বধির বেহালাবাদক

দীপ শেখর চক্রবর্তী

 

প্রতিটি জায়গা ছেড়ে আসার একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে।একজনের পাড়া হয়ত।প্রতিটি রাস্তার বাঁক।ঠিক যে জায়গায় পৌঁছনোর পর তাকে বিদায় জানাতে হয়।বিদায় জানানোর পর তার দূরে চলে যাওয়া দেখার জন্য কিছুক্ষণ।এই কিছুটা সময় জীবনের সমস্ত স্তব্ধতার ভেতর থেকে নিজেকে দেখা।এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদায় যখন জুড়ে গিয়ে এক বৃহৎ বিদায়রজ্জুতে পরিণত হয় তখন তার দুদিক ধরে দুজনে যত টান দেওয়া হোক না কেন,একজনের পতন নিশ্চিত।ভালোবাসার নরম সেই রূপ মাটির পুতুলের মতো ভেঙে গিয়ে মিশে যায় ধীরে ধীরে।

তবু কি আশ্চর্য পৃথিবীর মোহ।যা কিছু হারায় সেই হারানোর মধ্যেই একটা পাওয়া রেখে যায়।যা নেই,তা তো একপ্রকারের নেইয়ের থাকা।সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়,থেকে যায় এমন পাড়া সঠিক সময়ে যা ছেড়ে আসা প্রয়োজন ছিল।ভুল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল রাস্তার মোড়্গুলো,অথচ কি অদ্ভুত তার বাড়ির দেওয়ালের রঙ মনে থেকে যায়।মনে নাকি বোধে?

সেই পুরনো পাড়াতে গেলে বুঝি মাটিতে পা পড়ছে না।হাওয়ায় ভেসে চলেছি।আমার স্পর্শক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে সময়।যত সেই পথ ছুঁতে চাই,হাওয়ায় ভেসে থাকি।হলুদ রঙের এক আলোর নীচে গিয়ে দাঁড়াই,দেখি আমার অদূরে একজন বেহালাবাদক তার বেহালা নিয়ে বাজাচ্ছে।কিন্তু তার বেহালার কোন তার নেই।আরও যাই,দ্রুত যাই,দেখি আমার সঙ্গে অদূরের সম্পর্ক সে ঠিক বজায় রেখেছে।তাকেও ছুঁতে চাই,অথচ আমাদের অদূরের সম্পর্ক।

অথচ বেহালাবাদক নিজের ঐ ভাঙা তারের বেহালা নিয়ে স্পর্শ করতে পারছে মাটি, আমার মতো সে শূন্যে ভাসমান নয়।পুরনো অনেক চেনা মুখ আসে।চেনা কারণ তাদের সকলের মুখ একই।কোন তফাৎ নেই। আমাকে তারা প্রেতের মতো অসীকার করে এগিয়ে চলে।কেউ কেউ আমার এই শরীরের ভেতর দিয়ে শরীর ভেদ করে হেঁটে যায়।অথচ একদিন তাদের চোখে অদৃশ্য থাকার কত পরিকল্পনা করেছি আমি। আসি সেই শেষ বিদায়ের জায়গাটিতে।মাটির পুতুলের কিছু ভাঙা এদিকওদিক ।একটা হাত,ভেঙে যাওয়া,একটা কান অর্ধেক ঘাসের দিকে চলে গেছে।বেহালাবাদক তার বাদ্যযন্ত্র বন্ধ করে স্থির ভাবে আমাকে দেখে।তার চোখে কোন ভাষা নেই।তার দৃষ্টি আশ্চর্য শূন্য।দেখি আমার ভাঙা পুতুলের একটি চোখ অবহেলার ভেতর রয়ে গেছে।একটি চোখ।সম্পর্ক নাকি আমার?

মুখে হাত দিয়ে দেখি আমার বা চোখে একটা মস্ত বড় গর্ত।একি।ডানচোখ?একই!জলে ভিজে গেলো হাত। আমার চোখ নাকি এটি সেই ছেলেবেলার দীঘি?মাটির চোখটি তুলে নিতে নীচু হই, ঠিক যখন তখুনি দেখি বেহালা আবার বাজতে শুরু করেছে।নীচু থেকে মাথা তুলে দেখি গভীর রাতে নিজের লেখার টেবিলে বসে আছি।লেখার টেবিল? যে কাঠে ভালো কফিন হয় সেই কাঠে ভালো লেখার টেবিল হতে পারে।আমি লেখার টেবিলের ঢাকনা খুলে আমি বেরিয়ে আসি।এখন কত রাত কে জানে?

নীচে নেমে এসে দেখি মশারির ভেতরে মাংসপিণ্ডের মতো ঘুমিয়ে আছে আমার সম্পর্কসমূহ।সেই ঘুমনোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মশারি।আমি মশারির খুলে তাদের কাছে যেতে চাই,তবে কিছুতেই খুলতে পারিনা।জাল,চারিদিকে জাল।একটি ক্ষুধার্ত মশার মতো আমি মশারির বাইরে অপেক্ষা করি।সম্পর্কের কাছে যাওয়ার অপেক্ষা।

অথচ,লাভ কিছুই নেই।এভাবে হয়না।বেরিয়ে আসি আবার ঘর থেকে সেই পুরনো পাড়ার উদ্দেশ্যে।অমন রাতেও কোন কোন চালক থাকে যারা ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।আমি জানি তারা বহুদিন আগে আমাদের এই ছোট শহরে সাইকেল চালাতো তারা।একদিন তাদের চেন ছিঁড়ে গেছিল বলে আর তারা অপেক্ষা করেনি মেয়েদের ইশকুলের পেছনের গলিতে।তারা আর চুলের বাহার দেখায়নি।তারা আর বুকের কাছে দুটো বোতাম খুলে রাখেনি।এমন চালকই গন্তব্যে এমন রাতে পৌঁছে দিতে পারে।
নামার সঙ্গে সঙ্গে আমি শূন্যে ভেসে উঠি।দৃশ্যমান হয় সেই বেহালাবাদক।সময় নষ্ট না করে ছুটে যাই সেই অপেক্ষার জায়গাটিতে ।আমাকে খুঁজে পেতে হবে সেই চোখ।আমাকে বসিয়ে নিতে হবে সেই চোখ,নইলে এই বুকের ভেতরের দীঘির জল দুচোখ দিয়ে শুকিয়ে যাবে।বাইরে প্রখর সূর্যের মতো তাপ- মানুষের প্রতিহিংসা,অপমান,ঘৃণা।

অপেক্ষা করছে বেহালাবাদক তার শূন্য দৃষ্টি নিয়ে আমার এই পাওয়ার জন্য।আমি খুঁজি খুঁজি।চোখ-চোখের আড়াল-চোখের নিষ্ঠুরতা।ভোর হয়ে আসে প্রায়।মানুষের বেরিয়ে আসার সময় হয়ে এলো।

একটি শামুকের চলে যাওয়ার ভিজে পথে আমি পাই আমার চোখ।বুকের ভেতরে এক স্রোত- আমি এগিয়ে যাই- এগিয়ে যাই- নীচু হই আর তক্ষুনি আবার এসে পড়ি আমার লেখার টেবিলে।সেই সামান্য সময়টুকু-সেই যেমন তাকে বিদায়ের পর কিছুক্ষণ-জীবন,এক মস্ত রাক্ষস জীবন তার ধারালো দাঁত দিয়ে চিৎকার করে হাসে-

হাহাহা…

Be the first to comment

আপনার মতামত...