রুচিরা গোস্বামী
লেখক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জুরিডিকাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
করোনা অতিমারি আমাদের জীবন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন জীবন, নতুন ধরনের পড়াশোনা। শিক্ষাক্ষেত্রে অনলাইন পড়াশোনা ‘নিউ নর্মাল’ হয়ে উঠেছে। অনলাইন এডুকেশন পুরোপুরি নতুন নয়। তার বেশ কিছু সুবিধে আছে, তা আগে আলোচনা করি। প্রায় এক দশক ধরে কিছু শিক্ষা-বিষয়ক অ্যাপস বেরিয়েছে। তাদের উপস্থাপনা আকর্ষণীয়, বিষয়বস্তু যথেষ্ট ভালো, এবং তা বেশ আদান-প্রদান-মুখী। পুরনো বক্তৃতা পদ্ধতির থেকে তারা আলাদা। এরকম অ্যাপস ছোট শিশুদের জন্যও আছে, আবার কলেজের ছাত্রদের জন্যও আছে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এতে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী নিজেদের গতি অনুসারে পড়াশুনো করতে পারে। নিজেদের পড়ার সময়ও তারাই স্থির করতে পারে। যে মেয়েটি হয়ত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু যাতায়াতে প্রচুর সময় ও অর্থ খরচ হচ্ছে, তার যদি একটা সস্তার ইন্টারনেট অ্যাক্সেস থাকে, তাহলে হয়ত তার পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। অথবা বাড়ির কাছের কোনও কলেজে যে কোর্স হয় না, কিন্তু দূরের কোনও কলেজে যে কোর্স হয়, বা বিদেশের কোনও ইউনিভার্সিটি যে কোর্স বিনামূল্যে করাচ্ছে, তা সস্তার ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী সহজেই করতে পারবে। এগুলোকে আপাতভাবে অনলাইন শিক্ষার সুবিধার দিক মনে হতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে মোটামুটি ধরেই নেওয়া হয়, যে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত, স্বচ্ছল, শহুরে ছাত্র-ছাত্রীরাই শুধু যেন শিক্ষাঙ্গনে আছে, যাদের নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট কানেকশন পেতে অসুবিধে হবে না৷ বাস্তবে কিন্তু আমাদের দেশের মতো দেশে, অনলাইন শিক্ষার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল ডিজিটাল ডিভাইড বা বৈষম্য।
প্রকৃত পক্ষে, মধ্যবিত্ত সমাজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই প্রযুক্তিগত বদলটি বিশেষ অসুবিধের নয়। কারণ তারা এমনিতেও অনেকটা সময় ভার্চুয়াল সমাজমাধ্যমে কাটায়। তারা অনেক সহজে জুম, গুগল মিট, ওয়েবেক্স, মাইক্রোসফট টিমস জাতীয় অ্যাপগুলির কার্যপদ্ধতি বুঝতে পারে, এমনকি প্রবীণতর শিক্ষকদের চেয়েও তারা এসব বিষয়ে বেশি সড়গড়। কিন্তু সমস্যাটা ঘটছে অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে। যখনই বলছি, ‘ছোটরা পারে’, তখন প্রশ্ন উঠছে, কোন ছোটরা পারে? যাদের হাতে প্রযুক্তি আছে, যাদের পরিবারে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, অ্যান্ড্রয়েড একাধিক পরিমাণে আছে ও ইন্টারনেট সংযোগও আছে, তাদের পক্ষেই পারা সম্ভব৷ এমনকি অনেক শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারেও এটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ধরা যাক, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মা চাকরি করেন ও ছেলেমেয়ে দুটি ইস্কুলে যায়। তারা সবাই এখন বাড়িতে। একদিকে ছেলেমেয়ের স্কুলের পড়া আছে, অন্যদিকে আছে বাবা-মার ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তাই সকলের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চলতে গেলে লাগবে চারটি নানারকমের ডিভাইস ও চারজনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট। কটা পরিবার তা জোগান দিতে সক্ষম? তা যদি পাওয়াও যায়, তাহলে শান্তভাবে কাজ করার জন্য বা পড়াশুনোর জন্য তো আলাদা আলাদা পরিসর বা পরিমণ্ডল বা আলাদা ঘরও লাগার কথা। সেটাই বা একটা পরিবারে কতজন পেতে পারে, যদি একই সময়ে কাজগুলি করতে হয়? এইখানেই অ্যাক্সেসের প্রশ্নটি জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণেই অনলাইন শিক্ষার আলোচনা ডিজিটাল ডিভাইডের আলোচনা ছাড়া অসম্পূর্ণ।
সম্প্রতি একটি খবরে প্রকাশিত হয়েছে যে হিমাচল প্রদেশে এক ব্যক্তি ছয় হাজার টাকায় তাঁর গরুটি বিক্রি করে একটি মোবাইল ফোন কিনেছেন, যাতে তাঁর দুই সন্তান, দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের, পড়াশোনা অব্যাহত থাকে। ইস্কুল থেকে জানানো হয়েছিল যে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার জন্য মোবাইল ফোন আবশ্যক৷ ব্যাঙ্ক, মহাজন ও পঞ্চায়েতের কাছে আবেদন বিফলে যাওয়ায় কুলদীপ কুমারকে তাঁর রোজগারের একমাত্র পথ গরুটিকে বিক্রি করতে হয়েছে৷ সেই টাকায় কেনা স্মার্টফোনে তাঁর দুই সন্তান লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে (ইন্ডিয়া টুডে, ২০ জুলাই, ২০২০)।
চোদ্দ বছরের দর্শিনী (নাম পরিবর্তিত) তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনমে একটি বেসরকারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা এক বেসরকারি তেল ও গ্যাস কাম্পানির কন্ট্রাকচুয়াল কর্মচারী৷ তিন মাস মাইনে না পাওয়াতে মেয়ের ইস্কুলের মাইনে তিনি দিতে পারেননি৷ ইস্কুল থেকে হোয়াটস্যাপে মেসেজ আসে যে অভিভাবকরা মাইনে না দিলে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই মাইনে না দিতে পারলে সেই ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিতে ও পরীক্ষা দিতে পারবে না৷ পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে দর্শিনী আত্মহত্যার চেষ্টা করে৷ সেই সময় তার বাবা-মা কাজে বাড়ির বাইরে৷ দর্শিনীর দিদিরা ওকে বাঁচায়। খবরটি যখন বেরোয়, তখন দর্শিনী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন (দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩ জুলাই, ২০২০)।
প্রায় একই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার নিশ্চিন্দা অঞ্চলে। বাসচালক বাবার দুই সন্তানের একটিই মোবাইল ফোন৷ বড় মেয়ের ষোলো বছর বয়স, দশম শ্রেণির ছাত্রী। লকডাউন চলাকালীন ফোনটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। অনলাইন ক্লাস না করলে পরীক্ষার ফল ভালো হবে না, এই আশঙ্কা বাবাকে জানাতে তিনি আশ্বস্ত করেন, কয়েকদিনের মধ্যেই আরেকটা ফোন কিনে দেবেন, ততদিন বন্ধুদের থেকে পড়া বুঝে নিতে৷ মেয়েটিকে এরপর মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে তার ভাই। সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে (মিরর নিউ ডিজিটাল, ২০ জুন, ২০২০)।
এমন মৃত্যু কেরলেও ঘটেছে। চোদ্দ বছরের মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো৷ লকডাউনের জেরে দিনমজুর বাবার তিনমাস কাজ নেই। মোবাইল ফোন নেই৷ খারাপ হয়ে যাওয়া টিভি মেরামতেরও টাকা নেই। অনলাইন পড়াশোনা থেকে বাদ পড়ে যাবে, এই ভয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে (দ্য হিন্দু, ১১ জুন, ২০২০)।
বেশ কিছু বছর ধরেই বর্তমান সরকার ডিজিটাল এডুকেশন ও ই-লার্নিংকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ‘ডিজিটাল এডুকেশন রিপোর্ট’ অনুয়ায়ী ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে পড়াশোনা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে কী কী হয়েছে দেখা যাক৷ পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দপ্তর অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। অনলাইন ক্লাসরুমে অ্যাক্টিভিটি-বেস্ড পড়াশুনো শুরু হয়েছে৷ ‘বাংলাশিক্ষা অনলাইন’ পোর্টালে প্রাক প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব বিষয়ের কাজ (অ্যাক্টিভিটি) তৈরি করা হয়েছে। নানা ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, সাঁওতালি ও উর্দু ভাষায় পঠনপাঠনের উপাদান তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেন দূরভাষে, ই-মেলে, হোয়াটস্যাপে ছাত্রছাত্রীদের কাজগুলি বুঝতে সাহায্য করেন৷ প্রতিটি বিষয়ের উপাদান তৈরি করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটির তত্ত্বাবধানে।
ধরে নিলাম, এই সব সত্যিই করা সম্ভব হয়েছে৷ কিন্তু এসব সুবিধা পাওয়ার জন্যও তো কোনও না কোনও ডিভিটাল ডিভাইস লাগে৷ আর আমরা জানি ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া বা তাদের পরিবারের স্মার্টফোন বা কম্পিউটার নেই৷ থাকলেও, ইন্টারনেট সংযোগ বহু জায়গায় নেই বা অতি ক্ষীণ৷ তা দিয়ে সারাদিন ক্লাস করা সম্ভব নয়। মাসের পর মাস ক্লাস করার জন্য যে ইন্টারনেট ডেটা প্যাক লাগবে, তা ব্যয়সাপেক্ষ। বহু ছাত্রছাত্রীর পক্ষে প্রতি মাসে এই বাড়তি খরচ করা অসম্ভব৷ শিক্ষকরাও দিশেহারা, কী করে সব শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছনো যায়৷ অনেকে হোয়াটস্যাপে নোট পাঠাচ্ছেন, ফোনে ছেলেমেয়েদের পড়া বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকি মাইক নিয়েও ক্লাস নিচ্ছেন লকডাউনে। কোনওটাই ইস্কুলে গিয়ে ক্লাস নেওয়ার ধারে-কাছে নয়। পশ্চিমবঙ্গে দুটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষকরা কিছু বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন, প্রধানত উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। তবে টিভির মাধ্যমে শিক্ষাদানেরও কিছু সমস্যা আছে৷ মূলত এই ব্যবস্থা একমুখী৷ পড়ুয়াদের অসুবিধে হলে তারা জানাতে পারে না৷ শিক্ষকরাও কোনও প্রশ্ন করতে পারেন না৷ তবে স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের তুলনায় অনেক বেশি পরিবারের টিভি থাকায় পড়াশোনা হয়ত সম্পূর্ণ স্থগিত হয় না৷ অন্য সমস্যাটি হল, প্রাইভেট চ্যানেলগুলির জন্য প্রয়োজনীয় কেবল কানেকশন অনেক পরিবারের নেই৷ গ্রামের দিকে তো নেই-ই। সে ক্ষেত্রে সরকারি টিভি চ্যানেলে ক্লাস নিলে হয়ত অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী উপকৃত হবে। সম্প্রতি কিছু আলোচনা চলছে ওপেন এয়ার স্কুলিং নিয়ে৷ অন্যান্য কিছু দেশে, বিশেষত ইউরোপে, এইরকম খোলা পরিবেশে ছোট ছোট গোষ্ঠী করে সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে ক্লাস শুরু করা হয়েছে৷ কিন্তু ভারতবর্ষে যেখানে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া আর স্থানাভাব এ ধরনের ইস্কুল চালু করার পথে অন্তরায়৷ গ্রামাঞ্চলে যদিও বা সম্ভব, শহরে খোলা জায়গার অভাবে ওপেন এয়ার স্কুল করা অসম্ভব৷
সম্প্রতি একটি গবেষণার ভিত্তিতে ডিজিটাল ডিভাইড নিয়ে কিছু তথ্য উঠে এসেছে৷ ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের ২০১৭-১৮ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছেন সাবির আহমেদ ও মহম্মদ জাকারিয়া সিদ্দিকি৷ এনএসএস-এর ‘হাউজহোল্ড সোশ্যাল কনসাম্পশন অন এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া’-র পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন যে ভারতের—
১) প্রতি দশটি পরিবারের মধ্যে মাত্র একটি পরিবারের (১০.৭ শতাংশ) কোনও কম্পিউটিং ডিভাইস আছে, যথা ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি।
২) গ্রাম ও শহরের বিভাজন স্পষ্ট। গ্রামে তপশিলি উপজাতির ২.৪৭ শতাংশের মাত্র এসব ডিভাইস আছে। তপশিলি জাতির আছে ৩.২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে৷ সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে আছে ৩.৫৮ শতাংশ পরিবারের।
শহরে তপশিলি জাতির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ৷ কম্পিউটিং ডিভাইজ আছে শতকরা ১২.৭ শতাংশ পরিবারে। এসটি ও ওবিসিদের অবস্থান তুলনায় ভালো— ১৯ শতাংশ। গ্রামীণ ভারতে ১৫ শতাংশের কম পরিবারে ইন্টারনেট পরিষেবা আছে৷ তপশিলি উপজাতির ৯ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট পরিষেবা আছে৷ শহরে সেই পরিসংখ্যান হল ৪২ শতাংশ (২০১৮-২০১৯)।
গ্রামাঞ্চলে ১১ শতাংশ আর শহরে ৪০ শতাংশ মানুষ যাদের বয়স ১৪ বছরের বেশি, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন৷ গবেষকদের মতানুযায়ী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার ক্ষমতা শিক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং তা সীমাবদ্ধ শহরের উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে৷ তাই শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা ডিজিটাল এডুকেশন ও অনলাইন পড়াশোনায় স্বচ্ছন্দ, তাদের অভিভাবকরা প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করতে পারেন।
আবার এ বিষয়ে লিঙ্গবিভাজনও ভূমিকা নেয়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের অসুবিধে আরও বেশি ও তা পৃথক আলোচনার দাবি রাখে।
এক্ষেত্রে কী কী করণীয়? সরকারের উচিত ডিজিটাল স্কলারশিপ দেওয়া। অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তত মোবাইল ফোন দেওয়া, মাসে মাসে ডেটা প্যাক দেওয়া। শহরে ও গ্রামে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সুরক্ষিত ফ্রি ওয়াইফাই জোন তৈরি করা শুধু পড়ুয়ারাদের জন্য। স্যাটেলাইট চালিত শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতিগুলি পুনরজ্জীবিত করা উচিত। শিক্ষকদের ডিজিটাল লার্নিং-এর প্রশিক্ষণও জরুরি। সেসবের উদ্যোগ কোথায়?
অন্যদিকে, যে ধরনের সামাজিক পরিবর্তন হল হঠাৎ করে, তাতে আমরা দেখলাম যে বাচ্চাদের স্ক্রিনটাইম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। আগে আমরা বলতাম, বাচ্চারা যেন কম টিভি দেখে, ফোনে কম হাত দেয়। এখন চাই, আরও বেশি করে তারা সেই কাজগুলিই করুক। কারণ অনলাইনে এখন শুধু পড়াশোনা নয়, নাচের ক্লাস, আঁকার ক্লাস, গানের ক্লাস— সবই হচ্ছে। এ যে শুধু চোখের সমস্যা বা স্বাস্থ্যের সমস্যা সৃষ্টি করছে, তাই নয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। অনলাইনে কী কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হয়, কীভাবে ট্রলিং বা হেনস্থা এড়াতে হয়, এগুলো এতদিন তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না।
অভিভাবকরা মূলত ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ তত্ত্বে বিশ্বাসী৷ তাঁরা হয়ত ভাবছেন যে, কোনও ক্লাস না হওয়ার চেয়ে কিছু পড়াশোনা তো হল! কিন্তু স্কুল বা ক্লাস তো শুধু জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্র নয়। সেটা একটা মানসিক আদানপ্রদানেরও পরিসর। পরস্পরের কাছে আসার জায়গা। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসবে, খুনসুটি করবে, খেলবে, পড়বে, নোটস নেবে, আড্ডা দেবে, শিক্ষকরা পরস্পরের মধ্যে গল্প করবেন, ভাবনার আদানপ্রদান হবে শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে তথা শিক্ষক-ছাত্রর মধ্যে— এগুলো যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল৷ তাই এখন শিক্ষকদের সমস্যা হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের তাঁরা দেখতেই পাচ্ছেন না। ক্লাসরুম একটা খুব সচল পরিসর ছিল। সেখানে একজন শিক্ষক দেখেন, শোনেন, বলেন, থামেন। একটা পড়া এভাবে না বুঝলে ওভাবে বোঝান। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন, ছাত্র বুঝল কিনা। ছাত্র প্রশ্ন করলে উত্তর দেন। এই পুরো পরিবেশ যেন হঠাৎ চলে গেল। এই আদানপ্রদানের জায়গাটি অনলাইন শিক্ষায় খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদর্শ ও মূল্যবোধ তৈরি করার দায়িত্বও নিয়ে থাকে। শিক্ষাক্ষেত্র ছিল একসঙ্গে বড় হওয়ার জায়গা। সেখান থেকে আমরা চলে এলাম এক চরম ব্যক্তিগত পরিসরে, যেখানে আমি আমার কম্পিউটারটির সঙ্গে একা৷ তা যে অনেকের পক্ষেই খুব সুখকর নয়, তা বলাই বাহুল্য।
একজন শিক্ষক বা কর্মচারী বা ছাত্র বা অভিভাবক যখন বাড়ি ছেড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান, তখন একভাবে তাদের অনেকে কাছে তা একটা মুক্তির জায়গাও ছিল। বিশেষত যে পরিবারগুলিতে অশান্তি আছে, গৃহহিংসা আছে, যে পরিবার অগণতান্ত্রিক, সেই পরিবারের সদস্যের কাছে স্কুল বা কলেজ হতেই পারে এক মুক্তির শ্বাস৷ শিক্ষক-ছাত্র অনেকেই সেখানে এসে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারতেন। এমনকি যে মায়েরা বাচ্চাদের দিতে বা নিতে এসে দু দণ্ড গল্পগুজব করতেন, তাদের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য৷
প্রযুক্তিগত সমস্যা ছাড়া আরও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিক্ষকদের৷ ছাত্রদের মতো, তাঁদের থেকেও অনেক বেশি স্ক্রিনটাইম আশা করা হচ্ছে। বাড়িতে অনলাইন থাকা আর স্কুলে ক্লাস নেওয়ার মধ্যে তফাত আছে। মহিলারা বাড়ির কাজ করে ক্লাস নিতে গিয়ে চূড়ান্ত মাল্টিটাস্কিং করছেন। ধরে নেওয়া হচ্ছে, তিনি বাড়িতে আছেন যখন, তখন তিনি রান্না ও অন্যান্য কাজও করবেন, ক্লাসও নেবেন, বাচ্চাকেও দেখবেন।
কিছু স্কুলে সকাল আটটার বদলে ক্লাস ছটায় শুরু হয়, ইন্টারনেট জ্যাম এড়াতে৷ গরমের ছুটি ক্যান্সেল হয়ে যাচ্ছে, কারণ ধরে নেওয়া হচ্ছে, শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা যখন বাড়িতেই আছেন, তখন আলাদা করে আর কোনও গরমের ছুটির প্রয়োজন নেই। তাই ক্লাস চলুক, কাজ চলুক।
আরেকটা প্রধান অসুবিধা সৃষ্টি করেছে নজরদারি বা সারভেলেন্স৷ আগে ক্লাসরুম অনেক বেশি স্বাধীন পরিসর ছিল। শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা করছেন বা ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে কী বলছেন, তা ক্লাসরুমেই আবদ্ধ থাকত। তার মধ্যে আসতে পারত অনেক অপ্রিয় সত্য, অনেক সমালোচনা, যা হয়ত অগণতান্ত্রিক পরিবেশে কর্তৃপক্ষের কানে খুব একটা শ্রুতিমধুর নয়। কিন্তু এখন এই আদানপ্রদান রেকর্ডেড হচ্ছে, শিক্ষক তাঁর ক্লাসের বা বক্তব্যের উপর তাই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন৷ কোথায় কীভাবে তাঁর কথা ব্যবহৃত হবে, প্রয়োজনে কোথাও তা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে কিনা, তা তিনি জানেন না৷
প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তি শিক্ষক-শিক্ষিকার গুরুত্ব হারানোর সময় শুরু হল কিনা, তা নিয়েও। রেকর্ডের লেকচার যদি সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে রক্তমাংসের শিক্ষকের প্রয়োজন কি কমবে? যে কটি ক্লাসের জন্য বক্তৃতার রেকর্ড তিনি দিচ্ছেন, তার জন্য তাঁকে মাইনে দিলেই তো হয়! আজ হয়ত প্রশ্নগুলো অবান্তর মনে হতে পারে, কিন্তু যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে, তাতে আজ থেকে পাঁচ বছর পরে অনলাইন ক্লাসের হাত ধরেই শিক্ষকদের ছাঁটাই করা হবে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলবে৷ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অন্য যে প্রয়োজনটি ছিল মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে, তা তো ইতোমধ্যেই অন্তর্হিত হতে বসেছে অনলাইন ক্লাসের দৌলতে৷
আমি শেষ করব জেএনইউ-এর সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ পাঠক ওয়্যার-এ লেখা একটি প্রবন্ধে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, তা দিয়ে। তিনি বলছেন, এই অস্বাভাবিক অবস্থায়, এই অস্থির সময়ে, ভীতির আবহে, বদ্ধ পরিবেশে, যখন সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, তখন সিলেবাস শেষ করা বা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া কি অপ্রাসঙ্গিক বা অমানবিক নয়? পরিস্থিতি যেখানে ‘নর্মাল’ নয়, সেখানে ‘নর্মাল’ পড়াশোনার পাঠক্রম আলোচনা মনে হয় বিসদৃশ। তার বদলে অনলাইন প্রযুক্তিকে কি অন্যভাবে ব্যবহার করা যায়? ছাত্রছাত্রীদের বিপন্নতা, তাদের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা কি বেশি যুক্তিযুক্ত হত না? এসময় হতে পারত অন্তর্দর্শনের, এ তাদের নতুন মূল্যবোধ শেখানোর সময় হতে পারত৷ তাদের সামাজিক বোধ তৈরি করা যেত এই ফাঁকে। তাদের বলা যেত, বাড়ির একলা বৃদ্ধটির সঙ্গে গল্প করতে, বা দূরের একলা মাসিটির খোঁজ নিতে। এই ‘এথিক্স অফ কেয়ার’-এর শিক্ষা দেওয়ার এটিই হয়ত ছিল সঠিক সময়৷ কিন্তু এটাও আবার তাদের পক্ষেই করা সম্ভব, যাদের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস আছে। কিন্তু জেলার ও গ্রামের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী যে চলে গেছেন সম্পূর্ণ শিক্ষাজগতের বাইরে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও মোবাইল যদি অবশ্যসম্ভাবী হয়, তবে তা জোগানো কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়?
শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজনীয়, বিশেষত তার ব্যবহারিক দিকগুলি নিয়ে। অভিভাবক ও ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিং নেওয়ারও সুযোগ থাকা দরকার, যাতে মনখারাপ বা আশঙ্কার কথা তারা খোলাখুলি বলতে পারে। বড়দেরও এই অনিশ্চয়তার থেকে অনেকরকম মানসিক সমস্যা হতে পারে। তার প্রভাব সন্তানদের ওপর ভাল নাও হতে পারে। অনেক অতি উৎসাহী বাবা মা অনলাইন ক্লাস চলাকালীন পাশে বসে থাকেন, এমনকি ক্লাসে দেওয়া কাজও করে দেন। এঁদের বোঝা দরকার যে এই ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তাঁদেরও হয়ত কিছু ন্যূনতম প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ডিজিটাল লার্নিং শুধু এই করোনা পরিস্থিতির সময় অস্থায়ী ব্যবস্থা নয়, স্কুলে গিয়ে ক্লাস করার পাশাপাশি ডিজিটাল শিক্ষা হয়ত পরেও চলবে। তাই এর জন্য প্রস্তুতি দরকার। বৃত্তি, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য যে বিপুল রিসোর্স লাগবে সেটা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এর দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রের।