পবিত্র সরকার
লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ
এটা মার্কসবাদের একটি চেনাজানা কথা যে, রাষ্ট্র শাসন করে একটি বিশেষ শ্রেণি, এবং যেহেতু সেই শ্রেণি তার শাসন আর আধিপত্য চিরস্থায়ী করতে চায় তাই সে রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কীসের নিয়ন্ত্রণ, না নিজের শ্রেণি-মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণ, যা শাসিত জনগণকে নানাভাবে বঞ্চিত আর প্রতারিত করে নিজের শাসন অব্যাহত রাখতে চায়, নিজের একটা উপকারী মুখোশ তৈরি করে সকলকে দেখাতে চায়। এই লক্ষ্যেই, নিজের শ্রেণির স্বার্থেই, শাসকেরা শিক্ষার প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত কী পড়ানো হবে এবং কী পড়ানো হবে না— সবই এই শ্রেণি ঠিক করে দেয়। অর্থাৎ পাঠের গ্রহণ ও বর্জন, দুইই তাদের নজরে থাকে।
একেবারে স্বৈরশাসনের অধীনে ছাড়া সব সময় সেই শ্রেণির ইচ্ছামতো নির্ভেজাল, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পাঠ তৈরি করা সব সময় সম্ভব হয় না অবশ্য। বিশেষ করে তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হলে। পুঁজিবাদে আশ্রিত গণতন্ত্র এক হিসেবে ভেজাল গণতন্ত্র হলেও তাতে মার্কসবাদে যাকে দ্বান্দ্বিকতা বা ডায়ালেক্টিক্স বলা হয়, তার কিছু অবকাশ গড়ে ওঠে। যেমন সমস্ত ব্যবস্থাতেই হয়। প্রথম দ্বান্দ্বিকতা, ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সঙ্গে। এর আগেকার শাসকেরা যে পাঠ্যসূচি তৈরি করেছিল, তার সঙ্গে এবারের পাঠ্যসূচি সঙ্গতি রক্ষা করছে কি? এই পরম্পরাগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত হয় আরেকটা দ্বন্দ্ব। শাসকেরা পাঠ্যসূচি নির্ধারণের জন্য যে সব বিশেষজ্ঞের কমিটি নির্মাণ করেন, তাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব থাকে, তাদের সকলে শাসকদের মতাদর্শের অনুসারী নাও হতে পারেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা পাঠকদের মনে রাখতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ‘আধুনিক’ পাঠ্যসূচির সঙ্গে তাদের প্রণীত পাঠ্যসূচির সঙ্গতি আছে তো? না কি তা প্রগতি-বিরোধী, পশ্চাৎ-মুখী বলে সমালোচিত হবে? তাই এইরকম বাইরের আর ভিতরকার নানা দ্বান্দ্বিকতার সংঘাত-সংঘর্ষে এবং টানাপোড়েনে একটি সিলেবাস তৈরি হয়ে যায়, যা নিয়ে শাসকেরা অল্পস্বল্প অস্বস্তিতে ভোগে। এই অস্বস্তিও এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতারই চিহ্ন।
তাই তারা তক্কে তক্কে থাকে কখন কোন্ সুযোগ আসে— ওই (তাদের শ্রেণি-মতাদর্শের পক্ষে) অস্বস্তিকর সেই সব পাঠ তারা কখন এবং কীভাবে ছেঁটে ফেলতে পারে, ছাত্রদের চোখ এবং শিক্ষার এলাকা থাকে সরিয়ে নিতে পারে। আধিপত্যকারী শ্রেণির পক্ষে এ খুবই স্বাভাবিক এক কামনা, কারণ ওই সব পাঠ হয়তো আবার নতুন করে ছাত্রদের মনে প্রশ্নের এবং দ্বান্দ্বিকতার বীজ বুনবে, তাতে বর্তমান শাসকদের আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রশ্ন থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ, প্রতিরোধ থেকে বিদ্রোহ— কে জানে তা কোথায় গিয়ে থামবে! সব সময় এই চিত্রনাট্য বাস্তব না হলেও শাসকের উদ্বেগ কমে না। Uneasy lies the head that wears the crown.
করোনা এই রকম একটি চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে এবার রাষ্ট্রীয় শিক্ষা-প্রশাসকদের হাতে। করোনার প্রকোপে সিলেবাস শেষ করা যায়নি বা যাবে না, তাই তার ছাঁটকাট করতে হবে। ভালো কথা, কিন্তু কোন্গুলিকে? এবার সিবিএসই এগারো ক্লাসের পাঠ্যতালিকা থেকে তাই বাদ গেল Federalism (যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা), গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, নাগরিকতা ইত্যাদি অধ্যায়, আর দশ ক্লাসের তালিকা থাকে বাদ গেল গণতন্ত্র আর বহুত্ববাদ, লিঙ্গ আধিপত্যের প্রশ্ন, ধর্ম আর জাতপাত, আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি।
উপরের এই তালিকার দিকেহ একবার নজর ফেললেই শাসকদের উদ্দেশ্য জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। আমাদের কাছে আশ্চর্য লাগে যে, এই বিষয়টার মধ্যে তাঁরা এতটুকু আড়াল বা ছলনার জায়গাও রাখলন না, চক্ষুলজ্জারও কোনও চিহ্ন নেই। ওই সব বিষয়গুলো যে মতাদর্শের দিক দিয়ে আমাদের এখনকার শাসকদের অপছন্দের, তা কে না জানে? আর তাঁরা এতই বেপরোয়া যে, তাঁরা ভাবলেন, লোকে জানুক তো বয়েই গেল, আমাদের মেজরিটি যখন আছেই তখন আমরা আর কোনও রাখঢাক রাখি কেন, দে সব ছেঁটে। এই ছেলেমেয়েগুলো ওই সব বিপজ্জঙ্ক বিষয় না শিখুক, না বুঝুক। তাতে আমাদেরই সুবিধে।
এটাকে এখন একটা খুচরো ছ্যাঁচড়ামি বলে মনে হলেও, ভবিষ্যতে ভালো অবস্থাতেও যে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, এমন নয়। কাজেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, মাটি কামড়ে গণতান্ত্রিক এবং বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার হয়ে শাসকদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।