যুক্তি ও গণিতকে কি ‘বিজ্ঞান’ বলা চলে?

যুক্তি ও গণিতকে কি ‘বিজ্ঞান’ বলা চলে? -- দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য  

 


লেখক প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

সবাই জানে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয় কঠোরভাবে যুক্তি ও গণিতের পথ ধরেই। কিন্তু, স্বয়ং যুক্তি আর বিজ্ঞানও তো আলাদা চর্চা আর গবেষণার বিষয়। এদেরকে ‘বিজ্ঞান’ বলা চলে কি? এ প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎই বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও দার্শনিকরা ভীষণভাবে মাথা ঘামিয়ে আসছেন, এবং দারুণ চিত্তাকর্ষক সব কথাবার্তা বলেছেন। তবে, সাধারণত, আমাদের চারদিকে আমরা এ নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা শুনতে পাই না। বই পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান-টিজ্ঞান নিয়ে কথাবার্তা তো আকছারই হচ্ছে, কিন্তু সেখানে এই বিষয়টির উল্লেখ বিরল। অথচ, যুক্তি আর বিজ্ঞানকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, তাকে সত্যের নিজস্ব পথ বলে মানেন, তাঁদের এ চর্চায় অনাগ্রহী হবার কথা না। এখানে তবে বলি দুয়েকটা কথা। আগেভাগে জানিয়ে রাখা ভাল, এ লেখায় বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনার সময়ে সব সময়েই ‘যুক্তি’ আর ‘গণিত’-কে এক ব্র্যাকেটেই রাখব। অবশ্য, এ ব্যাপারে এমন সব বক্তব্যও আছে, যেখানে বলা হচ্ছে, গণিতে নিছক যুক্তি ছাড়াও আরও নানা ধারণাগত উপাদান আছে, যার জন্য গণিতকে মোটেই লজিক-এ ‘রিডিউস’ করা যায় না (এবং গ্যেডেলের অসম্পূর্ণতা উপপাদ্যই নাকি তার প্রমাণ)। তবে, সে সব কথা এখানে প্রাসঙ্গিক না। যুক্তি আর গণিতকে বিজ্ঞানের থেকে আলাদা করা বা না করার প্রশ্নে সাধারণত যে সব যুক্তিতর্ক আসে, তাতে এ সব বিচারের দরকার পড়ে না।

এ তো আর ফেলুদার রহস্যকাহিনি নয়, বা ড্যান ব্রাউনের থ্রিলারও নয়, কাজেই এখানে গোড়াতেই একটা স্পয়েলার দিয়ে রাখতে তেমন কিছু অসুবিধে নেই। নানা জটিলতা সত্ত্বেও, যুক্তি এবং গণিত জিনিসগুলো মোটের ওপর বিজ্ঞান বলেই আমার মনে হয়, এবং কেন তা মনে করি সেটাই এখানে বলার চেষ্টা করব, কোনও বিশেষজ্ঞতা বা ঐকান্তিক সত্যের দাবি ছাড়াই। কিন্তু সেটা বলার আগে ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা যা যা বলা হয়েছে বা হয়ে থাকে তার একটা ‘সামারি’ দিয়ে দেওয়া দরকার, অবশ্যই আমার একান্ত নিজস্ব ফোড়ন সহ। মিশিও কাকু এখন বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তম ভাষ্যকারদের মধ্যে পড়েন, কয়েকদিন আগে এ নিয়ে তাঁর একটা ছোট্ট ভিডিও দেখলাম ইউটিউব-এ। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞান এবং গণিতের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও দুটো ঠিক এক জিনিস নয়। উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, অনেক সময়ে বিজ্ঞানীরা নিজের কাজের জন্য নতুন গণিত বানিয়ে নেন, আবার অনেক সময় ঠিক উল্টোটাও ঘটে— গণিতজ্ঞরা যে গণিত নিজের খেয়ালে বানিয়ে তোলেন সেই গণিতই হঠাৎই দারুণভাবে খেটে যায় বিজ্ঞানের কোনও সাড়া জাগানো নতুন তত্ত্বের ক্ষেত্রে। কাকু এসব বলেছেন খুব সুন্দর করে, কিন্তু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বেশি যাননি। আর তার ওপর, শেষের দিকটায় আবার ‘ঈশ্বরের মন’, ‘মহাবিশ্বের সঙ্গীত’, এইসব বলে-টলে বেশ ঘেঁটেও দিয়েছেন। তা সে যা-ই হোক। ওখানে তিনি ওই যে সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করেছেন যে, দুটো জিনিস এক নয়, এটাই আজ এ ব্যাপারে ‘মেনস্ট্রিম’ অবস্থান। এর বিপরীতেও পণ্ডিতেরা অনেক কথা বলেছেন, সে সব কথা আজ একটু একটু পাড়া যাবে এখানে।

এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে নেওয়া জরুরি। কেউ কেউ ঠিক আমার মতই যুক্তি আর গণিতকে বিজ্ঞান বলে মনে করেন, খুবই সরল একটি  কারণে। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে,  বিজ্ঞান মানে সর্বজনীন সত্য, এবং যুক্তি আর গণিতও তাই, অতএব এরা হল গিয়ে বিজ্ঞান। এ যুক্তি দুর্বল বলেই মনে হয়। বিজ্ঞান সর্বজনীনতার খোঁজ অবশ্যই করে, তবে সব সময়েই এবং সবরকমভাবেই যে তা হয়ে উঠতে পারে এমন মোটেই নয়। একে তো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে প্রায়শই সুনির্দিষ্ট প্রয়োগসীমা থাকে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরে তার প্রযোজ্যতা বা প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। আর তার ওপর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রায়শই বাতিল বা সংশোধিত হয়। বরং যুক্তি ও গণিতের সর্বজনীনতা বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য, কেউ বলতে পারেন, বিজ্ঞানে সর্বজনীনতা আছে এই অর্থে যে, তা গোষ্ঠীবিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, রুচিবোধ, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস এইসবের থেকে অনেক বেশি সর্বজনীন (আর্কিমিডিস-এর তত্ত্ব ইংরেজ, ভারতীয়, চৈনিক ও আফ্রিকাবাসীর ক্ষেত্রে একই হবে)। কথাটা ঠিক, কিন্তু আমাদের সাধারণ জ্ঞানগম্যির মধ্যে সর্বজনীনতা একেবারেই নেই, এমন নয়। সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, খাদ্যবস্তু রান্না করে নিলে আরও সুস্বাদু ও সহজপাচ্য হয়, ভোঁতা জিনিসের থেকে ধারালো জিনিস দিয়ে কাটাকাটিতে সুবিধে বেশি, এই বোধগুলো স্থান-কাল-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব মানবগোষ্ঠীরই আছে। কাজেই, নিছক ‘সর্বজনীনতা’ ধর্মটিকে যুক্তি-বিজ্ঞান-গণিতের যৌথ মর্মবস্তু করে তোলাটা বোধহয় বেশ একটু কঠিনই হবে। এবং সেই হেতু, আমি যদি যুক্তি ও গণিতকে বিজ্ঞানেরই অঙ্গ বলে মনে করি, তো সেটা অবশ্যই নিছক ওই কারণে নয়।

যাঁরা তা মনে করেন না, অর্থাৎ যুক্তি ও গণিতকে বিজ্ঞান থেকে আলাদা করতে চান, তাঁদের মধ্যে একটি চালু অবস্থান হচ্ছে, যুক্তি এবং গণিত বিজ্ঞান নয়, কারণ তা হল বিজ্ঞানের ‘ভাষা’ মাত্র। কথাটা নাকি বলেছিলেন স্বয়ং গ্যালিলিও। একটু ব্যাখ্যা করা যাক তবে। আমরা সবাই যেমন নানা ভাষায় কথা বলি, বিজ্ঞান তেমনি গণিতের ভাষায় ‘কথা বলে’। ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম, গণিতশাস্ত্রও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রকাশের মাধ্যম। কথাটা এমনিতে শুনতে বেশ লাগসই, কিন্তু কঠোর যৌক্তিক বিশ্লেষণে দাঁড়াতে পারে না। বিজ্ঞান এবং গণিত উভয়েরই গবেষণা এবং বইপত্র নানা ভাষায় লেখা যায়। ‘গণিতের এই বইটি ইংরিজি ভাষায় লেখা’— এ কথার তবে অর্থ কী, যদি গণিত নিজেই একটি ভাষা হয়? ‘এই বাংলা বইটি চৈনিক ভাষায় লেখা’ বললে একটা উদ্ভট ব্যাপার হবে, কী যে বলতে চাওয়া হচ্ছে বোঝাই যাবে না। কিন্তু, ‘এই গণিতের বইটি ইংরিজি [বা ফরাসি বা জার্মান বা বাংলা ইত্যাদি] ভাষায় লেখা’ বাক্যটি পরিষ্কার বোঝা যায়, মোটেই উদ্ভট লাগে না। গণিত যদি নিজেই একটি ভাষা হত, এইটা মোটেই সম্ভব হত না। গণিত নিজে নিজেই প্রকাশিত হতে পারে না, অন্য সব চিন্তা বা ভাবের মত তাকেও ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশিত হতে হয়। অন্য সব নিবিড় চর্চার বিষয়ের মতই গণিতেরও নিজস্ব পরিভাষা ও চিহ্নসমেত একটি ‘ভাষা’ আছে, সেটা সাধারণ ভাষা থেকেই নানা কেরামতি করে একটু একটু করে বানিয়ে নেওয়া। কাজেই, বিজ্ঞানের থেকে গণিত ও যুক্তি আলাদা কারণ ওটা তত্ত্ব আর এগুলো ভাষা— এ অবস্থানটি আর খুব বেশি নিরাপদ থাকছে না।

সাধারণত পণ্ডিতি চর্চায় বিজ্ঞান থেকে যুক্তি ও গণিতকে যেভাবে আলাদা করার কথা বলা হয়ে থাকে, তাতে বিষয়বস্তুর পার্থক্যের দিকেই জোর দেওয়া হয়। সেটাই এ ব্যাপারে ‘মেনস্ট্রিম’ বা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ দার্শনিক অবস্থান, কাজেই এটাকে নিয়ে একটু চর্চা করা জরুরি। এ অবস্থানের বক্তব্যটা হচ্ছে, বিজ্ঞানের কাজ জগৎকে ব্যাখ্যা করা ও তার আচরণের ভবিষ্যদ্বা‌ণী করা, গণিতের সে দায় নেই মোটেই। বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিজ্ঞানের বাইরের বহির্জগত, কিন্তু যুক্তি আর গণিত ব্যস্ত শুধু নিজেকে নিয়েই, নিজের সঙ্গে নিজেরই খেলায়। বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু পাথর, জল, জীব, গাছ, গ্রহ, নক্ষত্র— যার দৃষ্টান্ত বাস্তব জগতেই থাকে, আঙুল দিয়ে দেখানো যায়। আর গণিতের বিষয়বস্তু সংখ্যা, বিন্দু, যোগ, বিয়োগ— যারা থাকে গণিতের মধ্যেই, যাদেরকে এ জগতের কোথাওই পাওয়া যায় না, আঙুল দিয়ে দেখানোও চলে না। গণিত শুধু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সুনির্দিষ্ট আকার ও অর্থ পেতে সাহায্য করে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কাজগুলো সে নিজে নিজে করে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, ‘সায়েন্স’ বা বিজ্ঞান মানে ‘এম্পিরিক্যাল সায়েন্স’, বা অভিজ্ঞতাজাত বিজ্ঞান। তার কাজ বাস্তব জগতের নানা বিষয় সম্পর্কে নিখুঁতভাবে তথ্য সংগ্রহ করা, এবং তারপর সে তথ্যগুচ্ছ থেকে জগতের স্বরূপ সম্পর্কে ঠিকঠাক তত্ত্ব বানিয়ে তোলা। সে সব তত্ত্বের আবার তিনরকম কাজ— আগে জগতের বা তারই কোনও নির্দিষ্ট অংশের ‘ডেস্ক্রিপশন’ বা ‘বর্ণনা’, তারপরে তার ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ বা ‘ব্যাখ্যা’, এবং শেষে তা থেকে ‘প্রেডিকশন’ বা ‘ভবিষ্যদ্বাণী’। সেখানে গণিতের ভূমিকা শুধুই সহায়কের।

গণিত (এবং যুক্তিশাস্ত্র) কেন বিজ্ঞান নয়, সে ব্যাপারে মেনস্ট্রিম ব্যাখ্যাটি তাহলে এইরকম যে, বিজ্ঞান চায় বাস্তব জগতের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা (এবং সম্ভব হলে তাকে বাস্তব দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগানো), আর গণিত হল শুধুই সংখ্যা, পরিসর ও আকার জাতীয় নানা মানসিক নির্মাণ ও তাদের পরিমাণগত সম্পর্ক নিয়ে যুক্তির খেলা। উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। পদার্থবিজ্ঞানের ‘ওহ্‌ম্‌স্‌ ল’ বা ওহমের নিয়মে আছে, একটা ইলেক্ট্রিক তারের একটি প্রান্তের তুলনায় অপর প্রান্তে ‘ভোল্টেজ’ যত বেশি হবে, তার মধ্যে দিয়ে তড়িৎপ্রবাহের মাত্রাও ততই বেশি হবে। গণিতের ভাষায় সম্পর্কটি ‘সমানুপাতিক’, অর্থাৎ, একটি যতগুণ বাড়বে বা কমবে, অন্যটিও ঠিক ততগুণই বাড়বে বা কমবে। এখন, ‘ওহম্‌স্‌ ল’-কে প্রকাশ করতে কাজে লাগছে বলেই যে ‘সমানুপাতিক’ নামক গাণিতিক সম্পর্কের ধারণাটির মধ্যে কোনও বৈদ্যুতিক ব্যাপার আছে, এমনটা মোটেই নয় কিন্তু। একটি ড্রামের মধ্যেকার জলের আয়তন ও ওজনের মধ্যে ঠিক ওই একই সম্পর্ক দেখা যাবে, অর্থাৎ যত বেশি জল ঢালা হবে (বা যত অংশ তুলে নেওয়া হবে), ওজনও ততগুণ বাড়বে (বা ততভাগ কমবে)। আবার, বাজার থেকে চাল কিনতে গেলেও একই গাণিতিক নিয়ম, মানে চাল যত বেশি বা কম হবে তার দাম সম অনুপাতেই বাড়বে বা কমবে। তাহলে, তারের তড়িৎপ্রবাহ বা জলের ওজন বা চালের দাম— এই সব বিচিত্র জিনিসের কোনওটার সঙ্গে কোনওটারই তো বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, অথচ সবেতেই কিন্তু সমানুপাতের গণিত সমানভাবে কাজ করে চলেছে! কীভাবে সম্ভব? এখানে মেনস্ট্রিম ব্যাখ্যা বলতে চাইবে, দেখুন, যদি গণিতশাস্ত্রীয় মানসিক নির্মাণগুলো (সংখ্যা বা বিন্দু বা কোণ বা সমতা) বাস্তব ‘কিছু একটা বটে’ হত, তো পদার্থবিদ্যা ও অন্যান্য বিজ্ঞানের কাজে লাগতে গেলে, ওই বিশেষ বিজ্ঞানটি বাস্তবতার যে অংশ নিয়ে কাজ করে তার সঙ্গে ওই বিশেষ গণিতশাস্ত্রীয় নির্মাণটির কোনও একটা অমোঘ বাস্তব সম্পর্ক থাকতেই হত, না হলে তা কিছুতেই কাজে আসতে পারত না। যেমন, ‘সমানুপাত’ ব্যাপারটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাপার ছাড়া আর কিছুতে লাগত না, ‘পাই’ সংখ্যাটি গোলাকৃতি বস্তু ছাড়া আর কিছুতে লাগত না, বিপরীত বর্গের নিয়ম মহাকর্ষ ছাড়া আর কিছুতে লাগত না, এই রকম আর কি। বিজ্ঞানে কিন্তু ঠিক এটাই ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, জীবরসায়নের তত্ত্ব দিয়ে জীবদেহের পরিপাক-ক্রিয়ার ব্যাখ্যা হতে পারে কিন্তু বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যাখ্যা হয় না, যেহেতু প্রথমটির সঙ্গে তার বাস্তব সম্পর্ক আছে এবং দ্বিতীয়টির সঙ্গে মোটেই নেই। আবার, ঠিক সেইরকম, পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক স্তরের তত্ত্ব দিয়ে প্রাচীন জীবের কালনির্ণয় হতে পারে, কিন্তু মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় মোটেই চলবে না। কাজেই, এটা তো তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে, সম্পূর্ণভাবে পরস্পর সম্পর্কহীন এত সব বিচিত্র ব্যাপারেও যখন একই গাণিতিক নির্মাণ এত ভালভাবে কাজে লাগছে, তখন নিশ্চয়ই এগুলো বাস্তব ‘কিছু একটা বটে’ নয়, পুরোপুরি মানসিক নির্মাণই হবে। আর তাইই যদি হয়, তাহলে বাস্তব জগত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কেজো জ্ঞানান্বেষী বিজ্ঞানের সঙ্গে তার একটা মৌলিক তফাত তো থাকছেই। কিন্তু, সেক্ষেত্রে আবার একটা অন্য খটকা আছে। নিছক মানসিক নির্মাণই বা খামোখা বাস্তবের সঙ্গে এত সুচারুভাবে মিলতে যাবে কেন? সে ব্যাপারে কে কী বলেছেন সেটা একটু দেখে নিয়েই আমরা চলে যাব— বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্তি ও গণিতের মৌলিক পার্থক্য বিষয়ক এই অবস্থানটির নিরাপত্তা কতটা নিশ্ছিদ্র— সেই চূড়ান্ত প্রশ্নে।

বিজ্ঞান থেকে গণিত ও যুক্তি সম্পূর্ণ আলাদা, কারণ, বিজ্ঞান বাস্তব জগত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, এবং গণিত ও যুক্তি তা করে না— এ হেন অবস্থানের আবার দু-ধরনের ব্যাখ্যা আছে। একটা ‘মিস্টিক’ বা মরমীয়াবাদী, আরেকটা যুক্তিবাদী। প্রথমটির বিখ্যাততম প্রতিনিধি সম্ভবত পদার্থবিদ জেম্‌স্‌ জিন্‌স্‌, যাঁর নাটকীয় ঘোষণা ‘গড ইজ আ পিওর ম্যাথমেটিশিয়ান’ আজ প্রবাদে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই যে সারা বিশ্বের গ্রহ-তারা-নীহারিকার মত প্রকাণ্ড সব বস্তু থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম কণাটি অবধি নিখুঁত নিয়ম মেনে গতিশীল রয়েছে, এর কারণ নিশ্চয়ই এই যে, ঈশ্বর এই সমস্ত কিছুকে এক বিরাট গাণিতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বানিয়ে রেখেছেন— এইরকম একটা ধারণায় মশগুল ছিলেন তিনি। যদিও, এমনতর সিদ্ধান্তের পেছনে খ্যাঁচ কম নয়। কোয়ান্টামতত্ত্বের উদ্ভবের পর জানা গেছে, অতি ক্ষুদ্র পদার্থকণার চলাফেরায় বিশৃঙ্খলা ও এলোমেলোভাব বিস্তর। অপর এক ধুরন্ধর পদার্থবিদ আর্থার এডিংটন আবার ভাবতেন, ওটাই ঐশ্বরিক লক্ষণ। জড়ের তো ইচ্ছাশক্তি নেই, সে তো যান্ত্রিকভাবে কঠোর নিয়ম মেনে চলবেই, বরং নিয়ম ভাঙলে বোঝা যাবে যে তার মধ্যে একটা স্বাধীন মন আছে। আর জড়কণার মধ্যে যদি মনের প্রকাশ দেখা যায়, তখন এও কি আর বলে দিতে হবে যে, সেটা ঈশ্বরেরই মন? এর মধ্যেকার মজাটা বার্ট্র্যান্ড রাসেল লক্ষ করেছিলেন। তিনি সকৌতুকে বলেছিলেন, ‘স্যার আর্থার এডিংটন ভগবান মানেন কারণ পরমাণুগুলো মোটেই অঙ্কের নিয়মকানুন মানে না, আর জিন্‌স্‌ ভগবান মানেন কারণ পরমাণুগুলো নিয়ম-টিয়ম খুব মানে!’

তবে, জিন্‌স্‌ আর এডিংটনের এই সংক্রান্ত লেখাপত্তরগুলোকে ঠিক বিজ্ঞান বলা যায় না, হয়ত বা বিজ্ঞান-ধর্ম-দর্শন মেশানো এক ধরনের প্রবন্ধ-সাহিত্য বলা যায়। কিন্তু, এই ধরনের মিস্টিক অবস্থান থেকেও যে যথার্থ গবেষণাপত্র লেখা যায়, এবং এমন কি তা যে ক্লাসিকের মর্যাদাও লাভ করতে পারে, তা দেখিয়েছিলেন গণিতজ্ঞ ইউজিন ভিগনার, তাঁর বিখ্যাত ‘দি আনরিজনেব্‌ল্‌ এফেক্টিভনেস অফ ম্যাথমেটিক্স ইন দ্য ন্যাচারাল সায়েন্সেস’ প্রবন্ধে। ‘আনরিজনেব্‌ল্‌’, ‘ডু নট আন্ডারস্ট্যান্ড’, ‘মিস্টেরিয়াস’, ‘আনক্যানি’, ‘মিরাক্‌ল্‌’, ‘ইরেস্পন্সিব্‌ল্‌’, ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিকোচিত শব্দে ভরপুর এই লেখাটিতে বহু যুক্তি এবং দৃষ্টান্ত সহযোগে যা বলা হয়েছে তার মোদ্দা কথা দুটো। এক, বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে কেন যে গণিত অতখানি নিখুঁতভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা কেউ জানে না। এবং দুই, যেহেতু সেটা বোঝা যায় না, অতএব এটাও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে, ওই একই সূত্র কোনওদিন সম্পূর্ণ অন্য আরেকটা গাণিতিক চেহারায় হাজির হতে পারে না। কিম্বা, কে জানে, কবে হয়ত বিজ্ঞানের মধ্যেই এমন দুটো মহাতত্ত্ব এসে হাজির হল যারা প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত, কিন্তু পরস্পরবিরোধী, এবং দুটোর সমন্বয় ঘটানোর বা একটাকে বাতিল করে অন্যটা বেছে নেবার কোনও যুক্তিসম্মত রাস্তা আদৌ খুঁজে পাওয়া গেল না! বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের কাছে দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতি, সন্দেহ নেই।

ওপরে বলেছি, গণিত ও যুক্তিকে বিজ্ঞান থেকে আলাদা বলে ভাবাটা শুধু ‘মিস্টিক’ বা মরমীয়াবাদী নয়, যুক্তিবাদী অবস্থান থেকেও হতে পারে। বার্ট্র্যান্ড রাসেলের ‘লজিসিস্ট স্কুল’ বা ডেভিড হিলবার্টের ‘ফর্ম্যালিস্ট স্কুল’ এই ধরনের। এই দুই ‘স্কুল’-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকলেও, এ ব্যাপারে এদের মোদ্দা অবস্থানটি প্রায় একই। সেটা খানিকটা যেন এইরকম। প্রথমত, গণিত হচ্ছে মূলত ‘লজিক’ বা যুক্তিই। অর্থাৎ, সংখ্যা বা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ জাতীয় গাণিতিক ধারণাগুলো সবই শেষতক নিছক যুক্তিশাস্ত্রে নামিয়ে আনা যায়। মানে, সংখ্যা সম্পর্কিত কতকগুলো প্রশ্নাতীত ও সরলতম বাক্য বা ‘স্বতঃসিদ্ধ’ থেকে শুরু করে স্রেফ ‘সত্যি’, ‘মিথ্যে’, ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘এবং’, ‘অথবা’ জাতীয় ধারণা বা তাদের নানা জটিল সমবায় দিয়ে যৌক্তিক প্রক্রিয়াকরণ করতে করতে পাটিগণিতে পৌঁছে যাওয়া যায়, নিরেট নিশ্ছিদ্র যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া যায়, কেন দুইয়ে দুইয়ে চারই হতে বাধ্য, অন্য কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, গণিত যদি মুলত যুক্তিই হয়, তাহলে পরের কথাটা উঠে আসে সহজেই— গণিত আর যুক্তি তবে আমাদের কথার ‘বিষয়বস্তু’ নয়, স্রেফ ‘ফর্ম’ বা ‘সিন্ট্যাক্স’ বা কাঠামো। ব্যাখ্যা করা যাক। নিচের যুক্তিটা লক্ষ করুন।

যদি [শরদিন্দুর গল্প পড়ি], তবে [মজা পাব]
[শরদিন্দুর গল্প পড়ছি]
অতএব, [মজা পাব]

ঠিক একইভাবে,

যদি [রসগোল্লা খাই], তবে [মিষ্টি লাগবে]
[রসগোল্লা খাচ্ছি]
অতএব, [মিষ্টি লাগবে]

নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, এর মধ্যে একটা কাঠামো আছে। কাঠামোটা হচ্ছে,

যদি [ক], তবে [খ]
[ক]
অতএব, [খ]

বুঝতেই পারছেন, ‘ক’ এবং ‘খ’ অক্ষরগুলো চিহ্নমাত্র, বীজগণিতের ‘এক্স’ আর ‘ওয়াই’-এর মতন ‘ভ্যারিয়েব্‌ল্‌’ বা চলরাশি, যার জায়গায় নানা কিছুই বসতে পারে। ‘শরদিন্দুর গল্প পড়ি’, ‘মজা পাব’, ‘রসগোল্লা খাই’, ‘মিষ্টি লাগবে’, এইসব হচ্ছে ওই চলরাশিগুলোর একেকটা ‘মান’। যুক্তিশাস্ত্রে এই বিশেষ ধরনের যুক্তিকে বলে ‘মোডাস পোনেন্স’। কাঠামোটা এমনই যে, এতে সত্যি বাক্য ঢোকালে সত্যি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবেই। এবার নিচের যুক্তিটা লক্ষ করা যাক।

যদি [উচ্ছে খাই], তবে [মিষ্টি লাগবে]
[উচ্ছে খাচ্ছি]
অতএব, [মিষ্টি লাগবে]

যুক্তির কাঠামো ঠিক থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কিন্তু সিদ্ধান্ত ঠিক হল না, কারণ, ‘উচ্ছে খেলে মিষ্টি লাগবে’ বিবৃতিটি সত্যি নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যুক্তির সঠিক কাঠামোতে সত্যি বাক্য ঢোকালে সত্যি সিদ্ধান্তই বেরোবে, বাক্যের বিষয়বস্তু যা-ই হোক না কেন। শরদিন্দুর গল্প নিয়েই কথা বলি বা রসগোল্লা বা উচ্ছে, সঠিক সিদ্ধান্ত তাতে আটকাচ্ছে না, যদিও এর কোনওটাই বৈজ্ঞানিক বিষয় নয়। এবার দেখা যাক, বাক্যের বিষয়বস্তু বৈজ্ঞানিক হলে কী দাঁড়ায়।

যদি [চুনের ওপর অ্যাসিড ঢালি], তবে [কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বেরোবে]
[চুনের ওপর অ্যাসিড ঢালছি]
অতএব, [কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বেরোবে]

কাজেই, এটা পরিষ্কার যে, সত্যি বাক্যের ওপরে যুক্তি খাটালে সত্যি সিদ্ধান্তই বেরোবে, বাক্যের বিষয়বস্তু বৈজ্ঞানিক হোক বা না-ই হোক। এটা ঘটবে শুধু যুক্তির কাঠামোটির নিজস্ব গুণের ফলেই, বিষয়বস্তুর গুণের কারণে মোটেই নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাধারণ কথা আর বৈজ্ঞানিক কথার যুক্তি যদি একই হয়, তবে বিজ্ঞানের আর বিশেষত্বটা কী রইল? এর সোজা উত্তরটা হচ্ছে, বিজ্ঞানের বিশেষত্বটা এইখানে যে, সাধারণ কথায় যেখানে যুক্তি হয় ঢিলেঢালা আর সিদ্ধান্তটা কতদূর সত্যি হল সে নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা থাকে না, সেখানে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তিটাকে যতদূর সম্ভব নিরেট ও নিশ্ছিদ্র রাখবার একান্ত চেষ্টা থাকে, যাতে করে ভুল সিদ্ধান্ত মোটেই বেরোতে না পারে।

আর, গাণিতিক সিদ্ধান্ত তবে কীভাবে অত অমোঘ হয়? কীভাবে ‘দুয়ে দুয়ে চার’ বা ‘সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ তার ভূমি ও লম্বের বর্গের যোগফলের সমান হবে’ জাতীয় সিদ্ধান্তগুলো এত অবিনশ্বর, অপরিবর্তনীয় হতে পারে? রাসেল ও তাঁর মতাবলম্বী গণিত-দার্শনিকেরা বলবেন, সেটা হয়, কারণ এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা থেকে আসে না, আসে ত্রিভুজ ও সংখ্যার নিজস্ব সংজ্ঞা থেকেই। সমস্ত মিস্টিক ধোঁয়াটেপনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাই বার্ট্র্যান্ড রাসেল তাঁর মার্কামারা কৌতুকবোধ সহকারে ‘হিস্ট্রি অফ ওয়েস্টার্ন ফিলোজফি’ নামক মহাগ্রন্থে ঘোষণা করেন, ‘এভাবেই, গণিতের জ্ঞান আর রহস্যময় থাকে না। বোঝা যায়, তিনফুটে এক গজ হয় এই কথার মধ্যে যে মহাসত্য আছে, সেই একই মহাসত্য আছে গণিতেও।’

তাহলে, পরিস্থিতিটা বোধহয় শেষমেশ দাঁড়াল এইরকম। মেনস্ট্রিম অবস্থান বলছে, একধারে বিজ্ঞান এবং অন্যধারে যুক্তি ও গণিতকে একই  পর্যায়ে ফেলা যায় না, কারণ বিজ্ঞান বাস্তব জগত নিয়ে ভাবিত, কিন্তু যুক্তি ও গণিত তা নয় । বাস্তব জগত নিয়ে ভাবিত না হওয়া সত্ত্বেও তা বাস্তব জগতের ক্ষেত্রে এত বেশি করে খেটে যায় কেন, সে প্রশ্নের উত্তরে জিন্‌স্‌ এবং ভিগনার বলবেন, কারণ তা রহস্যময়, অলৌকিক, ঐশ্বরিক (এ চিন্তাধারার শেকড় হয়ত বা আছে প্লেটো এবং পাইথাগোরাসের মধ্যে)। আর, ওই একই প্রশ্নের উত্তরে রাসেল ও হিলবার্টের মত যুক্তিবাদী গণিত-দার্শনিক বলবেন, যুক্তি ও গণিত বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান সবেতেই খাটে কারণ ও হল গিয়ে বিষয়বস্তু-নিরপেক্ষ কাঠামোগত সত্য, মানে অন্য কথায় বললে, ওর মধ্যে আদৌ বস্তুগত বা অভিজ্ঞতাজাত সত্য বলে কিছুই নেই!

এখন তবে আমরা এসে পড়লাম এমন এক বিন্দুতে, যেখানে বাস্তব জগতে যুক্তি ও গণিতের বিস্ময়কর প্রাসঙ্গিকতা ও প্রযোজ্যতাকে স্বীকার ও ব্যাখ্যা করতে গেলে হয় মানতে হবে যে এই ব্যাপারগুলো অবোধ্য/অলৌকিক/ঐশ্বরিক, আর নয়ত মেনে নিতে হবে যে, যুক্তি এবং গণিত বাস্তব বিষয়বস্তুহীন, ফাঁপা, পোশাকি! লাখ টাকার প্রশ্নটা হচ্ছে, আমরা কি এর মধ্যে যে কোনও একটাকে বেছে নিতে বাধ্য, না কি অন্যতর কোনও সম্ভাবনার কথাও ভাবা চলতে পারে? সে নিয়ে আমরা এখন একটু মাথা ঘামাতে চাইব, কিন্তু তার আগে বোধহয় বৈজ্ঞানিক সত্য এবং যৌক্তিক/গাণিতিক সত্যের প্রস্তাবিত ফারাকটা, যার কথা ওপরে বারবারই উঠে এসেছে, সেটা মনের মধ্যে আরেকবার একটু ঝালিয়ে নিলে সুবিধে হবে।

বৈজ্ঞানিক সত্য মানে হচ্ছে, জগত-সংসার সংক্রান্ত সত্য। সে সত্যের প্রযোজ্যতার নানা মাত্রা ও স্তর থাকতে পারে, এবং আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারের কাছে তার গুরুত্বও নানা মাত্রার হতে পারে, কিন্তু সেগুলো সবই জাগতিক সত্য। বছর ঘুরতে যে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন লাগে, এটা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সত্যি, কিন্তু শুধুমাত্র এই ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহটার জন্যেই সত্যি। আবার, রাতের আকাশে যে উত্তর দিকে ধ্রুবতারা থাকে, এটা হয়ত এ গ্রহের বর্তমান বাসিন্দাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যি, কিন্তু এই পৃথিবীরই কয়েক হাজার বছর আগেকার বাসিন্দাদের কাছে মোটেই সত্যি ছিল না। সেই রকম, এই সৌরজগতে ন-টি গ্রহ আছে, বা প্যারাসিটামল প্রয়োগে জ্বরের উপশম হয়, বা তরলের মধ্যে ভারি জিনিস ডুবে যায় আর হালকা জিনিস ভাসে, বা দু-ভাগ হাইড্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন মিলে জল হয়— এ সবই হল মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু নানা মাত্রার নিশ্চয়তা ও প্রযোজ্যতা বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক সত্য, এবং জাগতিক সত্যও। কলকাতার সমস্ত পথকুকুরদের লেজের দৈর্ঘের গড় যদি বার করি, তো সেও এক পরিশ্রমসাধ্য জাগতিক সত্যই হল, যদিও এর গুরুত্ব কানাকড়িও নয়, এত পরিশ্রম সত্ত্বেও এই মৌলিক জ্ঞানলাভের জন্য কেউই সম্ভবত আমায় পিএইচডি ডিগ্রি দেবে না। আবার, মাধ্যাকর্ষণ বা বিদ্যুৎ বা চুম্বক বা পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাদের আচরণের নিয়ম, এইসব সত্যিগুলো সারা ব্রহ্মাণ্ডেই খাটবে বা খাটার কথা, কাজেই তার গুরুত্বও সবচেয়ে বেশি, ফলে এগুলো যারা আবিষ্কার করে মানবসমাজ তাদেরকে মাথায় করে রাখে। তো এখন মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, এগুলো সবই বাস্তব জগতের জ্ঞান, এ রকম জ্ঞান পেতে গেলে বাস্তব জগতের নানা জিনিসপত্তর বা ক্রিয়াকলাপ খুঁটিয়ে দেখে দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়, দরকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাতে হয়, শুধু এক জায়গায় বসে বসে মনে মনে বুদ্ধি খাটিয়ে এ সব ব্যাপার-স্যাপার জানা যায় না।

আর, সে জায়গায়, যৌক্তিক/গাণিতিক জ্ঞান বা সত্যের ব্যাপারটা কিন্তু পুরো আলাদা। আগেই উদাহরণ সহযোগে ব্যাখ্যা করেছি, এ ধরনের ক্ষেত্রে বাক্যের সত্যাসত্য শুধু তার কাঠামোর ওপরেই নির্ভর করে, বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে না। এখানে আরও দু-একটা দৃষ্টান্ত দিলে সুবিধে হতে পারে। ধরা যাক, এক সুন্দর সকালে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলাম,  ‘সীসা হল তামার চেয়ে ভারি’। এখন, এ কথাটার বিষয়বস্তু হচ্ছে দুই জাগতিক বস্তু— সীসা ও তামা। কাজেই, সীসা ও তামা আসলে ঠিক কেমন সে বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান না থাকলে এ কথার সত্যাসত্য জানা অসম্ভব। কিন্তু এবার, ধরুন যদি বলি, ‘সীসা তামার চেয়ে হয় ভারি, আর না হলে ভারি নয়’— এ কথাটা কিন্তু সত্যি হতে বাধ্য, বাস্তবে সীসা আর তামা যেমনই হোক না কেন। ঠিক সেইরকম, ‘চিনি হল মিষ্টি’ এ কথাটার সত্যতা চিনি খেয়ে পরখ করতে হবে, কিন্তু ‘চিনি হয় মিষ্টি না হয় মিষ্টি নয়’ এই কথাটা সব সময়ই সত্যি থাকবে, চিনি জিনিসটা যেমনই হোক না কেন। একইভাবে, ‘লোহা তো লোহার মতনই হবে’, কিম্বা, ‘হয় পরীক্ষায় পাশ করবে আর না হয় করবে না, এর বাইরে তো আর কিছু হবে না’— এই সব কথারও সত্যি না হয়ে উপায় নেই, ‘লোহা’ আর ‘পরীক্ষায় পাশ করা’ ব্যাপারগুলো যা-ই হোক না কেন। এই কথাগুলোর মধ্যে যেহেতু বাস্তব জগত সম্পর্কে কোনও জ্ঞান ধরে রাখা থাকে না, অতএব মনে হতে পারে, এগুলো বুঝি স্রেফ তুচ্ছ অকাজের কথা, কিন্তু আসলে মোটেই তা নয়। বরং, জগত সম্পর্কে যা অল্প দু-চার কথা আমরা জানি, অর্থাৎ ওপরে বর্ণিত প্রথম ধরনের সত্য, তার সঙ্গে দ্বিতীয়োক্ত ধরনের অর্থাৎ যৌক্তিক/গাণিতিক সত্যকে মেলালে এমন সব আশ্চর্য সত্য জানা যায়, যা ইতিমধ্যে জানা সত্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল, কিন্তু যৌক্তিক/গাণিতিক বিশ্লেষণ ছাড়া কোনওদিনই কল্পনাও করা যেত না। জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের আকাশ পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ তথ্যগুচ্ছ থেকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে গ্রহদের চলাফেরার যে সুঠাম তত্ত্ব বার করে আনলেন বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার, বা কেপলারের তত্ত্ব থেকে আবার মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের মত যে মৌলিকতম মহাজাগতিক সত্যে গিয়ে পৌঁছলেন বিজ্ঞানী নিউটন, দীর্ঘ ও জটিল যৌক্তিক/গাণিতিক বিশ্লেষণ ছাড়া সেটা মোটেই সম্ভব হত না।

কিন্তু, এখানেই তো আবারও ঘুরে আসবে সেই পুরনো প্রশ্ন— জাগতিক সত্যের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যৌক্তিক/গাণিতিক বিশ্লেষণ এত কার্যকর  কেন, কেনই বা তার সঙ্গে যৌক্তিক/গাণিতিক সত্যের এত বেশি সদ্ভাব? এর উত্তর, আগেই বলেছি, মূলত দুরকম। জিন্‌স্‌-ভিগনারীয় মরমীয়াবাদী অবস্থান থেকে উত্তর হবে, এর কারণ দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময়, অলৌকিক। আর যুক্তিবাদী লজিসিস্ট-ফর্ম্যালিস্ট অবস্থান বলবে, বাস্তব জগত যেমনই হোক না কেন, যুক্তি আর গণিত তার সঙ্গে ঠিকই এঁটে যাবে বা যেত, কারণ এগুলোর মধ্যে বাস্তব বিষয় বলতে কিছুই নেই, এগুলো হচ্ছে শুধুই বাক্যের কাঠামোর ব্যাপার, এবং সেইহেতু একান্তভাবে ফাঁপা ও পোশাকি। এখন তবে সময় এসেছে এই দুই অবস্থানকে একটু নেড়েচেড়ে দেখার।

এ ব্যাপারে জেম্‌স্‌ জিন্সের বক্তব্য বিশ্বাসী ধার্মিকদেরকে উৎসাহিত করলেও সত্যিকারের বিজ্ঞানী/দার্শনিক মহলে বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি মোটেই, যদিও ইউজিন ভিগনারের ছোট্ট গবেষণাপত্রটি বৈদ্যায়তনিক গবেষকমহলে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রখ্যাত পদার্থবিদ থেকে গণিতজ্ঞ থেকে দার্শনিক পর্যন্ত অনেকেই এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন সাগ্রহে। ফলে, এখানে শুধু ভিগনারকে নিয়ে কথাবার্তা বলাটাই যথেষ্ট হবে।

১৯৬০ সালে ‘কম্যুনিকেশন্স ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স’ নামক গবেষণা-পত্রিকায় প্রকাশিত ভিগনারের এই বিখ্যাত প্রবন্ধটির নামেই ছিল বিষয়বস্তুর পরিষ্কার ইঙ্গিত, ‘দি আনরিজনেব্‌ল্‌ এফেক্টিভনেস অফ ম্যাথমেটিক্স ইন দ্য ন্যাচারাল সায়েন্সেস’। এতে যা বক্তব্য ছিল তা আগে বলেছি, এখন না হয় আরেকবার বলি। প্রথমত, গণিত হল কিছু ধারণা আর নিয়ম নিয়ে সুদক্ষ এক মানসিক কেরামতি, যার সঙ্গে বাস্তবের যোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান হল, প্রকৃতির খুব সামান্য কিছু অংশ সম্পর্কে আশ্চর্যরকম নিখুঁত কিছু গাণিতিক সূত্র (ভিগনার অবশ্য এখানে ‘বিজ্ঞান’ বলতে শুধু পদার্থবিদ্যাই বুঝিয়েছেন)। তৃতীয়ত, প্রকৃতির ঠিক ওই ওই অংশের ক্ষেত্রে যে গণিতের ঠিক ওই ওই সূত্রগুলোই কেন খাটবে, তার  বুদ্ধিগ্রাহ্য কোনও কারণই নেই (‘সৌন্দর্যবোধ’ বা ওই ধরনের কিছু ধোঁয়াটে ইঙ্গিত ছাড়া)। চতুর্থত, এই যে প্রকৃতির কোনও এক অংশের আচরণ কোনও এক গাণিতিক নিয়মের সঙ্গে মিলে গেলেই পদার্থবিদরা কার্যকারণ না বুঝেই সেটাকে দুম করে প্রকৃতির নিয়ম বলে ঘোষণা করে দেন, তার কারণটা হচ্ছে, পদার্থবিদরা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’! এইসব গুরুতর ঘোষণার পর ভিগনার কয়েকটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত হাজির করেন পদার্থবিদ্যার ইতিহাস থেকে, যেখানে গণিতের ব্যবহার আশ্চর্যরকম সফল, অথচ গণিতের ওই নির্দিষ্ট সূত্রটি কেন যে ওখানে খেটে গেল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই । যেমন, নিউটনের সূত্রের ক্ষেত্রে ‘ক্যালকুলাস’, উত্তেজিত পরমাণুর বিকিরণের ক্ষেত্রে হাইজেনবার্গ ও অন্যান্যদের ‘ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স’, এবং ‘ল্যাম্ব শিফ্‌ট্‌’ নামক আরেক ধরনের পারমাণবিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানী বেথে ও শোয়াইঞ্জার আবিষ্কৃত আরেকটি বিশুদ্ধ গাণিতিক সূত্র। ভিগনার এও দেখান যে, অনেক ক্ষেত্রে, গাণিতিক সূত্রটি বাছা হয়েছে যে বিশেষ বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধানের জন্য, সেই বিশেষ সমস্যার বাইরেও ওই বিষয়েরই আরও জটিল সমস্যার ক্ষেত্রেও সে সব গাণিতিক সূত্র আশ্চর্যভাবে খেটে যাচ্ছে!

একটি বিষয় কিন্তু লক্ষ করার মত । তাঁর গবেষণাপত্রের শুরুর দিকেই কিন্তু ভিগনার স্বীকার করে নিয়েছিলেন, পূর্ণ সংখ্যা বা ইউক্লিডের জ্যামিতির মত প্রাথমিক গণিত নিয়ে এমন কোনও সমস্যা নেই, কারণ, এইটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে এইগুলোর ধারণা সরাসরি বাস্তব জগত থেকেই এসেছে । তাঁর মতে, এই দুর্বোধ্যতার সমস্যাটা শুধু উচ্চতর গণিত নিয়েই । এখন, উচ্চতর গণিত যেহেতু প্রাথমিক গণিত থেকেই ধাপে ধাপে তৈরি হয়েছে, অতএব এই স্বীকৃতির ফলে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে রহস্যের ঝাঁঝ এমনিতেই কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল । তবু, ভিগনারের মত খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর তরফে এইসব রহস্যমাখা বক্তব্য প্রকাশিত হবার পর গবেষকমহলে বেশ সাড়া পড়ে, এবং নানা প্রতিক্রিয়া আসে এর পক্ষে ও বিপক্ষে । পরবর্তী কয়েক দশক ধরে অনেকেই এর পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খাড়া করার চেষ্টা করেন । যেমন, হয়ত গণিতের ধারণাগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব সত্যিই আছে কোথাও একটা (তথাকথিত ‘প্লেটোনিক’ অবস্থান), বা পদার্থবিদ ও গণিতবিদ উভয়ের চিন্তা ও উপলব্ধির মধ্যেই হয়ত ‘সৌন্দর্যবোধ’ জাতীয় অন্য কোনও বিষয় ঢুকে পড়ে একটা অদৃশ্য সেতু রচনা করে দিচ্ছে, বা জৈববিবর্তনের দীর্ঘ বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়ত কিছু মৌলিক জাগতিক ও গাণিতিক বোধ আমাদের মস্তিষ্কে আস্তানা গেড়ে বসে আছে, বা হয়ত আমরা মনে মনে জটিল প্রকৃতির মধ্যে কতকগুলো ব্যাপার ধরে নিয়ে আর অন্য কতকগুলো ব্যাপার ইচ্ছে করে বাদ দিয়ে তাকে এমনভাবে গড়েপিটে নিচ্ছি যাতে করে আমাদের পছন্দমত গণিতের নিয়মকানুন তাতে অনায়াসে খেটে যায় — এই রকম সব ব্যাখ্যা । অতি সম্প্রতি নরওয়ের বার্গেন ইউনিভার্সিটির গবেষক সোরিন বাঙ্গু এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টাগুলোর সারসংক্ষেপ ও মূল্যায়নকে এক জায়গায় ধরেছেন একটি মাত্র গবেষণাপত্রের মধ্যে, এবং সেইসঙ্গে পেশ করেছেন একান্ত নিজস্ব এক স্বতন্ত্র বিশ্লেষণও । তার কথা এখানে একটু বলে নিয়ে ভিগনারের প্রসঙ্গে ইতি টানব ।

অধ্যাপক বাঙ্গু তাঁর গবেষণাপত্রের শুরুর দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করেন ভিগনারের বক্তব্যের মধ্যেকার যুক্তির এক অতি সাধারণ ভ্রান্তির দিকে । ভিগনারের মোদ্দা যুক্তির কাঠামোটি ছিল এই রকম —

১ম বৈজ্ঞানিক সমস্যার ক্ষেত্রে ‘ক’ গাণিতিক সূত্রটি খেটে গেছে, এবং তার পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি
২য় বৈজ্ঞানিক সমস্যার ক্ষেত্রে ‘খ’ গাণিতিক সূত্রটি খেটে গেছে, এবং তার পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি
৩য় বৈজ্ঞানিক সমস্যার ক্ষেত্রে ‘গ’ গাণিতিক সূত্রটি খেটে গেছে, এবং তার পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি
৪র্থ ………………………………… ‘ঘ’ ………………………………………, এবং ……………………………………………………………….
৫ম ………………………………… ‘ঙ’ ………………………………………, এবং ……………………………………………………………….
[ ]-তম বৈজ্ঞানিক সমস্যার ক্ষেত্রে ‘[ ]’ গাণিতিক সূত্রটি খেটে গেছে, এবং তার পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি

অতএব, যত গাণিতিক সূত্র বিজ্ঞানে কাজে লেগেছে তার সবই অযৌক্তিক !

এখন, ভাল করে লক্ষ করে দেখুন, এই আকারের যুক্তি অন্য ব্যাপারে প্রয়োগ করলে তার ফল কী দাঁড়ায় —

‘ক’ একজন কবি, এবং তার দাড়ি আছে
‘খ’ একজন কবি, এবং তার দাড়ি আছে
‘গ’ একজন কবি, এবং তার দাড়ি আছে
‘ঘ’ ………………., এবং …………………….
‘ঙ’ ………………., এবং …………………….
অতএব, এ ধরাধামে কবি মাত্রেই দেড়েল !

দেখতেই পাচ্ছেন, সিদ্ধান্তটি হাস্যকর । এভাবে যেমন কবিত্বের সঙ্গে দাড়ির কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় না, ঠিক তেমনি আবার গণিতের সঙ্গে তার ‘অযৌক্তিক কার্যকারিতার’ কার্যকারণ সম্পর্কও প্রতিষ্ঠা করা যায় না । তবু তা সত্ত্বেও, উচ্চতর গণিত কেন এত কার্যকর সে প্রশ্ন হয়ত বা বেঁচে থাকে কোনও একরূপে, একটু মোটাদাগে হলেও । এর সম্ভাব্য নানা উত্তর নিয়ে নাড়াচাড়ার পর সোরিন বাঙ্গু যে উত্তরটি পেশ করেন, সেটি বেশ সরল, অথচ যথেষ্টই চমকপ্রদ ও চিত্তাকর্ষক ।

গণিতের মধ্যে আদৌ তেমন কোনও রেডিমেড অলৌকিক কার্যকারিতা নেই, কোন ধরনের গণিত কোথায় লাগবে সেটা অনেক কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হয় বিজ্ঞানীকে । কিন্তু গণিতের সুবিধেটা হচ্ছে এই যে, এর সাহায্যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সুনির্দিষ্ট আকার পায়, তা মূর্ত হয়ে ওঠে, তা নিয়ে নির্দিষ্টভাবে চর্চা ও সমালোচনা করা যায়, তাকে তখন  অনেক বাস্তব কাজেকর্মে লাগানো চলে । ফলে, কোনও বিজ্ঞানী যদি সঠিক তত্ত্বটি ভেবেচিন্তে বারও করে ফেলেন, তিনি মোটেই গুরুত্ব বা স্বীকৃতি পাবেন না, যদি গণিতের সাহায্যে তাকে গুছিয়ে প্রকাশ করতে না পারেন (কথাগুলো মূলত পদার্থবিজ্ঞানকে লক্ষ করেই বলা হচ্ছে, বুঝেছেন নিশ্চয়ই) । কাজেই, তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন না, ইতিহাসে স্থানও পাবেন না । পরবর্তীকালে আমরা স্মরণ করব শুধু তাঁদেরই, যাঁরা তা করে উঠতে পেরেছেন, যেমনটি স্মরণ করেছেন ভিগনার ।

তাহলে ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত দাঁড়াচ্ছে এই রকম যে, বিজ্ঞান গবেষণার পরিসর থেকে একটা সমস্যা উঠে এল, অনেক বিজ্ঞানীই ঝাঁপালেন তার সমাধানের জন্যে, তার মধ্যে অল্প কয়েকজন অনেক ভেবেচিন্তে ঠিকঠাক সমাধান খুঁজে পেলেন, এবং যাঁরা তা খুঁজে পেলেন তাঁদের মধ্যেও খুব অল্প দুয়েকজন মাত্র তা ঠিকঠাক গণিতের সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করতে পারলেন (একজন পেরে গেলেই বাকিরা আর চেষ্টা করবেন না) । এরপর আমরা করলাম কী, শেষের ওই সফল দুয়েকজনকে মনে রেখে বাকিদেরকে ভুলে গেলাম, এবং শুধু ওই সফল দৃষ্টান্তগুলোকে সামনে রেখে গণিতের অনির্বচনীয় কার্যকারিতায় মুগ্ধ হলাম, এর আগে কত গাণিতিক আঁকিবুঁকি যে ব্যর্থ হয়েছে সে খোঁজ নেবার আর দরকার মনে করলাম না ।

বাঙ্গু বলেছেন, একটা হাসপাতালে ঢুকে কেউ যদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এ কি, চারদিকে শুধু অসুস্থ লোকজন দেখছি কেন’, — তাহলে প্রশ্নটা যেমন শোনাবে, এও অনেকটা সেই রকমই । গণিতের ‘অলৌকিক’ কার্যকারিতা সংক্রান্ত ভিগনারীয় গসপেলটির নটেগাছটি, অতএব, মুড়োলো । লজিসিস্ট/ফর্ম্যালিস্ট গণিতদর্শন কথিত ফাঁপা ও পোশাকী যৌক্তিক/গাণিতিক সত্য সম্পর্কে পণ্ডিতেরা কে কী বলেছেন, সেদিকে এবার একটু নজর দেওয়া যাক তবে ।

লজিসিস্ট/ফর্ম্যালিস্ট ধারার গণিত-দার্শনিকেরা কেন যে যৌক্তিক/গাণিতিক সত্যকে একান্তভাবে বিষয়বস্তুহীন, কাঠামোগত, ফাঁপা, পোশাকী বলে মনে করেন, দৃষ্টান্ত সহযোগে তার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে একাধিকবার করেছি এ লেখায়, কাজেই এখন আর তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না । তার চেয়ে বরং এ হেন অনুসন্ধানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসিদ্ধান্তকে চোখের সামনে তুলে আনা যাক, যাতে করে তাদেরকে অবলম্বন করে এই অবস্থানটি সম্পর্কে আমাদের প্রশ্নগুলোকে সুনির্দিষ্ট আকার দেওয়া যায় ।

প্রথমত, এই লজিসিস্ট-ফর্ম্যালিস্ট অবস্থান যদি সত্যি হয়, তবে যৌক্তিক/গাণিতিক সত্যের মধ্যে অভিজ্ঞতাজাত উপাদান কিছু থাকবে না । ফলে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন নতুন অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে পুরোনো তত্ত্ব বাতিল বা সংশোধিত বা পরিমার্জিত হয়ে থাকে প্রায়শই, যুক্তি বা গণিতের ক্ষেত্রে তা মোটেই সম্ভব হবার কথা না । দ্বিতীয়ত, যে কোনও যৌক্তিক বা গাণিতিক ব্যবস্থা যদি পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ ও স্ববিরোধহীনভাবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে কোনও সময়ই কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গেই তার কোনও বিরোধ হবে না । এখন দেখা যাক, এই অনুসিদ্ধান্তগুলোর নিরাপত্তা প্রশ্নাতীত কিনা । অবশ্য, সেটা দেখার আগে, যুক্তির সুপ্রাচীন দার্শনিক ভিত্তিটির কথা একটু না পাড়লেই নয় ।

আড়াই হাজার বছর আগেকার প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক-চূড়ামণি অ্যারিস্টোট্‌ল্‌ যুক্তিসম্মত চিন্তার মধ্যেকার তিনটি নিয়মের কথা বলেছিলেন । প্রথমত, যে কোনও কিছুই (মানে বিবৃতি বা ধারণা বা বস্তু ইত্যাদি) তার নিজের সঙ্গে সমান/অভিন্ন হবে (বুঝতেই পারছেন, এটা না হলে কোনও কিছুই তার নিজস্ব সত্তায় স্থিত হতে পারবে না, সব কিছুই কেবলই ‘অন্য কিছু’ হয়ে যেতে থাকবে) । দ্বিতীয়ত, কোনও কিছুই একই সঙ্গে সত্যি এবং মিথ্যে হতে পারবে না (স্বাভাবিক ব্যাপার, এটা না হলে তো সত্যি আর মিথ্যের মধ্যে তফাতই থাকবে না) । তৃতীয়ত, যে কোনও কিছুকেই হয় সত্যি নয় মিথ্যে হতে হবে, তার বাইরে অন্য কিছু আর হতে পারবে না (সত্য আর মিথ্যের বাইরে তৃতীয় কোনও সত্যমূল্যের অস্তিত্ব থাকলে ‘সত্য’ ধারণাটিই ধোঁয়াটে হয়ে যাবে) । একটু ভাবলে বোঝা যাবে, অসামান্য প্রজ্ঞা থেকে উৎসারিত এই তিনটি নিয়ম না মানলে যুক্তিতর্ক সম্পূর্ণ অসম্ভব । প্রথম নিয়মটিকে দর্শনশাস্ত্রের ভাষায় বলে ‘ল অফ আইডেন্টিটি’ বা ‘অভেদের নিয়ম’ । দ্বিতীয়টিকে বলে ‘ল অফ নন-কন্ট্রাডিকশন’ বা ‘স্ববিরোধ না করার নিয়ম’ । আর তৃতীয়টির নাম ‘ল অফ দি এক্সক্লুডেড মিড্‌ল্‌’ বা ‘মধ্যমবর্জনের নিয়ম’, অর্থাৎ, সত্যি আর মিথ্যের মাঝামাঝি কিছু থাকা চলবে না এই নীতি ।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজ দার্শনিক জর্জ বুল অ্যারিস্টোট্‌ল্‌-এর এই তিনখানি নিয়মের ওপর ভর করে প্রায় খেলাচ্ছলে বানিয়ে তোলেন গণিতপ্রতিম এক সাঙ্কেতিক ভাষা-ব্যবস্থা, যা দিয়ে যুক্তিতর্কের সিদ্ধান্ত অঙ্কের মত করে ‘কষে’ বার করে আনা যায় । পরে এ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রোপোজিশনাল ক্যালকুলাস’ ওরফে ‘জিরো অর্ডার লজিক’, যা আজ তথ্যপ্রযুক্তির মূল তাত্ত্বিক ভিত্তি, এবং যুক্তিশাস্ত্রের প্রধান হাতিয়ার ।

বিপুল সাফল্য সত্ত্বেও, যুক্তির ভিত্তিস্বরূপ এই কালজয়ী প্রাচীন নীতিগুলো নিয়ে কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে বরাবরই । উনিশ শতের গোড়ায় দার্শনিক হেগেল এবং শেষে মার্ক্স ও এঙ্গেল্‌স্‌, এবং গোটা বিশ শতক জুড়ে মূলস্রোতকে প্রশ্ন করতে চাওয়া যুক্তিশাস্ত্রীরা এ নিয়ে আঙুল তুলেছেন ক্রমাগতই । অভিযোগ, এ যুক্তি জগতের স্থিতিশীলতাকে যতটা ভাল করে ধরতে পারে, তার গতি-পরিবর্তনশীলতা-জটিলতাকে ততটা ভাল করে ধরতে পারে না । আবার, দীর্ঘদিন যাবৎ গণিতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য হয়ে আসা ইউক্লিডের জ্যামিতি নিয়েও ধেয়ে এল প্রশ্ন — এ জ্যামিতির সিদ্ধান্তগুলো আমাদের ধরাছোঁয়ার পরিসরের ভেতরে যতটা ঠিকঠাক বলে মনে হয়, অতিবৃহৎ মহাজাগতিক পরিসরেও কি ঠিক ততটাই ? ভাল করে লক্ষ করে দেখুন, অভিযোগটা কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই বাস্তবতাকে সঠিকভাবে ধরতে পারা-না-পারা নিয়ে ! বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে এমন হওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ বিজ্ঞান বাস্তব জগত নিয়ে কথা বলে । কিন্তু যুক্তি বা গণিত যদি শুধু যদি শুধু বিষয়বস্তু-নিরপেক্ষ, কাঠামোগত, পোশাকী সত্য নিয়েই কথা বলবে, তবে তার বিরুদ্ধে বাস্তবতাকে যথেষ্ট নিখুঁতভাবে ধরতে না পারার অভিযোগটা আদৌ উঠবে কেন ? তবে কি তার মধ্যেও কোথাও লুকিয়ে আছে বাস্তব অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞানের উপাদান ?

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এ প্রশ্ন তাড়া করেছে বেশ কিছু চিন্তাশীল দার্শনিক, যুক্তিশাস্ত্রী, গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানীকে । ১৯৩৬ সালে গণিতজ্ঞ নয়ম্যান এবং বির্কহফ প্রস্তাব করেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বোঝার জন্য পুরোনো অ্যারিস্টোট্‌লীয় যুক্তি যথেষ্ট নয়, তাই চাই নতুন এক লজিক । যেহেতু ইলেক্ট্রনের মত অতি ক্ষুদ্র কণা তার চলার পথে কোথাও কোনও সূক্ষ্ম যন্ত্রে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত কখন ঠিক কোথায় ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, শুধুই সম্ভাবনার মাপকাঠিতে বলতে হয়, অতএব তার অবস্থানকে সত্যি বা মিথ্যে কিছুই বলা যাচ্ছে না । কাজে কাজেই, অ্যারিস্টোট্‌ল্‌-এর পূর্বকথিত তিনটি নিয়মের মধ্যে তৃতীয়টিকে (‘ল অফ এক্সক্লুডেড মিড্‌ল্‌’ বা মধ্যমবর্জনের নীতি) বাদ দিয়ে শুধু বাকি দুটি নিয়মকে সম্বল করে নতুন যুক্তিশাস্ত্র গড়তে হবে, এই ছিল তাঁদের দাবি । এ প্রচেষ্টা যে শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, এমন নয় । কারণ, প্রথমত, এ দিয়ে কোয়ান্টামতত্ত্বের অন্তর্নিহিত ধাঁধাগুলোর সমাধান যেভাবে হবে বলে প্রত্যাশা ছিল, সেভাবে হয়নি । দ্বিতীয়ত, একটি নিয়ম বাদ দিয়ে এর যুক্তি-ব্যবস্থাটি কিঞ্চিত দুর্বল হয়েছে, ফলে এ দিয়ে জটিল সব উপপাদ্য গড়ে তোলা বা প্রমাণ করা অনেক বেশি কঠিন । কিন্তু, এর মধ্য দিয়ে যে বাস্তব বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে খোদ যুক্তিশাস্ত্রকেই সংস্কার করার দাবি উঠছে, তাতে সন্দেহ নেই ।

১৯৫১ সালে দার্শনিক ও যুক্তিশাস্ত্রী ডব্লিউ ভি কোয়াইন লিখলেন এক সাড়া জাগান গবেষণাপত্র, নাম ‘টু ডগমাস অফ এম্পিরিসিজ্‌ম্‌’ । এতে তিনি সবিস্তারে দেখালেন, ‘সিন্থেটিক স্টেটমেন্ট’ বা অভিজ্ঞতাজাত বাক্য আর ‘অ্যানালিটিক্যাল স্টেটমেন্ট’ বা যৌক্তিক/গাণিতিক বাক্যের সীমারেখা সব সময় খুব স্পষ্ট থাকে না । সেখানে ভাষাগত বিশ্লেষণ যেমন তিনি করলেন, তেমনি আবার বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘কোয়ান্টামতত্ত্বের সাপেক্ষে যুক্তিশাস্ত্রকে সংস্কার করতে হবে’ এই দাবিটিকেও টেনে আনলেন । নাম না করলেও, ইঙ্গিতটা যে নয়ম্যান-বির্কহফের পূর্বোক্ত গবেষণাপত্রটির দিকেই, তাতে সন্দেহ নেই ।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, অভিজ্ঞতামূলক বাক্য আর যৌক্তিক বাক্যের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যাবার দৃষ্টান্ত শুধু সাধারণ ভাষা বা যুক্তিশাস্ত্রে নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যায়, যেমনটি দেখিয়েছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞান-দার্শনিক টমাস কুন, তাঁর ‘কনসেপ্টস্‌ অফ কজ ইন দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ ফিজিক্স’ প্রবন্ধে । শিরোনামেই পরিষ্কার, লেখক পদার্থবিদ্যায় ‘কার্যকারণ’-এর ধারণার বিবর্তন নিয়ে কথা বলতে চান । প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোট্‌ল্‌-এর তত্ত্বে জগতের এত সব গতি ও পরিবর্তনের কারণ চার রকমের, যার মধ্যে দুটিই প্রধান — ‘ফর্ম্যাল কজ’ বা রূপাকাঙ্খী কারণ এবং ‘ফাইন্যাল কজ’ বা পরম কারণ । ‘কারণ’ সম্পর্কে এ ধরনের ধারণায়, বিশেষত প্রথমটিতে, বস্তুর ভেতরকার নিজস্ব ‘প্রবণতা’ বা ‘ধর্ম’-কে তার ‘স্বাভাবিক’ আচরণের ‘কারণ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হত । যেমন, পাথরের ‘ধর্ম’ নিচের দিকে পড়া তাই সে ওপর থেকে নিচে পড়ে, আগুনের ধর্ম ওপর দিকে ওঠা তাই আগুন জ্বালালে তার শিখা ওপরে উঠতে চায়, এই রকম ।

ষোড়শ শতক অবধি এই সব ধ্যান-ধারণাই দাপটের সঙ্গে চলত, কিন্তু সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার উদ্ভবের ফলে এ ধারণা হাস্যকর হয়ে পড়ল । বলা হল, এ ধরনের ‘ব্যাখ্যা’-য় আসলে আসলে কিছুই ব্যাখ্যা হয় না, শুধু ব্যাখ্যার নাম করে একই কথাকে একটু ঘুরিয়ে বলা হয় । পাথর নিচের দিকে পড়ে কারণ তার মধ্যে ‘পতনশীলতা’ ধর্ম আছে, এ কথা বললে খালি একটা ব্যাখ্যা ব্যাখ্যা ভাব করা হয়, কিন্তু পাথর পড়ার প্রকৃত কারণটা কিছুই বোঝা যায় না । ফরাসী ব্যঙ্গ-নাট্যকার মলিয়ের তাঁর নাটকে এক বৈজ্ঞানিক চরিত্রকে রেখেছিলেন, যিনি দাবি করতেন, আফিং ঘুম পাড়াতে পারে, কারণ, তার মধ্যে আছে ‘নিদ্রা-প্রদায়ী ধর্ম’ ! এভাবে, ‘ফর্ম্যাল কজ’-এর ধারণা তখন ভুয়ো পণ্ডিতির প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল । কিন্তু, বিজ্ঞানের ইতিহাস-তাত্ত্বিক টমাস কুন এখানে মনে করিয়ে দিতে চান, এ ধরনের ব্যাখ্যা সত্যি সত্যি ফাঁকা বাগাড়ম্বর কিনা সে প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর কিছুটা জটিল, এবং পরিস্থিতি-নির্ভর । যদি প্রতিটি ঘটনার ব্যাখ্যার জন্যই একটি করে নতুন ধর্ম আমদানি করা হয়, তাহলে অবশ্যই সেটি বাগাড়ম্বর মাত্র । কিন্তু, যদি অল্প কয়েকটি ধর্ম দিয়ে বহু রকমের ঘটনার ব্যাখ্যা হয়, তাহলে ব্যাপারটা আর অত খারাপ থাকে না, পরবর্তীকালের পদার্থবিদ্যায় এ ধরনের ব্যাখ্যার সফল দৃষ্টান্ত আছেও ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অভিজ্ঞতাজাত সত্য আর যৌক্তিক সত্যের সীমারেখাটি বারবারই প্রশ্নায়িত হয়েছে — শুধু যুক্তিশাস্ত্র ও গণিতের পরিসরে নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শনের পরিসরেও । এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৬৮ সালে ‘ইজ লজিক এম্পিরিক্যাল?’ নামক এক বিখ্যাত গবেষণাপত্রে দার্শনিক হিলারি পাটনাম দেখালেন, কোয়ান্টামতত্ত্বের সাপেক্ষে যুক্তিশাস্ত্রকে সংস্কার করতে হবে এই দাবি, আর আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ’ তত্ত্বের সাপেক্ষে ইউক্লিডের জ্যামিতি বাদ দিয়ে নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতিকে গ্রহণ করতে হবে এই দাবি — দুটোর মূল প্রকৃতিটা আসলে একই রকম । কারণ, এ দুটোর মধ্যেই স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে, যৌক্তিক-গাণিতিক সত্যের মধ্যেও বস্তুগত উপাদান থাকে, যুক্তি আর গণিতও তবে বাস্তব জগত বিষয়ে ‘কিছু বলে’ !

এই একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকে হিলারি পাটনাম এ বিষয়ে তাঁর আরও কিছু ভাবনা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেন ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর অতি সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যমণ্ডিত এক প্রবন্ধে, যার শিরোনামটি ছিল, ‘হোয়াট ইজ ম্যাথমেটিক্যাল ট্রুথ?’ । রচনার গোড়াতেই তিনি পরিষ্কার করে বলে দেন, তিনি গণিতের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার প্রশ্নে ‘রিয়্যালিস্ট’ এবং ‘অবজেক্টিভ’, কিন্তু তাই বলে মোটেই প্লেটোনিক নন । অর্থাৎ, গাণিতিক নির্মাণগুলোর বাস্তব ভিত্তি আছে বলে মনে করলেও, তাদের কোনও পরম ও আধিভৌতিক অস্তিত্ব তিনি মানেন না । মানেন না, যেহেতু সেগুলোর মান্যতা তার বাস্তব প্রয়োগের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে, এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেগুলো সংশোধিতও হতে পারে । এ বক্তব্যের সমর্থনে পাটনাম বেশ কিছু দৃষ্টান্ত হাজির করেন গণিতের ইতিহাস থেকে । যেমন, সপ্তদশ শতকে র‍্যনে দ্যকার্তের স্থানাঙ্ক জ্যামিতি আবিষ্কার, এবং নিউটনের ক্যালকুলাস আবিষ্কার । সংখ্যা দিয়ে যে জ্যামিতিক পরিসরের প্রতিটি বিন্দুকে দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করা চলে এটা দ্যকার্ত বুঝেছিলেন, এবং গণিত ও পদার্থবিদ্যায় তার প্রায়োগিক সাফল্য ছিল প্রশ্নাতীত । একইভাবে, নিউটন তাঁর বৈজ্ঞানিক হিসেব নিকেশের জন্য যেভাবে নিজেই ‘ইনফাইনাইটসিম্যাল’-এর মত ধারণা তৈরি করে নিয়েছিলেন, তার সাফল্য নিয়ে আঙুল তোলা অসম্ভব । অথচ, এই দুটো ক্ষেত্রেই কিন্তু যুক্তিতে ফাঁক ছিল, অনেক পরে ডেডেকাইন্ড আর ভার্সট্র্যাস-এর মত উনিশ শতকীয় জাঁদরেল গণিতজ্ঞরা যে ফাঁকগুলো বোজাতে পেরেছিলেন । কিন্তু, পাটনাম আমাদেরকে ভেবে দেখতে বলেন, পরবর্তীকালে যদি এদের পেছনে নিশ্ছিদ্র যুক্তি না-ও পাওয়া যেত, তাতেও এদেরকে মোটেই ফেলে দেওয়া যেত না বিপুল সাফল্যের কারণে, এবং কোনও না কোনও উপায়ে গণিতশাস্ত্রে এদেরকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতেই হত । একই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন, স্বাভাবিক সংখ্যার বিপরীত বর্গের অসীম শ্রেণির যোগফল, বা পরপর দুটি বিজোড় সংখ্যা মৌলিক হবে এমন সম্ভাবনার গাণিতিক সূত্র, এগুলোর সাফল্যও অনেকটাই অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক ।

এই প্রেক্ষিতেই, হয়ত বা, খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আরেকটি তথ্যও । সাম্প্রতিককালের আরেক দিকপাল যুক্তিবিশারদ হার্ট্রি ফিল্ড তাঁর ‘রিয়্যালিজ্‌ম্‌, ম্যাথমেটিক্স অ্যান্ড মোডালিটি’ বইতে দেখিয়েছেন, যুক্তি ও গণিতের সমস্ত নিয়ম মান্য করেই এমন সব গাণিতিক ব্যবস্থাও নাকি বানানো যায়, যা পুরোপুরি স্ববিরোধহীন, অথচ যার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী । এর অর্থ কি তবে এই যে, যুক্তি ও গণিতের মধ্যে জগৎ-সম্পর্কিত কিছু মৌলিক বোধ অন্তর্লীন থাকলেও, যেহেতু আমরা জানিনা যে সেটা ঠিক কোথায় কতটা কীভাবে আছে, অতএব কোনও কোনও বিশেষ গাণিতিক নির্মাণের ক্ষেত্রে তা আমাদের অজান্তেই আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে, বা আমাদের অজান্তেই তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়তে পারে বাস্তবতা-বিরোধী কোনও অজাগতিক প্রাগানুমান ?

বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত থাকলেও, এখানে এ প্রশ্নে উপনীত হওয়ার সহজ অর্থ হচ্ছে এই যে, আমরা এ আলোচনার শেষপর্বে এসে পৌঁছেছি । কাজেই, এবার উপসংহার টানবার পালা । তবে সেটা করার আগে একবার পেছন ফিরে দেখে নেওয়া যাক, এতক্ষণ যা বললাম, তার মোদ্দা কথাগুলো কী কী । ক্রম বজায় রেখে সে কথাগুলোর একটা তালিকা যদি বানাই, তো সেটা বোধহয় অনেকটা এই রকম দেখতে হবে — (১) বিজ্ঞানের ভিত্তি হল যুক্তি আর গণিত, কিন্তু যুক্তি ও গণিত নিজেই বিজ্ঞান কিনা, এই হল গিয়ে প্রশ্ন । (২) এরা বিজ্ঞান পদবাচ্যই বটে, যেহেতু এদের সিদ্ধান্তগুলো বিজ্ঞানের মতই সর্বজনীন — এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় । (৩) যুক্তি আর গণিত বিজ্ঞান হতে পারে না, কারণ এরা আসলে বিজ্ঞানের ‘ভাষা’ মাত্র, এ কথাও টেঁকে না । (৪) বিজ্ঞানের থেকে যুক্তি ও গণিত আলাদা, কারণ বিজ্ঞান বাস্তব জগত সম্পর্কে কথা বলে, কিন্তু যুক্তি ও গণিত কথা বলে শুধু নিজেদের জগত নিয়ে, যে জগত নাকি ভাবনার, কল্পনার — এটি এই প্রসঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান । (৫) কিন্তু, তাই যদি হয়, তবে ভাবনার ও কল্পনার জগতের এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তব জগতে এত নির্ভুল ও গুরুত্বপূর্ণ হয় কীভাবে, কেন বিজ্ঞানের তত্ত্বকে প্রকাশ করতে তারা এত কার্যকর ? (৬) এর একটি উত্তর হতে পারে, যুক্তি/গণিতের কার্যকারিতা অযৌক্তিক, রহস্যময়, অলৌকিক, ঐশ্বরিক — যে কথা বলেছিলেন পদার্থবিদ জেম্‌স্‌ জিন্‌স্‌ এবং ইউজিন ভিগনার । (৭) আরেকটি উত্তর হতে পারে, যুক্তি আর গণিতের সত্য যেহেতু বাস্তব জগত থেকে আসেনা, তা বেরিয়ে আসে বাক্যের কাঠামো থেকে, অতএব তা বিষয়বস্তু-নিরপেক্ষ, ফাঁপা, পোশাকী, কাজেই তা যে কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গেই এঁটে যেতে পারে । আমি রোজ সকাল-বিকেলে দুটো করে কুমিরছানা দিয়ে টিপিন সারি, অতএব আমার মাসে একশো কুড়িখানা মতন কুমিরছানা লাগে — এটা অঙ্কের হিসেবে ঠিকই আছে, এবং কুমিরছানার জায়গায় রসগোল্লা বসালেও একই রকম ঠিক থাকত । কুমিরছানা (বা রসগোল্লা) সত্যি সত্যি খাদ্য হতে পারে কি পারে না সেটা বাস্তব জগত সম্পর্কিত প্রশ্ন, যুক্তি বা গণিতের তা নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা নেই । এটি লজিসিস্ট-ফর্ম্যালিস্ট অবস্থান, ফ্রেগে-রাসেল-হিলবার্ট প্রমুখ যুক্তিবিশারদেরা যার প্রবক্তা । (৮) ভিগনার যেভাবে গণিতের সাফল্যকে ‘অলৌকিক’ বলে দেখাতে চান তার যুক্তিটা ভুল — কয়েকটি ক্ষেত্রে গণিতের সাফল্যকে ব্যাখ্যা করা যায়নি তার থেকে এইটা প্রমাণ করা হয়না যে, গণিতের কার্যকারিতা ব্যাপারটাই অযৌক্তিক বা অলৌকিক । (৯) যৌক্তিক/গাণিতিক জ্ঞানের মধ্যে বাস্তব অভিজ্ঞতার ছাপ কিছুই থাকে না এ বক্তব্যও প্রশ্নাতীত নয়, কারণ তা যদি হত তবে আপেক্ষিকতাতত্ত্বের চাপে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি বদলাত না, বা কোয়ান্টামতত্ত্বের চাপে যুক্তির অন্যতম ভিত্তিস্বরূপ নিয়ম ‘মধ্যমবর্জনের নীতি’ বাতিল করার দাবি উঠত না (একান্তভাবে পদার্থবিদ্যায় গণিতের প্রয়োগের প্রেক্ষিতেই কথাটা বলছি, স্রেফ পদার্থবিদ্যার স্বার্থেই এ ধরনের গণিত সৃষ্টি হয়েছে এমন কিন্তু মোটেই দাবি করিনি) । (১০) অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক বিবৃতি আর যৌক্তিক/গাণিতিক বিবৃতির সীমারেখা সব সময় স্পষ্ট থাকে না, যুক্তিশাস্ত্র এবং বিজ্ঞানের ইতিহাস — উভয় ক্ষেত্রেই এর দৃষ্টান্ত আছে । (১১) পেছনে নিশ্ছিদ্র যুক্তি না থাকলেও (অন্তত আবিষ্কারের মুহূর্তে) স্রেফ প্রায়োগিক সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে বহু গাণিতিক আবিষ্কার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । (১২) সর্বোপরি, প্রাথমিক গণিত (অর্থাৎ গণনা, সংখ্যা, পাটিগণিতের হিসেবনিকেশ, জমির মাপজোকের জ্যামিতি ও পরিমিতি ইত্যাদি) যে বাস্তব অভিজ্ঞতাজাত, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন নি (এবং তার দায় গোটা গণিতের ওপরই পড়ার কথা) । (১৩) সম্ভাব্য সব রকমের গাণিতিক ব্যবস্থা যে বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, এমনটা নয় ।

এত সব কথার শেষে আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম তবে ? বোধহয় এই উপলব্ধির দোরগোড়ায় যে, যুক্তি আর গণিতও এই বাস্তব জগত সম্পর্কে পুরোপুরি বোধহীন নয়, কিছু মৌলিকতম বোধ হয়ত বা তারও ‘অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে’ । হয়ত বা সেই জন্যেই দার্শনিক হিলারি পাটনাম তাঁর গবেষণাপত্রের শুরুতেই ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, ‘লজিক ইজ, ইন আ সেন্স, আ ন্যাচারাল সায়েন্স’ । কে জানে, সংখ্যা ও অন্য সব গাণিতিক নির্মাণে হয়ত ধরা থাকে বস্তুর ভর-আকার-আয়তনের চেয়েও মৌলিকতর কোনও ধর্ম, হয়ত বা স্রেফ তার অস্তিত্বের নগ্ন  নির্যাসটুকুই, বা অন্তত আমাদের চেতনায় প্রতিফলিত সে নির্যাসের ‘অ্যাপ্রক্সিমেশন’ বা আসন্ন রূপমাত্র । সব রকমের বাস্তব পরিস্থিতিতে সব আসন্ন-রূপ নাও খাটতে পারে, যেমনটি বিজ্ঞানে হামেশাই ঘটে থাকে । একটি পেয়ারার সঙ্গে আরেকটি পেয়ারা এক জায়গায় হলে ‘একে একে দুই’- এর নিয়ম খাটে । একটি পেয়ারার সঙ্গে একটি আম জুটলেও খাটে, যদি তখন ‘পেয়ারা’ না বলে ‘ফল’ বলি । কিন্তু, দুটি জলের ফোঁটা এক জায়গায় হলে এ নিয়ম আর মোটেই খাটে না, আর তখনই খোঁজ করতে হয় অন্যতর কোনও গণিতের । এ প্রসঙ্গে অবশ্যই মনে পড়বে জেম্‌স্‌ জিন্‌স্‌-কে খোঁচা মেরে রাসেলের সেই অভাবনীয় উক্তি — ‘দুটো আপেলের সঙ্গে দুটো আপেল জুড়লে চার হচ্ছে বলে ভাবছেন ভগবান বুঝি অঙ্কটা খুব ভালই জানেন । কিন্তু, ঈশ্বর অঙ্কে যতটা দক্ষ হলে কেউ কেউ খুশি হতেন ততটা আসলে তিনি নন, কারণ, একটি নারীর সঙ্গে একটি পুরুষ জুড়লে দুই-এর বদলে তিনও হতে পারে ।’ বুঝুন তবে অবস্থাটা !

হয়ত কোনও একদিন যুক্তিশাস্ত্র ও গণিত-দর্শন এ প্রশ্নের এক স্বচ্ছতর উত্তর তুলে দেবে আমাদের হাতে, আমাদেরকে নিয়ে যাবে বস্তুর অস্তিত্বধারা আর সংখ্যার অস্তিত্বধারার সঙ্গমস্থলের আরও কাছাকাছি । কিম্বা হয়ত ভবিষ্যৎকাল বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে জানাবে, না হে, এমন কোনও সঙ্গমের অস্তিত্ব নেই আদৌ (হিলারি পাটনাম শেষ জীবনে সরে এসেছিলেন তাঁর বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান থেকে) ।

কিন্তু, যতদিন তা না হয়, ততদিন আমি বেঁচে থাকতে চাইব সে সঙ্গমের স্বপ্ন-যাপনেই । মাননীয় পাঠক, আপনি তাতে আপত্তি করবেন কি ?


প্রধান উৎসনির্দেশ (শিরোনাম বোল্ড, লেখক ইটালিক্স) :-

  1. History of Western Philosophy, by Bertrand Russell, Routledge, 1993
  2. Is Logic Empirical ?, by Hilary Putnam, Boston Studies in the Philosophy of Science, 1968
  3. The Logic of Quantum Mechanics, G. Birkhoff & J. Von Neuman, The Annals of Mathematics, Oct 1936
  4. What is Mathematical Truth?, by Hilary Putnam, Historia Mathematica 2, 1975
  5. Two Dogmas of Empiricism, by W. V. O. Quine, The Philosophical review, Jan 1951
  6. The Essential Tension, by Thomas S. Kuhn, The University of Chicago Press, 1977
  7. Realism, Mathematics & Modality, by Hartry Field, Blackwell, 1989
  8. গণিতের ধারাপাত ও গল্পসল্প, মিহির চক্রবর্তী, নান্দীমুখ সংসদ, ২০০৫
  9. The Unreasonable effectiveness of Mathematics in the Natural Sciences, by E. P. Wigner, Communications in Pure and Applied Mathematics, 13(1), 1960
  10. On “The Unreasonable effectiveness of Mathematics in the Natural Sciences”, by Sorin Bangu, in ‘Models and Inferences in Science, Eds. E. Ippoliti et al, Springer, Switzerland, 2016
  11. The Scientific Outlook, by Bertrand Russell, George Allen & Unwin Ltd., 1949

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. একটি আপাত কঠিন বিষয় নিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকার লেখা।

  2. অনেক ধন্যবাদ । সমালোচনা বা পরামর্শ কিছু থাকলে, তাও বলবেন প্লিজ ।

আপনার মতামত...