বিকাশ দাসের কবিতা
মানুষী মায়া
আমার সন্ন্যাস ছিল না
কিন্তু বৈরাগ্য ছিল—
আমার আসঙ্গলিপ্সা ছিল না
কিন্তু সঙ্গকামনা ছিল—
আমার রৌদ্র ছিল না
কিন্তু মেঘ-চাপা আলো ছিল—
আর ছিল ছায়া—
মানুষী মায়া মানুষী মায়া মানুষী মায়া…
একটি প্রকৃত প্রকৃতিবিষয়ক কবিতা
অনেকদিন পাহাড়ের কাছে যাওয়া হয়নি
দীর্ঘ বর্ষাকালীন মেঘাচ্ছন্নতায়
পাহাড়ও আসেনি আমার কাছে—
এদিকে থৈ থৈ টেথিস সমুদ্রে
জল যে কখন জমতে জমতে
হিমালয় হয়ে আছে খেয়াল করিনি—
অবশ্য হিমালয়ের বুকেও
জমাট বরফ গলে
জলঝর্ণারা কিন্তু নাচে…
ভেঙে যায় অভিমান
ভেঙে যায় অভিমান
যেমন রেশমি চুড়ি ভেঙে ভেঙে যায়
প্রবল পরুষ চাপে
তেমনি করে টুকরো টুকরো ভাঙে অভিমান—
এভাবে বিরহ যায়
এভাবে মিলনও যায়
শ্রীমতিও যান
হৃদয়ে বহতা নদী যমুনা সিনানে…
হৃদয়ে বহতা নদী
নরেশ আমাকে একটা ডিঙি নৌকো দিয়েছিল
কালিন্দীর জলে
অথচ নৌকোটা কিন্তু নরেশের নয়।
তবে কি নেপথ্যে ছিল কোনও রাজেন্দ্রাণী?
কি জানি কি জানি।
কালো কালিন্দীর জলে যমুনা সিনানে
অভিসারে চলেন শ্রীমতি
অথচ শ্যামের বাঁশি কোথাও বাজেনি –
তবে কি শ্রীমতি নীল শাড়িতে সাজেনি
পরেছিল কালো?
ভালো সেই ভালো—
ছলচ্ছল অন্ধকারে নৌকো ভেসে যায়…!
বুকে এসে বাজে
‘সন্ধ্যা হ’লে ঘরে ফিরে এসো’
বলেছিল যেইজন সেইজন রাত্রিতে মিশেছে
এখন আমার রাত্রি বর্ষা-ঘনঘোর
‘সন্ধ্যা হ’লে ঘরে ফিরে এসো’
তবুও ধুয়ার মতো বেজে চলে মল্লারের সুরে
গৃহহীন নিরুদ্দেশে ভেসে যায় যাবৎজীবন
‘সন্ধ্যা হ’লে ঘরে ফিরে এসো’-
করুণ শঙ্খের মতো বুকে এসে বাজে…!
প্রতিমা বিসর্জনের মতো রোদ
মেঘে মেঘে বেলা যায় –
প্রহর ভাঙে, গুঁড়ো হয়। মিহি ধুলোর মতো
মিশে যায় বিষাদঘন বাতাসে –
আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস
ঈষৎ আলস্য-মন্থর হয়ে ওঠে –
আমাদের হৈ-হল্লা
কথঞ্চিৎ সময়-শান্ত
আমাদের গৃহপালিত হাঁসেরাও
কুয়াশামগ্ন পালকে ঠোঁট এলায় –
এবং অন্ধকার হওয়ার আগে
পৃথিবীর মুখে
প্রতিমা বিসর্জনের মতো রোদ
প্রতিমা বিসর্জনের মতো রোদ
প্রতিমা বিসর্জনের মতো রোদ…
পারাপার
পুকুরে তিনটে হাঁস ছায়া ফেলে’
ভেসেছিল জলে –
হঠাৎই হৈ চৈ
হাওয়া দিলে তারা ছুটে চলে
চৈ চৈ ডাকে
এভাবেই কিছু মায়া থাকে
থৈ থৈ আজও এ সংসারে –
পুকুরে তিনটে হাঁস এপারেও
ভেসেছিল জলে
এখন ওপারে…!
সে আমার কেউ নয়
সে আমার কেউ নয় নদীজলে ঢেউ
ওঠে আর পড়ে
হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ে
তবু কেন সেদিকেই চাওয়া?
সে আমার কেউ নয় হৃদয়ের কাছে পাওয়া
দূরস্থান জেনেও জেনেও?
মন কি নিয়ম মেনে চলে
কিংবা সাধে কি লোকে বলে মন না মতিভ্রম
যত পণ্ডশ্রমে তার মতি -?
সে আমার কেউ নয় তবু তো নদীর জলে ঢেউ
অগতির গতি…!!!
মহাকালের মুদ্রা
শর্ত ছিল ছোঁব না কো
যেই ছুঁয়েছি লতা
লজ্জাবতী গুটিয়ে গেল
ঘনালো স্তব্ধতা –
ভাঙতে এখন দীর্ঘ সময়
সময়-হীনতায়
জীবন মরণ মুদ্রারত
মিথুন মহিমায়
কে নাচে কে নাচে…!
ম্যাজিক রিয়ালিজম
দুপুর বেলায় মেঘ জমেছে
বিকেল বেলায় কালো
অকাল সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আলো
গভীর থেকে গভীর অন্ধকারে
ঘরের কোণে লুকিয়ে মুখ
খুঁজছ চুপিসারে
যে মোমবাতি তাকেই তুমি জ্বালো
বিষণ্ণতার বুকে –
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
শৈশবাধীন সুখে
বিকাশ দাস ও তাঁর কবিতা: একটি অপার্থিব সান্নিধ্য
সুকুমার মণ্ডল
তখন আমি কলেজবালক। হঠাৎ একটি পোস্টকার্ড পেলাম, লাল কালির ডটপেন দিয়ে লেখা, আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরটি এমন, বারংবার চেষ্টায় অংশত পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। বেশ কয়েক বছর ধরে, মাঝে মাঝে পড়ে, যার সম্পূর্ণটা আমাকে বুঝতে হয়েছিল। আমার প্রথম একটি কবিতাগুচ্ছ সদ্য সদ্য ছাপা হয়েছে, অনুবর্তন পত্রিকায়। তাঁরই অনুভব-প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছেন জনৈক পাঠক এবং কবি বিকাশ দাস। এবং এই প্রতিক্রিয়াটি আবার কবিতায় লেখা। নতুন লিখতে আসা একজন তরুণের কাছে এর বেশি আর কী-ই বা হতে পারে? তাঁকে ‘কবি’ জেনেছি, কারণ, আমি অনুবর্তনের সেই সংখ্যায় তাঁরও একটি কবিতাগুচ্ছ পড়েছি, ইতিমধ্যেই।
এর চার-পাঁচ বছর পরে, আমি তখন মেদিনীপুর বি এড কলেজে পড়ি, একদিন বাড়ি ফেরার পথে বিষ্ণুপুরে স্টেশনে নেমে পড়ি। নেমেই রিক্সায় চড়ে কবিবন্ধু কৌশিক বাজারীর বাড়ি। অতপর, এইবার কবিদর্শনের পালা। কৌশিকের বাড়ি থেকে কবি বিকাশ দাসের আস্তানা মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ, আমরা দ্রুতই পৌঁছালাম। সত্তর উত্তীর্ণ একজন মানুষ বেরিয়ে এলেন। মানুষ নাকি এক সনাতন সাধু? পরনে টেরাকোটা রঙের লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি, মুখভর্তি সাদাশুভ্র দাড়ি। কৌশিক আলাপ করিয়ে দিতেই দুই হাত মাথার ওপরে তুলে ধরলেন, শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত, আমি যেন তাঁর কতকালের চেনা! একটি ছোটো-শীতল প্রায়ান্ধকার ঘরে কবি আমাদের নিয়ে গিয়ে বসালেন। এক অপার শান্তির মধ্যে তাঁর ঘন্টা দুয়েকের সান্নিধ্য যে কিভাবে কেটে গিয়েছিল, বুঝতেই পারিনি। আরও অনেকক্ষণ তাঁর পায়ের তলায় বসে থাকবার ইচ্ছেটুকু অপূর্ণ রেখেই ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
এরপর আরও বেশ কয়েকবার কবির কাছে গেছি। একজন অনুজ তো যাবেই আরেকজন বিদগ্ধ অগ্রজের কাছে, কবিতার ধ্যানধারণা ও তার নানা পরিসর চেনবার অভিলাষে। কিন্তু না, সে-সব বিষয়ের কোনো অবকাশ তৈরি হয় নি আমাদের মধ্যে। গল্প হতো না তথাকথিত কোন কবিসমাজের, যেরকমটি সচরাচর আমরা হয়ে থাকতে দেখি প্রায়শই, এলেখা-সেলেখার পর অবলীলায় যেরকমটি আমরা ঢুকে পড়ি কোনো নির্দিষ্ট কবি অথবা কবিকূলের ব্যক্তিগত নিন্দাবন্দনায়, এবং শেষমেষ ঘুরপথে আমি যে কতখানি বিশিষ্ট, তা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই এই সমস্ত আড্ডাগুলিতে। এইমতো বিষয়ে কথা বলবার মতো কোনো মুহূর্তের জন্ম হয়নি একবারও। কোন সৎ তরুণ কবি যদি কখনো বা কবির উদ্দেশ্য কারও কোনো কটূকথা শুনে তার ব্যথা প্রকাশ করেছেন, কবি তাঁর মাথার ওপর দুইহাত তুলে অকৃত্রিম অন্তর থেকে বলেছেন, ‘এইসব কথা এখন থাক ভাই, অন্য কথা বলো।’ এমনকি তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হতো না কবিতার ফর্ম অথবা ছন্দ নিয়েও। তবু ভাবি, তাহলে আমরা কয়েকজন কেন যেতাম তাঁর কাছে?
বস্তুত, এর উত্তর আমার কাছে খুব সহজ নয়। তাঁর কাছে যেতাম শুধুই কি তবে শান্তির জন্য? কবিতার জন্যে একটুও যেতাম না কবির কাছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখেছি, মনের মধ্যে শান্তির সেই জলস্তরটি না থাকলে কবিতাও সেভাবে আসবার কথা নয়! এই কথাটি আমি হয়তো শব্দ দিয়ে ঠিকঠাক লিখে উঠতে পারব না, কিন্তু কবি বিকাশ দাসের যাপিত জীবনের খণ্ডচিত্রটি দেখেও এই সত্যটি আমি খুব বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও এই কবিকে সম্পূর্ণ জানতে হলে, তাঁর দৈনন্দিন দিনলিপি জানাটা খুব প্রয়োজন। ভৌগলিক দূরত্বের কারণে সেই সুযোগটুকু আমার হয়ে ওঠেনি। এইমতো পূণ্য সৌভাগ্যটি অর্জন করেছিল আমার কৌশিক, শীতল ও অংশুমানের মতো বন্ধুরা। কৌশিক এক জায়গায় লিখেছে – “এক শীতের সন্ধ্যায় চাফির কাপ হাতে ধরিয়ে মূহ্যমান বসে পড়লেন তিনি। আমি চাফিতে চুমুক দেওয়ার আগেই তিনি দীর্ঘশ্বাস সহযোগে (জনান্তিকে, অথবা আমাকেই) বললেন – ‘বোনটি চলে গেল, ভাইটি এখন একা পড়ে রইল।’ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতে তিনি যোগ করলেন – ‘সেই পাগল ভাইবোন দুটির একজন, গতকাল চলে গেল। ওহ! কি শূন্য দৃষ্টি ভাইটির, আজ সকালে দেখা হল, সেই বটগাছের নিচের চাতালে বসে আছে একই জায়গায়, একা’। জেঠুর চোখে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম পাগলের চোখের শূন্যতার উপর নেমে আসা শোক ও আরো শূন্যতা কতদূর হয়!” এইমতো আরো কত কত চিত্রবিচিত্র মানুষের সঙ্গে যেন নাড়ির টান ছিল কবির!! আর শুধুই কি মানুষ? সূর্যোদয় দেখতে ভোরবেলায় হঠাৎ বেরিয়ে পড়তেন, কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে কখনো চলে যেতেন দ্বারকেশ্বরের নদীর তীরে। হঠাৎ জঙ্গল দেখতে পেয়ে কোনো বাসস্টপের আগেই খালাসিকে বলে নেমে পড়তেন মাঝপথে। ‘মাত্র’ চৌত্রিশবার হিমালয় ভ্রমণ করেছেন, নিষ্পাপ শিশুর মতো হাসিমুখে বলতেন সেইকথা!
মাইথনের ডিভিসি ব্রাঞ্চে তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। আর বিষ্ণুপুর ছিল কবির স্থায়ি নিবাস। কিন্তু তাঁর কবিতার বসবাস ঠিক কোথায়, এর নিদান কে বা কারা দেবেন? আমরা মনে করি শাশ্বত সময় আর আবহমান পাঠকই তার একমাত্র বিচারক। কিন্তু বিস্ময়কর হল, আজীবন কবিতা লিখেও তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থ নেই। অথচ তিনি লিখেছেন কৃত্তিবাস ও দেশ পত্রিকায়, এবং এমনকি, অনুবর্তন ও তিরপূর্ণি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ বীজপত্রেও। তবে? কিভাবে এমন একজন কবি আপামর কবিসমাজের কাছে অপরিচিতই থেকে যান। নাকি আমাদের মনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এইসব কবিদের না-চিনতে পারার অভিলাষ? তথাকথিত কবিসমাজের কাছে দৈহিক উপস্থিতিটুকু কি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ, এক্ষেত্রে? তবে এ-ও সত্য, খুব গুঁটিকয় সম্পাদক হলেও একটু অতিরিক্ত গরজেই তাঁর কবিতা ছাপতেন। এবং যাঁরা ছাপতেন, একসঙ্গে অনেকগুলি করেই ছাপতেন। পত্রিকায় লেখা বা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রতি তাঁর কোনোরকমের আগ্রহও ছিল না। কৌশিক সম্পাদকদের অনুরোধে কিছু লেখা কপি করে পাঠিয়ে দিত।
ভাবি, তবে কোন্ আনন্দের কোলাহল থেকে নিরন্তর লিখে যেতেন এই কবি? এই প্রশ্নের মুখে বসতে গিয়ে দেখেছি, নিজের সব কোলাহল থেমে গেছে। এইমতো বিকাশ দাসের কবিতা পড়তে দেখি, তাঁর পায়ের কাছে নিবিষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে থাকবার মতো এক আস্বাদ! পাঁচ বছর আগে, পঁচাশি বছরের একটি সম্পূর্ণ জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকু কবি রেখে গেছেন এই পৃথিবীতে, যার নাম কবিতা। তাঁর কবিতার বিষয়ে কথা বলবার মতো খণ্ডভাবনা থেকে বিরত রইলাম। তাঁর কবিতার এক আঁজলা জল বরং পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরবার সাধ হয়!
সেই সাধ থেকেই, পাখিরা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি কাব্যসংগ্রহ।
খুব ভালো লাগল।
সুকুমার দার লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। আর জ্যেঠুর লেখা নিয়ে কি আর বলি। শুধু মাথা নত করি।