নীলাঞ্জন হাজরা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তান
প্রেম মোক্তানের কথা আজ আর কারও মনে নেই৷ শেষের দিকে মাথাটা কেমন একেবারে বিগড়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের৷ ইউথ হোস্টেলের দাওয়ায় একলসেঁড়ে ওই পাইন গাছটার তলায় ওঁর একমাত্র ছেলেটাকে কুকরি দিয়ে ওরা কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে দেওয়ার পর থেকেই৷ সেই থেকে আমি আর কোনও দিন ইউথ হস্টেলে যাইনি৷ দার্জিলিং ইউথ হস্টেলে৷ মেঘে মেঘে তিরিশটা বছর পেরিয়ে গেল! আজ এই লেখা লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি আমার জীবনের সব থেকে তীব্র আপশোস হয়তো আশ্চর্য সেই পরিপূর্ণ মানুষটির একটি ছবিও আমার কাছে নেই৷ একটাও না৷ ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তান৷ আমার রক্তে, আমাদের রক্তে সম্ভবত আমাদের বেশ কয়েকটা প্রজন্মের রক্তে যিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন পাহাড় আর অরণ্যের বার্তা৷ বুকে দম আর পেশিতে শক্তি থাকলেই যেখানে গাড়ি যায় না তেমন পাহাড়েও চড়ে পড়া যায়৷ কিন্তু পাহাড়ের কথা শুনতে পাওয়া যায় না৷ তা পেতে হলে ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তানের মতো একজন শেখ পেতে হয়৷ সে বড় ভাগ্যের কথা৷
‘সো রহা হ্যায় সালা? উঠো৷ উঠো সব৷ হাত বাটাও৷ তুরন্ত,’ ক্যাপ্টেন মোক্তানের হুঙ্কারে ধড়মড় করে উঠে পড়ি৷ প্রবল শীত৷ পালিশ করা নীল আকাশ৷ কিন্তু চারপাশ ভিজে সপসপ করছে৷ পিকচার পোস্টকার্ডের মতো ক্যাপ্টেন মোক্তানের একচিলতে সফেদ কাঠের বাংলো-কোয়ার্টারটার পাশের একলসেঁড়ে ঢ্যাঙা পাইন গাছটার পিছন দিয়ে ঝকঝকে পাল তোলা নৌকোর সারি বেঁধেও কোথাও যাচ্ছে না কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ নিজেকে সামলাতে পারি না৷ ক্যামেরা তাগ৷ বাইশশো টাকার এসএলআর৷ জেনিথ৷ রুশ ক্যামেরা৷ শাটার পরে ট্রেনের বোগি শান্টিং করার মতো শব্দ তুলে৷ কোথায় আড়ালে ঘাপটি মেরে ছিলেন কে জানে? ফের ঝাড়৷
ঘটনা এরকম— কাল রাত্রের আচমকা প্রবল বর্ষণে জলা পাহাড়ে ইউথ হোস্টেলের ঠিক নীচে অন্তত দশটা মাটি-পাথরের বাড়ি সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছে৷ স্থানীয়রা ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটির স্তূপ সরিয়ে যেটুকু পারা যায় জিনিসপত্তর উদ্ধার করছেন৷ আর তোমরা শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে পিক্স দেখবে৷ তারপর আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে দার্জিলিং টি খাবে চুক চুক করে৷ তারপর ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াবে৷ চলবে না৷ আমার ইউথ হোস্টেলে এসেছ৷ পাহাড়কে জানতে শেখো৷
আমরা একদল তরুণ-যুবক— বাঙালি, বিহারি, গ্রিক, নিউ জিল্যান্ডবাসী, জার্মান, দক্ষিণ ভারতীয়— এক কোমর কাদায় ঘণ্টা তিন চারের প্রবল পরিশ্রমে মাটি খুঁড়ে বার করতে থাকি ঝলমলে স্টিলের বাসন-কোসন, সবুজ-গোলাপি ফুলকারি করা ট্রাঙ্ক, কাঠের পায়া ভাঙা তক্তা, কাদা ল্যাপ্টানো রঙিন জামাকাপড়, ফাটা বালতি, জল ধরার ক্যানেস্তারা৷ ভিড়ের মধ্যে থেকে ফুটফুটে শিশুদের তারস্বরে কান্না ভেসে আসে৷ কঠোর পরিশ্রমে এই সব মাটি-পাথরের বাড়ি ফের গড়ে নেওয়া হবে৷ তত দিন কোথায় থাকবে এই পরিবারগুলি কে জানে? ‘ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়৷ ভাগো,’ বলে যখন মাঝ সকালে ক্যাপ্টেন মোক্তান আমাদের নিষ্কৃতি দেন, আমরা স্টুপিড পিকচার পোস্টকার্ড টপকে দার্জিলিংকে চেনার পথে প্রথম পা রেখে ফেলেছি৷ সেটাই তো শেখের কাজ৷
কিন্তু আমরা তো গাঁটের কড়ি ফেলে— তা যতই সামান্য হোক, তখন বোধ হয় বেড পিছু দশ টাকা ছিল প্রতিদিন— থাকতে এসেছি৷ খামোখা ওয়ার্ডেনের কথায় দেশোদ্ধার করতে মাতব কেন? হ্যাঁ, হোস্টেলের ভেতরে তাঁর কথা অনুযায়ী আইন-কানুন মানতে হবে অবশ্যই৷ কিন্তু তা বলে গালি দিয়ে কাকভোরে ঘুম ভাঙিয়ে মাটি কাটানো? টুরিস্ট মশাই, দাসখৎ লেখা মুনিশ নাকি? যাঁরা কখনও প্রেম মোক্তানকে দেখেননি, যাঁদের কাঁধে কখনও পড়েনি তাঁর স্নেহের চাপ্পড় তাঁরা এ সব অতি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তুলবেন বইকি৷ যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানবেন, সুফিবাদে ‘যুক্তি’ ব্যাপারটাকে এত কম পাত্তা দেওয়া হয় কেন! সে বাধার দেওয়ালগুলো আমার বেলা ধসে গিয়েছিল এ ঘটনার বেশ কয়েক বছর আগে৷
১৯৮৪৷ মে৷ প্রথমবার মোটেই নয়, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে প্রথম বার চলেছি কার্শিয়ং, তার পর সেখান থেকে দার্জিলিং, মিরিক হয়ে বাড়ি৷ এই ছিল ১৫ দিনের প্ল্যান৷ গোড়া থেকেই প্ল্যান গুবলেট হতে শুরু করল৷ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন৷ গৌরাঙ্গ ভবন৷ কাল থেকে ছুটি পড়ছে৷ কাল রাতে দার্জিলিং মেল৷ থ্রি-টিয়ারে চারটি বার্থ বুক করা৷ চার মূর্তিমান— নীলু, শুভো, দাদু আর হাম্বা৷ কাল দুপুর নাগাদ ট্যাক্সি ধরে এন্টালি মার্কেটের পাশে জয়ের বাড়ি৷ দুপুরে সেখানেই খাওয়া-দাওয়া৷ সন্ধ্যায় জয়ের বাবার গাড়িতেই শিয়ালদা৷ আমরা যে কোনও ঘোর বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছি না, বাপ-মায়েদের সেটা বোঝানোই একটা লম্বা অধ্যায়৷ সে অধ্যায় পার করে গোছগাছ সব হয়ে গিয়েছে৷ ক্রমাগত প্ল্যান হচ্ছে ট্রেন থেকে নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে নামার পর ঠিক কী করা হবে৷ ব্রেকফাস্ট কি স্টেশনেই করা হবে? রিকশা করে শিলিগুড়ি গিয়ে বাস ধরা হবে, নাকি এনজেপি থেকেই শেয়ারের জিপ? রেনকোট নেই, কেনার দরকার আছে কি? অজস্র অমীমাংসিত প্রশ্ন৷ প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে বাঁকুড়ার দিগন্তের মতো বুকের ভিতরটা তিরি তিরি কাঁপছে৷ চার মূর্তিমান শেষ দিনের ক্লাস সেরে হোস্টেলে ফিরছি, হঠাৎ জিডিএস-এর মুখোমুখি৷ গোপাল দত্ত্ সিং৷ আমাদের ইতিহাসের মাস্টার৷ ইম্ফল নিবাসী মণিপুরী৷ গৌরাঙ্গ ভবনেই থাকেন৷
‘টুমরা নাকি, ডার্জিলিং যেটেছো কাল?’ জিডিএস-এর প্রশ্ন৷ ‘হামিও যাব ভাবছি৷’
চকিতে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি হয়ে যায়৷ সকলেই মনে মনে প্রমাদ গুনছি৷ সঙ্গে মাস্টার৷ সব মজা তো এখানেই শেষ হয়ে গেল৷ মুখে বলি, ‘হলে তো দারুণ হয় স্যার৷ কিন্তু টিকিট তো স্যার চারটে৷’
‘উ প্রবলেম নাই৷ আই ক্যান সিট আউট দ্য নাইট৷ একটা টিকিট ঠাকলেই হোবে৷ টিটি ওন্ট মাইন্ড৷’
এ কথোপকথন আরও খানিকক্ষণ চলেছিল, যার সার কথা— জিডিএস যাবেনই৷ মনটা একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল৷ পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ আমরা তৈরি৷ ব্যাগ-স্যুটকেস গেটের কাছে৷ জিডিএস-কেও সময় বলা আছে৷ উনি এলেই কেউ এক জন মেন গেট থেকে ট্যাক্সি ধরে আনতে চলে যাবে৷ সকলেই খানিকটা মনমরা৷ মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে এক্সকার্শনটা ঠিক আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না৷ যাই হোক, আমি যাই জিডিএসকে রুম থেকে ডেকে আনতে৷ ঘরের দরজা খুলতেই তারস্বরে নারীকণ্ঠ ভেসে আসে— বনি রেইট! জিডিএস এক চিলতে একটা তোয়ালে জড়িয়ে সম্পূর্ণ খালি গায়ে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে সিগারেট খাচ্ছেন৷ ধবধবে সাদা, লোমহীন, নির্মেদ মণিপুরী শরীর। চারপাশে ব্যাগ-স্যুটকেসের কোনও চিহ্ন নেই৷ মনটা আনন্দে নেচে ওঠে৷ নির্ঘাৎ সিদ্ধান্ত বদলেছেন, যাবেন না৷
‘স্যার আমরা বেরোচ্ছি,’ বনি রেইটের ওপর গলা তুলে জিজ্ঞেস করি৷
‘ওহ্৷ আজই যাওয়া নাকি?’
আমি কী বলব ভেবে পাই না৷ একটু পরে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে জিডিএস নিজেই বলেন, ‘ওয়েট, ওয়েট৷ উ দেখো টো, খাটের নীচে হামার সাইড ব্যাগটা হবে৷’ স্নান নেই৷ দাড়ি-টাড়ি কাটা নেই৷ ঠিক দশ মিনিটে জিডিএস তৈরি৷ আর একটা আলমারির ধুলো ধূসরিত বইয়ের পিছন থেকে তাঁর নির্দেশে বার করি অদ্ভুত এক ক্যামেরা, যেমনটা আমি আগে জিন্দেগিতে দেখিনি৷ পোলারয়েড ক্যামেরা৷ তাতে নাকি চৌকো মতো ক্যাসেট ফিল্ম ঢোকাতে হয়৷ ছবি তোলার পর সে ফিল্ম ক্যামেরার নীচের দিকের একটা ফাঁক দিয়ে ক্যাঁচ করে বেরিয়ে আসে৷ কিছুক্ষণ হাওয়ায় নাড়লেই সে ফিল্মের ওপর ছবি ভেসে ওঠে৷ আমি বাকি তিনজনের কাছে ফিরে আসি৷ সঙ্গে জিডিএস৷ ঢোলা জিন্সের জামা পেট অবধি বোতাম খোলা৷ জিন্সের প্যান্ট৷ পায়ে স্নিকার্স৷ গা থেকে ভুরভুর করে দামি পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে৷ চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে অহরহ না আঁচড়ানো চুল ঠিক করে নিচ্ছেন৷
ট্যাক্সি সবে গড়িয়ার ফিলিপ্সের মোড়ে পৌঁছেছে৷ হঠাৎ পিছন থেকে জিডিএস-এর হাঁক— ‘রোকো৷ রোকো৷ টু মিনিট্স৷ হামি আসছি৷’ বলেই পলক মাত্র দরজা খুলে উধাও৷ আমরা স্তম্ভিত৷ ট্যাক্সি সাইড করে আমরা গল গল করে ঘামছি, আর বোঝার চেষ্টা করছি ঠিক কী ঘটছে৷ এমন তো ঠিক প্ল্যানে ছিল না৷
এমন সময় এক বিরাট খবরের কাগজের মোড়ক বগলে জিডিএস-এর পুনরাবির্ভাব৷ ট্যাক্সিতে উঠে ঝড়াং করে দরজা বন্ধ করেই সেই মোড়ক খুলে আমাদের প্রত্যেকের হাতে তিনি ধরিয়ে দিলেন একটি করে চিল্ড্ বিয়ারের বোতল৷ তারপর পকেট চাপড়ে বার করলেন চাবির রিং যাতে লাগানো একটা বট্ল ওপেনার৷ ভটাং করে নিজের বোতলটা খুলে, বোতলটা শূন্যে তুলে শান্ত গলায় বললেন— ‘Cheers! Man is born free, and everywhere he is in chains. One man thinks himself the master of others, but remains more of a slave than they are.’
ট্যাক্সি ছুটছে নরেন্দ্রপুর থেকে এন্টালি মার্কেট৷ মে মাসের দ্বিপ্রহর৷ রাস্তার অ্যাসফল্ট থেকে একটা ভাপ উঠছে৷ দু’ হাতের মুঠোয় একটা পরমাশ্চর্য মসৃণ ঠাণ্ডা৷ জীবনে প্রথম৷ বন্ধু জয়ের বাড়িতে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম৷ তার আগেই বোতল খালি করতে হবে৷ ব্যাপারটা যে এত সহজ সেটা কল্পনাই করতে পারিনি৷ সন্ধ্যায় দার্জিলিং মেল ধরে এনজেপি পৌঁছনো পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি৷ মাঝরাতে শুধু একবার ছাড়া৷ আমি বসেছি জানালার ধারে৷ কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে শুভ৷ শুভজ্যোতি। মাঝখানের বাঙ্কে দাদু আর হাম্বা৷ দাদু দেবাশিস। হাম্বা অনির্বাণ। আমরা এই চারজন ছিলাম হরিহর আত্মা। তবে এই আমরা চারজন আর কোনও দিন কোথাও একসঙ্গে বেড়াতে যেতে পারব না— পারব না কারণ গত বছর হাম্বা এই সব একগাদা স্মৃতির নিজের ভাগেরটাও আমাদের তিনজনের বুকের মধ্যে গুঁজে দিয়ে মরে গেছে।
যাই হোক, জিডিএস একদম ওপরের বাঙ্কে উঠে ‘হামি রাটে কিছু খাবো না’ জানিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ আমাদের উল্টো দিকে একদম তলায় এক যুবতী৷ মাঝখানে তাঁর বর৷ আর একেবারে ওপরে অন্য একজন৷ ট্রেনে রাতে আমার ঘুম হয় না৷ রাত দুটো আড়াইটে হবে৷ ঝড়ের গতিতে দার্জিলিং মেল ছুটছে৷ কামরা প্রায় অন্ধকার৷ ট্রেনের টানা তাল আর লাইন চেঞ্জ করার শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই৷ হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি একটা ফটফটে সাদা দেহ কামরার পিছনের দিকে মিলিয়ে গেল৷ ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার— জিডিএস৷ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ঠিক যা আন্দাজ করেছি— সম্পূর্ণ খালি গায়ে এক ফালি জাঙিয়া পরে তিনি বাথরুমের দিকে হাওয়া৷
তাড়াতাড়ি শুভকে তুলি— ‘আরে জিডিএস খালি গায়ে বাথরুম চলে গেছে৷ তুই একটা টাওয়েল নিয়ে দৌড়ো৷’ কিন্তু পায়ে কী দিয়ে গেলেন? তাঁর স্নিকার্স রয়েছে৷ আমাদের সকলের জুতোও৷ চকিতে বুঝতে পারলাম তিনি সামনের বাঙ্কের সেই যুবতীর হিল তোলা জুতো পায়ে দিয়েই চলে গিয়েছেন৷
এহেন জিডিএসকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন একটা জিপ ভাড়া করে হিলকার্ট রোড ধরে সবে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছি, আকাশ ফুটো করে শুরু হল বৃষ্টি৷ তারই মধ্যে জিপ ছুটছে৷ চলেছি কার্সিয়ং৷ ঠিক কার্সিয়ংও নয়৷ শহর ছাড়িয়ে আরও ওপরে ডাওহিল৷ ডাওহিল গার্লস স্কুলে পড়ান হাম্বার মা৷ তাঁর কোয়ার্টারেই আমরা থাকব৷ ক্রমাগত ঝাপটা মারছে কনকনে বাতাস আর বৃষ্টি৷ ডাওহিল যখন পৌঁছলুম, আমরা সকলেই তখন আমাদের বাঁকুড়ার ভাষায় যাকে বলে ভিজে জুরুকজুদ্যাঁ৷ হাড় পর্যন্ত জমে গেছে৷ হুড়মুড় করে হাম্বাদের কোয়ার্টারে ঢোকার পর তার মা আমাদের প্রথমেই যেটা ধরিয়ে দিলেন তা হল বিশাল এক বোল করে ধূমায়িত টোমাটো স্যুপ৷ এমন গভীর পরিতৃপ্তি নিয়ে জীবনে এর আগে বা পরে টোমাটো স্যুপ খাইনি৷ সে দিন বহুক্ষণ বৃষ্টি চলেছিল৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা-কাঞ্চনজঙ্ঘা করে বাঙালির দার্জিলিং ছোটার হিড়িকে আমরাও ছুটেছিলাম, কিন্তু সে দিনই প্রথম অনুভব করলাম পাহাড়ে— দার্জিলিং পাহাড়ে— বর্ষার অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা৷
বর্ষায় পাহাড়ি পথ
যদি মাটি-পাথরের বাড়ি না হয়, যদি খাড়া পাহাড় বেয়ে মাইল দুয়েক উঠে পাহাড়ের গা বেয়ে চলে যাওয়া জলের পাইপের কোথাও কোনও একটা ফুটো থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোতে থাকা খাবার জল ক্যানেস্তারায় ধরে বাড়িতে আনতে না হয়, যদি পাঁচ মাইল হেঁটে হেল্থ সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন না হয়, তা হলে পাহাড়িয়া বর্ষায় সমস্ত ইন্দ্রিয় ভরে অনুভব করা যায় কাকে বলে রাগ মল্হার৷ পাহাড়ের— দার্জিলিং পাহাড়ের— ঝমঝমে বর্ষার একটা গভীর শব্দ আছে যা আমি কখনও কোনও সমতলের বর্ষায় পাইনি, যে শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দমকে দমকে ভেজা-ভেজা বাতাসে ভেসে আসে ভিজে যাওয়া ধূপি গাছের গভীরতর গন্ধ, আর ধুনুচির ধোঁয়ার মতো কোন গভীর থেকে ভলকে ভলকে উঠে আসে তার থেকেও গভীরতর মেঘ৷ আর সেই সব মেঘ আসা যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে রেখে যায় দূর কোনও পাহাড়িয়া বসতির টুকরো টুকরো পিকচার পোস্ট-কার্ড৷ শেষে ঝমঝমে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর, জোঁকের তোয়াক্কা না করে যখন আমরা ডাওহিলের গহন পাইন বনে হাঁটতে বেরোই তখন চারপাশের প্রগাঢ় সিক্ত সবুজ যেন আমাদের চোখগুলো শুষে নেয়, আর কান দখল করে ঝিঁঝি পোকার একটানা তীব্র ডাকের সঙ্গে মেশা পাহাড়ের অজস্র খাঁজে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অজস্র ঝর্নার শতজলধ্বনি৷ মাঝে মাঝে বিপুল দলা দলা মেঘ এসে চশমা আবছা করে চলে যায়৷ আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে এই পাইনবন জুড়ে এমন এক আলো-ছায়ার খেলা চলতে থাকে, মাটিতে দুলতে থাকে এমন এক আলো-ছায়ার ফুলকারি যা ক্যামেরাবন্দি করার ক্ষমতা কখনও হবে না দুনিয়ার সেরা ফটোগ্রাফারেরও৷
ডাওহিলের সেই বিশাল পাইন বন নাকি আজ অনেক ফিকে হয়ে গেছে, যা একটুও ফিকে হয়নি তা হল এই পাইন বনে একা হাঁটার ভয়৷ কিছুটা চলতে চলতেই ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায় দূর কার্সিয়ং শহরের গাড়ির হর্ন, ডাওহিল গার্লস স্কুল আর ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের মৃদু কলরব, কখনও-বা টয়-ট্রেনের হাল্কা ঝিকঝিক আর তীব্র সিঁটি৷ আর কোনও মনুষ্য-জাত শব্দ এখন নেই৷ এখন শুধু নিজের পায়ের শব্দ৷ আর তার পরেই অবধারিতভাবে বোঝা যায় কেউ একজন পিছনে পিছনে হাঁটছে৷ চট করে এক ঝলক পিছনে তাকিয়ে কাউকে দেখা গেল না৷ আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে পাইনের মাথা৷ পাখি ডাকছে৷ কোথাও একটা পাথর গড়িয়ে পড়ল৷ আলো থেকে পথটা বেঁকে আধা-আলোয় হারিয়ে গেছে৷ কিন্তু ফের পিছনে কেউ হাঁটছে৷ কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না আর৷ ফের পেছন ফেরা, ফের কেউ কোত্থাও নেই৷ অস্বাভাবিক জোরে ডাকতে ডাকতে একটা দাঁড়কাক উড়ে গেল৷ তার পরেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল ছেলেটা৷ গলা থেকে কাটা— মুণ্ডুটা নেই৷ গা শিরশির করা গল্পটা এমনই৷
পরিবারের সঙ্গে আমি প্রথম দার্জিলিং আসি ১৯৭৬-এ৷ সে সময় আমাদের মতো মধ্য-মধ্যবিত্ত কলেজ মাস্টারের পরিবারের দার্জিলিং যাওয়ার ঘটার কথা মনে পড়লে আজ সাংঘাতিক হাসি পায়৷ তখন বাঙালির বেড়ানোর তিনটি অতি অবশ্য সঙ্গী ছিল যা আজ বেমালুম হাওয়া হয়ে গিয়েছে— হোল্ডল, ওয়াটার বট্ল আর ফ্লাস্ক৷ আর মধ্যবিত্ত বাঙালির দার্জিলিং ভ্রমণের অত্যাবশ্যক অঙ্গ ছিল মাঙ্কি ক্যাপ! আর অবশ্যই দার্জিলিং মেল৷ এই সফরেই আমার জীবনে প্রথম ও শেষবার টয় ট্রেনে চড়া৷ গভীর সবুজের বাঁক থেকে তীব্র সিঁটি বাজিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেরিয়ে আসা টয় ট্রেনের দৃশ্য যতটা বর্ণনাতীতভাবে সুন্দর এ ট্রেনে তিন ঘণ্টার পথ সাত ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া ততটাই প্রাণান্তকর বোরিং মনে হয়েছিল৷ সেই সফরের একটা ছবি আমার মনে আজও গেঁথে আছে— একটা বাঁকে ট্রেনটা কোনও ক্রমে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে চলেছে৷ জানালার পাশ দিয়ে চলেছে একসার স্কুলের বাচ্চা৷ জানালার ধারে বসা ব্যক্তিটি তাদের দেখে হাত নাড়ালেন আর অমনি একটা বাচ্চা ছুটে এসে থক্ করে তাঁর মুখময় থুতু দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল৷ আগুনটা যে তখন থেকেই ধিকি ধিকি জ্বলছে তা টেরই পাইনি৷ পেলাম ১৯৮৬-র পুজোয় খাঁ-খাঁ দার্জিলিংয়ে পৌঁছে৷ আর সেবারই দেখেছিলাম ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তানের কলজের জোর৷
যে ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮৪-র এই চার মূর্তি+১-এর ট্রিপ-এ৷ যে ট্রিপ শুরু হয়েছিল ডাওহিল দিয়ে৷ ডাওহিলে কয়েক দিন কাটিয়ে আমরা দার্জিলিং রওনা দিলাম বাস ধরে৷ তবে ডাওহিল ছেড়ে যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলে যেতেই হবে৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই৷ বেশ জোর বৃষ্টি হচ্ছে৷ বাড়িতে কেউ নেই৷ আমি একা৷ হঠাৎ ডোর বেল৷ খুলে দেখি সুসজ্জিতা এক পাহাড়ী যুবতী (নেপালি না গোর্খা না লেপচা তা বলতে পারি না)৷ আমি আমার সেরা হিন্দিতে বলি, বাড়িতে কেউ নেই৷ আপনি দয়া করে আপনার নামটা বললে আমি জানিয়ে দেব৷ মেয়েটি খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটিও কথা না বলে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে আমার সামনেই দরজাটা ভেজিয়ে দেয়৷ আমি তো ভয়ঙ্কর প্রমাদ গুণতে শুরু করেছি৷ মেয়েটি হাতের ভেজা রঙিন ছাতাটা দরজার পাশে এক কোণে রাখে৷ হাতের ঘড়িটা খুলে রাখে টেবিলে৷ তারপর নিঃশব্দে রান্না ঘরে ঢুকে বাসন মাজতে শুরু করে! সেই থেকে আজ অবধি, দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে এই আশ্চর্য সম্ভ্রমবোধের কখনও অন্যথা দেখিনি৷ পাহাড়ের গ্রামে গ্রামান্তরে হেঁটে হেঁটে ঘোরার সময়ে দেখেছি দরিদ্রতম মানুষও নিজেদের সাধ্যমতো কী আশ্চর্য পরিপাটি রাখেন নিজেকে এবং নিজেদের ঘর-দুয়ার৷
দার্জিলিংয়ে জিডিএস ঠিক কোথায় ছিলেন আজ কিছুতেই মনে করতে পারছি না৷ সম্ভবত কোনও একটা হোটেলে উঠলেন তিনি৷ আর আমরা লট-বহর কাঁধে চললাম ইয়ুথ হস্টেল৷ সেই গোলঘর রেস্তোরাঁ (যা ছিল আগের দু’বারের পারিবারিক ট্রিপে আমাদের সপরিবারে খাওয়ার জায়গা) ছাড়িয়ে, সেই ফেলুদার গল্পে পড়া কিন্তু তোপসের মতো হাজার বায়না করেও হট চকোলেট খাওয়াতে বাবাকে রাজি করাতে না পারায় ঢুকতে না পারা কেভেন্টার্স, সেই দাস স্টুডিও (যেখান থেকে সেই ৭৬-এ কেনা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিটা আজও আমাদের বিষ্ণুপুরের বসার ঘরে টাঙানো আছে), সেই ম্যাল (তখনও আমরা মল্ বলতে শিখিনি), তারপর ঘোড়ার আস্তাবলের পাশ দিয়ে যখন ইউথ হস্টেলের বাড়িটার সামনে পৌঁছলাম তখন সকলেরই জিভ বেরিয়ে গিয়েছে৷ আর সিঁড়ির মুখেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গাট্টাগোট্টা মাঝারি হাইটের এক ভদ্রলোক৷ ‘বচ্চা বচ্চা লড়কা, অওর সিনা মে দম নেহি? সন্দাকফু ক্যায়সে যায়োগে?’ এই ছিল আমাদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মোক্তানের প্রথম পরিচয়ের প্রথম বাক্য৷
ইয়ুথ হস্টেলের জানালায় প্রতিফলিত দার্জিলিং। ১৯৮৪ সালে তোলা ছবি।
সন্দাকফু! ঝপ করে একটা নতুন দুনিয়ার দরজা খুলে দিলেন প্রেম মোক্তান৷ জানলাম দিন দুয়েকের হাঁটা পথ। আর সেখান থেকে তেমন তেমন দিনে ১৮০ ডিগ্রি দৃষ্টি কোণে দেখা যেতে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘা, থ্রি সিস্টার্স এবং এভারেস্ট শৃঙ্গ। ক্যায়সে যে সেই সন্দাকফু যাওয়ার বন্দোবস্ত হল তা আর আজ মনে নেই৷ আজ যেমন সন্দাকফু যাওয়াটা মিরিক যাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছে ১৯৮৪-তে কিন্তু তেমনটা ঠিক ছিল না৷ খাঁটি পাহাড়-প্রেমিকরা সেদিনও সেখানে গিয়ে হাজির হতেন ঠিকই, কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা এতই কম যে এক বছরে সন্দাকফু যানেওয়ালা টুরিস্টের সংখ্যা দু হাতে গোনা যেত৷ প্রধান সমস্যা ছিল থাকার বন্দোবস্ত৷ পর্যটন দপ্তরের যে কিছুই ছিল না, সেটা স্পষ্ট মনে আছে৷ সম্ভবত একটি মাত্র ইরিগেশন বাংলো ছাড়া আর কিচ্ছুটি ছিল না সেখানে৷ হাম্বাই কীভাবে যেন কোন কাকা না কাকে যোগাযোগ করে সেই বাংলো আমাদের জন্য বুক করে ফেলল৷ ঠিক হল তার পরের দিন দার্জিলিংয়ে কাটিয়ে পরশু আমরা সন্দাকফু রওনা হয়ে যাব৷ হতেই হবে, কারণ ততক্ষণে মোক্তান সাহেব আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন দার্জিলিংয়ে এসে যারা সন্দাকফু যায় না তাদের দার্জিলিংয়ে আসার কোনও দরকার নেই৷
থ্রি সিস্টার্স। সন্দাকফু থেকে ১৯৮৪-তে তোলা ছবি
কিন্তু সে তো পরশু, আপাতত কোনও ক্রমে ইউথ হস্টেলের প্রত্যেক বেড-এর নীচের বড় ড্রয়ারে মাল-পত্তর গুঁজে ম্যালের পথে দৌড়৷ আর সেই দৌড়ে হস্টেল থেকে একটা বাঁক ঘুরেই আবিষ্কার করলাম আশ্চর্য এক রেস্তোরাঁ, যা পরবর্তী বহু বহু বছর আমার ডেরা হয়ে উঠেছিল৷ একেবারে খাদের ওপর এক চিলতে একটা চৌকো ঘর৷ তাতে কয়েকটা চেয়ার টেবিল পাতা৷ তার খাদের দিকের দেওয়ালটা প্রায় পুরোটাই কাচের৷ যেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা বিজবিজে শহর, তারপর যতদূর চোখ যায় মেঘের মাঝখানে ভেসে থাকা পাহাড়ের পর পাহাড়ের পর পাহাড়৷ তার কাচের দরজায় লেখা ‘লিট্ল কর্নার’৷ আর তার কাউন্টারে বসে পাট ভাঙা স্যুট পরা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, টিকোলো নাক, চোখে দড়ি লাগানো চশমাওয়ালা এক পাহাড়ি ভদ্রলোক৷ চার জনেরই তখন খিদেয় পেট চুঁইচুঁই৷ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ি৷ ছেঁড়া ময়লা এক পাতার মেনু৷ সেই মেনুর ‘টিবেটান’ বিভাগে লেখা— পোর্ক থুকপা, চিকেন থুকপা, ভেজিটেবিল থুকপা৷ যা থাকে কপালে বলে তিন প্লেট পোর্ক থুকপা অর্ডার করে দেওয়া হল। খাবার বিষয়ে রিস্ক নেওয়াটাকে চরম মূর্খামো-মনে-করা শুভ অর্ডার করল ‘বাটার টোস্ট অ্যান্ড অ্যান অমলেট উইথ টু এগ্স প্লিজ!’৷ এ কথা ভাবতে অবাক লাগে সেই ট্রিপে এবং তার বেশ কয়েক বছর পর পর্যন্তও আমি অন্তত দার্জিলিংয়ে কোথাও মোমো দেখিনি৷
লিট্ল কর্নার আবিষ্কার ছাড়া সেই দু দিনের দার্জিলিং সফরের হাইলাট ছিল সে দিনই সন্ধ্যায় জিডিএস-এর সৌজন্যে গ্লেনারিজ-এ ডিনার৷ চোখ টেরিয়ে গিয়েছিল৷ পরিষ্কার মনে আছে এইবেলা শুভর সকালের নীতি অনুসরণ করে কোনও রিস্ক না নিয়ে অর্ডার করেছিলাম ছিলাম ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার পোর্ক’৷ রিস্ক না নিয়ে বলছি এই কারণেই যে এর আগে আমি এমন গমগমে ঝলমলে কোনও রেস্তোরাঁয় খেয়েছিলাম একবারই৷ সে রেস্তোরাঁটাও আজ আর নেই৷ সে নামেই আর একটা রেস্তোরাঁ খুলেছে বটে কিন্তু সেটিকে আসলটার ব্যর্থ ক্যারিক্যাচার বললেও কম বলা হয়৷ ওয়াল্ডর্ফ৷ তখন আমি খুবই ছোট৷ সপরিবারে যাওয়া হয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের সেই ডাকসাইটে চিনা রেস্তোরাঁয়৷ অর্ডার করা হয়েছিল অনেক কিছুই৷ সঙ্গে ছিল আমার ফুলমামা৷ আমরা দুজনে ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম ওই সুইট অ্যান্ড সাওয়ার পোর্ক৷ খাওয়া-দাওয়া সেরে মামা-বাড়িতে ফিরেছি৷ আমার মামাবাড়ি গোঁড়া ভটচাজ পরিবার৷ আমার ছোটবেলায় সেখানে মুর্গিও ঢুকত না৷ রাত্রে শোবার আগে ফুল দেখি আমায় চুপি চুপি ডাকছে— ‘সেজমামাকে বলেছিস?’
আমি অবাক, ‘কী?’
ফুলমামা— ‘পোর্ক খেলি যে, বলেছিস?’
‘না-না,’ আমি তাড়াতাড়ি ফুলমামাকে আশ্বস্ত করি৷
‘ধুর, তা হলে আর ক্রেডিট-টা কী হল!!’ ভারি হতাশ দেখাল ফুলকে!
সেই থেকে ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার পোর্ক’ নামটা মনে গেঁথে ছিল৷
স্পষ্ট মনে আছে জিডিএস হুইস্কি অর্ডার করার পর ওয়েটার আমাদের দিকে ড্রিঙ্ক্স মেনুটা বাড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের সলজ্জ ঘাড় নেড়ে না বলা দেখে সে একগাল হেসে বলেছিলো, ‘হোয়াই? অ্যাক্টিং হোলি?’ আর সেবারের দার্জিলিং হাইলাইটের মধ্যে ছিল আশ্চর্য সূর্যাস্ত, যেমন খুনোখুনি আকাশ আমি তার আগে আর কখনও দেখিনি৷ সেই সফরের যে কয়েকটি ছবি আজও রয়ে গেছে, তার মধ্যে রয়েছে সে দৃশ্য৷
আর মনে আছে সে দু দিনে একবারের জন্যও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলেনি৷ কিন্তু সন্দাকফু-র ট্রেকিং থেকে ফিরেই দার্জিলিংয়ে যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলাম সন্ধ্যা সকালে তার তুলনীয় কোনও পর্বতশৃঙ্গ আর দুনিয়ার কোথাও দেখার সুযোগ আমার হয়নি৷ ট্রেকিংয়ের নাম শুনেই জিডিএস বাগডোগরা থেকে ফ্লাইটের টিকিট কেটে কলকাতা ফিরে গেলেন! যে দিন গেলেন সে দিনই আমরা ইয়ুথ হস্টেল থেকে দিনে আড়াই টাকা দিয়ে ভাড়া করা রুক স্যাক আর স্লিপিং ব্যাগ পিঠে চড়িয়ে মানেভঞ্জং-এর বাসে উঠে পড়লুম৷
‘ইয়াদ রাখনা— Take nothing but pictures, leave nothing but footprints৷ চঢ়নে কে সময় দারু নেহি পিনা হ্যায়৷ সিগ্রেট নেহি পিনা হ্যায়৷ গাঁওমে বদ্তমিজি নেহি করনা হ্যায়৷ ওকে বয়েজ?’ আমাদের ট্রেনিং দিচ্ছেন দার্জিলিং ইয়ুথ হস্টেলের ওয়ার্ডেন ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তান৷ আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি মানেভঞ্জং বসতি থেকে সন্দাকফু হয়ে ফিরতি পথে উৎরাইয়ে রিম্বিক পর্যন্ত যে ট্রেকিং রুট, তার নাম হওয়া উচিত Prem Moktan Trail৷ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে সন্দাকফুকে জনপ্রিয় করে তোলায় তাঁর যে অবদান তা অবিস্মরণীয়৷ আমরা নরেন্দ্রপুরে ফিরে আসার পর সে সফরের বর্ণনা তুমুল হিট করায় একদল ছাত্র নিয়ে ইয়ুথ হস্টেলে হাজির হয়েছিলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল মুক্তিরূপানন্দজি মহারাজ স্বয়ং৷ প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। তাঁকেও সন্দাকফু ট্রেকে পাঠিয়ে ছেড়ে ছিলেন প্রেম সাহেব৷
পরে এই প্রেম সাহেবের উৎসাহেই পিঠে রুকস্যাক নিয়ে পাহাড়ের পথে বেরিয়ে পড়ে কত যে ছোট ছোট আজগুবি অভিজ্ঞতা হয়েছে! যেমন একবার অন্য চার বন্ধুৱ সঙ্গে ফের চলেছি সন্দাকফু— দোলনদা, অনিরুদ্ধদা, মিঠুদা আর পার্থ৷ সালটা ঠিক মনে নেই, তবে ১৯৮০-র দশকের একেবারে শেষে বা ১৯৯০-এ৷ আগেও গিয়েছি৷ চেনা পথ, জানা রাস্তা৷ মানেভঞ্জং থেকে হাঁটা শুরু করে, গৈরিবাস-এ একরাত৷ পরের দিন সন্দাকফু৷ অক্টোবর মাস৷ রোদ্দুর আশ্চর্য সোনালি৷ আকাশ আশ্চর্য গাঢ় নীল৷ বর্ষার পরের পাহাড় আশ্চর্য প্রগাঢ় সবুজ৷ দিব্যি হাঁটছি৷ কালিপোখরি বলে খান কুড়ি বাড়ির একটা গ্রাম৷ এখানে থামার কথা নয়৷ কিন্তু পাহাড়ের মজাই হল, পাহাড়ে এরকম আবহাওয়া হবেই বা কিছুতেই হবে না এমনটা কিছুতেই বলা যায় না৷ দুপুর দুটো নাগাদ, কী তার একটু আগেই হবে বোধ হয়, নিমেষের মধ্যে আকাশের রং হয়ে গেল স্লেট পাথরের মতো৷ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল গোটা আকাশটা৷ মিনিট দশ-পনেরো একটা অস্বাভাবিক স্থিরতা৷ কিচ্ছু নড়ছে না৷ গাছের একটা পাতাও নয়৷ পাখিগুলোও যেন নিশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ রুদ্ধশ্বাস৷ তার পরে একটা চোখ ধাঁধানো আলো৷ একটা কান ফাটানো বাজ৷ আর তার পরে ঝড়৷ আমি কলকাতার বাইপাস থেকে আরও বেশ কিছুটা পুবে, আয়লা দেখেছি, আর কদিন আগে আমফান দেখলাম৷ কিন্তু সে দিনের সে ঝড়ের মতো ঝড় আর কখনও দেখিনি৷ পড়ি কি মরি করে ছুটে গ্রামের একটা বাড়ির দাওয়ায় উঠে পড়ি৷ না, এখানে তো থাকার ব্যবস্থা নেই, ওই দিদি-র বাড়ি যাও৷ ও মাঝে সাঝে তোমাদের মতো ট্রেকারদের একটা ঘর ভাড়া দেয়৷ সেটাই গ্রামের সব থেকে বড়সড় বাড়ি৷ পাথরের দেওয়াল খানিকটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো৷ ততক্ষণে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে৷ আর মিনিটে মিনিটে এপাশ ওপাশ থেকে বাজ৷ ভিজতে ভিজতেই দৌড়ই৷
দিব্যি ঘর পাওয়া গেল৷ দুটো বড় বড় খাট৷ একটা টেবিল৷ চেয়ার৷ সচ্ছল পরিবার৷ হবেই না বা কেন? জানতে পারি ‘দাদা’ সেনাবাহিনীতে হাবিলদার৷ এ গ্রামে এ বাড়ির খাতিরই আলাদা৷ ব্যবস্থা ভালোই৷ চলবে!
খালি রাতের খাওয়ার ব্যাপারটা বাকি, ‘দিদি, রাতো কো খানে কে লিয়ে কেয়া মিলেগা?’
‘রোটি অউর মাস্ দে সকতি হুঁ৷ চলেগা?’
ওহ্৷ আজকের সন্ধ্যাটা জমে গেল৷ পটাপট রুক স্যাক থেকে রামের বোতোল, চানাচুর ইত্যাদি বেরিয়ে পড়ে৷ চারপাশ এখন দুর্ভেদ্য অন্ধকার৷ টিনের চালে ঝমঝম ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে৷ কনকনে ঠান্ডা৷ কে যেন কোথায় একটা গিটারে নেপালি গানের সুর বাজাচ্ছে৷ হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা বাড়ছে কমছে৷ আমরা দোতলায়৷ একতলা থেকে নারীকণ্ঠের হাসাহাসি ভেসে আসছে৷ মোমবাতির কমলা আলোয় গোটা ঘরটা দুলছে৷ ঠিক মনে নেই, তবে সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ দিদি জানান, রাত অনেক হয়েছে এবার খেয়ে নিলে ভালো হয়৷ অবশ্যই, অবশ্যই৷
খানা আসে৷ প্লেটে প্লেটে রুটি আর পেঁয়াজ৷ আর চারটে বিপুলাকার ঝলমলে স্টিলের বাটি ভর্তি মাংস৷ বাটি থেকে ধোঁয়া উঠছে৷ ওয়াঃ৷ দিদি চলে যায়৷ আমরা যে যার শেষ চুমুক মেরে বসে পড়ি৷ তারপরেই খেলা জমে ওঠে৷ ঝোলটির রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ৷ নোনতা ছাড়া আর অন্য কোনও স্বাদের খামোখা ডিস্টার্বেন্স নেই! মাংস ছোট ছোট টুকরোয় কাটা৷ এক টুকরো তুলে মুখে পুরি৷ ঠিক সুপুরির মতো শক্ত৷ না, হাড় নয়৷ হাড়ের কোনও বালাই নেই৷ পিওর মাংস৷ ভাগ্যিস আমাদের সঙ্গে কয়েকটা মিল্কমেড-এর টিন ছিল!
দিদি এক কাজের মেয়েকে সঙ্গে করে থালা বাসন নিতে এসে স্তম্ভিত৷ প্রত্যেকের মাংসের বাটি যেমনটি ছিল তেমনটি ধরা আছে৷
আমিই মুখ খুলি, ‘দিদি কেয়া মাস্ থা ইয়ে?’
‘কিউঁ? চম্রি গাই!!’ প্রথম চমক— চামরি গাই, মানে ইয়াক৷
কিন্তু আরও চমক বাকি ছিল৷ জিজ্ঞেস করি, ‘কব কাটি থি ইয়ে মাস্?’
উদাস চোখে দিদি বহুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন, ‘বহু-উ-উ-উ-উ-ত পহিলে!’
এর পরে কথোপকথন আর বিশেষ এগোয়নি৷ নীচে হাত ধুতে গিয়ে দেখি৷ রান্নাঘরের উনুনের গরম ঘিরে পাড়ার মহিলারা জুটেছেন৷ কথা-বার্তা শুনে বুঝি এমন উপাদেয় মাংস কোনও স্টুপিড বাবুরা ফেলে দিতে পারে, তা তাঁরা ভেবে পাচ্ছেন না৷ দেখি উনুনের পিছনের দেওয়ালে একটা বিশাল মাংসের চাঙড় ঝোলানো!
তবে প্রেম মোক্তানকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বে দেখেছিলাম ১৯৮৬-তে৷ ’৮৬-র মে মাসে গোটা পাহাড় দপ করে জ্বলে উঠল৷ সহসা আমরা কেউ কেউ সেই আগুনের শিখায় সম্পূর্ণ অন্য এক পাহাড় দেখতে পেলাম৷ পুরনো সাদা-কালো বাংলা ছবির গোর্খা দারোয়ান, আর বাঙালি টুরিস্ট যুবকদের বেলেল্লাপনার ‘কাঞ্চি’ হয়ে থাকতে অস্বীকার করে দিল দার্জিলিং পাহাড়৷ স্তম্ভিত হয়ে সে দিনও দেখলাম কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে যখন লেখা হচ্ছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সাক্ষী আছে, বাংলা ভাগের চক্রান্ত রুখছি রুখব’, তখনও আম বাঙালির কাছে পাহাড়ের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাক্রম হোটেলের বুকিং, ট্রেনের টিকিট ক্যান্সেল এবং পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার বিকল্প জায়গা খুঁজে বার করার নিদারুণ সমস্যার বাইরে আর কিছুই ছিল না৷ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল সিপিআই(এম)-এর আনন্দ পাঠক আর তামাং দাওয়া লামাদের রাজত্ব৷ আসলে পাহাড়ে যে লক্ষ লক্ষ মানুষও থাকেন তা সিপিআই(এম)-এর বা তারও আগে কংগ্রেসের— মানে পশ্চিমবঙ্গের মূল সমতলের রাজনীতির— লাগাম-ধরা বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা তা বুঝে উঠতেই পারেননি৷ কাজেই আম বাঙালির কাছে পাহাড়িরা এতকাল ছিলেন গপ্পে পড়া গোর্খা রেজিমেন্টের নির্মম ভয়ঙ্কর যোদ্ধা, নেপালি দারোয়ান, নাক চ্যাপটা কাঞ্চি আর বিরাট একটা পর্যটন শিল্পের নাট-বল্টু৷ ১৯৮৪-র পর থেকে আমি টানা বছর দশেক প্রত্যেক বছর দার্জিলিং পাহাড়ে গিয়েছি৷ বরাবর দেখেছি গ্রামের পর গ্রামে জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, সমতলের বড়লোকের বাচ্চাদের জন্য দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়ংয়ে বিশাল বিশাল সাহেবি স্কুল, কিন্তু স্থানীয়দের স্কুলে যেতে হয় পাঁচ-দশ কিলোমিটার হেঁটে— ঝমঝমে বর্ষায়, প্রবল শীতে৷ কোনও বাঙালি রাজনীতিককে কখনও তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে দেখিনি৷ তাঁরা কেবল ব্যস্ত হয়ে পড়েন হঠাৎ বন্ধে কিংবা সহসা রাস্তা ধসে গিয়ে পাহাড়ে বাঙালি টুরিস্টরা আটকে গেলে৷ দার্জিলিং পাহাড়াঞ্চলকে পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গ হিসাবে দাবি করার অধিকার ঐতিহাসিকভাবে সমতলের বাঙালিরা অর্জন করতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না৷
আর সেটা পারেনি বলেই ১৯৮৬-তে দপ করে জ্বলে উঠল পাহাড়৷ ঠিক করেছিলাম মে মাসেই যাব৷ কিন্তু শুনলাম পৌঁছতেই পারব না৷ পরিস্থিতির তাপ একচুল ধিমে হতেই অক্টোবর মাসে ছুটলাম৷ এক একটা মোড় ঘুরছি আর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠছে৷ একাই গিয়েছি সেবার৷ সম্পূর্ণ জনশূন্য পথঘাট৷ যে লাডেন-লা রোডে এ সময় টুরিস্ট গিজগিজ করে তা যেন যুদ্ধক্ষেত্র৷ মোড়ে মোড়ে বালির বস্তার ব্যারিকেড৷ ব্যারিকেডের ওপর থেকে বেরিয়ে রয়েছে রাইফেলের নল আর জলপাই রঙের হেলমেট৷ হেলমেটের তলায় জোড়া জোড়া বুক হিম করা চোখ, ক্রমাগত সে চোখ চারপাশে ঘুরছে৷ কখনও কখনও দূর থেকে হুইস্ল সোনা যাচ্ছে, কথনও কখনও পুলিশের গাড়ির হুটার৷ মলে ঢোকার আগে দেখলাম গ্লেনারিজের গেটটা কাঠের তক্তা দিয়ে সিল্ করা, রোস্তোরাঁটা পুড়ে খাক৷ হেঁটে চলেছি৷ সব দোকানের শাটার টানা৷ ভূতুড়ে মলে নেড়ি কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ একটা বেঞ্চে একদল নেপালি যুবা বসে গুলতানি করছে৷ হাতে গিটার৷ স্পষ্ট বুঝলাম আমার দিকে কিছু বাছা বাছা গালি উড়ে এল৷ জলাপাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ আস্তাবলগুলো খালি৷ ইয়ুথ হস্টেলের বাড়িটায় টিমটিম করে কয়েকটা বাল্ব জ্বলছে৷
ভয় হল ইউথ হস্টেলে জায়গা মিলবে তো? দেখি মূল হস্টেলের বাড়ি আর তার থেকে একটু দূরে একই চৌহদ্দির মধ্যেই তাঁর একরত্তি কোয়ার্টারের মাঝখানে পায়চারি করছেন ওয়ার্ডেন সাহেব৷ তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করি হস্টেল খোলা কিনা৷ ‘Of course! The whole hostel is lying empty for you!’ আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানালেন ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তান৷ আর একজন কর্মচারীও নেই৷ নিজেই বিছানার চাদর, কম্বল, বালিশের ওয়াড় বার করে দিলেন৷ আমাদের মধ্যে আন্দোলন নিয়ে কোনও কথোপকথন হয়নি৷ কিন্তু বুঝেছিলাম দার্জিলিং পাহাড়কে যা দেয় প্রাণশক্তি (কারণ দশকের পর দশক ধরে অন্য কোনও জীবিকার ব্যবস্থা করার কোনও চেষ্টা করেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার) সেই পর্যটন ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধিকারের আন্দোলনের পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন না তিনি৷ এর কিছু বছর পরে একবার বহু সমতলের পর্যটক দার্জিলিংয়ে আটকে যাওয়ায় মহা সমস্যায় পড়েছিলেন৷ স্থানীয় হোটেলগুলো থেকেও তাঁদের বার করে দেওয়া হচ্ছিল৷ সে সময় তাঁদের জন্য অবাধে ইয়ুথ হস্টেল খুলে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন মোক্তান৷ সেই সব দিনে, যখন সুবাস গিসিং ক্রমাগত বাঙালি বিরোধী বিষোদগার করছেন, যাঁরা দার্জিলিং গিয়েছেন, তাঁরা জানেন কত বড় বুকের পাটা থাকলে প্রেম মোক্তান যা করেছিলেন তা করা সম্ভব৷ আর সেইজন্যই শুনেছি নাকি তাঁকে দিতে হয়েছিল সেই চরম মূল্য, যা কলকাতা-শিলিগুড়িতে ছেঁদো স্লোগানবাজি করা কোনও নেতাকে কখনও দিতে হয়নি৷ কয়েক বছর পরে ওই ইয়ুথ হস্টেলের চৌহদ্দির মধ্যেই কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁর ছেলেকে৷ সেই ভয়াবহ ঘটনার পরে গিয়ে দেখলাম কোয়ার্টারটায় তালা মারা৷ শুনলাম হস্টেলের দায়িত্বে আর তিনি নেই৷ মল্-এর ওপর যে পর্যটন দপ্তরের আপিস সেখানে বসেন৷ খোঁজ করতে গিয়েছিলাম সেখানেও৷ নেই৷ এক সহকর্মী জানালেন, ‘উয়ো কভি আতা হ্যায়৷ কভি নেহি আতা হ্যায়৷ উসকা দিমাগ বিগড় গয়া হ্যায়৷’
সন্দাকফু, মেঘমা, কালিপোখরি, টোংলু, গৈরিবাস, রিম্বিক— এ সব জনপদ আজ দার্জিলিং পাহাড়ের পর্যটন মানচিত্রে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে৷ এক পরমাশ্চর্য সম্মিলিত স্মৃতি-বৈকল্যে আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছি ক্যাপ্টেন প্রেম মোক্তানের কথা৷
(চলবে)