্যায় 

 

কলকাতায় বৃষ্টির ভেতর

হোয়াটস্অ্যাপ ফেসবুকে সব কথা হয়ে গেছে এখন গোধূলি
নামছে নিরন্তর, সঙ্গীবিহীন চলো দুজনে মিলে ময়দানের কাছ
থেকে ঘুরে আসি দেখে আসি সেন্টপলস্ গির্জার চূড়া আর
ভিক্টরিয়ার শিখরে নীল পরীর চাহনি এই কলকাতায় অনর্গল
বৃষ্টিপাতের ভিতর আমরা হারিয়ে গিয়েছি কতবার ধূসর
মরুভূমির মতো শুকনো খরার মধ্যে নেমে এসেছে সেই তীব্র
শাণিত বৃষ্টিপাত তখন হোয়াটস্অ্যাপ ছিল না ফেসবুকও
অজানা ছিল মোবাইল ফোন তখনও চালু হয়নি।

সেই যুগের মতই গভীর গোধূলি আবার নেমে এসেছে পৃথিবীতে
তোমাকে আমাকে সঙ্গীহীনতা বা নিঃসঙ্গতার কথা বলতে হয়তো
রাত্রে আবার সেই বিস্মৃত যুগের মতো জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়বে
কলকাতার পিচের রাস্তায় চলো আমরা সত্তরের অথবা আশির
দশকে ফিরে যাই তার জন্য টাইম মেশিন বানানো অত্যন্ত জরুরি
প্রয়োজন দ্যাখো কিরকম প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার কলকাতার
ফুটপাতে পথে ঘাটে মানুষের চোখে মুখে অন্তরে।

দ্যাখো নির্জনতা শুয়ে আছে সুপ্রাচীন, বয়োবৃদ্ধ, সঙ্গিবিহীন।

 

অফিসপাড়ায় একটি সন্ধ্যা

সন্ধ্যা নামল ধর্মতলায় এসপ্ল্যানেড চৌরঙ্গি ফাঁকা
শুধু অন্ধকার বাড়ে ঘুরতে থাকে বিনাশের চাকা
দূরন্ত দূরবীন হাতে পাখি খোঁজে রিক্ত পাখিধরা
হৃদয়ে জ্বলতে থাকে সন্ধ্যার কলকাতা

রক্তে পুড়তে থাকে খরা।

জীবিকাকে পণ ধরে এ জীবন শূন্য করে দিয়ে
ছুটেছে রাত্রির হাওয়া ময়দানে শিশির বিছিয়ে
গিলে করা পাঞ্জাবি ঝুলে আছে দরজার পেরেকে
নেই কোনও সঙ্গী সাথী শূন্যতা ও ক্ষুধা ব্যতিরেকে।

বুভুক্ষু এ শহর কাজ করে ভোর থেকে রাতে
সকাল শুরু না হতে অস্ফুট উষার প্রপাতে
স্নান করে কলকাতা মুখ ধোয় প্রাতরাশ সারে
কলকাতার চোখে অশ্রু বুকে ব্যথা

জমে বারে বারে।

দিগন্তে তাকিয়ে থাকি সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখি
ভেসে বেড়াবার ইচ্ছা ফিকে হয়ে, অধুনা সাবেকি।

 

ঘড়িতে ক’টা বাজে

সাতটা বাজেনি এখনও
ঘড়িতে প্রকটভাবে প্রস্ফুটিত ৬টা বেজে পাঁচ
শব্দ করে ফেটে যায় জানলার কাচ
অমীমাংসিত থেকে যায় সন্ধ্যার আগমন।

এই তো দিব্যি কর্মহীন বেকার জীবন
যদি কোন দুঁদে ব্যবসায়ীর হাতে প্রতারিত হও
এই ভয় তোমাকে অধিক কর্মহীন করে তোলে
তাই ঘড়িতে অপূর্ণ সময়ের সঙ্কেতে ফুটে ওঠে।

মনে মনে বাসনা করো যদি খুব দ্রুত

সাড়ে সাতটা বাজে

তবু অধিকাংশ নগরবাসী ব্যাপৃত রয়েছে কোনও কাজে
চিনে বাদামের খোসার মতো ফেটে যায় বিহ্বল সময়
আমার বুকের মধ্যে অনির্ণীত সময়ের কার্তুজ ফেটে যায়।

ঘরের একপাশে ফুলদানি, বাতিল খবরের কাগজ আর ফুল
গোলাকৃতি টুলের উপর বাসি দিবাস্বপ্নের গন্ধে মশগুল।

 

শীতকালের একটি রাত্রি

মস্তিষ্ককোষের ভিতর খেলা করে নীল অন্ধকার
জানলার ধারে শুয়ে রাত্রিকে প্রদক্ষিণ করি
চারিদিকে জেগে থাকে ইউক্যালিপ্টাসের গাঢ় ছায়া
আকাশকে ছেয়ে থাকে নক্ষত্রহীন দীর্ঘ শর্বরী।

সমস্ত দিনের শেষে এই রাত্রি ঘন হয়ে এলে
জানলা দিয়ে প্রবেশ করে নিশাচর ঠাণ্ডা বাতাস
ক্রমশ নিসৃত জ্যোৎস্না একাকীত্বে সুরারোপ করে
বুকের ভিতর ফোটে নিদ্রাকাতর দীর্ঘশ্বাস।

প্রতিটি রাত্রির দেহে, রোমকূপে, পল অনুপলে
শীতের স্পর্শে ফোটে আঁধারের অনুরণিত সুর
দেহের বিলোল জ্যোৎস্না অন্ধকারে বিলুপ্ত হলে
তবু শুনতে পাই যেন শৈত্যের ছন্দিত নুপুর।

অধুনা নানান কথা নানা মুখ দর্পণে প্রতিবিম্বিত
বয়ে চলে শীতরাত্রি অনন্ত অন্ধকার নিমজ্জিত।

 

স্খলিত নৈঃশব্দ্যে একা একা

স্থলিত নৈঃশব্দ্যে বাজে মাতালের গান অবিরত
লকডাউন মাথায় করে পাড়ি দিয়েছে মদের পাথারে
আকাশে অম্লান চাঁদ অন্ধকার নেশায় প্রতিহত
মাতাল ডুব দিয়েছে চন্দ্রালোকিত অন্ধকারে।

দু্র্বিীত রাত্রি এসে শীতল জ্যোৎস্নার বুকে হানে
হূদয়হীন পাথরের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সঙ্গীত
মাতাল অনুনয় করে আরো বেশি মদ খেতে চায়
অকস্মাৎ বৃষ্টি নামে চূর্ণ হয় উচ্ছাসের ভিত্।

সমস্ত কথার গায়ে অবিচ্ছিন্ন নীল রাত্রি আঁকা
করস্পর্শে মোছাতে পারে প্রগাঢ় দুঃখের এই রাতি
এমন এক কিশোর এসে মাতালের সঙ্গে কথা বলে
অকপটে জ্বেলে দেয় আঁধারহস্ন্তারক বিজলী বাতি।

শেষত ঘরে ফিরবার, পথ বিস্মৃত হলে পর
অন্ধকার নেশার ভিতর প্রস্ফুটিত মৃত্যুর সাগর।

 

একটি তারা

একটি তারা আঁকা থাকে দূরের আকাশে যা মুখ্যত মুক্তির কথা বলে সন্ধ্যা ঘনালে পার্কের বেঞ্চিগুলিতে জড় হয় হার্মাদ বাতাস – যদিও কখনও টুঁ শব্দটি সে করে না – পা্র্কের ঘাষজমিতে ছড়িয়ে থাকে ভাঙা শিশি ও বোতল পরিত্যক্ত নীল রুমাল কথা বলে ওঠে অকস্মাৎ  সন্ধ্যা গভীরতর হলে আমি নির্জনে পার্কের এককোণে বসে থাকি সিগারেট ধরিয়ে, আগুনের শিখা থেকে ছলকায় আলো  গরম বিরক্ত সন্ধ্যায় এইভাবে একাকিত্ব আর অবসন্ন প্রহরগুলি যাপিত হয় ঘুমের রঙিন হাতছানি দেখতে পাই দৃশ্যমান ল্যাম্পপোষ্টের বাতি জ্বালা সম্পন্ন হলে – একটি তারা আঁকা থাকে নীলিমায় অজস্রবার কেঁপে ওঠে।

কখনো সিগারেটের নেশায় বুঁদ হয়ে পালামৌ অরণ্যের কথা ভাবি কখনো ফোয়ারার মত ঝলসে ওঠে পরিশ্রান্ত চেতনায় পুরীর সমুদ্রের ধারে ইস্কুলের শৃঙ্খলমুক্ত পূজার ছুটির দিনগুলো কখনো সন্ধ্যার গুমোট বাতাসে ফুঁসে ওঠে কলেজের ছুটিতে বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছি লাল মাটি আর মহুয়ার সন্ধানে – সেই রঙিন স্মৃতির মঞ্জরি।  নানান দৃশ্য ও সুর মিলেমিশে স্মরণে আসে ফেলে  আসা অপাপবিদ্ধ কৈশোর, তবু মুক্তি নেই, সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয় সিগারেট নিভে আসে অতিরিক্ত সুখটানে – এবার বাড়ি ফিরতে হবে।  বাড়ি ফিরে আমার দোতলার ঘরের জানলাটা টান মেরে খুলে দিই দেখি সেই একাকী তারাটি আকাশের এক কোণে নীলিমা উদ্ভাসিত করে ফুটে আছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...