সঞ্জীব দেবলস্কর
একটা সময় লিরিল ফ্রেশনেস অনুভূতিতে বিভোর হয়নি এরকম যুবক-যুবতী খুঁজে পাওয়া ভার ছিল। টিভির পর্দা ভেদ করে এক স্নিগ্ধ নয়নাভিরাম জলপ্রপাতের মধ্যে লা-লা লা-লা লা সুরে ভেসে সুন্দরী লিরিলকন্যার স্নানপর্ব কেমন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগাত। সেয়ানারা অবশ্য এর মধ্যে শুনতে পেতেন কাঁচা মুদ্রার ঝনঝনানি। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেল এক ছন্দপতন। এ স্বপ্নসুন্দরীর নাকি ওই বিজ্ঞাপনের দ্বিতীয় শুট করতে গিয়ে অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছে। দিনকতক নানা জল্পনা-কল্পনার অবসানে সঠিক সংবাদ এল। দুর্ঘটনা একটি ঘটেছিল অবশ্যই, কিন্তু মুখমণ্ডলে অনেকগুলি আঘাতের চিহ্ন নিয়েও এ সুন্দরী এখন বহাল তবিয়তে বিদেশের একটি স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতে মগ্ন আছেন। তাঁর জীবন লিরিল সাবানের ফেনা হয়ে আকাশে মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু হায়, এদিকে এই লিরিল-অনুষঙ্গে এক উন্মাদিনীর আখ্যানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ায় আমার কাছে লিরিল-সতেজতার মধুর আহ্বান একেবারে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। লিরিল সাবান দেখলেই আমার মনে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। পুরো জিনিসটি না জানলে পাঠকেরা এর খেই ধরতে পারবেন না, তাই এর সঙ্গে জড়িত সেই মানুষটির প্রসঙ্গে যাই, দেখবেন পৌঁছে যাবেন ফেনায়িত জলপ্রপাতের কাছে যেখানে কেবলই অলীক বুদবুদ আর হাওয়ায় মিশে যাওয়া চকিত কলধ্বনি এবং নিঃসীম শূন্যতা।
লোকটির নাম ওয়াসিম আবেদিন। এত গালভরা নাম কোনও রাজনৈতিক নেতা, কবি বা চিত্রকরদের হলে বেশ মানানসই হত বোধহয়। আমাদের ওয়াসিম সাহেব এরকম কিছুই নন, তবে ক্রমে ক্রমে জানতে পারলাম তিনি এমনিতে কিছুই না আবার অনেক কিছুই বটে। অ্যাংলো-পার্সি অভিধান থেকে জানলাম নামটির অর্থ ‘সুন্দরের উপাসক’। গ্রামের কেউ অবশ্য অতশত ভাবেটাবে না। তাঁর সম্বন্ধে একেক জন একেক রকম কথা বলে হরদম। তবে সবাই এ ব্যাপারে প্রায় একমত, তিনি একটু ক্ষ্যাপা। এ অঞ্চলে মানুষ কাউকে বুরবাক না বলে যেমন বলে লোকটা একটু সোজা, তেমনি তাঁকেও অন্য কিছু না বলে এই ক্ষ্যাপা শব্দটিই ব্যবহার করে আর কি!
একদিন রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের একটি জীবনীমূলক বই না পেয়ে দুঃখ করলেন— “আপনাদের ইশকুলগুলোতে কেবল কাগজের বোঝা!” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম এবং এঁদের সঙ্গে কাজীসাহেবের বন্ধু শৈলজানন্দ আর দিলীপ রায়ের উপর কোনও কিতাব এঁরা রাখেন না। এটা তাঁর সঙ্গত ক্ষোভই, লোকে যাই বলুক না কেন। বুঝলাম নেহাত গ্রামীণ ক্ষ্যাপা নন ইনি। কথার প্রসঙ্গ টেনে বললেন– “আপনার … কথা অমৃত সমান পড়িয়া যে আনন্দ, এইটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। … আমরা যোগেন চৌধুরী, দেবব্রত দত্ত, নিবারণ লস্কর, মেহেরাব আলির ছাত্র। আপনার কোনও দোষ নাই। আপনি তো তাঁদেরকে দেখেন নাই। না-দেখা মানুষজন নিয়ে লেখা পাপ।” বুঝতে পারলাম সাময়িক পত্রিকার ক্রোড়পত্রে এ অভাজনের কলামও তিনি পড়েন। জানলাম জেলার নামকরা কলেজটিতেও তিনি পড়েছেন। গ্রামের মানুষ এসব জানে না বা জানলেও বেমালুম ভুলে গেছে। তবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথায় পরে আসব। আপাতত তাঁর সাম্প্রতিক ভাবনা বা দুর্ভাবনার কথা বলি। ইদানিং ইনি রীতিমত গবেষণা শুরু করেছেন এক উন্মাদিনীকে নিয়ে। এ ব্যাচারি সেদিন মুদির দোকানে গিয়ে কিছু খুচরো পয়সা ছুড়ে দিয়ে অর্ডার দিল, “লিরিল সাবান দাও।” দোকানি তো হেসেই খুন– “যা বেটি তোর পয়সা নিয়ে। লিরিল কিতা জানসনি?” অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন ওয়াসিম সাহেব। পাশেই একটা ঘর ভাড়া করে তার হোমিওপ্যাথ চেম্বার। তাই এখানে তাঁর পরিচয় ডাক্তারসাহেব। মুদিখানায় এ পাগলির হেনস্থা তাঁর সহ্য হল না। পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন– “দিয়ে দাও একটা লিরিল। আমি দিচ্ছি টাকা।” মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “যা বেটি ভালো করে গোসল কর।” দোকানের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে বেটিয়ে লিরিল সাবান ডিমান্ড করতে পারে, সে খুব সাধারণ ঘরের বেটি নয় রে! ড্রয়িংরুমো বইয়া কালার টিভি দেখার কথা আছিল তাইর। হায় আল্লা! কারে তুমি পথে পথে ঘুরাইয়া মারো!”
শুধু এই সমস্ত কারণেই ডাক্তার সাহেবকে লোকে ক্ষ্যাপা বলে তা নয়। তাঁর চেম্বারে প্রায়ই দেখা যায় পাকা কলার ছড়া, পেয়ারা, লুকলুকি এমনকি কাঁচাপাকা আমড়াও। এসব বিক্রির জন্য নয়। সকাল থেকে চেম্বারে বসে স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। দুপুরবেলা চটজলদি জোহরের নমাজ শেষ করেই বারান্দায় এসে দাঁড়াবেন। সকালবেলা যাদের টার্গেট করে রেখেছেন এখন তাদের এদিকে আসার সময়। এদের ডেকে সার করে দাঁড়া করাবেন দোকানের, থুড়ি চেম্বারের সামনে। স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যালোচনাক্রমে সামনে দাঁড়িয়ে এদের ফল খাওয়ানো তাঁর নিত্যকর্ম। খাওয়ানো শেষ হলে সব কটি বাচ্চার মাথায় দোয়া পড়ে একটা ফুঁ দিয়ে বিদেয় করেন। কোনও মূল্য নেই, তবে বিনিময়ে পড়াশোনা করতে হবে এ প্রতিশ্রুতি তাঁর চাই। এখানে স্মর্তব্য, যৌবনে ওয়াসিম সাহেব সাম্যবাদী স্লোগান দিয়ে ফিরেছেন অনেকদিন। ক্রমে তাঁর স্যাঙাতেরা নিজেদের জন্য সুবিধাজনক রাজনৈতিক আচ্ছাদন খুঁজে নিলে তিনি বিলকুল একাকী পথিক।
বাড়িতে গিয়েই নাকি ওয়াসিম সাহেবের ভিন্নতর চেহারা। কোদাল হাতে সটান সবজি ক্ষেতে। কোন গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে, কোনটায় জল দেওয়া হয়নি, কোনটা কলম করার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে– এসব দেখা তাঁর নিত্যকর্ম। সকালবেলা অবশ্য তার সময় কম। নমাজ, স্নান, খাওয়া সেরে চেম্বারে পৌঁছতে হবে দশটার আগে। দুপুরবেলাটা অবশ্য তার প্র্যাকটিসের সময়। মোটা কেতাব, মেটেরিয়া মেডিকা সামনে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পেছনে স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের বাঁধানো ফটো এবং সঙ্গে কাবা শরীফের ছবি। সামনে কাঠের বেঞ্চিতে রোগীদের বসার স্থান। তবে এরা রোগী না রিলিফপ্রার্থী ঠিক বোঝা যায় না। দেদার উপদেশবাক্য বর্ষণ করতে করতে সাদা চৌকো কাগজে ওষুধের পুরিয়া বানাবেন। উপদেশের মধ্যে থাকে বাড়ির আনাচে-কানাচে আদা চাষের পরামর্শ, হাড়েঙ্গা, আন্দগাছ বাঁচিয়ে রাখা, ব্রাহ্মীলতা দেশছাড়া হলে পাগলের সংখ্যা বেড়ে যাবে ইত্যাদি। এ শাকের অবর্তমানে অ্যালঝাইমার রোগ যে বাড়বে এটা তো সত্যিও বটে। তাঁর এসব কথা নিয়ে তিনমুখির চায়ের দোকানে, অ্যালোপ্যাথ ফার্মেসিতে অনেক রসালাপও চলে। ঔষধের দাম দিলে দাও, বাকি হলেও চলবে, না দিলেও চলবে। কখনও রোগা জীর্ণ ব্যক্তির হাতে পুরিয়া দিতে দিতে জিজ্ঞেস করবেন– “জনাবের দুপুরে খাবার কী ব্যবস্থা?” উত্তরগুলো সাধারণত এরকমই হয়– ওই তো সকালে রুটি খেয়েছে, দুপুরে চা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে, আর রাত্রে কিছু একটা আর কি। ডাক্তারসাহেব এতেই যা বোঝার বুঝে নেন। সটান উঠে পাশের দোকান থেকে দশ টাকার চাল আর ডাল একসঙ্গে নিয়ে, ফ্রি একটা আলু দিয়ে পুঁটুলি বানিয়ে রোগীর হাতে দিয়ে বলবেন, “এই দিয়ে পথ্য করলে তবেই ঔষধের গুণ। নইলে ডাক্তারবাবুর ঔষধ তো চিনির গুড়া।”
ওদিকে ডাক্তারসাহেবের দিমাগে লিরিলকন্যার বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্ব লাভ করছে। লিরিল সাবান মেখে জট লাগানো সোনালি-চুলো মেয়েটির পরিধানে এখন একটি রঙিন চুড়িদার, সঙ্গে একখানা ওড়নাও। অতি নিশ্চিত, ডাক্তারসাহেব নিজ কন্যার পুরনো জামার স্তূপ থেকে এনেছেন স্ত্রীর নজর এড়িয়ে। তিনি লক্ষ করেছেন মেয়েটি একটি পরিত্যক্ত সাইকেল-সারাই কারখানার বারান্দায় একটুখানি জায়গায় রাতের আস্তানা গেড়েছে। সংসার বলতে তো কিছুই নেই। রান্নাবান্না নেই, এক লিরিল সাবান ছাড়া আর কোনও চাহিদাও যে নেই তাও জানা গেল। কেউ কিছু খেতে দিলে খায়, না খেলেও চলে। সন্ধ্যাবেলা ওদিকে যখন মগরিবের আজান তখন অবশ্য আমাদের লিরিলকন্যার সন্ধ্যা-আরতির সময়। হাতে একটুকরো কাঠি, বাঁশের টুকরো বা এরকম কিছু নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে ধূপধুনো দেওয়ার ভঙ্গিতে গলায় ওড়না জড়িয়ে দীর্ঘ প্রণাম। এসব পর্যবেক্ষণক্রমে ওয়াসিম সাহেব যা বোঝার বুঝে নিলেন। ধারণা তাঁর একেবারেই ঠিক, শ্রীমতি কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দু ঘরের কন্যা। কপাল দোষে আজ এ দশা। যুক্তিবাদী ওয়াসিম সাহেব অবশ্য এ হতভাগিনীর ওপর কোনও জিন, পরি বা ইবলিসের প্রভাব বেমালুম অস্বীকার করেন। এটা কোনও দুর্বৃত্ত খবিচের অত্যাচার বা অন্য কোনও মানসিক আঘাতজনিত কারণে ঘটেছে, এই তাঁর অভিমত।
তিনি অবশ্য ইতিপূর্বে আরও কজনকে নিয়ে এমনতর দুর্ভাবনার অধ্যায় শেষ করে এসেছেন। একজন গেলেই আরেকজন তাঁর আশ্রয়ে চলে আসে। বেশ কয়েক মাস তাঁর ছত্রছায়ায় থাকা মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান এক বিজ্ঞ ব্যক্তি একদিন তাঁর কাছে নালিশ জানাল যে, ইশকুলে গিয়ে বিরাট হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে তাকে। মাস্টারমশাইরা যেমন-তেমন, কিন্তু চৌকিদার ব্যাটার আস্পর্ধা দেখে সে একটা বিচারই চেয়ে বসল। বৃত্তান্ত শুনে ওয়াসিম সাহেব বললেন, “কী দরকার তোমার ইশকুলি টাইমো এই দিকে যাইবার? ছাত্ররা তোমারে পাগল বানায়, চৌকিদারে মারে গল্লা।” তার সরল স্বীকারোক্তি, “কিতা করতাম ডাক্তারসাব, পেটো কিছু বিদ্যা লইয়া ঠেকছি। বাইরে জ্ঞানর কথা কইলে মানুষ ভাবে পাগল, ইশকুলো গিয়ে বিদ্যা উগলাইতাম চাই, এরও উপায় নাই। বড় পেরেসান আমার। কোন দেশো আইয়া পড়লাম!” অবশেষে এ জ্ঞানের বোঝা নিয়ে ব্যাচারা ডাক্তারসাহেবের তদারকির বাইরে কোথায় গেল জানা যায় না, তবে এরপর আরেক পার্টটাইমার নিয়ে ডাক্তারবাবুর শুরু হল নতুন দুশ্চিন্তা। এ ব্যাচারা নাকি গ্রীষ্মকালে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, কিন্তু শীত এলেই একেবারে স্বাভাবিক। তখন কে বলবে এই বৃষ্টিকাদার দিনে এর এই অবস্থা— ছেঁড়া লেবাস, হাতে একটা লাঠি, উসকোখুসকো চুলদাড়ি, মুখে অবিরাম বকবক? বাড়াবাড়ি হলে বাড়ির লোকজনেরা হাসপাতালেও নিয়ে যায়। কিন্তু আজকাল হাসপাতাল এরকম রোগীকে রাখতে চায় না। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, প্রায় সবখানেই এ ধরনের মহাজনেরা স্কুলকলেজের সামনের জায়গাটিকেই তাদের কেরামতি প্রদর্শনের আদর্শ স্থল হিসেবে বিবেচনা করেন। ওয়াসিম সাহেব এর গতিপথ অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সে তার পাকা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে, “আমার আর ভালো হইয়া কাম নাই!” ব্যাপারটা বুঝলেন না? এই ব্যক্তি ডাক্তার সাহেবের কাছে কবুল করেছে, এমনকি পকেট থেকে বের করে কাগজও দেখিয়েছে, সে টেম্পোরারি ইনসেনিটি সিনড্রোমের রোগী। তার আক্ষেপ, কথাটা অনেকেই জানে, কিন্তু মানতে চায় না। ইশকুলের মাস্টাররা নিশ্চয়ই জানেন, কিন্তু ছাত্রদেরকে শেখাতে পারেন না। তাই অফ-সিজনে সে যখন ভালোমানুষের মতো রাস্তায় বের হয়, এরা পেছনে সবাই লাগালাগি করে। তাকে ভালোমানুষ হিসেবে মানতে রাজি নয় কেউ। বড় অভিমান নিয়েই সে বলেছে— “ভালো মানুষ আমি রওয়ানা দিলাম পোস্টাপিসের দিকে, তো কেউ আমার ছাত্তি ধরি টান দেয়, সাদা শার্টর উপর কলম ঝাড়ায়, বাজারর ব্যাগ টানাটানি করে। দাওয়াত খাইতে গেলাম ভালাবালি মানুষ, তে ডাইল দিতে আইয়া কোন ছিচকায় আমার পাত ভাসাইয়া দেয়। তারকারি, নিমক, ভাজি, মাছ, মাংস একাকার। এরা ভাবে আমি দাওয়াত ছাড়াই আইছি, হোলটাইমার পাগল হিসাবে। এই জিনিস আর কতদিন সহ্য করা যায়? এর চাইতে সারা বছর পাগল থাকাউ তো ভালা। এইসব বিবেচনা সাপেক্ষে একটা সিদ্ধান্ত লইছি। আমি আর ভালা অইতাম নায়।” এতসব ঝক্কি সামলাতে হয় ওয়াসিম সাহেবকে। আপাতত লিরিলকন্যাকে নিয়ে তাঁর গবেষণা চলতে থাকুক। আমরা ওয়াসিম আবেদিন সাহেবের আরও কিছু বিশেষ দিকে আলোকপাত করার ইচ্ছে রাখি।
গ্রাম কাছাড়ের মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান ওয়াসিম সাহেবের মাঠের ফসলএ বছরের খাওয়ার সংস্থান হয়েও ভাঁড়ারে উদ্বৃত্ত থাকে। তিনি বলেন কাত্তি ভরা ধান আছে। আর মাচাঙে তোলা আছে কয়েকশো মিঠালাউ, কয়েক মণ আলু, পেঁয়াজ। আছে জুঙ্গি[1] ভর্তি শস্য। ঘানিঘরে নিয়ে গেলে মিলবে খাঁটি তৈল, গরুর খাদ্য খৈলও মিলবে। পুকুরে কয়েক কিলো ফেলে দিলে ওই শস্যের খৈল খেয়ে মাছের স্বাদ যেমন বাড়ে তেমনি বৃদ্ধিও। বর্ষা ঘনিয়ে এলে মাচাঙের লাউ নিতে টঙিঘরের বারান্দায় পাইকারের ভিড়। বাড়ির সামনে মসজিদের মতো গম্বুজ নিয়ে খাড়া দুটো খড়ের ফেইন[2]। দু হাত দিয়ে টেনে নাও, নিদানের দিনে গরু-মহিষকে খাওয়াও, কোনও পয়সা দিতে হবে না। দুর্গাপূজার মাস দু-এক আগে হিন্দু পাড়া থেকে লোক আসবে— প্রতিমা নির্মাণে খড় চাই ভালো কোয়ালিটির। মাছ তাঁর কিনতে হয় না। বঁড়শি দিয়েই ধরা যায় যদি মাছের মর্জি ঠিক থাকে। অবশ্য ঝাঁকিজাল ফেললে কারও মর্জির তোয়াক্কার প্রয়োজন নেই। কাঁটা, লতাপাতা, আগড়ম বাগড়ম ভেতরে দিয়ে হগরা[3] ফেলে রাখা আছে দিঘিতে। টেনে তুললেই এক বেলার চ্যাং, মাগুর, কৈ, খলিশা মিলবে। বৃষ্টির দিনে পুকুরের ঢাল খুলে ডরি[4] বসিয়ে দিলে তো কথাই নেই। আর আম-কাঁঠালের দিনে ইশকুলের বাচ্চাদের দিয়েও প্রচুর ফল ঘরে নষ্ট হয়। “আমার ছেলেমেয়েদের এই সব রুচে না। এরা পেপসি, রু আফসা, ম্যাগি আর দোকানের বিষ খাইয়াই বাঁচতে চায়। আমি নিষেধ দেওয়ার কে—” এই তাঁর আক্ষেপ।
বিচিত্র স্বভাবের এ ব্যক্তি খবর পেয়েছেন তাঁর মাসতুতো ভ্রাতা বিএ পাশ করে এদিক ওদিক বিচরণ করে দিন কাটাচ্ছেন। গর্বিত পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন পুত্র কী করছে? বিমর্ষ উত্তর সংক্ষিপ্ত— “সড়কো হাঁটে।” বুঝলেন তো কী কর্মে নিযুক্ত? খবর পাঠালেন আর্জেন্ট কাল সকালে সাইকেল নিয়ে রেডি থাকতে— “আর তার স্যাঙাত… ওই যে কী যেন নাম… এরও তো কোনও কামধান্ধা নাই। সেও সঙ্গে চলুক।”
দুই বন্ধুর সেই গ্রীষ্মের দুপুরে সাইকেল মেরে মাইল তিনেক দূরে এক টিলাবাড়ির দিকে যাত্রা। সঙ্গে অভিভাবক ওয়াসিম সাহেব। ওখানে টিলা এবং পুকুর সহ তাঁর নিজস্ব একখণ্ড জমি আছে। বেলা দ্বিপ্রহরে অকুস্থলে পৌঁছে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন– “এই এই এই… আমার ত্রিসীমানা। এই খড় আর বাঁশের ঘর। বিশ্রাম নিতে পারো, বাসনবর্তন আনলে দুইটা ভাত ফুটাইয়াও খাইতে পারো। এই মাটিতে সোনা ফলবে।” তিনি আদা, লঙ্কা, কচু, মুখি, ঢ্যাঁড়শ, কাকরুল, করোলা, রামাইস, কুমড়ো ফলনোর পরামর্শ দিলেন– “তোমাদের কাম শুধু ফসল বস্তা ভর্তি করে রাখা। টিলার নিচে নামানো আর বাজারে নেওয়ার ব্যাপারির অভাব নাই। এরপরে খালি ট্যাকা গুনতি করা আর পোস্ট অফিসে জমা দেওয়া।” আরও প্রস্তাব– “এই যে পুকুর। এখানে কিলবিল করে শিঙ্গি, মাগুর, কৈ। চোরে নিয়াও শেষ করতে পারে না। … আমার কিছু লাগে না। ইচ্ছা যদি হয় মাঝে মাঝে দুই একটা খাওয়ার জন্য দিবে। তো কালই তোমরা কাজে লাগো। পণ্ডিতমশায়ের কথা আছে না, শুভস্য শীঘ্রম? দেখবে তোমরার ট্যাকা খাইয়া শেষ করা যাইবে না। গ্র্যাজুয়েট চাষির কদর করার মন্ত্রী নাই। নইলে…” ইত্যাদি। কিন্তু বলাই বাহুল্য এ হেন লোভনীয় প্রস্তাবের মর্ম উপলব্ধি করে সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা এই দুই ভাগ্যান্বেষীর পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। এরা এখন ভেঞ্চার ইশকুলের মাস্টারি নিয়ে ভিন্নতর জীবনযাত্রা শুরু করেছে, আল্লায় দিলে দিন ফিরবে এই তাদের বিশ্বাস। তবে ওয়াসিম সাহেবকে দেখলে এখনও তাদের রাস্তা পালটে চলতে হয়। নয়তো জিজ্ঞেস করে বসবেন, ইশকুলে কটি গাছ লাগিয়েছে, বাড়িতেই বা নারকেল গাছ কটা বেঁচেছে, আমআদার চারা পাঠিয়েছিলেন সেগুলোর খবর কী, এলআইসির দালালের উপর ভরসা না-রেখে দুইটি স্বাস্থ্যবান গরু রাখলে কী হয় ইত্যাদি হাবিজাবি কথা।
গ্রামের ইশকুলে যে ভালো বই নেই তা তো আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। মাঝেমাঝে বাজারি মানুষদের সামনেই বেমক্কা মাস্টারদের বলেন “ইশকুলে ভালো কিতাব না থাকলে ছাত্রদের মনে দেশপ্রেম জাগবে কীভাবে? দেশপ্রেম কি আকাশ হইতে নাজিল হইবে?” লাইব্রেরিস্যার তো পারতপক্ষে তাঁর দিকে পা মাড়ান না। একদিন পড়ন্ত বেলায় তিনি ইশকুলে ঢুকেছিলেন। হেডমাস্টারকে কিছু দেশীয় আর মরশুমি ফুলের গাছ লাগালে যে কী শোভা হবে তার একটা প্রাঞ্জল বর্ণনাও দিলেন। ব্যাচারা আগ্রহ দেখিয়ে পড়লেন মহা বিপদে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়াসিম সাহেব কৃষিবিপণি থেকে কয়েক প্যাকেট ফুলের বীজ, একটি লোহার খুরপি, প্লাস্টিকের স্প্রে কিনে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। ওদিকে নিজেরই হাজারটা ঝামেলায় জর্জরিত হেডমাস্টারস্যার এসব নিয়ে কী করে স্কুল সাজাবেন ভেবে বিপন্ন। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে এসেই এখন তার হাঁটার গতি হয় দ্বিগুণ আর চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে মাটির দিকে।
এরই মাঝে এক দুপুরে টাউনি মাস্টরব্যাটায় ইশকুলের চৌকিদারকে পাঠালেন ওয়াসিম ডাক্তারের থেকে এক পুরিয়া মাথাব্যথার ঔষধ আনতে। সঙ্গে পাঠানো টাকার নোটটি দেখে বলেন, “আমার ডাক্তারির স্বীকৃতি আইছে। তোর হাতের টাকার চাইতে এইটা বড়। ডাইনে বাঁয়ে এতটা ফার্মেসি থাকতে আমার কাছে ঔষধ চাওয়া, এটা বেশ মোটা কথা। যা ঔষধ লইয়া যা। মাস্টরব্যাটারে আমার সালাম-নমস্কার জানাইস।”
আবেদিন সাহেবের বয়স হয়েছে। ছেলেরাও বকাঝকা করে– কী দরকার নদী ডিঙিয়ে দুই মাইল রাস্তা হেঁটে ডাক্তারি করার? রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে মানুষ তো ছেলেমেয়েকেই বদনাম দেবে! ওঁর বিবিজানেরও দুর্ভাবনা একতাইয়া রোখা মানুষটাকে নিয়ে। নিজে যা বুঝবেন তাই করবেন। এখন আবার নতুন ঢং হয়েছে। সকালে চান-টান করে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ‘ইয়া মুকাদ্দেম’ বলে ভাত না খেয়েই দৌড়। চেম্বার ধরতে হবে। গিন্নি ব্যাচারির হয়েছে জ্বালা। সকালে এক কাপ দুধ আর একটি কলা খেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছে মানুষটা। কী করে তার নিজের মুখে অন্ন ওঠে! এসব করলে শরীর টিকবেই বা কী করে মানুষটার? খোঁজ পড়ল সেই মাসতুতো ভাইয়ের। সে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানল সম্প্রতি বাজারের তেমাথায় এক ব্যাচারি ভাতের হোটেল খুলেছে। ত্রিশ টাকায় পেট ভরে নিরামিষ আহারের ব্যবস্থা রাখা সত্ত্বেও লোকটি যথেষ্ট সংখ্যক কাস্টমার পাচ্ছে না। ভাবছে হোটেল উঠিয়েই দেবে। এটা কি কোনও কাজের কথা হতে পারে? তাই তার অগ্রজ কদিন থেকে মহা আড়ম্বরে লোকজনকে দেখিয়ে নিরামিষ হোটেলে মধ্যাহ্নভোজন সারছেন। তাঁর কথা হল, হোটেল বানানো কঠিন, উঠিয়ে দেওয়া তো এক নিমেষের খেল। ভাই বলল, “ঠাকুরজি, এইদিকে আপনি এইসব কর্ম করতেছেন, আর ওইদিকে আমার ভাবিজান যে নিত্যনৈমিত্তিক রোজাধারী হয়ে সম্প্রতি গ্যাসের রোগী।” এমতাবস্থায় দাদার নিশ্চিন্তে ডাঁটাচচ্চড়ি চিবানো কিঞ্চিৎ অস্বস্তির ব্যাপারও বটে। “আরে তুই বুঝবি না! হোটেলওয়ালাকে উৎসাহ দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা ক্ষমতা আছে আমার!” পরিস্থিতি সামাল দিতে ভাইজানকে ডেকে নিতে চাইলেন নিজের দলে– “আয়, একদিন দুইভাই একসঙ্গে খাই, হিন্দু বাবুর্চির পাক। পিঁয়াজ ছাড়া মুগডাইল, কালিজিরার ফুড়ন, আর সবজি। কী খুসবু! এই আলুভাজির সোয়াদই আলাদা।” ব্যাচারা হোটেলওয়ালা ব্রডগেজ সম্প্রসারণ শুরু হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাহাড় লাইনে গাড়ি চলাচল বন্ধ হওয়াতে বিপন্ন হয়ে এদিকে এসে খুলেছে তার ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। তিনি ভাইকে বোঝাচ্ছেন “এই অবস্থায় তাহার পিছনে দাঁড়ানো আমাদের ফর্জ।”
বাড়িতে থাকলেও তো বিশ্রাম তাঁর কোষ্ঠীতে লেখা নেই। টিভি তাঁর দু চোখের বিষ। অবশ্য সন্ধ্যাবেলা রেডিওটা চালানো থাকে স্থানীয় সংবাদ তক্। ইদানিং একটি মোবাইল ফোনও হয়েছে তাঁর। কেউ লাগিয়ে দিলে কথাও বলেন। আর কী-ই বা বলবেন? দেশে হিন্দু-মুসলমান আর এক থালে খাওয়ার পক্ষে নাই। কাকেই বা দোষ দিবেন? যুবসমাজ তো টিভি আর মোবাইল খেলতে খেলতে চিন্তাশক্তি-রহিত। আর এদের কে নেতৃত্ব দিবেন? যত নষ্টের গোড়া তো সব প্রৌঢ় আর বুজুর্গের দল। এরা নিজেরাই দেশটাকে চিনতে পারল না, যুবসমাজকে কী চিনাবে? নিজের মনের ভিতর জমা হিংসা আর বিদ্বেষই দূর করতে পারে না। দেশে শান্তি আনা কি এদের কাম? মনের ভিতর পুষে রেখেছে এক একটা শয়তান। এরার কাজ হইল সকালসন্ধ্যা ময়না পাখির মতো কানে কানে হিংসার বয়ান ঢালা। নমাজরোজার কী ক্ষ্যামতা এদের সাবুদ করে! এ কথাগুলো বলবেন নিতান্ত বিনয়ের সঙ্গে। ‘আমি যদি ভুল না বলে থাকি’ ইত্যাদি বাক্য এর আগে এবং পেছনে থাকবে অবশ্য।
তাঁর চেম্বার অনেকদিন বন্ধ। বিবিও বিগত হয়েছেন। এখন বুঝতে পারেন নিঃসঙ্গতার জ্বালা। মানুষের কি এত সময় আছে এখন আর ওয়াসিম আবেদিন সাহেবের মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো লোকটির খবরাখবর করার? তিনি কোনও ধর্মনেতা নন, পির-ফকিরও নন। নেতামন্ত্রী এলে গলায় লাল গামছা জড়িয়ে ভিড়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মানুষও তিনি নন। তাঁর ধর্মাচার একান্তভাবে তাঁর নিজের। আড়ম্বরবিহীন। তবে তাঁর কিছুটা অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব নাকি রয়েছে প্রান্তিক হরজন, দেশোয়ালি, তাঁতি, পান-ব্যাপারি বারৈ সম্প্রদায়ের প্রতি। সন্দেহপ্রবণ মুরুব্বিদের বলেন, “এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরে কিছু মায়া না করলে দেশের বদনাম।” এসব শুনে কেউ কেউ ফিক ফিক করে হাসে, আর কেউ কেউ করে ভ্রূকুটি। কে কাকে বলে সংখ্যালঘু! রাগী মুরুব্বিদের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেই তিনি পূবগ্রামের ছেলে-ছোকড়াদের ডেকে এনে সরস্বতীপূজার চাঁদা দেন, হরিজনবস্তির পরব, হিন্দুস্তানিদের ছটপূজার খবরাখবরও নেন উৎসাহের সঙ্গে। দুই ঘর আচার্য পরিবার নিয়ে কুমারপাড়ার উৎসব, বিয়ে, অন্নপ্রাশনে আনন্দের অংশীদারও হন।
দেশের অবস্থা যখন একবার একটু বেতালা হয়েছিল তখন বোধহয় এসব আদিখ্যেতা দেখেই ফচকেরা তাঁর নাম বিকৃত করে বলেছিল ওয়াসিম আদোবানি। তিনি অবশ্য এসব সমালোচনা গায়ে মাখেন না। একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপর দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করেন দেওয়ান হাসন রাজার পদ—
কতদিন আর খেলবে রে হাসন, এই ভবেরই খেলা
খেলতে খেলতে হাসন রাজার আর লাগে না ভালা।
এই যে দেখ ভবের বাজার, কেবল এক জ্বালা
স্ত্রীপুত্র কেহ নয় তোর, যাইতে একেলা।
হাসন জানে, হাসন রাজায় মাইল এক ঠেলা
চল চল শীঘ্র করি, চল শালার শালা।
কখনও আবার শেষ কথাটা রিপিট করেন ‘শালার ঘরর শালা’। যে যেরকম ইচ্ছা অর্থ বের করুক এ দেহতত্ত্বের গীত থেকে, তাঁর কী এসে যায়? তবে এসব কথা থাক, আমরা সেই লিরিলকন্যার বিষয়ে কয়েকটি কথা বলেই গল্পের ইতি টানব।
ওয়াসিম সাহেব উন্মাদ হতভাগিনীটির আবোলতাবোল বাক্যগুলো দিনকতক খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে একটি নোটশিট তৈরি করলেন। লক্ষ করেছেন মেয়েটি দোকানের আসবাবপত্র, দরজার হুড়কো, বেড়ার কঞ্চি এগুলোকে ছাত্র বানিয়ে মাস্টারিও করে। তিনি নোট করেছেন এর ভাষাটা বাংলা, সঙ্গে অসমিয়া এবং ইংরেজি শব্দেরও ছাট আছে। যা গবেষণা করার তা হয়ে গেছে। মেয়েটি আসামের (এদিকে প্রাচীনদের মুখে আসাম মানে কামরূপ কামাখ্যার দেশ) বাসিন্দা, যেখানে মিশ্র জবান প্রচলিত। তবে ইনি বঙ্গললনা, এবং ইশকুলের মাস্টারনি অতি নিশ্চয়। এটা আবিষ্কার করে ওয়াসিম সাহেবের মুখে ‘হায় আল্লা, হায় আল্লা’ উচ্চারণটা বেড়ে গেল।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকুরিরতা এ উন্মাদিনীর এতটুকু তথ্য আবিষ্কারের পরেও যে কর্মটি বাকি রয়েছে তা হল তার নিবাসটি নির্ধারণ করা। এ কাজটুকু হয়ে গেলেই ওয়াসিম সাহেবের পরবর্তী পদক্ষেপ। উৎসাহীরা জিজ্ঞেস করলে বলেন— “দেখা যাক, খোদার মর্জি। এই ঘটনা, নৌজুবিল্লা, তোমার-আমার ঘরের কোনও বেটিরও তো হতে পারত। নিজের উপর নিয়া ভাবলে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝা যায়।”
এখন ওয়াসিম সাহেবের প্র্যাকটিসে আর মন নেই। চেম্বারে বসে দিস্তা কাগজে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন। তিনি নাকি মেয়েটির ঠিকানার হদিশ পেয়ে যাচ্ছেন। সেদিন তার মুখে একটি স্থাননাম খুব স্পষ্ট করে উচ্চারিত হতে শুনেছেন। আরও কয়েকদিন একই নামটি উচ্চারিত হওয়াতে তিনি স্থির নিশ্চিত হলেন, মেয়েটি ডিফু কিংবা কার্বি আংলং জেলার কোনও এক স্থানের। মাননীয় জেলাধিপতি কার্বি আংলং বরাবরেষু সমীপে ইংরাজিতে একটা দীর্ঘ দরখাস্তের বয়ানও তৈরি হল। এখন একজন ইংলিশনবিশ মাস্টারকে দেখিয়ে টাইপ করিয়ে রেজিস্ট্রি ডাকে যাবে আবেদনটি যাতে সরকার বাহাদুর এ মেয়েটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করার বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ওয়াসিম সাহেব ভেবে রেখেছেন এর একটি ইংলিশ কপি আপাতত অসমের মহামান্য রাজ্যপালের কাছেও যাবে। এরপর তো আরও আবেদনের পথ খোলা রয়েছে। মনোরোগের চিকিৎসা করানো, মেয়েটার জিপিএফ, ভলান্টারি পেনশন ইত্যাদি পাওনাগন্ডা আদায় করে করে ওর নিজস্ব টাকা দিয়েই চিকিৎসা শুরু হতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশে এসব ব্যবস্থা করা সরকারের ফর্জ।
সর্বশেষে কী ফল হল সেটা আর জানা যায় না। কোনও এক সুন্দর প্রভাতে এ লিরিলকন্যা, কার্বি আংলঙের মাস্টারনি তার জীর্ণ আস্তানা ছেড়ে কোথায় যে গেল কেউ বলতে পারে না। সবার অলক্ষ্যে ওই একই স্থানে এখন বহাল হয়েছেন আরেক নীরব মহাপুরুষ। গাল ভর্তি দাড়ি, গায়ে একাধিক বস্ত্রের সমাবেশ এবং কোলে একটি বিড়ালবাচ্চা। শূন্যস্থান কখনও অপূর্ণ থাকে না। জেলার দক্ষিণের এ অঞ্চলটি বুঝি এমনই একটি স্থান যেখানে এ ধরনের বিশেষ বিশেষ মানুষই তীর্থ করতে আসেন কিছুদিনের জন্য। এদের কেউ ফকির, কেউ সাধু আর কেউবা ধূপদুরস্ত উন্মাদ, আর কেউ এমনি ভাগ্যের ফেরে সুন্দরী কন্যা যার চোখে মুখে শরীরে হাজারটি ক্ষতের মাঝেও ঝিলিক দেয় হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের চ্ছটা।
গল্পটিতে বরাক উপত্যকায় প্রচলিত কিছু দেশজ বাংলা শব্দ সব পাঠকের বোধগম্য নাও হতে পারে এ বিবেচনায় নিম্নলিখিত সংযোজন:
[1] শস্য সংরক্ষিত রাখতে বাঁশের তৈরি পেটমোটা জালা বিশেষ
[2] গম্বুজাকৃতি শুকনো খড়ের গাদা (বরাক অঞ্চলে চাষি বাড়িতে দেখা যায়)
[3] বাঁশের তৈরি একটি মাছ ধরার সরঞ্জাম যার খোলা মুখটি প্রশস্ত। ভেতরে আগড়ম বাগড়ম জিনিস ঢুকিয়ে পুকুরে ফেলে দিলে মাছ ঢুকে থাকে, এবং টেনে তুললেই হল
[4] বাঁশের শলাকা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার সরঞ্জাম, উপর খোলা এবং মুখের দিকে সামান্য রাস্তা। পুকুরের ঢালু নালায় বসিয়ে দিলে মাছ জলের তোড়ের সঙ্গে ঢুকে যাবে, কিন্তু বেরোতে পারবে না
You have , through your heart touching story Liril Konya ,made me emotionally obsessed and materially nostalgic.Roughly thirtyfive years back I came in contact with a girl like of which I found in Liril Konya .That is a long story to be detailed in pages and narrated in hours as to how I could be able to rescue the girl and rehabilitate in her family in Tripura with the help of Dr. Dipali Dutta of GMCH and the then Officer in Charge of Paltanbazar police station .
Next , your description of the tematha bazar was in fact a mirror for me to discover the exact immage of what I had seen a few years ago ,when I had gone to Barkhola to have a glimpse of my bigone years passed on that vibrant village .
But basically ,the humane character of Wasim Abedin his sensitivity,his spontaneous social responsibility ,his selfless approaches without any aspiration of being so called leader, will inspire every sensible reader . More such purposeful ,meaningful and serious writings come from your pen ,more we shall be enriched. I beg to be pardoned for not being able to write in Bengali ,save and except due to absence of Bengali scripts in my hand set .
-Hiranmay Ghosh ,Guwahati .
অসাধারণ! পুরো ছবির মত চোখের সামনে চরিত্রগুলো ভেসে উঠল।