শুচিস্মিতা সেন চৌধুরী
হঠাৎ সেদিন ফোন এল অচেনা এক নম্বর থেকে। ওপারে বিশ্বনাথ। অবাক হলাম খুব। প্রায় তিরিশ বছর পর মনে রাখে মানুষ? হ্যাঁ, সত্যি মনে রাখে। আমি স্মৃতি হাতড়ে যতটুকু মনে করতে পারি তাতে অস্পষ্ট এক ছবি। এক কিশোর বা বালক। চার-পাঁচজনের একসঙ্গে পড়তে যাওয়া। নানান ক্লাসের ছোট বড় বন্ধু। দোমোহনির তিস্তার চড়ে ওর বাসা। বাসা (বাড়ি) কথাটাই প্রচলিত ওখানে। তিস্তা বলতে মনে পড়ে বাঁধ, বর্ষাকালে জল দেখতে যাওয়া, লোকজনের গুঞ্জন, বন্যা হবে না তো এ বছর? এই আশঙ্কা নিয়েই প্রতিবছর ধান চাষ করত ওরা। মাঝে মাঝে ডুবে যেত জমি। নষ্ট হত ফসল। ইতিহাস বলছে ১৯৬৮ সালে তিস্তার বাঁধ ভেঙে বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছিল রেলশহর দোমোহনি। তাই অতি বর্ষণে ভয় থাকত সবার। গবেষক ও সাহিত্যিক শোভেন সান্যালের রাজকাহিনী[1] বইটিতে পাওয়া যায় দোমোহনি নামের উৎপত্তির সূত্র। চেল বা ধরলা নদী একদিকে যেমন তিস্তার উপনদী তেমন শাখানদীও। একই স্থানে দুটি মোহনার উপস্থিতির কারণে সে অঞ্চলে গড়ে ওঠা জনবসতির নাম হয় দোমোহনি। শোভেন সান্যালের কাছেই জানতে পারি এই জনবসতির উৎপত্তি ১৭৮৭-র পর। তার আগে ডুয়ার্সের মধ্যে ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল এই জায়গা।
করোনা ভাইরাসের অত্যাচারে আমরা যখন গৃহবন্দি, তখন নানান স্মৃতির অবাধ বিচরণ। বিশেষ করে শৈশবের স্মৃতি। জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দোমোহনি। স্মৃতির ভারে বিবর্ণ এক জনপদ। গল্প শুনে বড় হয়েছি আমরা। যে গল্পের প্রধান কথক আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রী কমল সেন চৌধুরী আর নায়ক সম্ভবত আমার ঠাকুরদা স্বর্গীয় শ্রী সুরেশ সেন চৌধুরী। দেশভাগের আগে গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন ছিল দোমোহনি। কর্মসূত্রে আমার ঠাকুরদা কয়েক বছর দোমোহনিতে পোস্টেড্ ছিলেন। নিযুক্ত ছিলেন গার্ড পদে। ব্রিটিশ আমলে রেল যোগাযোগের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র দোমোহনিতে ছিল খুব বড় রেল শেড ও কর্মশালা। ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে। এর প্রধান কার্যালয় ছিল দোমোহনিতে। ১৫৩ মাইল দীর্ঘ মিটারগেজ লাইনটি তিস্তার এক প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে শেষ হত লালমনির হাটে।[2] ১৮৯৩ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত অস্তিত্ব ছিল এই রেলের।[3] ১৯৫১ সালে বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে মিলিত হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে।[4] এই লাইনের গুরুত্ব ছিল চা ও কাঠের ব্যবসার ক্ষেত্রে। আমার পিসি ও কাকুর স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারি দোমোহনি থেকে ফরিদপুর যাতায়াত ছিল ঠাকুরদার। কারণ দেশের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার গয়ঘর গ্রামে। ঠাকুরদার রেলে প্রথম চাকরি বাংলাদেশের বাউরাতে। ১৯৩৯ সালে দোমোহনিতে পোস্টেড হন এবং ১৯৫৮ সালে উনি অবসর নেন রঙ্গিয়া থেকে। দোমোহনির গুরুত্ব ক্রমশ কমে আসছিল দেশভাগের পর থেকে। তবে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এটা জংশন স্টেশন ছিল বলে জানা যায়। একটা লাইন ছিল চ্যাংড়াবান্ধা হয়ে লালমনির হাট পর্যন্ত, পরে তা শুধু বর্ডার পর্যন্তই যেত। একটা লাইন মাদারিহাট পর্যন্ত আর অপর লাইনটি শেষ হত বার্নেস ঘাটে। তিস্তার এক দিকে বার্নেস ঘাট আর অন্য দিকে ছিল কিং সাহেবের ঘাট। তখনও তিস্তার ওপর ব্রিজ তৈরি হয়নি। ফলে নৌকো করেই চলত যাতায়াত। তিস্তা ব্রিজ তৈরি হয় ১৯৬৫ সালে। ঠাকুরদা যতদিন চাকরিতে ছিলেন ততদিন বাংলাদেশে গিয়েছেন এবং প্রায় ইলিশ মাছ নিয়ে আসতেন বলে শুনেছি। এমনকি প্রতি বছর দুর্গাপূজাতে দেশের বাড়িতে যাওয়ার রীতি ছিল। ফরিদপুর থেকে পাকাপাকিভাবে দোমোহনিতে আসা ১৯৪২-এ। ঠাকুরদা সপরিবারে দোমোহনির রেলকোয়ার্টারে ছিলেন বেশ কিছু বছর। তারপর বাড়ি করেন পুরানো বাজারে। প্রসঙ্গত আমি যখন গবেষণার কাজে বাংলাদেশ যাই ২০০৮ সালে, তখন ঘটনাচক্রে লালমনির হাট স্টেশনটি দেখার সুযোগ হয়েছিল। কল্পনা করা যায় তিস্তার পার ধরে রেললাইন চলে গিয়েছে অধুনা বাংলাদেশের এক জেলায়, যা এক সময় জুড়ে রেখেছিল দুটো শহরকে। লালমনির হাট স্টেশন দেখলে মনে হয় এখনও যেন ১৯৪১-এ দাঁড়িয়ে। আর দোমোহনিও আছে সেই তিমিরেই। শুধু হারিয়ে গিয়েছে জৌলুস।
দুই
আমি একসময় ভাবতাম একই পরিবারের প্রায় আশি শতাংশ পুরুষ কেন রেলে চাকরি করেন? আর এটা কীভাবে সম্ভব। পরে বুঝলাম এটা স্থানমাহাত্ম্য। রেল সূত্রে আমার বাবার প্রথম চাকরি অসমের নিউ বঙ্গাইগাঁও-তে ১৯৬৭ সালে। তিন বছর পর স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগ দেন বেদগারায়। ময়নাগুড়ির কাছে এক ছোট স্টেশন ছিল বেদগারা। সেখান থেকে দোমোহনিতে। আমরা যখন খুব ছোট তখন একটা পরীক্ষা দিয়ে বাবা ক্লেম ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত হন, পোস্টিং হয় মালিগাওঁ-তে। অবসর নেন সেখান থেকেই। চাকরিসূত্রে বাবার বেশিরভাগ সময় কাটত ভারতবর্ষের কোনও স্টেশনে বা ট্রেনে। আমরা দোমোহনি ছেড়ে কলকাতায় আসি ১৯৮৮ সালে। পলহোয়েল সাহেবের নামে তৈরি রেলের প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম আমি, আর দিদি হাই স্কুলে। সকালে বাবা কখনও সাইকেলে চাপিয়ে দিয়ে আসতেন আবার কখনও যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে। দিদির হাত ধরেও গিয়েছি কিছুদিন। ফেরার পথে কখনও কখনও দেখা করে আসতাম বাবার সঙ্গে। কারণ স্কুলে যেতে হলে পেরোতে হত স্টেশন। সকাল ১০টা নাগাদ একটা ট্রেন আসত আবার কিছুক্ষণ পর চলে যেত। চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত চলাচল করত ট্রেন। সারাদিনে ওই একটাই ট্রেন। তাই লাইন ধরে হাঁটার অসুবিধা ছিল না কোনও। সেই স্টেশন এখন সেজেগুজে উঠেছে। দু জোড়া ট্রেন চলে, একটা কোচবিহার থেকে শিলিগুড়ি আর একটা নিউ বঙ্গাইগাঁও থেকে শিলিগুড়ি। স্টেশন মাস্টারের ঘরটা আগের মতো নেই। দরজায় কান পাতলে কি এখনও শোনা যাবে বাপির কণ্ঠস্বর? খুঁজতে থাকি। পেয়েও যাই জানো? ঠিক কণ্ঠস্বর নয়, তবে নামের মাহাত্ম্য। স্কুলের পথ ভুল করে নতুন বাজারে ঢুকে পড়লে পরিচয় দিই বাবার। এক ভদ্রলোক চিনতেও পারেন। কী আশ্চর্য। এখনও বাবাকে মনে রেখেছেন দোমোহনির মানুষ।
নতুন বাজার আর পুরানো বাজার ছিল দুটো ভাগ দোমোহনির। দুই প্রান্তে দুটো দুর্গাপূজা হত। সন্ধ্যা হয়ে গেলে এই দুই বাজারের মধ্যে যাতায়াত বেশ ভয়ের সঞ্চার করত। পথে আঁধারের সঙ্গী হত ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর জোনাকির দল। শিয়ালের ডাকও শুনেছি কোনও কোনও দিন। গল্পে আছে আমাদের পরিবারের এক শিশুকে নাকি নিয়ে গিয়েছিল শিয়াল। নতুন বাজার কিছুটা গোছানো পুরানো বাজারের থেকে। কারণ নতুন বাজারে ছিল রেলপুলিশের ক্যাম্প। বেশ কিছু রেলকোয়ার্টার ছিল। পরিচিত লোকজনের সূত্রে যাতায়াতও ছিল সে সব ব্রিটিশ আমলের কোয়ার্টারে। আমাদের বাড়িটা ছিল পুরানো বাজারে। সেখান থেকে কাছেই তিস্তার চর। বিকেলে বেড়াতে যেতাম বাবার হাত ধরে। বর্ষায় বাঁধের ধারে জল চলে আসত, শীতে চলে যেত অনেক দূরে। বিকেলের আর একটা আকর্ষণ ছিল দাড়িয়াবান্ধা খেলা। এখন কেউ খেলে কিনা কে জানে। একটা মাঠ ছিল বাড়ির কাছে। নাম গরুরহাটি। অর্থাৎ গরুর হাট হত সেখানে সপ্তাহে একদিন। আমরাও দেখেছি। অন্যদিনগুলো খেলার জন্য পেতাম। সব খেলায় এগিয়ে থাকত দিদি। আমি পেছনের সারিতে। মনে পড়ছে খেলার সঙ্গীদের নাম— সঞ্জীব, মনজিৎ, টুসি, পিঙ্কি আরও অনেকে। পিঙ্কি খুব ছোট বয়েসে চলে গিয়েছে পৃথিবী ছেড়ে। এখন তো আমাদের বাড়িটাও আর নেই। নেই গল্পকার। আছে শুধু নস্টালজিয়া। আবেগ আর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত দোমোহনির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। সময় পাল্টে যাবে, বদল হবে মানুষের, কিন্তু থেকে যাবে গল্পটা।
তিন
কোনও জায়গার প্রতি ভালোবাসা আর আগ্রহ থাকলে যে কত তথ্য সংগ্রহ করা যায় তা আমি বেশ কয়েকদিনের গবেষণায় উপলব্ধি করেছি। দোমোহনি শুধু গুরুত্বপূর্ণ রেলশহর ছিল না, বিখ্যাত ছিল আরও দুটি কারণে। ব্রিটিশ আমলে ডুয়ার্সের অন্যতম স্কুল ছিল পলহোয়েল স্কুল এবং হোস্টেল। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পড়তেন পলহোয়েল স্কুলে। তার বাবা ছিলেন রেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ঠাকুরদার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল তাঁর। কিছু বছর ছিলেন দোমোহনিতে। ওনার লেখা “গন্ধটা খুব সন্দেহজনক” গল্পে উল্লেখ আছে দোমোহনির। উনি ছিলেন আমার বড় জেঠুর বন্ধু। তাই জানতে পেরেছিলাম অনেক কথা। দোমোহনির ফুটবল টিম নাকি জনপ্রিয় ছিল খুব। জেঠু ছিলেন সক্রিয় ফুটবল খেলোয়ার। শীর্ষেন্দুর গল্পে বিবরণ আছে দোমোহনির এক আশ্চর্য ফুটবল খেলার।
আরও একজন বিখ্যাত মানুষের কথা না বললে তো অসম্পূর্ণই থেকে যাবে এই কাহিনি। তিনি জ্যোতি বসু। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে রেলশ্রমিক কেন্দ্র থেকে সিপিআই প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।[5] উত্তরবঙ্গ সংবাদের সাংবাদিক তথা শিক্ষক শ্রী জ্যোতি সরকারের কাছে জানতে পারি জ্যোতি বসু ছিলেন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সমিতির সদস্য। সে সময় রেল কনস্টিটুয়েন্সিতে ভোটাধিকার ছিল রেলকলোনির বাসিন্দাদের। বহুদিন দোমোহনিতে থেকে প্রচার চালিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। দোমোহনি এবং মালবাজারের অধিবাসীদের ভোটেই জয়ী হন তিনি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী হুমায়ুন কবীরকে হারিয়ে আসনটি লাভ করেন জ্যোতি বসু। পিসির কাছে শুনেছি উনি থাকতেন বাবুপাড়ায় একটা বাড়িতে। সেটি এখনও আছে, স্টেশন আর স্কুলের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধংসের মুখে সেই বাড়ি। এরকম অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে দোমোহনি থেকে। যেমন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে রেলের কর্মশালা। যেমন ভৌতিক শূন্যতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেলের ইনস্টিটিউট হল যা একসময় গমগম করত নানান জলসায়। আমার মনে পড়ছে এক এক দিন আমরা বন্ধুরা ঢুকে পড়তাম সেই ইনস্টিটিউট হলের ভেতর আর চিৎকার করতাম একে অপরের নাম ধরে। ফাঁকা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আওয়াজ যখন ফিরে আসত তখন খুব আনন্দ পেতাম আমরা। আর ভয়ও পেতাম ভূতের। বিকেলে কোনও দিন ওদিকে যাইনি। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সে সব দিন। হারিয়ে গিয়েছে বিদ্যুৎ সংঘের মতো ক্লাব যেখানে একদিন ছন্দের সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন দেবশ্রী রায়, গান গেয়েছিলেন প্রখ্যাত গায়ক শ্যামল মিত্র। তবে হারিয়ে যাওয়ার মাঝেও থাকে কিছু পাওয়ার আশা। এখন গুগলে দোমোহনি ধরা দেয় রেলের পরিচয়ে। চলে আসে স্টেশন কোড আর তারপরেই পাওয়া যায় রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্স ট্রেনিং সেন্টার, যা এখনও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
সেইসব গৌরবময় ইতিহাস বুকে নিয়ে যারা এখনও বেঁচে আছেন তাঁরা আশা করেন একদিন ঠিক স্বীকৃতি পাবে দোমোহনি। ফিরে আসবে সেই সব মানুষ যারা নানান প্রয়োজনে ছেড়ে চলে গিয়েছেন বা আমাদের মতো কেউ যারা ভালোবেসে বারবার ফিরে আসতে চায় দোমোহনিতে। হয়তো একদিন দোমোহনি ফিরে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া গরিমা।
সাক্ষাৎকার: ১. শ্রী শোভেন সান্যাল, ২. শ্রী জ্যোতি সরকার
স্মৃতিচারণ: ১. শ্রীমতি তৃপ্তি গুহ, ২. শ্রী নির্মল সেন চৌধুরী, ৩. স্বর্গীয় শ্রী অমল সেন চৌধুরী
পাদটীকা:
[1] শোভেন সান্যাল, ২০১৯, কোচবিহার আলিপুরদুয়ার— রাজকাহিনী, কলকাতা: ঋতবাক।
[2] https://en.wikipedia.org/wiki/Bengal_Dooars_Railway
[3] https://wiki.fibis.org/w/Bengal_Dooars_Railway
[4] ২ নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য
[5] https://en.wikipedia.org/wiki/Jyoti_Basu
স্মৃতির শহর। মায়াময় ছবি।