হিন্দোল ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
কবির ব্যক্তিত্ব নিয়ে আগেরবার কথা বলেছিলাম। এই বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায়। কারণ চরিত্র বলতে আমি শিল্পীর এই ব্যক্তিত্বকেই বুঝি। এক চিরাচরিত সামাজিক দ্বন্দ্বের বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। অনেকের দাবি, আগে ভালমানুষ হতে হবে, তার পরে কবি। ভালমানুষ না হলে নাকি শিল্পী বা কবি হওয়া যায় না। শিল্প, দর্শন, বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস এই সব ভাবনার পরিপন্থী। একজন শিল্পী ভালমানুষ হতেই পারেন। কিন্তু ভালমানুষ হলে তিনি শিল্পী হবেন না, বা খারাপ মানুষ হলে তিনি ভাল শিল্পী হবেন না, এ জাতীয় সাধারণীকরণের কোনও অর্থ নেই। আসল কথা হল একজন শিল্পী, তাঁর কবি বা শিল্পীসত্ত্বার ব্যক্তিত্বকে বজায় রেখেছেন কিনা। আর সেটি করতে গেলেই, তাঁকে একপ্রকার নির্দিষ্ট চরিত্র অর্জন করতে হয়। এই চরিত্র ফুটে ওঠে তাঁর লেখায়।
শিল্পীর চরিত্রহীনতা আসলে তাঁর লেখার চরিত্রহীনতা। একজন খুনী বা ধর্ষক বা সামাজিক ভাবে অপরাধী মানুষের সাজা দিতে পারে আইন। কিন্তু একজন লেখকের সাজা দিতে পারে সময়। তবু, দেখা যায়, সময় সম্পর্কে বেশিরভাগ লেখক অকুতোভয়। যেন বা মরে গেলে কী হবে তা কি আমি দেখতে আসব? এখন যা পাচ্ছিস ভাই লুটেপুটে নে। এই ধরনের ভাবনাই একজন কবি বা লেখককে আত্মপ্রেমী করে তোলে। সেই আত্মপ্রেম তাকে বাইরের সমস্ত আকর্ষণের দিকে ঠেলে দেয় যেভাবে একজন ধনী মানুষ বা কর্পোরেট বা অফিসার বা ব্যবসায়ী মানুষের মন ছুটে যায় চকচকে লোভের ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তির দিকে। কিন্তু সমস্যাটি মনে হয়, গেঁড়ে বসে যায় তার মধ্যে সেই তখনই, যখন তিনি এই চোখে শিল্পকে বা কবিতাকে দেখতে শুরু করেন বা নিজের কাব্যজীবনকে দেখতে শুরু করেন।
ক্ষমতা এবং কবিতা বা ক্ষমতা এবং শিল্প বিপরীতার্থক। একজন যখন কবিতা লিখতে আসেন, তখন তো সামাজিক ভাবে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার বাসনা নিয়ে আসেন না। তিনি আসেন, কারণ তিনি প্রকৃত কবিতাটি লিখতে চান বলেই। যেভাবে একজন শিশু জন্মের পরে অপরাধী হয়ে যায় না। তার চোখে থাকে জগতের সমস্ত বিস্ময়কে জানার জন্য কৌতূহল, তারপর বিস্ময়, তার পর আনন্দ এবং আস্তে আস্তে বিষাদ। এই কৌতূহল, বিস্ময়, আনন্দ এবং বিষাদের যে শিশুসুলভ অথচ প্রকৃত জ্ঞানীর জার্নি চলতে থাকে কবি বা শিল্পীর জীবনে, তা কখনও থামে না। থেমে গেলেই, তিনি নিজের সৃষ্টিকেই বারবার নানা ভাবে লিখে যেতে থাকেন। কিন্তু যে কবি বা যে শিল্পী তা করেন না, তাঁরা এই কৌতূহল ও আনন্দ এবং বিষাদে আক্রান্ত হয়ে নিজেকে এক অভিশপ্ত পতঙ্গের মতোই করে তোলেন। তাঁর কিছু করার থাকে না। তাঁর জীবন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। একটা মোমবাতির মতো দশা হয় তাঁর, যা আস্তে আস্তে পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। কিন্তু আলো চলতে থাকবে অনন্তকালের দিকে।
আহার নিদ্রা এবং মৈথুনের যে পৃথিবী আছে, ইন্দ্রিয়বোধের যে ‘মার’-এর পৃথিবী রয়েছে, একজন কবি বা শিল্পী যদি সেই মার-এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে হেরে যান, তাহলে, তাঁরা কীভাবে নিজের লেখাকে, ভাবনাকে অন্য লেভেলে নিয়ে যেতে পারবেন, তা ভাবার বিষয় তো বটেই। আবার এও সত্যি জীবনে তেমন ভাবে কোনও পাপ না করেই, না অন্ধকারের অলিগলি দিয়ে ঘুরে, যে সব লোকে পাপ ও পুণ্যের কথা বলেন, তাঁরাও জানেনই না, ইনফের্নো আসলে কী! কিন্তু একজন লেখক বা কবি তো নিজের ভাবনাকে সেই জায়গাতেই নিয়ে যান, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি নীচের দিকে নয়, তাকাতে পারেন উপরের দিকেই। নরকের সূর্যোদয় যেমন তিনি দেখতে পান, তেমন তিনি দেখতে পান নরকের অন্ধকারও। আর এইভাবেই, জুতোর ফিতে বাঁধার সময়েও যিনি আসলে একজন কবি, তাঁর পাখির চোখ আসলে কবিতাই। ক্ষমতা নয়। যদি কবিতার মাধ্যমে ক্ষমতাই হয় মূল লক্ষ্য, যদি ক্ষমতার মাধ্যমে পেশী বা শক্তিপ্রদর্শন বা নিয়ামক হয়ে ওঠার আত্মপ্রসাদ তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে তিনি কবিতা থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে চলেই গেছেন ধরে নেওয়া যায়।
তাহলে প্রশ্ন হল, যে কবি, কবিতা থেকে ক্ষমতার দিকে বহুদিন আগেই চলে গেছেন, সেই কবি সম্পর্কে আমরা আলোচনাই বা করব কেন? কারণ আমরা এখনও এই গ্লোবালাইজড দেশে একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখেছি। আর সেই সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় এখনও মোড়ল বা পুরোহিত বা মন্ত্রী বা নেতার কথার মূল্য অপরিসীম। এই সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোয় পুরো বিষয়টিই চলে হুইমস-এর উপরে, চলে ইচ্ছে এবং কর্তৃত্বের উপরে। ফলে, যে সমস্ত কবিরা ক্ষমতার দিকে হাঁটতে শুরু করেন, তাঁদের আমাদের সমীহ করে চলতেই হয়। কারণ তাঁদের হাতে আমাদের সামাজিক সফলতার চাবিকাঠি। যতই আমরা পারিনি বলে ভাল্ল কেরিয়ার হয়নি, তবু ইচ্ছে তো কবি লেখকদেরও হয় উষ্ণ এবং বাতানুকূল একটা জীবনের, যেখানে হাতে সামান্য একটূ ক্ষমতা থাকলে অন্তত এইটুকু নিজেকে বলা যাবে, কবিতা লিখে আমি সামাজিক ভাবে একদম ব্যর্থ নই।
কিন্তু…কিন্তু…কিন্তু… কবিতাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কারণ কবিতা তো মৃত্যুর সামনে বসে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার মতো দুরূহ একটা কাজ। মৃত্যুর কাছে যেমন্ সামাজিক রণ-রক্ত-সফলতার কোনও মূল্য নেই, যেমন মূল্য নেই ভালমানুষী বা খারাপমানুষীর, তেমন মূল্য নেই ক্ষমতা এবং ক্ষমতাতন্ত্রের। ইডিপাসকেও নিজের চোখ খুবলে নিতে হয়েছিল। কেউ সময়ের করালগ্রাসের বাইরে নয়। আর কবিতা তো তার সঙ্গে কথাবার্তা চালাবেই, কারণ কবিতা তো লিখিতই হয়েছে আত্ম-অনুসন্ধানের জন্য।
সুতরাং সামাজিক ভাবে ক্ষমতাবান মানুষ হয়ে ওঠা আমাদের সাবকনসাসে থাকলেও, একজন কবি বা শিল্পীর ব্যক্তিত্বের প্রধান জায়গাটি হল, সেই ক্ষমতাকে সচেতন ভাবে পরিহার করা। কিন্তু তাঁর জীবনের লক্ষ্য কখন হয় ক্ষমতাতন্ত্র? যখন তিনি বুঝতে পারেন আর যাই হোক, কবিতাটি তাঁর হয়নি, হবেও না। শিল্পের লোক তিনি নন। তিনি প্রশাসক। তিনি মহান। কিন্তু কবি নন।
অনেকদিন তো ভাই দেখলাম, এবার সত্যি কথাগুলো আমাদের স্বীকার করার সময় আসেনি কি? এটা হল সবচেয়ে বড় মিডিওক্রেসির লক্ষণ, যে, ক্ষমতাকে আমরা একটা ইউটোপিয়ান চোখে দেখব। ক্ষমতার সঙ্গে ইউটোপিয়ার টমাস মুর কৃত সম্পর্ক যে অনুসৃত হয়নি, তাও সকলের জানা। আমার মনে হয়, ব্যক্তিগত জীবন যাই হোক না কেন, একজন কবির যাবতীয় সমস্যার মূলে তার ক্ষমতাপ্রেম এবং সামাজিক সফলতার প্রতি অদম্য কামনা।
কবিতা লিখতে আসার সময় মেনে নিতে হবে যে কবিতা আমাদের একা করবে, ধ্বংস করবে, নিঃস্ব করবে। হয়তো কবি পো-র মতো বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকবে রাস্তার ধারে নর্দমায়। একটিও কবিতা না লিখতে পেরে মৃত্যুর পরে গান স্যালুট নিতে নিতে বিদায় নেওয়ার চেয়ে মনে হয় এই একা এডগার অ্যালান পোর মৃত্যু অনেক বেশি প্রাপ্য।
কবি ক্ষমতার বাইরে থাকেন। ক্ষমতা তাকে সন্দেহ করবে, নিঃস্ব করবে, অন্তরীণ করে রাখবে, হত্যাও করতে পারে। কিন্তু ক্ষমতা তাকে আত্মীয় করতে পারবে না। কখনওই না।
(ক্রমশ)