মেসবাড়ি

দেবব্রত সরকার

 

তখন মেসে থাকি। বেলঘরিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে। পুরো বাড়িটাই ভাড়া দেওয়া মালিকের ঘর বাদ দিয়ে। সাথে এজমালি রান্নাঘর, এজমালি পায়খানা। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই নিচের তলার প্রথম যে ঘর। সেটাতে একঘর ফেমিলি ভাড়া থাকে। বাকি বাড়িটা মেস।

সে যাই হোক আমার মেস জীবনের শুরুতে এই ঘরে একটা ফেমিলি ভাড়া ছিল। মা বাবা আর কলেজে পড়া একমাত্র মেয়ে। বাড়ির কারও গলা সারাদিন পাওয়া যেতনা শুধু সকালটা বাদ দিয়ে। সেটা মেয়েটির গানের রেওয়াজের সময়। সেকি রেওয়াজের ধুম। শুধু সরগম সা… রে… গা… মা… আর তাতেই সারা পাড়া গমগম।এমন সুন্দর গলা লতা মঙ্গেশকর তার সঙ্গীত জীবনের প্রথমে শুনলে হয়তো তিনি সঙ্গীতকে কোনওদিনও পেশা হিসেবে নিতেন না। অবশ্যই এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

আমরা যারা তখন পড়াশুনো করি তাদের রাত বাড়ার সাথে সাথে পাটি গনিতের অঙ্কের মতো সমানুপাতিক হারে এনার্জি বাড়ে। আর সকালে কে কতক্ষন ঘুমাতে পারে তার অলিখিত প্রতিযোগিতা। রাঁধুনি মাসি এসে বাজার যাওয়ার জন্য হত্যে না দিলে। ঘুম থেকে ওঠান নাম নেই।

সেখানে সাত সকালে পুরনো দিনের ঘড়ির এ্যলার্মের মতো এমন গলা সাধা একেবার প্রান ওষ্ঠাগত যাকে বলে। সকলে মিলে পরামর্শ করে এক বন্ধুর বোনের খারাপ হারমোনিয়াম সারিয়ে দেওয়ার নাম করে মেসে আনা হল। আর আমরাও সকালে শুরু করলাম পাল্লা দিয়ে হরে কৃষ্ণ হরে রাম…। কৃষ্ণ নাম জপ।

একেবার পড়োসন সিনেমার মারকাটারি দৃশ্য।

আমাদের প্রার্থনা সঙ্গীতে ঈশ্বর তুষ্ট হলেন।

অচিরেই কমপ্লেন গেল বাড়ির মালকিনের কাছে। শোনা গেল মিটিং বসবে আমাদের মতো অসভ্যদের শায়েস্তা করতে। আমরাও আস্তিন গোটাতে শুরু করলাম। আলোচনা চলল। ওপরে মিটিংয়ে ডাক এলে কি বলা হবে। কে বলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু দেখা গেল কয়দিন পরেই ফ্যামিলিটাই ভোকাট্টা। আমরাও মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম কি হল কেসটা।

এবার আবার নতুন ভাড়াটে। এবং নব বিবাহিত জুটি। রহস্যটা বোঝা গেল। ছোট ফেমিলি। বাচ্চা কাচ্ছা নেই। আর ভাড়াও দেবে বেশি। তাতেই বাড়ির মালকিন পটে গেছেন। বৌদিটাও বেশ হাসিখুশি।

কিন্তু পছন্দ হলনা দাদাটাকে। খুব বারফাট্টাই। বাড়িতেই টিউশনি পড়ান। ঘর ভর্তি ছাত্র ছাত্রী আসে। শুধু মেয়ে গুলোকেই বেশি করে বোঝান। দরজা খোলা থাকে। আমরা আসতে যেতে দেখি।

দাদা মাঝে মাঝে এমনসব জ্ঞান ছাড়েন যেন ভারতের টেলিকম রেভ্যুলেশন উনিই করতে চলেছেন। অর্থনীতিতে এবারের নোবেল উনিই আনবেন আরও কত কি…! যতক্ষন দাদা পড়ান বৌদি হয় খাটের ওপর বসে থাকেন না হলে বাইরে দাড়িয়ে থাকেন। ঘর বলতে একটাই।

বৌদির দশা দেখে আমাদের মতো মেসের দেওরদের কারও কারও বুকে প্রচন্ড ব্যাথা।

খুব তাড়াতাড়ি আবিস্কার করা গেল সন্ধ্যে হলে; দাদা বৌদি ছাড়া আর কাউকে চেনেন না। অতিগরমেও সামনের দিকের দরজা জানালা সব বন্ধ থাকে। ঘরে নাকি একটা ক্যাটক্যাটে লাল লাইট জ্বলে। আর দাদা যখন বৌদিকে শুয়ে অনেক গল্প শোনান। তখন নাকি ঘরের পিছনের দিকের জানালার একটা পাল্লা খোলা থাকে।

সেই জানালার সামনে দিয়ে বয়ে গেছে গঙ্গার মতো পবিত্র বেলঘরিয়া নালা। কলকাতার প্রায় সব মশার আতুঁড় ঘর। জানালার ঠিক নিচেই আমাদের রান্নার মাসির জ্বালানি কাঠ রাখার জায়গা। মাঝে মাঝে নাকি সাপেরও উৎপাতও হয় সেখানে।

  • কিন্তু দাদার ঘরের পিছনের দিকের জানালা যে রাতে খোলা থাকে সেটা কে দেখেছে?
  • কেন? বরুন দা দেখেছে। আর বরুন দা প্রতিদিন নাকি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখে।

আমাদের চোখে বরুনদার সন্মান কয়েক লক্ষ গুন বেড়ে গেল। দুপুরেই বরুন দাকে ছোট খাটো সম্বর্ধনা দিয়ে দেওয়া হল। নিতাই জানালো আমাদের দিলদার বরুন দা তার এই আবিস্কারটা তিনি যেভাবে মেসের সবার জন্য দান করে দিল সেটা আলফ্রেড নোবেলের দানের থেকে কোনও অংশে কম না।

ঠিক হলো আজ রাতেই বরুন দা পুরো মেসকে নিজের দায়িত্বে তার সেই আবিস্কার দেখাবে। সাত সন্ধ্যে রাতের খাওয়া সেরে পুরো মেস একেবারে তৈরি। দরজা বন্ধ হতেই জানালার বাইরে ভিড় বাড়া শুরু। বাইরে ভোঁ ভোঁ করছে বেলঘরিয়ার জগৎ বিখ্যাত মশার দল। দাড়িয়ে সকলে সারা গায়ে হাত বোলাচ্ছে। মশা মারার জন্য কোনও চড় চাপাটির শব্দেরও পারমিশন নেই। বরুন দার একেবারে মিলেটারি হুকুম। ভালো কিছু দেখতে গেলে নাকি এমন একটু আধটু স্যকরিফাইস করতে হয়। স্যাকরিফাইসের নাম করে সেখানে দাড়িয়ে কতো লিটার রক্ত দান হয়ে গেল তা ঠিক সময়ে আমাদের দেশের উদ্দ্যেশে দিলে ভারতবর্ষ অনেক আগেই হয়তো স্বাধীন হয়ে যেত।

আমার আর বিশুর সন্ধ্যে বেলা ক্লাশ ছিল। রাতে ফিরে খেয়েই তাড়া লাগালো বিশু চল পিছনে যেতে হবে।

তাড়াহুড়ো করে যেতে বাড়ির পিছন দিকে পৌছেই লাফিয়ে উঠল বিশু চাপা গলায় সাপ বলেই উল্টে পড়ল আমার ওপর আর আমি টাল সামলাতে না পেরে দাদা বৌদির ঘরের পিছনের দিকের দরজার এক রাম ধাক্কা। মুহর্তে বদলে গেল পরিবেশ।

বন্ধ হয়ে গেল দাদা বৌদির ঘরের ভিতরের লাল আলো ভেসে এলো আওয়াজ – কে? কে ওখানে?

আর আমরা সবাই পড়ি কি মড়ি দৌড়। মাঠ একদম ফাঁকা। আবিস্কার কর্তা বরুন দা দৃশ্য ভালো ভাবে দেখার জন্য উঠে দাড়িয়ে ছিল রাঁধুনি মাসির কাঠের গাদায়। তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে পা পিছলে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল কাঠের গাদা সমেত।

জ্বলে উঠল বাইরের লাইট। বেরিয়ে এলো দাদা বেশ তিরিক্ষে গলা – “বরুন এখানে দাঁড়িয়ে কি অসভ্যতা হচ্ছে”?

বরুন দা তখন বাধ্য ছেলের মতো কাঠ কাঠ হয়ে কাঠ গোছাচ্ছে – “ক… ক… কই কিছু নাতো? সকালে রাঁধুনি মাসি আসবে তাই কাঠ গুছিয়ে রাখছি”।

Be the first to comment

আপনার মতামত...