মণিদীপা ব্যানার্জ্জী
লেখক প্রাবন্ধিক, পেশায় আইনজীবী
#BoycottChina হ্যাশট্যাগ গুঁজে চিনের পণ্য বয়কট করার দাবি তুলে আর চিনের ‘ম্যাপ’ বদলের কড়া জবাব প্লে-স্টোরের ‘অ্যাপ’ ব্যান করে দিয়েই যারা ভাবছেন আমরা চিনের অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিয়ে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার পথচলা শুরু করেছি, তাঁদের ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি এই গালওয়ান আর চিনের নাটকের মধ্যেই পূর্ব ভারতের বৃহত্তম আদিবাসী উচ্ছেদ হতে চলেছে। দেড়শো বছরেরও বেশি আগে ব্রিটিশ ভারতে, যে জঙ্গল রক্ষা করার জন্য একটা সময় অত্যাচারী জমিদার-জায়গিরদারদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল, সিধু-কানহু-বিরসা মুন্ডা যে অরণ্যের অধিকার রক্ষায় প্রাণ দিয়েছিলেন, আমার দেশের সম্পদ সেই অরণ্যকেই আজ স্বাধীন ভারতে নির্দ্বিধায় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। আর দিচ্ছে আমারই দেশের সরকার।
গত ১৮ই জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাণিজ্যিক খনির জন্য ৪১টি কয়লা ব্লকের নিলাম উন্মুক্ত করেছিলেন। যদিও বাণিজ্যিক কয়লা খননকে ২০১৫ সালে এনডিএ সরকার অনুমোদন করেছে এবং এটির নিলাম পদ্ধতিটি ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদের দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল, অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রীসভা কমিটি এবছর ২০শে মে রাজস্ব ভাগাভাগির ভিত্তিতে কয়লা ও লিগনাইট খনি বিক্রয় ও কয়লা সংযোগের মেয়াদ বৃদ্ধির পদ্ধতিটি অনুমোদন করেছে। সেই মোতাবেক খনিজ আইন সংশোধনের মাধ্যমে এই ভয়ঙ্কর মহামারি পরিস্থিতিতে রীতিমতো অর্ডিন্যান্স জারি করে সরকার কয়লা ব্লকগুলির জন্য বিশ্ব-দরপত্র দাবি করে দ্বি-পর্যায়ের বিড প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কয়লামন্ত্রক সম্ভাব্য দরদাতাদের সঙ্গে ২৫শে জুন থেকে ১৮ই জুলাইয়ের মধ্যে প্রাক-বিড সভা করবে। বিড জমা দেওয়ার শেষ তারিখ হবে ১৮ই আগস্ট। ভারতে নিবন্ধিত যে কোনও সংস্থা কয়লা নিলামে অংশ নিতে পারবে এবং কয়লা বিক্রয় বা ব্যবহারে কোনও বিধিনিষেধ থাকবে না। মোদির সঙ্গেই ই-অকশনে সামিল ছিলেন টাটা সনস-এর চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখরন, বেদান্ত গ্রুপের অনিল আগরওয়াল। আর খরিদ্দার হিসাবে ছুটে এসেছে টাটা, বেদান্ত, আদানি, জিন্দাল, হিন্ডালকো, জেএসডব্লিউ থেকে বিএইচপি, রিও টিন্টো, বিলিটনপিবডির মত বিদেশি কর্পোরেট গ্রুপ।
পাঁচটি রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা এই ৪১টি কয়লা ব্লকের মোট ভূতাত্ত্বিক খনি রয়েছে ১৬,৯৭৯ মিলিয়ন টন এবং প্রায় ১২ লক্ষ হেক্টর জমির ওপর এটি বিস্তৃত যার অধিকাংশই বনভূমি। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ লক্ষ হেক্টর জমি ‘নো গো’ এরিয়ায় অর্থাৎ গভীর বনাঞ্চলের অন্তর্গত। ‘নো গো’ এলাকা মানে সেখানে আছে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, গভীর বনাঞ্চল, নানাধরণের প্রাণী আর বিভিন্ন নদী-উপনদীদের অজস্র জলধারা। এর মধ্যে ১১টি মধ্যপ্রদেশে, ৯টি করে ব্লক ছত্তিশগড়, ওডিশা এবং ঝাড়খণ্ডে আর তিনটি মহারাষ্ট্রে।
ঝাড়খণ্ডের নয়টি কয়লা ব্লক ১০ জেলায় ৪৭.৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটারে বিস্তৃত। ঝাড়খণ্ডের ১০ জেলায় প্রায় ৩০-৩২টি গ্রাম স্থানান্তরিত করা দরকার। ঝাড়খণ্ডের কোলিয়ারি এলাকা থেকে অপরিকল্পিত খনি খাদানের জন্য বর্তমানে প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এখন বেশিরভাগ লোক যারা রিকশাচালক বা কুলি, তাদের অনেকেই নিজ নিজ জমি থেকে বাস্তুচ্যুত। এরপরে সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে বাড়বে।
ওডিশার নয়টি খনির আটটি আঙ্গুল জেলায় রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩২,০০০ হেক্টর জমি খননের জন্য অধিগ্রহণ করতে হবে, যার ফলে আনুমানিক দশ হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্বকালের বৃহত্তম বাস্তুচ্যুতি মহল হিসাবে পরিণত হতে পারে। এই জেলার ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষক। সেচ সুবিধা থাকায় এনারা বছরে দুটি ফসল পান। কিন্তু এলাকায় কয়লার ধুলো সমস্ত জলাশয় এবং বায়ুকে দূষিত করছে। তালচের অঞ্চলে কয়লা খননের কারণে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড অনুযায়ী অঙ্গুলি জেলা ইতিমধ্যে রাজ্যের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চলগুলির অন্যতম। কয়লা উত্তোলনের কারণে জেলায় ইতিমধ্যে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ক্যান্সার এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগ রয়েছে। এই কয়লা ব্লকের নিলাম কেবলমাত্র একসঙ্গে হাজার হাজার পরিবারের জীবনকে ধ্বংসই করবে না, ঐ অঞ্চলের বন্যজীবনকে বিপদে ফেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করবে। এই ৮টি ব্লক খনন করা হয়ে গেলে আঙ্গুলে বাস করা কোনও দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতার চেয়ে কম কিছু হবে না।
ছত্তিশগড়ের লেদেড়ু এলিফ্যান্ট রিজার্ভের ১৭০,০০০ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত হাঁসদেও আরান্দ বনাঞ্চল ধ্বংস করবে এই নিলাম। হাঁসদেও বনাঞ্চল আর মান্ড নদীর ধারে বুনো হাতিদের এতই আনাগোনা যে মাঝেই মাঝেই মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগে। হাতি-মানুষ সংঘর্ষ এড়াতে ছত্তিশগড় সরকার হাসদেও বনাঞ্চলের ১৯৯৫ স্কোয়ার কিলোমিটার জমি যুক্ত করেছেন লেরমু হাতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে, অথচ ওই এলাকাই ৪১টি ব্লকের মধ্যে অন্যতম।
এই কয়লা ব্লকগুলিতে প্রায় ২৫-৩০ লক্ষ গাছ রয়েছে। খনিটি কেবলমাত্র হাঁসদেও নদীকেই দূষিত করবে না, এই খননটি হাঁসদেও আরান্দ এবং এর ভিতরের অঞ্চলে অবস্থিত হাতিদের বাস্তুচ্যুত করে তাদের চলাচলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলটি একেবারে ধ্বংস করে দেবে।
মহারাষ্ট্রে বান্দর ও মার্কি মঙ্গলি-২ কয়লা ব্লক নিলামের বিরুদ্ধে রাজ্য আপত্তি তুলেছে। বান্দর কয়লা ব্লক একটি বাঘ করিডোরের চূড়ায় পড়ে এবং ঘন বনাঞ্চলের কারণে মার্কি মঙ্গলি-২টিকে ‘নো-গো’ এরিয়া হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
মধ্য প্রদেশেও, ৩টি কয়লা ব্লক মার্কি, বারকা এবং বাঁধা ‘নো গো’ অঞ্চলে। এমনকি মারওয়াতোলা ব্লকটি বাঘের করিডোরে অবস্থিত হয়েও ‘ইনভায়োলেট’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় নিলামে। মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুরের গোটিটরিয়া পূর্ব কয়লা ব্লক ৮০ শতাংশ বন এবং এটি সিতেরেভা নদীর জল নিষ্কাশনের কাজ করে। এই নিলামের ফলে যেখানে বাস্তুতন্ত্র ব্যাপক মাত্রায় বিঘ্নিত হবে।
গভীর অরণ্যের গাছ কেটে, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে দেশের জাতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া যাবে না লোভী ক্ষুধার্ত নিজের পছন্দসই কর্পোরেটদের হাতে। কয়লা ব্লকগুলি গুরুত্বপূর্ণ নদীর সান্নিধ্যে হয় ঘন জঙ্গলের মধ্যে অথবা ঘন জনবহুল অঞ্চলে। এগুলি যদি বাণিজ্যিক খনির জন্য উন্মুক্ত করা হয়, তবে এটি পরিবেশগত অবক্ষয়, বিস্তৃত স্থানচ্যুতকরণ এবং জলাশয়গুলির ধ্বংসের দিকে পরিচালিত করবে।
ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এই জাতীয় সম্পদ লুঠ করার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে গেছেন।
ছত্তিশগড়ের বনমন্ত্রী মোহাম্মদ আকবর খনি নিলামের বিরোধিতা করে চিঠি লিখেছেন।
হাঁসদেও আরান্দে পড়া গ্রামগুলি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে বাণিজ্যিক খনির জন্য এই অঞ্চলে পাঁচটি কয়লা ব্লকের নিলাম বন্ধ করতে বলেছে কারণ এটি তাদের জীবিকা ও সংস্কৃতিতে বাধা সৃষ্টি করবে।
বান্দর কয়লা ব্লক খোলার বিপদগুলির দিকে ইঙ্গিত করে মহারাষ্ট্রের পরিবেশমন্ত্রী আদিত্য ঠাকরে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
কয়লা ব্লক নিলামের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রায়ত্ত কোল ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ রুখতে, গত ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই টানা তিন দিন ধর্মঘট ডেকেছিল কয়লা ক্ষেত্রের সবকটি ট্রেড ইউনিয়ন একসঙ্গে। এমনকি তাতে যোগ দিয়েছিল আরএসএস-অনুমোদিত ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বিএমএস)।
অরণ্য বাঁচাতে ধর্মঘটে সামিল ‘ভূমি অধিকার আন্দোলন মঞ্চ’। প্রফুল্ল সামন্ত, দয়ামণি বারলা, মেধা পাটকর, আনন্দ মাজগাঁওকার, স্বাতী দেসাই, কৃষ্ণকান্ত পার্থর মতো বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও পরিবেশবিদদের স্বাক্ষরিত এনএপিএম বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে লাভজনক উপার্জনকারী দেশি-বিদেশি কর্পোরেট খনির সত্তাগুলিতে এই অঞ্চলগুলি উন্মুক্ত করা অপরিবর্তনীয়ভাবে প্রাচীন বনভূমিগুলিকে বিপদগ্রস্ত করবে একটি বড় অংশের আবাসকে ধ্বংস করবে।
জঙ্গল মানে শুধু আরণ্যকের শাল পিয়ালের অপরূপ সৌন্দর্য নয় বা আগন্তুকের মমতাশঙ্করের ধামসা মাদল বাজিয়ে আদিবাসী নৃত্য নয় বা বেতলা নেতারহাটে জঙ্গল সাফারি নয়।
জঙ্গল মানে আত্মরক্ষার অধিকার। জঙ্গল মানে সম্পদের অধিকার। জঙ্গল মানে তোমার খাবার কেউ কেড়ে খেলে পাল্টা ঝাঁপিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার। আর সেই অধিকার আমার দেশের সাঁওতাল কোল মুন্ডা গোন্ড ওঁরাওরা ছেড়ে দেননি। তাঁরা এখনও লড়ছেন নিজের দেশের সম্পদকে রক্ষার জন্য, নিজদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য।
একটা সময় সিধু-কানহুর মাথার দাম ব্রিটিশরা রেখেছিল দশ হাজার টাকা। সিধু কানহু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, শহিদ হয়েছিলেন কিন্তু অধিকার ছাড়েননি।
নাহ্, আমাদের এখনও তাকিয়ে দেখার সময় হয়নি। আমরা এখনও চিৎকার করিনি। আমরা কেরলের হাতির দুঃখে কেঁদে উঠেছি অথচ ছত্তিশগড়ের হাঁসদেও জঙ্গলের হাতিদের খবরও রাখিনি! আমরা যারা জানি না তারা গালওয়ানে সিয়োক নদীর ধারে বা টিকটক অথবা ইউ ক্যাম ব্যানের তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত, আর যারা জানি তারা চুপ!