স্টেশন মাস্টার
কোভিড যুগ, ভূয়োদর্শীরা বলিতেছেন, গোটা বিশ্বের মানবসম্প্রদায়কে এমন এক সঙ্কটে নিক্ষেপ করিল, যেরূপ সঙ্কট বিগত একশত বৎসরের মধ্যে আসে নাই। পৃথিবী নাকি কোভিড-পূর্ব ও কোভিড-উত্তর— দুইটি পৃথক কালবিভাজিকায় চিরদিনের ন্যায় বিভক্ত হইয়া গেল। ভারত রাষ্ট্রের সামান্য নাগরিক হিসাবে আমরা যদি অতশত না-ও ভাবি, যদি দৃষ্টিপরিসর কিঞ্চিৎ সঙ্কীর্ণ করিয়া আনি, দেখিব, প্রায় একই কথা, সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতেও প্রযোজ্য হইতে পারে।
ভারতবাসী বর্তমানে এমন এক সঙ্কটের সম্মুখীন, যাহা স্বাধীন ভারতের সপ্ততি বর্ষের ইতিহাসে একমাত্র জরুরি অবস্থার সহিত তুলনীয়। তিন মাসাধিক কাল পূর্বে আমরা, দেশের নাগরিকগণ, যদ্যপি খিলকুলুপে আবদ্ধ হইয়া গৃহ-অন্দরে প্রবেশ করিলাম, বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া দেখিলাম, রাষ্ট্র অনতিবিলম্বে দমনপীড়নের সমস্ত উপকরণ যথা দানবিক আইন, গ্রেফতারি পরোয়ানা, পুলিশি ব্যবস্থা, এমনকী বিলগ্নিকরণের সিঁদকাঠি লইয়া মহাসমারোহে রাজপথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। বিগত কয়েক মাসে, সংবাদমাধ্যমের দুর্বল উপস্থিতিতে, লকডাউনে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ শূন্য জ্ঞানে রাষ্ট্রব্যবস্থা তাহার শরীর হইতে গণতন্ত্রের শেষ লজ্জাবরণটিকে খসাইয়া ফেলিতে উদ্যত হইয়াছে। এতদূর পাঠ করিয়া পাঠক যদি ভাবেন এ-হেন পর্যবেক্ষণ নিতান্তই অতিরঞ্জন— প্রাইম টাইমের সঞ্চালকগণের ন্যায় অসত্য-অর্ধসত্য পরিবেশন-পূর্বক টিআরপি শিকারের ছল— আসুন, তাঁহাদের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য পেশ করা যাউক।
প্রথমত, রাষ্ট্র এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে বলপূর্বক স্তব্ধ করিবার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়াছিল, কোভিডকে হাতিয়ার করিয়া সে উদ্যোগ অধিকতর প্রাণবান হইয়া উঠে। গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় গোটা পৃথিবীর দৃষ্টির সম্মুখে যে কার্য সম্পাদন এতদিন অসুবিধাজনক ছিল, সামাজিক দূরত্বযাপনের স্বাস্থ্যবিধির ফলে গণপরিসরের সঙ্কোচন তা সহজতর করিয়া দিল। দেশজোড়া আন্দোলনের মুখ শাহিনবাগ ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিল যে, কয়েক হাজার আন্দোলনকারী নহে, কোভিড-পরিস্থিতিতে মাত্র ছয়জন আন্দোলনকারীর উপস্থিতিতে প্রতীকী আন্দোলন বহাল রাখা হইবে। কিন্তু তাহাতে চিঁড়া ভিজিল না, ভিজিবার কথাও ছিল না, ২৪ মার্চ বলপূর্বক শাহিনবাগ জনশূন্য করিয়া দেওয়া হইল। বিজেপি সরকারের এই আচরণ যে নাগরিকের জনস্বাস্থ্য লইয়া উদ্বেগজনিত কোনও সিদ্ধান্ত নয়, বরঞ্চ এক প্রতিহিংসামূলক প্রতিবর্ত, তাহা অচিরাৎ স্পষ্ট হয়। একই দিনে মন্ত্রী-অমাত্য-ক্যাডার সমভিব্যাহারে শ্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হন, সেই ঊর্ধ্ববাহু উদযাপনে কোভিড-স্বাস্থ্যবিধির কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। ইহাতেই শেষ নহে, সারা দেশ যখন করোনা জীবাণুর প্রকোপ হইতে প্রাণ বাঁচাইতে গৃহাভ্যন্তরে থরহরিকম্প, দেশে চিকিৎসকদিগের ব্যবহারযোগ্য পিপিই-র যথেষ্ট যোগান নাই, সেই দুরূহ সময়েও সরকার অতি যত্নে খুঁজিয়া-খুঁজিয়া সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দিগের, বিশেষত জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রছাত্রীদের একের পর এক চার্জশিট ধরাইতে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকী, কোভিড-আক্রান্ত দিল্লি-উত্তরপ্রদেশে ত্রাণ বিতরণকারী সমাজসেবীরাও গ্রেফতারি এড়াইতে পারেন নাই। এই কুকর্মে সরকারের অস্ত্র হইল দানবিক এনআইএ ও ইউএপিএ আইন, যাহা মূলত বিশেষ পরিস্থিতিতে উগ্রপন্থীদিগের উপর প্রয়োগ করিবার কথা। এই আইনে সরকার যে কোনও নাগরিককে দেশদ্রোহের অভিযোগে বিনা প্রমাণে, জামিন-অযোগ্য ধারায়, এজলাসে না তুলিয়াও কমপক্ষে এক বৎসর অবধি জেলবন্দি রাখিতে পারেন, এক বৎসর পর অভিযুক্ত মুক্তি পাইলেও ঠিক তাহার পর দিন আবার অভিযুক্তকে পুনরায় একই ধারায় পুনরায় এক বৎসরের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা যায়। এই আইন যে কোনও ফ্যাসিস্ত সরকারের স্বপ্নের আইন।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রব্যবস্থা এই দীর্ঘ কয়েক মাসের খিলকুলুপকে প্রত্যাশিতভাবেই ব্যবহার করিয়াছে বিরুদ্ধ কণ্ঠকে রুদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যত নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে, সমাজে অসন্তোষের স্বর ধামাচাপা দিতে সরকার ততই তৎপরতা বাড়াইয়াছে। দমনের খড়্গ তীব্রতম বেগে নামিয়া আসিয়াছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের উপর। দিল্লিস্থিত একটি পেশাদার সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী মার্চ ২৫ হইতে মে ৩১, ২০২০— এই সময়কালের মধ্যে সরকারের পক্ষে অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর সংবাদ প্রকাশের ‘অপরাধ’-এ সারা দেশে প্রায় ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, এফআইআর, কারণ দর্শানোর নোটিশ ইত্যাদি জারি হইয়াছে, হয় তাঁহারা শারীরিক নিগ্রহের শিকার হইয়াছেন অথবা তাঁহাদিগের সম্পত্তি নষ্ট করিবার হুমকি দেওয়া হইয়াছে। কুচা সাংবাদিকেরা তো কোন ছার, এই তালিকায় সিদ্ধার্থ বরদারাজন, বিনোদ দুয়া-র ন্যায় বরিষ্ঠ সাংবাদিকগণও রহিয়াছেন। নিগ্রহিত সাংবাদিকের সংখ্যা সর্বাপেক্ষা অধিক আদিত্যনাথের রামরাজ্য উত্তরপ্রদেশে (১১)। বস্তুত, সাংবাদিকের অধিকার খর্বের প্রসঙ্গে শুধুমাত্র কাশ্মিরের ঘটনাগুলি লইয়া একটি পৃথক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাইতে পারে। দেশের মিডিয়ার বিরুদ্ধে সরকারের এহেন রক্তচক্ষুর তীব্রতা আমরা প্রত্যক্ষ করিলাম মাত্র কয়দিন আগেও, যখন প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া-র ন্যায় প্রাচীন ও সর্বতোমান্য সংবাদসংস্থার কপালে কার্যত রাষ্ট্রদ্রোহিতার তকমা জুটিল— জনৈক চিনা রাজপুরুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে ভারত সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর মন্তব্য পরিবেশনার দায়ে।
দেশদ্রোহী, শহুরে নকশাল ইত্যাদি বদনাম পূর্বেই জুটিয়াছিল অশীতিপর কবি ভারভারা রাও ও গৌতম নওলাখা, সুধা ভরদ্বাজ প্রমুখ সমাজকর্মীর। ভারভারা পূর্বেই, এবং নওলাখা ও আনন্দ তেলতুম্বড়ে এই বৎসর ১৪ এপ্রিল গ্রেফতার হইয়াছিলেন। ইঁহারা মূলত আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আর কে না অবগত আছেন, আদিবাসীদের অধিকারসচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া তোলা রাষ্ট্রের চোখে চরম ঘৃণিত অপরাধগুলির একটি, কেননা ইতিহাস শিক্ষা দেয় অধিকারসচেতন আদিবাসী তাহার জল-জঙ্গল-জমির অধিকার কর্পোরেট পুঁজির হস্তে সমর্পণের পথে মূর্তিমান বাধাস্বরূপ। একাধারে সমাজকর্মী-আন্দোলনকারীদের বন্দি করিয়া রাখা এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ, খনিজ সমৃদ্ধ পাহাড়-উপত্যকা, এমনকি ওনএনজিসি, রেল, এয়ার ইন্ডিয়া, বেঙ্গল কেমিক্যাল-সহ সংখ্যাগুরু পিএসইউ সংস্থাগুলিকেই ঘুরপথে বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলিয়া দেওয়া— লকডাউনের অবকাশে এই দুইটি মহাগুরুত্বপূর্ণ কার্য সমাধা করিয়া ফেলিয়াছে কেন্দ্র সরকার।
প্রসঙ্গত, আমরা জানি কাফিল খানের সহিত কী ঘটিয়াছে। আমরা জানি, সফুরা জারগারের সহিত কী ঘটিয়াছে। দিল্লি-দাঙ্গার দিনে তিনি নিকটে উপস্থিত না-থাকিয়াও হিংসায় উসকানির দায়ে গ্রেফতার হইলেন, অথচ গণহত্যার এক প্রধান মদতদাতা হিসাবে অভিযুক্ত বিজেপি-নেতা কপিল মিশ্রর বিপক্ষে গুরুতর অভিযোগ ও পাকা প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি খুলে-আম বিহার করিতেছেন। রাষ্ট্রের এই দমনপীড়ন অভূতপূর্ব, জরুরি অবস্থা ঘোষণা না-করিয়াও কীভাবে কয়েকটি আইনের সাহায্যে ও মেরুদণ্ডহীন মিডিয়াকে হাতে রাখিয়া জরুরি অবস্থাকেও ছাপাইয়া যাওয়া যাইতে পারে, এই সরকারের কর্মকাণ্ড তাহার যথার্থ প্রমাণ।
… ‘রক্তকরবী’-র রাজা অন্তরালে থাকিতেন। তবু, কাঠিন্যের আবডালে তাঁহারও একটি মথিত হৃদয় ছিল। আজ বাঁচিয়া থাকিলে কবি নিশ্চয় ‘রক্তকরবী’-র রাজাকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান সেবকের আদলে আঁকিতেন ও তাহাতে কোমলতার চিহ্নমাত্র রাখিতেন না।
জুলাই সংখ্যায় খিলকুলুপের এই তিন মাসে রাষ্ট্র যেই যেই ক্ষেত্রে সরাসরি দেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছে, সেই ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করিয়া, রাষ্ট্রের দেশবিরোধী ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। প্রচ্ছদকাহিনির নিবন্ধগুলিতে তাহারই চিহ্ন রহিল। লিখিলেন প্রতাপ ভানু মেহতা, মোহন মানি, নীলাঞ্জন দত্ত, সৌমিত্র দস্তিদার, সুশোভন ধর এবং শঙ্খশুভ্র বিশ্বাস।
সদ্যোপ্রয়াত বরিষ্ঠ সাংবাদিক জলি মোহন কল এবং বিজ্ঞানী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করা হইল এই সংখ্যায়। লিখিলেন যথাক্রমে শঙ্কর রায় এবং মানস প্রতিম দাস। রবিশঙ্করকে লইয়া লাজওয়ান্তি খান গুপ্তা এবং কবি শম্ভু রক্ষিতকে লইয়া সুব্রত ঘোষের দুইটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হইল। ঠিক এক বৎসর কাল পরে এই মেল ট্রেন হইতে পুনরায় যাত্রা শুরু করিল প্রিয়ক মিত্রের ধারাবাহিক উপন্যাস তারান্তিনো। সঙ্গে অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ, যথা, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, অন্যগদ্য, অণুগল্প, ফটোফিচার এবং বিশেষ বিভাগগুলি— স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, ডিসট্যান্ট সিগনাল, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর— রহিল যথারীতি।
পড়ুন, মতামত দিন, সুস্থ থাকুন, প্রতিবাদে থাকুন…
অলমিতি…