যুগান্তর মিত্র
একদিন রাজকুমার অফিসে বেরিয়ে যেতেই বালিশের নীচে হাত ঢুকিয়ে চিরকুটটা বের করে এনেছিল শিল্পী। আচমকা দেখতে পায় রাজকুমার ঘরে ফিরে এসেছে। সেদিন চশমা ফেলে চলে যাচ্ছিল। সেটা নিতেই তার ফিরে আসা। শিল্পীর হাতের চিরকুটটা রাজকুমার আড়চোখে একবার দেখল। তারপর চশমা নিয়ে মুচকি হেসে ঘরের বাইরে পা রাখল। আর যেতে যেতে কথা ভাসিয়ে দিল হাওয়ায়, তর সইছে না কেন? একটু অপেক্ষা করতে পারো না? মজা করেই বলেছিল রাজু। কিন্তু শিল্পী লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে তাই একটু সময় অপেক্ষা করত শিল্পী। গলির মুখ থেকে রাজকুমার বড় রাস্তায় পৌঁছে যাওয়ার পরই চিরকুট তুলে নিত হাতে। রাজকুমার আর শিল্পীর মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। ঘরে থাকাকালীন রাজকুমারের লেখা চিরকুট দেখবে না শিল্পী। আবার শিল্পীর লেখা চিরকুটও রাজকুমার দেখবে ওর অগোচরে। কখনওই চুক্তির খেলাপ করেনি ওরা।
কার নাম লেখা আছে রাজুর চিরকুটে? উৎসুক হয়ে ভাঁজ খুলে শিল্পী দেখেছিল, একটাই নাম লেখা। সাধারণত একাধিক নাম লেখা থাকে রাজুর হিট লিস্টে। নামটা দেখে শিল্পী যেমন অবাক হয়েছিল, তেমনি শঙ্কিতও হয়ে উঠেছিল। আমূল কেঁপে উঠেছিল সে। এ কী নাম লিখল রাজু! কেনই-বা লিখল!
মাস কয়েক আগে রাজুর জামা কাচতে গিয়ে পকেটে একটা চিরকুট পেয়েছিল শিল্পী। এক, দুই, তিন নম্বর দিয়ে পরপর তিনজন মহিলার নাম লেখা। একটা নামের সঙ্গে ওর অফিস কলিগের নামের খানিকটা মিল আছে। প্রতিমা। বাকি দুজনের নাম পারভিন ও জুলি। এরা কারা? রাজু কি প্রেমে পড়ল কারও? ওর কথাবার্তায় তো কিছুই বোঝা যায় না? অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে প্রতিদিনই বউকে একবার জড়িয়ে ধরে রাজু। শিল্পী হয়তো তখন রান্নাঘরে চাউমিন বা অন্য কোনও খাবার তৈরি করছে রাজুর জন্য। কিংবা চা করছে। এমনকি তার গোপনাঙ্গ এতদিন দেখার পরেও একইরকম আকর্ষণ নিয়ে দেখে রাজু। সেই মানুষটা কারও প্রেমে পড়ল, ভাবতেই পারে না শিল্পী। আগের দিন রাতেও তো কম দামালপনা করেনি বিছানায়! তবে কি সবই অভিনয়? তাছাড়া তিনজন মহিলা? এ কি হতে পারে? তীব্র অভিমানে চোখ ঝাপসা হয়ে যায় শিল্পীর। চিরকুটটা লুকিয়ে রেখেছিল রান্নাঘরে একটা ফাঁকা মশলার কৌটোর মধ্যে। নাম তিনটে নিয়ে সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে ছিল। অনেক ভাবার পর শিল্পী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবার থেকে নজর রাখতে হবে রাজুর আচরণে।
অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিনের মতো একইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনও। সেই একই উচ্ছ্বলতা রাজুর মধ্যে। এতটা অভিনয় করা সম্ভব রাজুর পক্ষে? অনেক ভেবেও কোনও কুলকিনারা পায়নি শিল্পী।
সপ্তাহ খানেক পরে রাজুর পায়জামার পকেট থেকে আবার একটা চিরকুট আবিষ্কার করেছিল সে। সেদিন সকালেই পরেছিল পায়জামাটা। রাজু কিছুতেই রবিবার বা ছুটির দিন কাচাকাচি করতে দেয় না। ‘এই দিনগুলো আমার আর তোমার জন্য। রান্নাবান্না আর খাওয়া ছাড়া সংসারের আর কোনও কাজ করা চলবে না।’ একদিন সাফ বলে দিয়েছে রাজু। শিল্পীকে রান্নায় সাহায্যও করে ছুটির দিনে। দুজনে মিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ির কাজকর্ম মিটিয়ে নেয়। তারপর পুরো সময়টা শুধু দুজনের। হাসি, মজা, খুনসুটিতে কাটিয়ে দেয় তারা।
–ইস, এমন কেলেকুষ্টি পাজামা পরে আছ কেন? খোলো। আজ দুপুরেই কেচে দেব।
–এখনই খুলে দেব? রাজুর চোখে হাসির ঝিলিক।
–না। স্নানের সময় বাথরুমে রেখে এসো। কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিল শিল্পী।
স্নান সেরে অফিসে চলে গিয়েছিল রাজু। পায়জামাটা কথামতো বাথরুমে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দুপুরে সেটা কাচতে গিয়েই চিরকুটটা পায় শিল্পী। এবার আর কোনও মেয়েদের নাম নয়। চারজন পুরুষের নাম। রাকিব, শ্যামল, হালিম আর বিপুল। এসব কী? কাদের নাম লিখে রেখেছে রাজু? ও কি কোনও পাল্লায় পড়ল? কোনও খারাপ সঙ্গ? কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে চিরকুটটা তুলে রেখেছিল শিল্পী সেই কৌটোর মধ্যে। আর ধৈর্য রাখতে পারেনি সে। এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। ভেবেছিল শিল্পী। রাজু তখন অফিস থেকে ফিরে টিফিন খাচ্ছিল। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়াল শিল্পী। তারপর হাতের আঙুলে আঙুল জড়াতে জড়াতে বলল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? ঠিকঠাক জবাব দেবে?
প্রথমটায় হকচকিয়ে যায় রাজু। মিতুন খোলা মনের মেয়ে। এভাবে তো কখনও তার সঙ্গে কথা বলে না! চোখেমুখে সংশয়, চোখ মেঝের দিকে! অবাক হয় রাজু। কী হয়েছে মিতুন! এভাবে বলছ কেন? এত হেজিটেট কীসের?
হাতের মুঠো খুলে চিরকুটটা রাজুর সামনে মেলে ধরে শিল্পী। এটা কী? এগুলো কার নাম?
শিল্পীর হাত থেকে রাজু প্রায় কেড়ে নেয় কাগজের টুকরোটা। তারপর মুড়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলে ওঠে, ও কিছু নয়। ছাড়ো তো! বলেই হাসি ছড়িয়ে দেয় ঘরের বাতাসে।
শিল্পী গোঁ ধরে থাকে। আমাকে বলতেই হবে এরা কারা। কেন এদের নাম লিখে রেখেছ? এর আগেও এইরকম চিরকুট পেয়েছি। তাতে মেয়েদের নাম লেখা ছিল। সেটাও রাখা আছে আমার কাছে।
হাসতে হাসতেই রাজু বলে ওঠে, থাক না মিতুন! এ আমার এক খেলা। এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন?
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ে শিল্পীর। এটা তোমার একটা খেলা? মাথা ঘামাব না বলছ? কার না কার নাম লেখা কাগজ তোমার পকেটে! বলতেই চাইছ না? আর আমি চুপ করে থাকব?
বৌভাতের রাতে আংটি পরানোর সময় রাজকুমার বলেছিল, ‘শিল্পী নামটা খুব কমন। আমাদের পাড়াতেই দু-তিনজন আছে। এই নামটা আর পাঁচজনের জন্য থাক। আমি তোমাকে মিতুন বলে ডাকব।’ নতুন নাম খুব পছন্দ হয়েছিল শিল্পীর। একটু অন্যরকম। কী মিষ্টি নাম! খুশি মনে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল সে। রাজু আড়ালে তাকে এই নামেই ডাকত আগে। বিয়ের মাস ছয়েক পরে রাজুর মা মারা যান। বাবা যখন মারা গেছেন, রাজুর তখন বছর চোদ্দ বয়স। মায়ের মৃত্যুর পরে আর ওবাড়ি বেশিদিন থাকা হয়নি। মা চলে যাওয়ার আগেই পলকা যৌথপরিবারের ঝুরঝুরে বড় বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাড়ি ছাড়ার জন্য প্রোমোটার সবাইকেই দু-মাস সময় দিয়েছিল। তারপর ভাঙাভাঙি শুরু করবে। এক বাড়িতে থাকলেও সকলেই আলাদা আলাদা থাকত। তলে-তলে অন্য জায়গায় হয় ফ্ল্যাট কিনেছে প্রত্যেকেই, নয়তো জমি কিনে বাড়ি করে নিয়েছে। প্রায় গোপনেই সবাই কাজ সেরেছে। কেউ ওখানে ফ্ল্যাট নিতে রাজি হয়নি। তার বদলে অনেক বেশি টাকা পেয়েছে।
মায়ের মৃত্যুর পর এই ফ্ল্যাটটা কিনেছে রাজু। প্রোমোটারের থেকে পাওয়া টাকায় দু কামরার খোলামেলা, বড়সড় ফ্ল্যাটটা নিতে পেরেছিল। আরও টাকা বেঁচে গেছে। এখন আর রাজু গোপনে মিতুন বলে ডাকে না। দুজনের সংসারে খোলা হাওয়া বয়ে যায় সবসময়। গোপনীয়তার প্রশ্নই ওঠে না।
শিল্পী রাজুর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। যতটা সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমাকে বলবে কিনা বলো? এরা কারা জানতে চাই। কেন এদের নাম লিখেছ? নিশ্চয়ই এমন কেউ এরা যাদের কথা আমাকে লুকোচ্ছ!
রাজু হো হো করে হেসে ওঠে। কী যা-তা বলছ মিতুন! তোমার কাছে লুকোব? তেমন কিছু আছে নাকি লুকোবার?
তাহলে ওভাবে কাগজটা টেনে নিলে কেন? বলো না লক্ষ্মীটি! এবার শিল্পীর গলা নরম। অনুনয়ের সুর ফুটে ওঠে।
রাজু নিঃশব্দে উঠে গিয়ে সেদিনের খবরের কাগজটা নিয়ে এসেছিল। তারপর প্রথম পাতার অ্যাঙ্করের খবরটার এক জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল শিল্পীকে। সকালে এই খবরটাই পড়ে কেঁপে উঠেছিল শিল্পী। সাত বছরের এক শিশুকে চারজন মিলে ধর্ষণ করে খুন করেছে। ধরাও পড়ে গেছে। সেই চারজনের নাম লিখেছে রাজু। কেমন একটা ভয় জাপটে ধরে শিল্পীকে। এরা কি রাজুর চেনা? এদের নাম কাগজে লিখে রেখেছে কেন ও?
এদের নাম… ফ্যাসফ্যাসে গলায় এই দুটো শব্দই বেরিয়ে আসে শিল্পীর মুখ থেকে।
এরা আমার হিট লিস্টে আছে মিতুন। এরা কেউ মানুষ নয়। এক-একটা জানোয়ার! পশুরও অধম। যে মেয়েটাকে আদর করার কথা, তাকে ধর্ষণ করে খুন করে দিল? রাজুর মুখে যন্ত্রণার ছাপ।
হিট লিস্ট! এসব কী বলছ তুমি? হিট লিস্টে নাম লিখে রেখেছ মানে কী? শুনেছি খুন করার জন্য এইরকম নামের তালিকা করে খুনিরা। তুমি…
ঠকাস করে আধ-খাওয়া চায়ের কাপ ট্রের মধ্যে নামিয়ে রেখে উত্তেজিত রাজু বলে ওঠে, আমিও খুন করি। আলবাত করি। প্রতিদিনই কাউকে-না-কাউকে খুন করি আমি। বেশ করি।
রাজুর শক্ত হাতের মুঠো দেখে ভয়ে শিল্পীর গলা শুকিয়ে যায়। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে রাজুর দিকে। ও নিজে মুখে বলছে খুন করে? হু-হু কান্না ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দু-চোখে।
–এই দ্যাখো। কাঁদছ কেন মিতুন? সত্যিকারের খুন করি না আমি। বিশ্বাস করো। মনে মনে করি।
কান্নার মাঝেই রাজুর কথাগুলো শিল্পীর কানে যায়। ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয় সে। তবু মনের মধ্যে সংশয় থেকেই যায়। ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে রাজুর দিকে। মুচকি হেসে রাজু তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলে…
খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এইরকম ঘটনা দেখলেই রাজুর মনের মধ্যে তোলপাড় হয়। মনে হয় এদের বাঁচিয়ে রাখার কোনও মানে নেই। কিন্তু সত্যিসত্যিই খুন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারও শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাজুর নেই। তাই তাদের নাম লিখে হিট লিস্ট তৈরি করে। শুধু ধর্ষণ, শিশুপাচার, রাজনৈতিক খুন, অনার কিলিং বা এই ধরনের জঘন্য অপরাধই নয়, রেশনের চাল চুরি, জাতপাতের হিংসা, কিছুই বাদ যায় না তার হিট লিস্ট থেকে।
খবরের কাগজ ছাড়াও রাস্তাঘাটে বা অফিসে নানা অনাচার চোখে পড়ে রাজকুমারের। নাম জানা থাকলে নামটাই লেখে। না-জানা থাকলে সাদা শার্ট, নীল চুড়িদার, গোলাপি শাড়ি বা ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, এইরকম লেখে। এরপর বারবার নামগুলোর দিকে তাকায় আর রাগ বাড়তে থাকে তার। মনে মনে শাস্তিবিধান করে। কারও ফাঁসি, কারও যাবজ্জীবন, কারও-বা মাস কয়েকের জেলহাজত। কাউকে মনে মনেই পিস্তল চালিয়ে গুলি করে মারে। ছোটখাটো ভুলের ক্ষেত্রে চড়চাপড় বা বেত্রাঘাত বরাদ্দ। এসব শুনে অবাক চোখে রাজুর দিকে তাকিয়ে থাকে শিল্পী। এমন কথা কোনওদিন সে শোনেনি।
–তুমি যে টিফিনের সঙ্গে কোনওদিন আপেল, পেয়ারা বা শশা দাও, আমি সেগুলো টুকরো টুকরো করে কাটি। বেশ শক্তি ব্যবহার করেই কাটি। সেদিনের হিট লিস্টে যাদের নাম থাকে, তাদের নামে নামে ফল কাটি। তারপর কচকচ শব্দে চিবোই। মনে মনে বলি, তোকে ফাঁসি দিলাম। তোকে যাবজ্জীবন জেলে পাঠালাম। আশেপাশে যারা থাকে, আমার খাওয়ার শব্দে তারা বিরক্ত হয় বুঝতে পারি। কেউ কেউ টিফিন বক্স নিয়ে দূরে গিয়ে বসে। আমি খাবার ঘরে বসেই টিফিন খেতে থাকি। কাউকে পাত্তাই দিই না।
রাজুদের অফিসে কাজের টেবিলে বসে টিফিন খাওয়া মানা। টিফিন খাওয়ার আলাদা ঘর আছে। জানে শিল্পী। সেকথা মনে করে বলে সে, সে কি কথা! তোমাকে তো খারাপ মানুষ ভাবে তারা। হয়তো আনকালচার্ড ভাবে। কিংবা…
–ভাবতে দাও মিতুন। খুনিকে কেই-বা ভালো মানুষ ভাবে! এই নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
–এ আবার কী কথা? তুমি খুনি হবে কেন? এটাকে কি খুন বলে? ভ্রূ কুঁচকে ওঠে শিল্পীর।
–তা জানি না মিতুন। সত্যিকারের খুন হয়তো করি না, যা করলে জেল হবে, সাজা হবে।
–তোমার মতো নরম মনের মানুষ খুন করবে? হাসে শিল্পী। ব্যাপারটাকে লঘু করতে চায় সে।
–তুমি হাসছ মিতুন? আজকাল এমন রাগ উঠে যায়, কোনওদিন হয়তো হাতের কাছে অপরাধীকে পেলে খুনই করে ফেলব।
আঁতকে ওঠে শিল্পী। যদিও জানে বড় অপরাধীকে হাতের নাগালে কোনওদিনই হয়তো পাবে না রাজু। কিন্তু যদি পেয়ে যায়! যদি কাছাকাছি থাকা ছোটখাটো ভুলচুক-করা কাউকে মারে? তখন যদি দু-পক্ষে মারদাঙ্গা বেঁধে যায়? ভেবেই ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায় শিল্পী। রাজু তো এতটা মাথা গরম করার লোক নয়! মাথার গোলমাল হল না তো? কুঁকড়ে যাওয়া মন ক্রমশ নেতিয়ে পড়তে থাকে। রাজু তখন বারান্দায় উঠে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিল। ঘরে সিগারেট টানলে নাকমুখ জ্বালা করে শিল্পীর। তাই বারান্দায় গিয়ে সবসময় সিগারেট ধরায়। এমনভাবে রাজু উঠে চলে গিয়েছিল, যেন সে শিল্পীর সঙ্গে কথা বলছিল না। একাই ছিল ঘরে।
শিল্পী ধীর পায়ে রাজুর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল অন্যমনস্ক হয়ে আছে রাজু। কাঁধে হাত রাখলে হয়তো চমকে উঠবে। কিন্তু তেমনটা হল না। রাজকুমার সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরে শিল্পীর হাতের ওপর একটা হাত রাখে।
আজকাল কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারি না মিতুন। রাগ হয়। বড্ড রাগ হয়! ঘুরে দাঁড়িয়ে বুকে জাপটে ধরে বউকে। শিল্পীও তার দু-বাহু প্রসারিত করে স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে নিয়েছিল রাজুকে।
সেদিন রাতে খাবার টেবিলে বসে শিল্পী জিজ্ঞাসা করেছিল, হিট লিস্টের মেয়েগুলো কারা?
ওরা শিশু পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। হয়তো ছাড়াও পেয়ে যাবে কোনও নেতানেত্রীর আশীর্বাদে। তুমিই বলো মিতুন, এদের কঠিন শাস্তি প্রাপ্য নয়? জিজ্ঞাসা ভাসিয়ে দিয়েছিল রাজু। কথাটা মেনে নিয়েছিল শিল্পী।
সেই থেকে রাজকুমারের মতো শিল্পীও এক বা একাধিক নাম লেখে চিরকুটে। কোনও মন্ত্রী-আমলার নামও বাদ যায় না। এমনকি বাদ যায় না দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামও। মাত্র দুদিন ওদের হিট লিস্টের নাম মিলে গিয়েছিল। একদিন রাজুর চিরকুট দেখার আগেই নিজে লিখেছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম। সেদিন রাজু বালিশের নীচে চিরকুট রাখেনি। ভুল করে টেবিলে বইচাপা দিয়ে রেখেছিল। শিল্পী অবাক হয়েছিল না-পেয়ে। পরে অফিসে গিয়ে ফোন করে রাজু বলেছে চিরকুটটার কথা। আর-একদিন দুজনেই সকাল সকাল লিখে ফেলেছিল নাম। সেদিন রাজু স্নান করতে বাথরুমে ঢোকার পরেই বালিশের নীচ থেকে টেনে নিয়েছিল চিরকুটটা। আগেই খেয়াল করেছিল রাজু নাম লিখছে। তড়িঘড়ি একটা নাম লিখে রাজুর জামাকাপড় গুছিয়ে রেখে তার নীচে চিরকুট চাপা দিয়ে রেখেছিল শিল্পী। রাজুর চিরকুট হাতে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করেছিল, তারা দুজনই এলাকার কাউন্সিলের নাম লিখেছে। খুব হেসেছিল দুজনে।
এখন প্রতিদিনই দুজন নির্দিষ্ট জায়গায় চিরকুট রেখে দেয়। চুক্তিমতো দুজন দুজনের আড়ালে চিরকুট পড়ে। রাজু চিরকুট রাখে বালিশের নীচে। আর শিল্পী রাখে বিছানার ডানদিকের কোণে তোষকের নীচে। সে বেশিরভাগই নামের তালিকা প্রস্তুত করে বেলার দিকে। রাজু অফিস থেকে এসে তোষকের নীচ থেকে চিরকুট খুঁজে নেয়। তারপর সন্ধ্যায় টিফিন খেতে খেতে তালিকা নিয়ে দুজনের মধ্যে গভীর আলোচনা হয়।
ইদানিং রাজু রান্নাঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরে না তার মিতুনকে। সেইসময় সে অপরাধীর শাস্তির রকমফের নিয়ে ভাবে। রাতে শুয়ে শুয়েও অপরাধীদের শাস্তিবিধান করে তারা। কালেভদ্রে শারীরিক মিলন হয় তাদের। সঙ্গমের সময়েও অপরাধীর শাস্তি দেওয়া চলে শরীরী-কৌশলে। অনেক সময় শিল্পী আঘাত পায় শরীরের নানা জায়গায়। কখনও রাজুর উপরেও শাস্তির আঘাত এসে পড়ে। তবু কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। বরং অপরাধীকে শাস্তি দিতে পেরেছে বলে খুশি হয়।
রাজুর কাছে বারবার আবদার করে শিল্পী শিলনোড়া আনিয়ে নিয়েছে। আমার ঠাকুমা বলতেন পাটাপুতা। তাতে মশলা বাটতেন।
–তুমিও মশলা বাটবে নাকি? হাজার রকমের গুঁড়ো মশলার প্যাকেট পাওয়া যায় এখন।
–হ্যাঁ বাটব। এতে রান্নার স্বাদ খুব ভালো হয়। আসলে শিলনোড়ায় হলুদ বা কাঁচালঙ্কা পিষে পিষে বাজে লোকগুলোকে শাস্তি দেব। বুঝলে বুদ্ধুরাম! হেসে বলেছিল শিল্পী। তার কথা শুনে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় রাজুর কাছে।
শুরুর দিকে মাঝে মাঝে অপরাধী শনাক্ত করত ওরা। এখন প্রতিদিনই অপরাধী খুঁজে পায়। ছুটির দিন দুপুরে মাংসের হাড় চিবোতে গিয়ে শাস্তিবিধান ও তার প্রয়োগের পালা চলে। অন্যদিন সন্ধ্যায় বা রাতে হিট লিস্ট আলোচনায় উঠে আসে। হিট লিস্ট এখন ওদের দুজনের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ।
রাজুর হিট লিস্টে শিল্পীর নাম। গোটা গোটা অক্ষরে ফুলস্কেপ কাগজের ওপরে লেখা ‘মিতুন’। একবারে নীচে লেখা ‘রাজু’। নিজের নাম দেখে বিস্মিত হয় শিল্পী। কেঁপে ওঠে থরথর করে। তার কী অপরাধ বুঝতে পারে না সে। দুজনেই একই অপরাধে অপরাধী? নাকি দুজনের ভিন্ন ভিন্ন অপরাধ? ভাবতে গিয়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে শিল্পীর। সমস্ত দিন হিট লিস্টের ভাবনা তাকে জড়িয়ে রাখে।
রাজু আসার আগেই তালিকা প্রস্তুত করে রেখে দিয়েছিল তোষকের নীচের নির্দিষ্ট জায়গায়। শিল্পী বড় বড় অক্ষরে লিখে রেখেছিল দুটো নাম। সেও একটা ফুলস্কেপ পৃষ্ঠার ওপরে লিখেছে রাজুর নাম। একেবারে তলায় নিজের নাম। শিল্পী লক্ষ করে, দুজনের হিট লিস্টের মাঝেই বিরাট ফাঁকা জায়গা।
আজকাল একই ছাদের নীচে বাস-করা দুজন দুজনকে আড়চোখে দেখে। কেউ কাউকে হিট লিস্ট নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে না। তাদের প্রাত্যহিক কাজের অবসরে সংশয় ও সন্দেহের বাতাস বয়ে যায়।
খুব ভালো।অভূত
খুব ভাল গল্প।