য়েছে দরজে ঠংছি
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ: বাসুদেব দাস
য়েছে দরজে ঠংছি ১৯৫২ সনে কামেং সীমান্তে, বর্তমান অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেং জেলার জগং নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়ায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সনে অরুণাচল প্রদেশ প্রশাসনিক সেবায় যোগদান করে ১৯৯২ সনে ভারতীয় প্রশাসনিক সেবায় পদোন্নতি লাভ। লেখকের বিভিন্ন গ্রন্থগুলির মধ্যে কামেং সীমান্তের সাধু, মৌন ওঠ মুখর হৃদয়, লিংঝিক, বিষকন্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য অকাদেমি এবং ভারতীয় ভাষা সম্মাননা পুরস্কারে সম্মানিত এই লেখকের বহু রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
গ্রামপ্রধান ইন্ডি ফিনয়া আজকাল একেবারে নিঃসঙ্গ মানুষ। এরকম নয় যে তার নিজের কোনও মানুষ নেই। আছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মানুষ আছে। নিজের ঔরস থেকে জন্মে ডালপালা মেলে দেওয়া একটি বৃহৎ পরিবারবর্গ আছে। বুড়োর তিনটি পত্নী থেকে হওয়া একুশটি সন্তানসন্ততি, তাদের থেকে হওয়া নাতি-নাতনি, পরিনাতনিদের নিয়ে এক বিশাল গুণে উঠতে না পারা পরিবারের সে হল প্রধান। বুড়োর দুঃখ কেবল এটাই যে তার নিজের যে একুশটি ছেলেমেয়ে ছিল তাদের একজনও আজ বেঁচে নেই। বেঁচে না থাকলেও তারা বুড়োর জন্য এক দল নাতি-নাতনি, পরিনাতি-পরিনাতনি রেখে গেছে। এটাও নয় যে তারা বুড়োকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে। না। বরং প্রত্যেকেই স্নেহ ভালোবাসা, আদর দিয়ে বুড়োকে ঘিরে রেখেছে। বুড়োর কোনও কিছুর অভাব নেই। থাকার জন্য ঘর, খাবার জন্য বিভিন্ন খাদ্য, পরার জন্য কাপড়-চোপড়, ঘুরে বেড়ানোর জন্য গাড়ি, কোনও কিছুরই অভাব নেই। বুড়োকে সুখে রাখার জন্য, বুড়োকে তোষামোদ করার জন্য, আদর-টাদর করার জন্য পরিবারের সব সদস্য যেন সবসময় তৎপর হয়ে রয়েছে। প্রত্যেকেই বুড়োকে নিজের কাছে রাখতে চায়, এবং বুড়ো যার বাড়িতেই থাকুক না কেন, সেই বাড়িকে একটা তীর্থস্থানে রূপান্তরিত করার জন্য সবাই যেন এক ধরনের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সেই বাড়িতে বুড়োবুড়ির নাতি-নাতনি, পরিনাতি-পরিনাতিনীদের স্রোত বয়ে যায়। কেউ যদি আশেপাশের বাড়ি থেকে এসে থাকে, তো বাকিরা এসেছে দূরদূরান্ত থেকে। এবং এলেই কেউ খালি হাতে আসে না, সবসময়ই বুড়োর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। নানারকমের খাওয়ার জিনিস থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড়, জুতো ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য জিনিস থেকে শুরু করে এমনকি হাতঘড়ি, মোবাইল, রেডিও টেপ ইত্যাদি পর্যন্ত। বুড়ো সেই জিনিসগুলি জমা করে রাখে, কারণ প্রত্যেকেই নিজের দেওয়া জিনিসগুলি বুড়ো ব্যবহার করে কিনা খবর নিয়ে থাকে। বুড়োর এত জিনিসপত্র রয়েছে যে সেগুলি ব্যবহার করার মতো বুড়োর সময় নেই, প্রয়োজনও নেই। তা বলে বুড়ো যদি জিনিসগুলি নিজের সঙ্গে না রেখে অন্যকে উপহার দিয়ে দেয়, তাহলে আত্মীয়স্বজনরা খারাপ পায়। খারাপ পায় বলেই বুড়ো সেসব জমা করে রাখে। সবসময়েই নিজেদের কেউ না কেউ ইন্ডিবুড়োর কাছে থাকে। কেবল নিজের মানুষই কি? অন্য মানুষরাও বুড়োকে অনবরত ঘিরে থাকে। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসে। বুড়োকে দেখার জন্য আসে যেন বুড়ো একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর মূর্তি। তারা এসে বুড়োর ফোটো তুলে নিয়ে যায়। এতকিছু সত্ত্বেও বুড়ো কিন্তু নিঃসঙ্গ। বুড়ো কাউকে মনের কথা বলতে পারে না, অন্যের কথাও বুঝতে পারে না। আকারে-ইঙ্গিতে যতটুকু পারে তা দিয়েই সবার সঙ্গে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে। কিন্তু তা আর কতটুকু? তা দিয়ে মনের কথা কাউকে খুলে বলা যায় না। কাউকে নিজের ফেলে আসা দিনগুলির কথা, গ্রামটার কথা, নিজের সমসাময়িক মানুষ— যে সমস্ত মানুষ আর এই পৃথিবীতে নেই, তাদের বিষয়ে কিছু বলা যায় না। ইন্ডিবুড়ো দেখে আগামী পৃথিবীর কথা, সেই তখনকার প্রকৃতির কথা, পাখপাখালি, বন্য জীবজন্তু ইত্যাদির কথাও বলা যায় না। এটা বলা যায় না যে ইন্ডিবুড়ো বোবা, কথা বলতে পারে না, বা কালা, কানে শোনে না। সে কথাও বলতে পারে, এখনও পর্যন্ত কানে ভালো শোনে। কেবল দৃষ্টিশক্তি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে, দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। ব্যস এতটুকুই।
দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক থাকা সত্ত্বেও, কোনও অভাব অনটন না থাকা সত্ত্বেও, সবারই ভালোবাসা এবং সম্মান আদায় করে থাকা সত্ত্বেও বুড়োর দুঃখ। পৃথিবীতে এই ধরনের দুঃখ সৃষ্টির দিন থেকে কেউ ভোগ করেছিল কিনা কেউ জানে না। কী সেই দুঃখ? সেই দুঃখ হল বুড়োর নিজের মাতৃভাষা হারানোর দুঃখ। সেই মাতৃভাষায় কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারার দুঃখ। কারও মুখ থেকে সেই মাতৃভাষায় একটিও বাক্য শুনতে না পাওয়ার দুঃখ। মানুষের কথা তো বাদেই, এমনকি কুকুর, বিড়াল, শুয়োর, মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত জন্তু এবং পাখিকে তার মাতৃভাষায় আয় আয় বললেই লেজ নাড়াতে নাড়াতে কাছে চলে আসত। এখন এই ধরনের জন্তুজানোয়ার এবং পাখির কথা তো বাদেই, নিজেদের জাতির মানুষেরাই নিজেদের পিতৃপুরুষের ভাষা বুঝতে পারে না। এরকম একদিন আসবে ইন্ডি ফিনয়ার পূর্বপুরুষরা, ইন্ডি ফিনয়ার প্রজন্মের মানুষেরা ভাবতেই পারেনি। এই অবস্থা কিন্তু একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছিল, চট করে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।
এক বিশাল অঞ্চলের দুটো পাহাড়ের মাঝখানের সঙ্কীর্ণ সমতলভূমিতে ইন্ডি ফিনয়ার ছিনছুং নামের গ্রামটা অবস্থিত। গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি ছোট ঝর্ণা বয়ে গেছে, যার জল গ্রামের মানুষেরা আগে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত। কিছু দূরে গিয়ে সেই ঝর্ণা টাঙ্গা নামে নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। টাঙ্গা নদীর আশেপাশে মাঝেমধ্যে আছে এক একটি সমভূমি। কৃষির উপযোগী ভূমি। যদিও ছিনছুং গ্রামের মানুষ তাতে চাষবাস করত না। গ্রামের দক্ষিণের পাহাড়গুলিতে তারা চাষআবাদ করত। জুমখেতি চাষ। প্রত্যেক বছরে নতুন নতুন জঙ্গল কেটে কুমারী মার মাটিতে ভুট্টা, মারুয়া, ফাপর, বজ্রা ইত্যাদির সঙ্গে কচু, মিষ্টি আলু, কাঠ আলু এবং নানা মাহ জাতীয় মিশ্রণ চাষ করার জন্য উৎপাদন ভালো হত। খাওয়াপরার অভাব হয়নি। অভাব যদি হয়েছিল, তা জিনিসপত্রের। কারণ চাষবাস ছাড়া ইন্ডি ফিনয়ার জনজাতির মানুষ হস্তশিল্পে একেবারে কাঁচা ছিল। জানতই না বলা যেতে পারে। তাই কাপড়চোপড়, ঘরের বাসনপত্র ইত্যাদি কিনতে হত আশেপাশের অকা এবং চেরদুকপেন জনজাতিদের কাছ থেকে। অকা এবং চেরদুকপেনরা বছরে একবার সমতলে নেমে আসত। নিজের অসমিয়া ছন্দি অর্থাৎ হিন্দু ধর্মাবলম্বী অসমিয়া, সঙ্গে বড় কছারী, রাভা, তিয়া ইত্যাদি মানুষের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করার জন্য এবং ওদালগুড়ি হাট থেকে কাঁসার বাসনপত্র এবং সুতো, এন্ডি কাপড় ইত্যাদি কেনার জন্য তারা নেমে আসত। তার ভাগ ইন্ডির বুগুন জনজাতিরাও পেত। পৃথিবীতে মানুষ বলতে ইন্ডি ফিনয়ারা এই দুটো পাশের জনজাতি ছাড়া কিছু দূরের মিজি আর মনপা, তার থেকেও দূরের তিব্বতীয় এবং অকাদের থাকার জায়গার পূব দিকে থাকা নিসিদের জানত, অর্থাৎ তাদের সঙ্গে কদাচিৎ কখনও দেখাসাক্ষাৎ হত। অকা এবং চেরদুকেপনদের মুখ থেকে শুনেছিল চোখে দেখতে না-পাওয়া বিস্তৃত সমতলভূমিতে বসবাস করা অসমিয়া, কছারি, রাভা ইত্যাদি লোকজনের কথা। তাদের অবশ্য কখনও দেখেনি। নিজের ভাষা ছাড়াও অকা এবং চেরদুকপেনদের সঙ্গে আসা-যাওয়া-থাকার জন্য ইন্ডি ফিনয়ার বুগুন জনজাতির মানুষ এই দুটো জনজাতির মানুষদের ভাষাও বলতে পারত। অকার সঙ্গে অকা ভাষায় এবং চেরদুকপেনের সঙ্গে চেরদুকপেন ভাষায় তাদের ভাবের আদানপ্রদান করতে হত। কিন্তু এই জনজাতিরা বুগুন ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারত না। অর্থাৎ বুগুন ভাষা ছিল একান্তভাবে তাদের নিজেদের জনজাতিরা ব্যবহার করা ভাষা। সঙ্গে তাদের লালনপালন করা জন্তুদের বোঝার ভাষা। এখন ইন্ডির নিজের দুই-একজন নাতি-পরিনাতি দুই-একটি শব্দ বোঝা ছাড়া সেই ভাষা কেউ বুঝতে পারে না। ইন্ডি ফিনয়া ছাড়া পৃথিবীতে কেউ বলে না। ইন্ডি ফিনয়া এখনও সেই ভাষা ব্যবহার করলেও বস, উঠ, খা, যা জাতীয় দুই একটি শব্দের বাইরে সম্পূর্ণ বাক্য বলতে পারে না, কারণ সম্পূর্ণ বাক্য তার নাতি-পরিনাতিরাও বুঝতে পারে না। তাই একটা বাক্য বলার বুড়োর প্রয়োজনও নাই হয়ে গেল।
যে বিশাল এলাকা আগে জনশূন্যভাবে পড়েছিল, যে পাহাড়ে একদিন কদাচিৎ কখনও মানুষের যাওয়া আসা ছিল সেই এলাকায় ভারতের স্বাধীনতার পরে প্রথমে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হল। ইন্ডি ফিনয়ার গ্রামের পাশ দিয়ে। প্রথমে ইন্ডি ফিনয়ারা সেই রাস্তা দিয়ে কামেং সীমান্ত অঞ্চলের সদর স্থান বমডিলা এবং মহকুমা সদর স্থান তাওয়াঙে সরকারি মানুষদের আসা-যাওয়া করা দেখছিল। জীবনে মানুষ বললে আঙুলের ডগায় লিখতে পারা দুই একজন দেখা ইন্ডিরা তখন থেকে নতুন নতুন চেহারার নতুন নতুন মানুষ দেখতে আরম্ভ করেছিল। তবু বেশ কয়েকবছর পর্যন্ত সেই পথ দিয়ে মানুষ গাড়িতে আসা-যাওয়া করত, স্থায়ীভাবে থাকা দূরের কথা এমনকি একটা ক্যাম্প পেতেও থাকত না। ইন্ডি ফিনয়া শুনেছিল গাড়িতে আসাযাওয়া করা মানুষগুলি নাকি সরকারি মানুষ। সমতলের মানুষ। তারা ওয়াংহো গ্রামের কাছে বমডিলা নামে পাহাড়ের বুকে গ্রাম স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে। সেখানে উড়োজাহাজগুলি এসে ওপর থেকে খাবার জিনিস ফেলে রেখে যায়। সেই দিনগুলি ছিল ইন্ডিদের প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস দেখে স্তব্ধ হওয়ার দিন। এভাবে কয়েক বছর যাওয়ার পরে শুরু হল যুদ্ধ। কখনও আগে নাম না শোনা চিন নামের কোনও জায়গার মানুষ বন্দুক নিয়ে সমতল থেকে এসে এই পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় থাকতে শুরু করা মানুষের সঙ্গে মারামারি শুরু করল। সমতলভূমি থেকেও হাতে বন্দুক নেওয়া মানুষগুলি এল, যদিও তারা চিনের হাতে বন্দুকের গুলি খেয়ে মারা যাওয়ায় সমভূমির মানুষগুলি পালিয়ে বাঁচল। কেন জানি চিনারা পুনরায় নিজের দেশে ফিরে গেল এবং সমতলের মানুষগুলি পুনরায় ফিরে এল। পরে ইন্ডিরা জানতে পারল সমভূমি থেকে আসা মানুষগুলি ইন্ডিয়া না কি ভারত সেই দেশের এবং ওদের গ্রামের সঙ্গে অকা, মনপা, চেরদুকপেন ইত্যাদি সমস্ত পাহাড়ের মানুষের গ্রামগুলি নাকি ভারত নামের দেশের ভেতরে। দেশ যে কী জিনিস ইন্ডিরা তা তখন জানতই না। এমনকি পৃথিবী বললেও ওদের জ্ঞানের পরিসীমায় ছিল চোখ যতটুকু যায় সেই পাহাড়মালা এবং সেখানে ছড়িয়ে থাকা দূরদূরান্তের গ্রামগুলি যেখানে দুই একটি অন্য ভাষা বলা মানুষ বসবাস করত। তারই চার-পাঁচটা গ্রামে একই ভাষা বলা বুগুন-জাতীয়রাও বাস করত এবং সেই একই ভাষা বলা মানুষগুলির সঙ্গে ওরা বিয়ে-সাদি করতে পারত, একই নিয়ম, একই সংস্কৃতি মেনে চলত। মানুষগুলিকে জানত গ্রামের নামে, দেশের নামে না। সেই সমতল থেকে মানুষ আসতে শুরু করা সময় ইন্ডিরা ইন্ডিয়া, চিন, আমেরিকা, জাপান, আদি দেশ এই মাটি, পর্বত, নদী, জঙ্গল আদির দ্বারা গঠিত পৃথিবী নামে জায়গাতে আছে বলে শুনতে শুরু করেছিল। সেই চিনের সঙ্গে সংঘটিত মারামারিকে যুদ্ধ বলেও জানতে পেরেছিল আর এই ধরনের যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে সংঘটিত হয় বলে জানতে পেরেছিল। এরকম যুদ্ধের পরেই ইন্ডিদের ছিনছুং গ্রামের আশে পাশে থাকা সমতল এবং পাহাড়ের মধ্যে থাকা ছোট ছোট সমান জায়গাগুলিতে ইন্ডিদের গ্রামের মানুষ বেশ কয়েকবছর সেই বন্দুকধারী মানুষগুলির ভয়ে ওদের কাছ থেকে পাশ কেটে গিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল, যদিও ধীরে ধীরে তারা সিপাহিদের সঙ্গে মিলে-মিশে যেতে শুরু করেছিল। ইতিমধ্যে তাদের গ্রামে একটি স্কুলও স্থাপিত হয়েছিল এবং সেখানে ইন্ডি ফিনয়ার ছোট ছোট নাতিনাতনিরা পড়তে শুরু করেছিল। ইন্ডিদের গ্রামের এলাকায় বসবাস করা সিপাহিদের জন্য, তাদের পরিবারদের নিয়ে এসে সঙ্গে রাখার জন্য এলাকাটিতে দোতলা সুন্দর সুন্দর পাকা বাড়ি নির্মাণ করার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাটিতে সিপাহি ছাড়াও অসংখ্য শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের প্রব্রজন শুরু হয়েছিল। অরুণাচলে যেহেতু বাইরের কোনও মানুষ জমির মালিক হতে পারে না এবং ব্যবসাবাণিজ্যের জন্যও কোনও ধরনের পারমিট পায় না সেইজন্য দোকান খোলার জন্য গ্রামের স্থানীয় মানুষের নামে পারমিট দেওয়া হয়েছিল। আর তা বাইরে থেকে আসা বিহারি, বাঙালি, ইত্যাদি মানুষদের ভাড়ায় দেওয়া হয়েছিল। ভাড়াঘরগুলি টাঙ্গা নামের একটি জায়গায় তৈরি করতে হয়েছিল বলে সেখানে একটি বাজার গড়ে উঠেছিল। ষাট-সত্তরের দশকের সময় ছিনছুং গ্রামের আশেপাশে বাইরের মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে থাকা একটি বড় নগর গড়ে উঠেছিল এবং তার মধ্যে ইন্ডিদের মানুষ হারিয়ে গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল তাদের সাজপোষাক এবং তার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছিল আধুনিক সাজপোষাক, শার্ট, লং পেন্ট ইত্যাদি। পায়ে জুতো মোজা। আগের মতো আর খালি পায়ে হাঁটার কোনও প্রয়োজন ছিল না। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছিল।আগের মতো ইন্ডিকরা কষ্ট করে প্রতি বছর নতুন নতুন জঙ্গলের বড় বড় গাছ কেটে মুক্ত করে জুম চাষ করার প্রয়োজন রইল না। জুমা চাষ করে উৎপাদন করা গোমধান, কনীধান, কচু, কাঠ আলু ইত্যাদির পরিবর্তে সৈনিকদের উদ্বৃত্ত রেশনের আটা এবং চাল অথবা সৈনিকদের ক্যাম্পে গিয়ে করা শ্রমের বিনিময়ে নাহলে সুলভ মূল্যের দোকান থেকে রেহাই মূল্যে কেনা চালের ভাত মানুষগুলি খেতে শুরু করেছিল এবং কালক্রমে চালের ভাত খাওয়ার অভ্যাস বুগুনদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। তারই সঙ্গে ইন্ডিদের গ্রামের মানুষের মধ্যে অন্য একটি প্রয়োজনীয়তা এসে পড়েছিল, তা হল নিজের ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় ভাবের আদানপ্রদান করার প্রয়োজনীয়তা। তাই গ্রামের মানুষগুলি হিন্দি ভাষা বুঝতে পারা এবং বলতে পারা শিখতে শুরু করেছিল। কারণ সমগ্র অঞ্চল্টাতে সৈন্যের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলায়, সেনাবাহিনীর নানা ধরনের কাজ করার জন্য ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দিভাষী শ্রমিক, ঠিকাদার, দোকানি ইত্যাদি এসে ভরে যাওয়ায় ইন্ডিদের অঞ্চলে হিন্দি হয়ে পড়েছিল প্রত্যেকেরই বোঝা এবং বলতে পারা ভাষা, ভাবের আদানপ্রদানের ভাষা। কিন্তু ইন্ডি হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শিখতে পারেনি। তারজন্য গ্রামের মানুষের তিরস্কার, ঠাট্টা-মস্করা, ইত্যাদি সহ্য করতে হয়েছিল। কারণ গ্রামের মানুষের নিজের ভাষার বাইরেও আলাদা একটা ভাষায় কথা বলার শক্তি আহরণ করতে পেরে গৌরবে বুক ফুলে উঠেছিল। সেই গৌরবে ভেসে বেড়িয়ে তারা এমনকি নিজেদের মধ্যেও হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছিল। এমনকি নিজের ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা না শিখিয়ে ছোট থেকেই হিন্দি ভাষা বলতে শিখিয়েছিল। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মাতৃভাষা না বলে যদি হিন্দি ভাষায় কথা বলে মাতা-পিতা আনন্দে দিশাহারা হয়। অন্যদের সামনে গর্ব করে বলছিল— ‘দেখ, দেখ আমার ছেলে এত ছোট থাকতেই হিন্দি বলতে শিখে গেছে।’
কেউ কেউ আবার বলে— ‘জানো, আমার মেয়ে আমাদের নিজের ভাষায় কথা বললে কিছুই বুঝতে পারে না। ওকে হিন্দিতে বললে তবেই বুঝতে পারে।’
কোনও কোনও মা-বাবা তার চেয়েও বেশি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করার সুযোগ পেয়েছিল যখন ছেলেমেয়ে স্কুলে ইংরেজি শিখে এসে ভুল-শুদ্ধ দুই একটা ইংরেজি বাক্য বলে। তারা বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেছিল ‘আমার ছেলের কথা কী আর বলবে। সে গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারে। কাল আর্মি অফিসারের সামনে সে ইংরেজিতে কথা বলল। তাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেখে আর্মি অফিসার খুব খুশি হলেন।’
গ্রামের সমস্ত মানুষ বলাবলি করতে শুরু করেছিল— ‘কী হবে আমাদের বুগুন ভাষা শিখে? বাইরে গেলেই কেউ বুঝতে পারে না। আমরা নিজের ভাষায় কথা বললে লোকেরা হাসাহাসি করে।’
ইন্ডি ফিনয়ার বয়স ততদিনে ভাটির দিকে যেতে শুরু করেছে, তার সঙ্গে জন্মানো, আগে-পরে জন্মানো অনেকে সংসার থেকে বিদায় নিয়েছিল। অন্য লোকগুলির ছেলেমেয়েরা হিন্দি, ইংরেজি বললে তিনি কখনও কখনও আপত্তি করতেন। বলতেন— ‘তোরা বিশাল ভুল করছিস। এভাবে আমরা লোকের ভাষায় কথা বলতে থাকলে একদিন আমাদের ভাষায় কথা বলার আর লোক থাকবে না। ভাষা না থাকলে আমাদের জাতিও এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। কত খারাপ হবে তোরা কেউ সেটা ভেবে দেখেছিস?’
ইন্ডির কথায় কেউ কেউ সমর্থন জানিয়েছিল, বিশেষ করে তার সমসাময়িক বুড়োবুড়িরা। নিজের ভাষাকে অন্য ভাষার আগ্রাসন থেকে কীভাবে রক্ষা করা যেতে পারে একদিন তা নিয়ে গ্রামে একটা সভাও বসল। উদ্যোগ নিল নিজের ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া এবং আগের দিনে বমডিলা হাইস্কুলে অসমিয়া মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরূপে কাজ করে অবসর নেওয়া দাম্বিং নামের মানুষটা।
সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে দাম্বিং আরম্ভ করলেন— ‘আপনারা সবাই জানেন আমি আর মামা ইন্ডি কেন এই সভার আয়োজন করেছি।’
‘হ্যাঁ, জানি জানি।’ সভায় উপস্থিত প্রায় সমস্ত মানুষ সমস্বরে বলে উঠলেন।
–আমাদের বুগুন সমাজের মানুষেরা আমাদের নিজের ভাষাটা ভুলে যেতে শুরু করেছে। এখনই যদি আমরা সাবধান হয়ে একে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা না করি তাহলে একদিন আমাদের ছেলেমেয়ে, আমাদের নাতিনাতনি, ভবিষ্যতের বংশধররা এই ভাষাটা একেবারে ভুলে যাবে। আমাদের এই প্রজন্মের মানুষদের সঙ্গে আমাদের ভাষাও মৃত্যুবরণ করবে।
–হ্যাঁ, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আমরা বুড়োমানুষরা মরে গেলে আমাদের ভাষায় কথা বলা মানুষ নাই হয়ে যাবে। পুরি খাবার জন্য একটা শব্দ থাকবে না। অন্য একজন মন্তব্য করল।
–সেইজন্যই আমরা বলছি, এখন সময় থাকতে একে রক্ষা করার জন্য কিছু একটা করতে হবে। কী করলে আমাদের ভাষা রক্ষা পাবে, ভবিষ্যতেও আমাদের বংশধররা যাতে আমাদের এই সুন্দর ভাষা বলার সুযোগ পায় তার জন্য আপনাদের সবার কাছ থেকে আমি পরামর্শ চাইছি।
–ভাতিজা দাম্বিং সঠিক কথাই বলেছে। আমাদের ভাষা বেঁচে থাকবে কিনা, বেঁচে থাকে যদি কতদিন বেঁচে থাকবে সেকথা নিয়ে বড় চিন্তায় রয়েছি। দুঃখও হচ্ছে, খারাপও লাগছে, আমাদের ভাষার এই দুরবস্থা দেখে। আমার মতে আমরা আমাদের নিজেদের মানুষের মধ্যে হিন্দিতে কথাবার্তা না বলে নিজেদের ভাষায় কথা বলা উচিত…।
–কীভাবে কথা বলব? আমাদের ভাষায় কথা বললেও আমাদের ইংরেজি এবং হিন্দি শব্দ ব্যবহার করতেই হবে। আমাদের ভাষায় টেলিফোন, বাজার, মার্কেট, গাড়ি, শার্ট, বুট, পেন, বই ইত্যাদি শব্দ আছে কি? একজন যুবক ইন্ডির কথা শেষ করতে না দিয়ে মাঝখানে বলে উঠল।
–নাই। ইন্ডি বুড়ো ঢোক গিলে কোনওরকমে বলল।
–তাহলে? তাহলে? তাহলে কীভাবে আমরা ইংরেজি এবং হিন্দিতে কথা না বলে থাকতে পারব? পারব কি? যুবকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল।
–পারবে না। আজকের যুগে হিন্দি কথা বলতে না পারলে চলতে পারবে না। আমরা নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাজারে এলেই হিন্দি বলতে হবে। কারণ এখানকার দোকানিরা আমাদের বুগুন ভাষা জানে না। আমরা অসমে গেলে অসমিয়ায় কথা বলতে হবে। কারণ সেখানকার মানুষ অসমিয়া ছাড়া অন্য ভাষা জানে না। কথাটা আমি সাধারণ অসমিয়া গ্রামবাসীদের বোঝাতে গিয়ে বলছি। সেখানেও, অসমেও আজকাল বেশিরভাগ মানুষই হিন্দি বলতে পারে। আর তুমি যে বলছ, টেলিফোন, বাজার, মার্কেট, ইত্যাদি শব্দগুলি। সেই শব্দগুলি আমাদের ভাষাতে নেই। কারণ আমাদের সময়ে আমাদের মধ্যে সেইসব জিনিস ছিল না। টেলিফোন, গাড়ি ইত্যাদিও ছিল না। বাজার, মার্কেট ইত্যাদিও ছিল না। তাই আমাদের ভাষায় সেইসব শব্দ নেই। তাই আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলার সময় সেইসব শব্দ ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু আমাদের ভাষায় তো ডিম, কাপড়, পথ, গ্রাম ইত্যাদি শব্দ আছে। আমরা কথা বলার সময় নিজের মা বাবাকে কেন ভাত দে না বলে খানা দে বলি? নিজেদের ছিনছুং গ্রাম না বলে ছিনছুং বস্তি কেন বলি? যে শব্দ আমাদের নিজেদের ভাষার মধ্যে বিদ্যমান আমরা সেইসব শব্দ ব্যবহার করি না কেন? আমি কয়েকটা উদাহরণ দিয়েছি।
দাম্বিং সবাইকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল।
–আমাদের ভাষা, ভাষা নাকি? এটা কোনও ভাষা নয়। এটা একটা উপভাষা। স্কুলের এক ছাত্র আপত্তি করল।
–এটা ভাষা না হলে আর কী? ইন্ডি অবাক হয়ে বলল।
–আমাদের বইয়ে লেখা আছে যে ভাষায় ব্যাকরণ আছে তাকে ভাষা বলে, যেখানে ব্যাকরণ নেই তাকে উপভাষা বলে। তাই স্যার বলেছেন আমাদের বুগুনদের ভাষা নেই উপভাষা আছে।
–হ্যাঁ, আমাদেরও স্কুলে সেভাবেই পড়ানো হয়েছিল। দাম্বিং ছেলেটির কথা সমর্থন করে বললেন।
ইন্ডি বুঝতে পারল না ছেলেটি কী বলল। বুঝতে পারলে বলতেন, এই ধরনের লোকের বইয়ে যা লেখা আছে তা একেবারে ভুল। তোমাদের ভুল শেখানো হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। কিন্তু দাম্বিং পুনরায় বলে উঠলেন— ‘সেদিন গ্রামপ্রধান মামার বাড়িতে তার খোঁজে দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন প্রফেসর এবং একদল গবেষক এসেছিলেন। তারা মৃতপ্রায় হওয়া ভাষাগুলির বিষয়ে গবেষণা করছে এবং তাদের বলা অনুসারে আমাদের বুগুন ভাষাও মৃতপ্রায় এবং মৃত হতে চলা ভাষার মধ্যে রয়েছে। প্রতিদিন বাইরের মানুষ এলে গ্রামপ্রধান মামা কথাগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকার মতো সেদিনও মামা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নয় কি মামা?’
–হ্যাঁ, আমি গ্রামপ্রধান হলেও অসমিয়া ভাষা ছাড়া হিন্দি, ইংরেজি আদি ভাষার কথা জানি না। সেইজন্য ভাইপো না থাকলে আমি অন্য মানুষ দেখা করতে এলে কথাই বলতে পারি না। ইন্ডি গ্রামপ্রধান বললেন।
–আমি যখন তুমি বলা কথাটাই বললাম যে আমাদের ভাষা নেই, উপভাষা আছে, তখন সেই প্রফেসার আমাকে বুঝিয়ে বললেন সেটা আমাদের ভুল পড়ানো হয়েছিল। বইয়ে ভুল লেখা আছে বলে তিনি আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। তার মতে ভাষা হল মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মানুষ যে ভাষায় মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে সেই ভাষা অন্য ভাষার তুলনায় দুঃখী কখনও হতে পারে না। আমাদের ইন্ডি মামা অসমিয়া ছাড়া অন্য ভাষা জানে না, কিন্তু বাড়িতে থাকলে নিজের মানুষের সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বললে কখনও ইংরেজি হিন্দি মিলিয়ে কথা বলেন না। আমাদের নিজেদের বুগুন ভাষায় ভালোভাবে মনের সমস্ত ভাব প্রকাশ করে দেয়। তাই সেই প্রফেসার আমাদের ভাষা যে আমাদের জন্য কত মূল্যবান সেই কথা মামা এবং আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর কথাটা শুনে আমাদের চোখ খুলে গেল। আমরা আমাদের ভাষাকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে এই উপলব্ধি আমাদের দুজনেরই হল। সেইজন্য আমরা দুজনে আজ এই সভা পেতে আপনাদের মতামত নিয়ে সেই বিষয়ে কীভাবে এগোনো যেতে পারে তার জন্য কার্যক্রম তৈরি করব বলে ভেবেছি। জনগণের মতামত কী? দাম্বিং ভাষার আসল তাৎপর্য কী বুঝিয়ে দিয়ে সভার মহৎ উদ্দেশ্য বিষয়ে জনগণের মতামত চাইলেন।
–হ্যাঁ, সেই দিল্লি থেকে আসা বুড়ো মানুষটা আমাদের চোখ খুলে দিল। আমরা বুগুনরা আমাদের ভাষা ভুলে যেতে চলেছি। অন্যান্য জনজাতিদের মধ্যে এরকম ঘটনা ঘটেনি। বড় লজ্জার কথা…
ইন্ডি গ্রাম প্রধানের কথা শেষ হতে না দিয়ে পেনজ নামে গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বারটি মাঝখানে বলে উঠল—
–শুধুমাত্র আমাদের বুগুনদের ক্ষেত্রে এরকম হয়নি। আজ অরুণাচলের সমস্ত জনজাতির মধ্যে এই কথা চলছে। স্কুলে ইংরেজি মাধ্যম নামেমাত্র রয়েছে, সেখানে আসলে হিন্দিতেই সমস্ত কিছু পড়ানো হয়। মানে বই ইংরেজির, কিন্তু শিক্ষক পড়ানোর সময় ছাত্রদের হিন্দিতে বুঝিয়ে দেয়। হোস্টেলে ছেলেমেয়েরা হিন্দিতেই কথাবার্তা বলে। দেখেননি রামকৃষ্ণ মিশন, বিবেকানন্দ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা ছুটিতে বাড়িতে এলে আমাদের সঙ্গেও হিন্দিতে কথা বলে। যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা শৈশবে নিজের ভাষায় কথা বলেছিল তারাও নিজের ভাষা ছেড়ে হিন্দিতে বলা শুরু করেছে।
–দিরাঙের মন-পা ছেলেমেয়ে, রূপার চেরদুকপেন ছেলেমেয়ে, জামিরীর অকা ছেলেমেয়ে এবং নাফ্রার মিজি ছেলেমেয়েরাও আজকাল আর নিজেদের ভাষা বলতে পারছে না। চোজু নামের একজন সচেতন মানুষ এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
–হ্যাঁ, কেবল আমাদের জেলাতেই নয়, সমগ্র অরুণাচলে একই অবস্থা হয়েছে। আমাদের কোনও জনজাতির ছেলেমেয়ে নিজেদের মাতৃভাষা বলতে পারছে না। ইটানগরের ঘরে ঘরে আজকাল হিন্দিতে কথাবার্তা বলা হচ্ছে। পেনজেয়ো দুঃখের সঙ্গে চোজুর কথায় সায় দিল।
–তাই নাকি? সত্যি খুবই দুঃখের কথা। আমি ব্যাপারটা জানতাম না। সরকার এই বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? উদ্বিগ্নভাবে ইন্ডি জিজ্ঞেস করল।
–সরকার কী করতে পারবে? আমাদের অরুণাচলের নিজের কোনও পৃথক ভাষা না থাকার জন্য এখন মন্ত্রী, এমএলএ, অফিসার সবাই নিজেদের মধ্যে ইংরেজি না হলেও হিন্দিতে কথা বলে। আগে অসমিয়াতে বলত। এখন বেশিরভাগেই হিন্দিতে কথা বলে। তাই আমাদের ভাষাগুলি বিলুপ্ত না হয়ে কী হবে? এক এক করে সমস্ত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে রাষ্ট্রভাষা হিন্দিই অদূর ভবিষ্যতে অরুণাচলের সমস্ত জনজাতির মাতৃভাষা হবে। তখন আমরা অরুণাচলবাসীরা এক হয়ে এক ভাষা এক জাতির মানুষ হতে পারব। কোনও আদি, আপাতনি, নিচি, মনপা, বুগুন থাকবে না। গালো, খামতি, অকা, চেরদুকপেন, নক্তে, বাংছু, টাংচা সবাই এক হয়ে যাবে। আমাদের ভাষার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিও লোপ পেয়ে আমাদের সমস্ত জনজাতির সংস্কৃতি এক হয়ে যাবে, ধর্ম এক হয়ে যাবে। আমরা আমাদের সাজপোশাক প্রায় ছেড়ে দিয়েছি বলা যায়, এখন যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাও আমাদের মাঝখান থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ…
হঠাৎ চোজু জোরে জোরে হাসতে লাগল। দুঃখে না আনন্দে হাসছে সেকথা চোজু ছাড়া কেউ বুঝতে পারল না।
–এতে হাসির কী আছে? ইন্ডি প্রায় ধমক দেওয়ার সুরে চোজুকে বলল।
–না হেসে কী করব? হাঃ হাঃ হাঃ। চোজু আরও জোরে জোরে হাসতে লাগল। এইবার চোজুর হাসিতে অন্যান্যরাও যোগ দিল। হাসতে হাসতে চোজু একটা সময়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। তার কান্না দেখে ইন্ডি বলল— ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? কথা নেই বার্তা নেই হো হো করে হাসবে, আবার হাউমাউ করে কাঁদবে।’
–না কেঁদে কী করব? কাঁদতেই হবে। যেদিন আমাদের ভাষার মৃত্যু হবে সেদিন কান্নার জন্য কেউ থাকবে না। হয়তো আমাদের মধ্যে একজন এই পৃথিবীতে আমাদের বুগুন ভাষা বলা শেষ মানুষ হবে। আর সেই মানুষটির মৃত্যু হলে কাঁদার মতো কোনও মানুষ থাকবে না। সেইজন্যই আমার আজই কেঁদে নিতে ইচ্ছা করছে।
–আমাদের যাতে কাঁদতে না হয় সেই পথ খূঁজে বের করার জন্য আমরা আজ এখানে জমায়েত হয়েছি। শুনুন, আমি কিছু পরামর্শ দিচ্ছি। প্রথম কথা হল আজ থেকে আমাদের গ্রামে নিয়ম করে দিতে হবে— আজ থেকে আমরা বাড়ির ভেতরে নিজেদের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বলতে পারব না।
দাম্বিং তার প্রস্তাবগুলি তুলে ধরতে আরম্ভ করল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ। আমরা সমর্থন করছি। আজ থেকে কেউ বাড়িতে ইংরেজি বা হিন্দি বলতে পারবে না।
–বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের লোকেরা হিন্দি বা অন্য ভাষায় কথা বলতে পারবে, নিজের গ্রামের মানুষের সঙ্গে সব সময় নিজেদের ভাষাতেই কথা বলতে হবে। তারা হিন্দি, ইংরেজি ভাষায় কথা বললেও উত্তর নিজের ভাষায় দিতে হবে।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। সবাই হাতে তালি দিয়ে দাম্বিঙের কথায় সমর্থন জানাল।
–আমি আরও একটি প্রস্তাব তুলে ধরতে চাই। –এইবার গ্রামের মেম্বার পেনজেই বলে উঠল।
–কী প্রস্তাব বলো। ইন্ডি গ্রামপ্রধান আদেশ দিল।
–আমাদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই ভাষায় স্কুলে পড়ানো শুরু করতে হবে। আমাদের এখানে ইংরেজি পড়াচ্ছে, হিন্দিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে পড়ানো হচ্ছে। আমাদের গ্রামের স্কুলগুলিতে আমাদের নিজেদের বুগুন ভাষা তৃতীয় ভাষা হিসেবে পড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাতে হবে।
–ঠিক কথা। তবে আমাদের কোনও লিপি নেই, কোনও বই নেই। তাই আমাদের বুগুন ভাষায় স্কুলে কীভাবে পড়ানো হবে? দাম্বিং চিন্তান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল।
–তার জন্য আপনিই তো রয়েছেন। আমাদের বুগুন ভাষার একটা উপযুক্ত লিপি আপনি উদ্ভাবন করুন। প্রাইমারি ক্লাসের জন্য বই লিখুন। বই ছাপানোর জন্য যত টাকা লাগে আমি দেব। চিন্তা করবেন না। মেম্বার পেনজেই বলল।
–বড় ভালো প্রস্তাব দিয়েছ পেনজেই ভাইটি। বড় ভালো প্রস্তাব। সেভাবে করতে পারলে আমাদের ভাষা বেঁচে যাবে। মাস্টারবাবু, আপনি আজ থেকে কাজে লেগে যান। বই ছাপানোর জন্য আমি যত টাকা প্রয়োজন দেব। চোজু উৎসাহ ভরে বলল।
–ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে এই কাজে সাহায্য করার জন্য আরও মানুষ চাই। দাম্বিং বলল।
–যাকে যাকে নিলে কাজ হয়ে যাবে বলে মনে হয় তাকে সঙ্গে নিয়ে নাও। ইন্ডি কথাটা ভালো বুঝতে না পারলেও দাম্বিঙের আদেশটুকু জারি করল।
সেই দিনের সভায় যে সমস্ত পরিকল্পনা গৃহীত হল কয়েকদিন গ্রামের সবাই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলল। দাম্বিংও মনেপ্রাণে নিজের ভাষার জন্য একটা লিপি উদ্ভাবন করায় লেগে পড়ল। কিন্তু ধীরে ধীরে যত দিন যেতে লাগল মানুষগুলির পরিকল্পনার প্রতি মনোভাব ঢিলা হতে লাগল। তখনই একটি মোটর দুর্ঘটনায় দাম্বিঙের মৃত্যু হল। তার কিছুদিনের মধ্যে একে একে অসুস্থ হয়ে পেনজে এবং চোজুও ইহ সংসার ছেড়ে চলে গেল। তারপরে একজন দুজন করে গ্রামে নিজের ভাষা বলতে পারা মানুষের সংখ্যা কমে যেতে লাগল। নিজেদের বুগুন ভাষা জানা মানুষের মধ্যে বেঁচে রইল কেবল ইন্ডি ফিনয়া। দাম্বিঙের মৃত্যু ইন্ডি ফিনয়া বুড়োকে বড় মনোকষ্ট দিল। নিজের পত্নীদের মৃত্যু, ছেলেমেয়েদের এক এক করে মৃত্যুর সময়েও ইন্ডি গ্রামপ্রধান এতটা দুঃখিত হয়নি, এত নিরাশায় ভোগেনি। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই বুড়ো বয়সে মৃত্যু হয়েছিল। মানুষ হয়ে জন্মালে একদিন না একদিন মরতেই হবে। সেইজন্য মানুষ মরলে বুগুনরা উৎসব পালন করে, বনভোজ খায়, নাচগান করে। কিন্তু ভাষার কি কখনও মৃত্যু হয়? অথচ এখন তাই হতে চলেছে, যতটুকু আশা ছিল দাম্বিঙের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই আশাও নির্বাপিত হয়ে গেল। ইন্ডিবুড়ো ভেবে পায় না নিজের ভালোবাসার এই বুগুন ভাষাকে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করবে। সে বহু চেষ্টা করেছে নিজেদের নাতি পরিনাতিদের মধ্যে, গ্রামের মানুষগুলির মধ্যে কীভাবে নিজেদের ভাষার প্রচলন করা যায়। সে তাই দরকার হলেই নিজের ভাষায় কথা বলে। সে জানে অসমিয়াতে যাকে পানি বলে হিন্দিতেও তাকে পানি বলে। তাই ইচ্ছা করলে তৃষ্ণা পেলে তিনি পানি শব্দটা উচ্চারণ করলেই পানি এসে যাবে। কিন্তু পানির জন্য হিন্দি অসমিয়ায় না বলে বুড়ো জেনেশুনে বুগুন ভাষায় পানি চেয়ে বলবে, খো ফি। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন দাদু?, সে উত্তর দেয় কো গোং, অর্থাৎ আমি ভালো আছি। তারপরে ইন্ডিবুড়ো যদি জিজ্ঞেস করে ‘নো খে আন’ অর্থাৎ তুমি কেমন আছ, তখন ওপাশের মানুষ বূড়োর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাবে, অর্থাৎ বুড়ো কী জিজ্ঞেস করছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই সমস্ত কারণে বুড়ো একটা সময়ে নিশ্চিত হল তার মৃত্যুর পরে বুগুন ভাষার কোনও শব্দতরঙ্গ এই পৃথিবীতে আর ভেসে উঠবে না। দিল্লি, গুয়াহাটি ইত্যাদি জায়গা থেকে মানুষ বুগুন ভাষার বিষয়ে কিছু জানার জন্য এসে বুগুন ভাষা কীভাবে উচ্চারিত হয়েছিল শুনতে চাইলেও শোনানোর মতো কেউ থাকবে না। আর এরকমও হতে পারে একদিন দাম্বিঙের মতো, পেনজে এবং চোজুর মতো বা তার নিজের মতো হয়তো ছিনছুং গ্রামে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসবে এবং তারা একদিন হয়তো মৃত বুগুন ভাষা পুনরায় উদ্ধারের জন্য উঠে পড়ে লাগবে। তাই ইন্ডি বুড়ো একটা কাজ শুরু করে দিল, তাকে কোনও একজনের এনে দেওয়া টেপ রেকর্ডারে নিজের ভাষা রেকর্ড করতে লাগল। তার জন্য সে নিজের জানা অসমিয়ার সঙ্গে হিন্দি এবং ইংরেজি কিছু শব্দের সাহায্য নিল। নিজের দরজা বন্ধ করে এক, ন্যেং— দুই, প্রাণ— মানুষ, মলিয়া— মহিলা, তুমি কেমন আছ— নো খে আন? ইত্যাদি রেকর্ড করতে লাগল। এই কাজে ইন্ডিবুড়ো এতটাই নিমগ্ন হয়ে গেল যে তার জন্য সে দিনরাতও ভুলে গেল। খেতে ঘুমোতে ভুলে গেল। লোকেরা বলাবলি করতে লাগল— বুড়োর মগজ কাজ করছে না। বুড়ো পাগল হয়ে গেছে। যার বাড়িতে সেই সময় ইন্ডিবুড়ো ছিল তারা বুড়োকে নিজের ইচ্ছেমতো থাকতে দিল। আর একদিন নাতবৌ ভাত দিতে গিয়ে দেখল বুড়ো টেপরেকর্ডারটা জড়িয়ে শুয়ে আছে। নাতবৌ বুড়োকে জাগাতে গিয়ে দেখল বুড়ো বেঁচে নেই। টেপরেকর্ডারটা জড়িয়ে ধরেই ইন্ডিবুড়ো মৃত্যুকেও জড়িয়ে ধরেছে।
ইন্ডি ফিনয়ার মৃত্যু পৃথিবীতে অহরহ ঘটতে থাকা সাধারণ মৃত্যু ছিল না। এই মৃত্যু ছিল পৃথিবীর বুক থেকে একটি ভাষার মৃত্যু ঘটে একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়া মৃত্যু। একটি জাতির, একটি সংস্কৃতির চিরমৃত্যু। যদিও ইন্ডিবুড়ো জীবনের শেষ দিনগুলিতে তার সঙ্গে যেখানে সেখানে যেন তার মাতৃভাষার মৃত্যু না ঘটে, একদিন তা যেন পুনরায় বেঁচে ওঠে তার বন্দোবস্ত করেছিল, সেকথা তার নাতি-পরিনাতিরা, গ্রামের মানুষেরা বুঝতে পারেনি। কারণ নিয়ম অনুসারে বুড়োর মৃতদেহের সঙ্গে বুড়োর সমস্ত জিনিসপত্রও সমাধিস্থ করতে হয়। করলও তাই। বুড়ো নিজের ভাষাটা রেকর্ড করে রেখে যাওয়া টেপরেকর্ডাও বুড়োর সঙ্গে কবরে পুঁতে ফেলা হল।