চার নম্বর নিউজডেস্ক
১৯৩৬ সালে ড. বি আর আম্বেদকর যখন তাঁর ইস্তাহারপ্রতিম মহাগ্রন্থ ‘The Annihilation of Caste’ প্রকাশ করছেন, তিনি নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারেননি স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও শিক্ষিত, গণতান্ত্রিক, আধুনিক ভারতবর্ষে নবজাতকের জাতের পরিচয় এতখানি গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। ঠিক এমনটিই ঘটল ২০২০ সালের বাংলায়, নদিয়া জেলার নবদ্বীপে।
নামের শেষে পদবী মানুষের জাতের পরিচায়ক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে চলা বৈষম্যমূলক বর্ণাশ্রমের চিহ্ন এখনও ধরে রাখা আছে হিন্দু নামে। স্বাধীন ভারতবর্ষে জাতিপরিচয় অনুযায়ী কোনও ভারতবাসীই আইনত কোনও বৈষম্যমূলক আচরণের স্বীকার হতে পারেন না। তা সত্ত্বেও, মানুষের নাম শুনে (অর্থাৎ জাত পরিচয় জেনে) তার সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করে নেওয়া হয়, এমন উদাহরণ তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও কম নয়। এমনও দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে রোগী ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে এসে ডাক্তারের নিম্নবর্গীয় পদবী দেখে ফিরে চলে গেছেন, তিনি শুধুমাত্র কোনও ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের কুলীন কায়স্থ চিকিৎসকের কাছেই নিজের সমস্যার কথা জানাবেন, অন্য কাউকে নয়।
এই পরিস্থিতিতে, প্রকৃত শিক্ষিত ও এগিয়ে থাকা চিন্তার দম্পতি প্রতাপ ও মৌসুমী নিজেদের সদ্যোজাত সন্তানকে এক মুক্ত নতুন পৃথিবী উপহার দিতে চেয়েছিলেন, নিজের সন্তানের কোনও পদবী না দিয়ে। এই সামান্য সদিচ্ছার কারণে এই ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের কতখানি লড়াই করতে হল, সেই গল্পটাই আজ আমরা শুনব।
নবদ্বীপের এক নার্সিংহোমে মৌসুমী তার পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় গত চোদ্দই জুন, এবং প্রতাপ ও মৌসুমী গভীর চিন্তাভাবনা শুরু করে তার সন্তানের জন্য একটি জুৎসই নাম সংগ্রহের ব্যাপারে— যে নামে থাকবে ধর্মমুক্তির বার্তা। এখানে বলে রাখা দরকার, প্রতাপ নিজে একজন বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য। প্রতাপ-মৌসুমীর সমমনা বন্ধু ও যুক্তিবাদী সমিতির এক কর্মীর সংগ্রহে থাকা অভিনব নামের জমকালো ভাণ্ডারটি থেকে শিশুর পিতামাতা বেছে নেন বিশেষ একটি নাম— ‘অনীশ সংকল্প’।
অতএব, প্রতাপ এই নামটিই তার সন্তানের নাম হিসেবে নথিভুক্ত করার আবেদন জানান নবদ্বীপ পৌরসভার কাছে, গত পঁচিশে জুন। ইতিপূর্বে আমাদের দেশে ও রাজ্যে অনেকেই বিভিন্ন পৌরসভা থেকে সন্তানের পদবীহীন নাম নথিভুক্ত করাতে পেরেছেন, অতএব এ নিয়ে আদৌ যে কোনও সমস্যা হতে পারে, এমনটা প্রতাপ বা মৌসুমী কেউই ভাবতে পারেননি। বংশপরিচয় রক্ষার তাগিদ অন্তত সরকারি প্রতিষ্ঠানকে তাড়া করে বেড়াবে না আজকের দিনে— এমন একটা আত্মতুষ্টিতে মশগুল ছিলাম আমরা। কিন্তু, সে আত্মতৃপ্তি যে কতখানি অসার, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন নবদ্বীপ পৌরসভার বর্ষীয়ান চেয়ারম্যান। তিনি প্রতাপকে সামনাসামনি ডেকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন, এমনতর অদ্ভুত কাণ্ড তিনি কোনওদিন দেখেননি, কাজেই এই পদবীহীন নামে জন্ম-শংসা প্রদান করতে তিনি অপারগ, যদি না নবান্ন বা আদালত থেকে যথাযথ আদেশ আসে। অন্যান্য পৌরসভা যে এর আগে বহুবার এ ধরনের জন্ম-শংসা মঞ্জুর করেছে, সে তথ্য তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেনি, এমনকি তিনি সে সব নথিপত্র নিজের চোখে দেখতেও সম্মত হননি।
প্রতাপ তাতে দমে না গিয়ে চেয়ারম্যানকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, সন্তানের নাম রাখা, তার নথিভুক্তি এবং জন্মশংসা প্রাপ্তি— এই সবই তাঁর আইনি অধিকার, অতএব অবিলম্বে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করা হোক, আর নয়ত অন্তত তাঁকে জানানো হোক, কোন আইন অনুসারে এ পরিষেবা তাঁর প্রাপ্য নয়। এ চিঠির প্রতিলিপি যায় নদীয়ার জেলাশাসকের কাছেও। কিন্তু, এহেন পত্রও চেয়ারম্যান সাহেবকে বিচলিত করতে পারেনি। তিনি আবারও প্রতাপকে ডেকে জানিয়ে দেন যে, তাঁর পূর্বোক্ত অবস্থানের একটুও পরিবর্তন হয়নি।
এই ঘটনার অব্যবহিত পরে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে সম্পূর্ণ ঘটনার উল্লেখ করে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়া হয়। প্রভূত সাড়া মেলে। নানা মানুষ এগিয়ে এসে প্রতাপ-মৌসুমীর লড়াইকে সমর্থন ও প্রশাসন আধিকারিকের অবস্থানকে ধিক্কার জানান। এমনকি কেউ কেউ এগিয়ে এসে এমন প্রস্তাবও দেন যে, সরকারি অনলাইন ফর্মের ধর্ম-সংশ্লিষ্ট অংশে ধর্মমুক্তি ঘোষণার সুযোগ রাখার দাবিতে যৌথভাবে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখার জন্য। ‘না-ধার্মিক মঞ্চ’-এর তরফ থেকে কয়েকজন প্রতাপের অধিকারকে সমর্থন করে চিঠি লেখেন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীকেও। সঙ্গে থাকা সাংবাদিকরাও এগিয়ে আসেন, তাঁদের বদান্যতায় বিষয়টি আন্তর্জালে ও সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে।
অবশেষে, নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। কৃষ্ণনগরের মহকুমাশাসক স্বয়ং প্রতাপকে ফোন করে জানান, তিনি খবরটি দেখেছেন, এবং ইতিবাচক পদক্ষেপও করতে চান, তবে প্রতাপকে একটি দরখাস্ত দিতে হবে তাঁর কাছে। প্রতাপ যুক্তিবাদী সমিতির সঙ্গে পরামর্শ করে একটি দরখাস্ত পাঠিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। মহকুমাশাসক তার প্রাপ্তি স্বীকার করে জানান, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তিনি করবেন, তবে কিনা, নবদ্বীপ পৌরসভার চেয়ারম্যানের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়ানো চলবে না।
বাস্তবিকই, পরের দিনই জন্ম-শংসা প্রস্তুত হয়ে যায়, এবং প্রতাপ তা হাতেও পেয়ে যায় অবিলম্বে। ফেসবুকে সেই কাগজটি হাতে ধরা অবস্থায় প্রতাপ ও মৌসুমীর যুগ্ম-চিত্রকে মহানন্দে লাইক ও শুভেচ্ছা দেন শয়ে শয়ে মানুষ। জয়যুক্ত হয় আধুনিক মানুষের যুক্তিবাদিতা, স্বাতন্ত্রবোধ এবং ধর্মমুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
বলা বাহুল্য, এ জয় শুধু প্রতাপ ও মৌসুমীর নয়, শুধু যুক্তিবাদী সমিতিরও নয়, এমনকি শুধু তাঁদেরও নয় যাঁরা এ লড়াইয়ে আগাগোড়া পাশে ছিলেন। এ জয় বাংলার সমস্ত যুক্তিবাদী মুক্তমনা ধর্মমুক্ত মানুষের জয়। এবং, আরও বেশি করে, এ জয় একটি অনন্ত সম্ভাবনাময় সদ্যোজাত শিশুর, যার কাছে এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কবিরা কবিতা রচনা করেন।
নিচে রইল সেই জন্ম-শংসাটিও। ইতিমধ্যে পোস্ট হওয়া অন্যান্য ছবির তুলনায় এটি সম্ভবত আরেকটু স্পষ্ট, অতএব কেউ প্রয়োজন বোধ করলে এটিকে জরুরি নথি হিসেবে সংগ্রহে রাখতে পারেন।
তথ্যসূত্র ও সহযোগিতা ও শংসাপত্রের ছবি: দেবাশিস ভট্টাচার্য, সম্পাদক, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি।
হেডার ছবি: https://www.telegraphindia.com/west-bengal/couple-denied-birth-certificate-of-newborn-by-nabadwip-municipality/cid/1785568
এত ভালো খবর অনেক দিন পর। এই প্রৌঢ় বয়সে মনে হয়, ইস্ যদি আমার নামটাও…..
বাহ চমৎকার!