প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
সাপ সাপ সাপ। লতা লতা লতা।
সাপ লতা সাপ লতা সাপ লতা।
সাপ উচ্চারণ করলেই তার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হবে লতা। নইলে অশুভ কিছু ঘটবে। বিশেষত সন্ধেবেলায় তো ‘সাপ’ শব্দটা উচ্চারণ করাই যাবে না।
এই সংস্কার বাবা বা মায়ের থেকে শেখেনি সে। শিখেছে রমার কাছ থেকে।
তার বাবা ‘সাহেবচাটা’। পাড়ায় সকলে তা-ই বলত। পাড়া মানে তার কলকাতার পাড়া। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির গলির ভেতর তাদের অট্টালিকাসম বাড়ি। ঠাকুরদা ভবেশচন্দ্র মুখুজ্জে স্থানমাহাত্ম্যেই বোধহয় প্রথমদিকে শাক্ত হয়েছিলেন এবং তারপর তন্ত্রচর্চা শুরু করেন আর সেসব তামসিক কাণ্ড দেখে তস্য পিতা সুরেশচন্দ্র বিরক্ত হয়ে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করতে উদ্যত হন। ওদিকে ভবেশের মা যোগমায়া ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ডেকেটেকে প্রায়শ্চিত্ত করানোর চেষ্টা করতে লাগলেন আর কাঁদতে লাগলেন পাড়া মাথায় করে। মানে সব মিলিয়ে সে একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড…
তন্ত্র ছেড়ে ভবেশ হঠাৎ ব্রাহ্ম হয়ে গেলেন। প্রথমে আদি, পরে নববিধান।
এরপর আবার কখন মনের ভাব পালটে ফেলে ছেলে, দুম করে যদি সন্ন্যাস-টন্যাস নিয়ে ফেলে— এসব ভেবে ভবেশের বিয়ে ঠিক করে ফেললেন সুরেশ। হিন্দুমতেই হল সে বিয়ে। সাত সন্তান জন্মাল, সবাই মেয়ে। ব্রাহ্ম ভাবধারা জলাঞ্জলি দিলেন। নিজের কৌলীন্য স্মরণ করে আবার বিয়ে করলেন। এবারে দুটি সন্তান, দুটিই ছেলে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেয়াদপটি হল বড়টি, দীনেশ। দীনেশচন্দ্র মুখুজ্জে।
ছেলে বখে যাচ্ছে দেখে ভবেশের দ্বিতীয়া স্ত্রী অন্নপূর্ণা অনেক চেষ্টা করলেন সংসারে ভবেশের মতি ফেরাতে। কিন্তু ভবেশ ততদিনে দ্বিতীয় বিয়ে করে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন যে তিনি আপন কুলরক্ষা করে নিজের সাংসারিক দায়িত্ব সমাধা করেছেন। এবার এসব মায়া ত্যাগ করলেই হয়। তাই তিনি কুলীন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ত্যাগ করে আবার নিরাকার ব্রহ্মের সাধনায় ফিরেছেন। বাড়িতে ব্রহ্মসঙ্গীতের আসর বসে। তবে কিনা চাদরের তলায় পৈতেটা লুকিয়ে রেখেছেন। সুরেশ, তাঁর পিতা, গত হয়েছেন বেশিদিন হয়নি। শান্তি-স্বস্ত্যয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু এসব হিন্দু রীতিনীতিতে আত্মা শান্তি পায় কিনা তিনি ঠাহর করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় পৈতে ছিঁড়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এর মধ্যেই দীনেশ সংস্কারের বাইরে চলে যায় ক্রমে। তারপর হঠাৎ একদিন কোনও বন্ধুর বাড়িতে শেরি খেয়ে বাড়ি ফিরে উঠোনে দাঁড়িয়ে বাপ আর কেশব সেনকে অশ্রাব্য গাল পাড়তে লাগলেন, ‘ভবেশ, ইউ ওল্ড রাসকেল, শুনে রাখ, আমি হিন্দুও নই ব্রাহ্মও নই— আমি সাক্ষাৎ ব্রহ্ম। নয়তো বকরাক্ষস! কিছু একটা হব। আমি সাহেবদের মতো মদ খাব, গরু খাব, অজাচার করব। তোর কুলের মুখে কালি দেব।’
ভবেশ তাঁর নিজের ঘরে বসে একমনে ভাবছিলেন নিজের বিচিত্র ধর্মজীবনের কথা। ভাবছিলেন, তিনি আদৌ মোক্ষ পেলেন কিনা! এমন সময় উঠোনে ছেলের এহেন হুঙ্কার শুনে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়লেন, অন্নপূর্ণা ‘ওগো আমার ছেলের ওপর কোন রাক্ষুসী ভর করল গো’ বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, ভবেশের প্রথমা স্ত্রী সুরবালা তাঁর তিন আইবুড়ো কন্যাকে (তাঁর সাত কন্যার মধ্যে বাকিদের বিবাহ হয়ে গিয়েছিল) তেতলার ঘরে বন্ধ করে পান চিবোতে চিবোতে দোতলার বারান্দায় ক্রন্দনরতা অন্নপূর্ণা এবং উঠোনে তাঁর সৎ ছেলের পানে চেয়ে রাঙা ঠোঁট বেঁকিয়ে ‘মরণ’ বলে বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে ‘কী অশৈলী! কী অশৈলী!’ বিড়বিড় করতে করতে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে দোর দিয়ে হামানদিস্তা দিয়ে কী একটা ছাঁচতে লাগলেন সশব্দে! দীনেশের ভাই গোবিন্দ হাঁদাকার্তিকের মতো শূন্য দৃষ্টিতে দাদার কীর্তি দেখতে লাগল। চাকরবাকররা ব্যস্তসমস্ত হয়ে দীনেশকে চ্যাংদোলা করে ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। দীনেশ বলতে লাগল, ‘হে হে সে যা পেইন্টিং! রামবাগানে অমন একটিও দেখিনি! পেন্টিং অবশ্য কোনও ফিরিঙ্গি সায়েবের আঁকা। ছবিতে যে ন্যুড লেডিকে দেখলাম তিনিও বোধহয় মেমই হবেন। আমি মেম বে করব, বুঝলি ইডিয়ট ভবেশ!’
ভবেশ এতক্ষণ ভাবছিলেন, যে কাপালিকের কাছে দীক্ষা নিতে নিতে তিনি ব্রাহ্ম হয়ে যান, সেই তিনি, নাকি তাঁর পিতা— কার অভিশাপে তাঁর বংশপ্রদীপের এই হাল হল?
হঠাৎ ‘আমি মেম বে করব, বুঝলি ইডিয়ট ভবেশ’— এ কথাটা তাঁর কানে তড়াক করে লাগল।
তাঁর বাবা তাঁর মতিভ্রম সামলানোর জন্য যে পন্থা নিয়েছিলেন, তা কাজে তো লেগেছে! ভবেশ তো সন্ন্যাসী না হয়ে সংসারীই হয়েছেন। তাহলে তার লম্পট ছেলেকেও তো এই পথেই বাগে আনা যায়!
কিন্তু দীনেশের সঙ্গে যদি সুরবালা বা অন্নপূর্ণার মতো পতিপ্রাণা (বা উপায়ান্তর না দেখে পতিপ্রাণা হয়েছেন এমন) কারও বিয়ে হত, দীনেশ আদৌ পালটাত না— একথা যে কোনও বিচক্ষণ ব্যক্তি বলতে পারবেন।
দীনেশের সঙ্গে বিয়ে হল লক্ষ্মীর। ভবেশের ব্রাহ্মসমাজের বন্ধু আশুবাবুর মেয়ে। লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী, রূপে লক্ষ্মী নয়। স্বভাবে তো নয়ই। বয়সে দীনেশের চেয়ে একটু ছোট। আইবুড়ো মেয়ের পক্ষে বয়স খানিক বেশিই বটে। বেথুন সাহেবের ইস্কুলে পড়াশোনা করেছে। সময়বিশেষে চোখের দৃষ্টি দেখে বেগড়বাঁই করার সাহস উবে যেতে পারে অনেক তাবড় পুরুষসিংহের।
ফুলশয্যার রাতে দীনেশ সদর্পে বলল, ‘বাপ ভেবেছে আমার ঘাড়ে একটা মেয়েছেলে ঠুসে দিলেই আমি বাপের মতো সাত্ত্বিক হয়ে যাব! কিন্তু আমি পষ্টাপষ্টি বলে দিচ্ছি, আমায় আলগা পিরিত দেখিয়ে লাভ নেই। আমি সকালে ঘুমোই, দুপুরে গিলেকুটে আবার ঘুমোই, তারপর সন্ধেবেলা আতর গায়ে ইয়ারবক্সিদের সঙ্গে বেরোই। রাঁঢ়বাড়ি যাই। বাঁধা রাঁঢ়ও আছে। ফুর্তি করি। গান শুনি। বাপ-ঠাকুরদার ব্যবসা আছে, সেসব অনন্তবাবু দেখেন। টাকাপয়সার অভাব নেই। তাই খাওয়াপরা জুটে যাবে। কিন্তু আমার ব্যাপারে বেশি নাক গলাতে এলে ফল ভাল হবে না। আর যদি কখনও তোমার ঘরে আসতে ইচ্ছে হয়, এমনিই আসব। আমার পায়ে পায়ে ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকবে না! আমি তেমন মেনিমুখো মিনসে নই, যে মাগের আঁচলে লেপটে থাকব। যাক, আজকের সন্ধেটা নষ্ট হয়েছে। আমি এখন বেরুব!’
‘কোথায় যাবেন?’
লক্ষ্মী আচমকা প্রশ্ন করে বসল!
দীনেশ শুধুই অবাক হল তা-ই নয়, ওর গা ছমছম করে উঠল। লক্ষ্মীর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, যা শুনে ভয় ধরতে বাধ্য।
‘কেন! রামবাগান!’
দীনেশ মিনমিনে স্বরে বলল, সামান্য ছদ্ম পৌরুষ দেখিয়ে।
এক ঠাস থাপ্পড়ে সেই পৌরুষের বালির বাঁধ খসিয়ে দিল লক্ষ্মী।
‘যাবেন না।’
দৃপ্ত, অথচ নীচুস্বর!
‘এত বড় সাহস তোর মাগি! তুই আমাকে হুকুম করিস!’ গলার মধ্যে কাঁপুনি ভরপুর। তবু ছোটখাটো গর্জন ছাড়ল দীনেশ।
‘মুখ সামলে কথা কন। ওই ভাষায় কথা বলবেন না আমার সঙ্গে! এইটে আপনার কুঠিবাড়ি নয়!’
দীনেশের হাঁ মুখের যা দশা হল, তা দেখলে ভবেশ নিশ্চিত হতেন, সাকার হোক বা নিরাকার— ব্রহ্ম ওখানেই আছেন। বিশ্বরূপ দেখা হয়ে যেত তাঁর।
বেফাঁস একটা প্রশ্ন করল দীনেশ।
‘মারবি নাকি?’
গলার স্বরের পর্দা নেমে গেছে খাদে।
‘তুইতোকারি করছেন কেন?’
কী প্রশ্নের কী উত্তর! তাঁর বাপ-ঠাকুরদা এমন প্রশ্ন এমন গলায় করলে, পাপের ভার নিয়েই বউরা একগলা গঙ্গাজলে গিয়ে দাঁড়াত। এ বউ না তাড়কা রাক্ষুসী! লক্ষ্মী না চামুন্ডা!
দীনেশ অতি কষ্টে বিনয়ী স্বরে বলল, ‘আপনি আজ্ঞে করব?’
গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে লক্ষ্মী বলল, ‘তাই করা উচিত! আমি যখন আপনি বলছি আপনাকে!’
ভবেশ কেন সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন, দীনেশ তা বুঝতে পারল। সংসার বিষম বস্তু। আজ, এখনই তার বিবাগী হতে ইচ্ছে করছে। তার এতদিনের অহঙ্কার একটু চুপসে গেল। সে বুঝল, তার পৌরুষ বলে কিছু তৈরিই হয়নি।
লক্ষ্মী আবারও বলল, ‘রামবাগানে যাওয়ার অনেক সময় পাবেন। আজ যাবেন না। ভালো দেখায় না। আর হ্যাঁ, রামবাগানেই যদি যাতায়াত করেন, তবে আমার ঘরে আর ঢুকবেনই না। জোর করলে ফল ভালো হবে না।’
দীনেশের ‘মা গো আমায় বাঁচাও গো’ বলে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সে আর বেইজ্জত হবে না! সে ভাবতে লাগল এই কথার মোক্ষম জবাব কী দেওয়া যায়?
কিন্তু সে যা বলল, তাতে লক্ষ্মীর অট্টহাসি শুরু হল। সে বুঝল, সত্যিই সংসারের মায়া ত্যাগ করার সময় এসে গিয়েছে তার। অবিশ্যি যে কথা সে বলেছিল, তা শুনে ঘোড়ায়ও হাসবে।
‘বাবা কুলপ্রদীপ চান। তাই বিয়ে দিয়েছেন। সন্তানাদি না হলে তোমাকে… মানে আপনাকে…’ এই জায়গাটায় একটু থমকেছিল সে, ভেবেছিল লক্ষ্মী বোধহয় খানিক লজ্জা পেয়ে আপনি-আজ্ঞে করতে বারণ করবে তাকে।
সে গুড়ে বালি! লক্ষ্মী মুচকি হাসে। হেসে বলে, ‘থামলেন কেন? বলুন!’
ওই গোলমেলে হাসি দেখে আরও ঘাবড়ে যায় দীনেশ। আমতা আমতা করে বলে, ‘না… মানে… তাহলে আপনাকে ত্যাজ্য করে আমাকে নতুন বউ নিয়ে আসতে হয়!’
লক্ষ্মী হাসতে শুরু করেছে সেই থেকে। আর থামছে না। দীনেশ একবার ভয় পেল, এমন হাসি শুনে অন্নপূর্ণা না উঠে আসেন। তিনি বোধহয় সারারাত্তির খোকার ঘরে কান পেতেই রয়েছেন। এসব কথাই কি তিনি শুনছেন? শুনলে নিশ্চয় তিনি তার বিহিত করবেন!
এরপর লক্ষ্মী যা উত্তর দিল তাতে হাড় হিম হওয়ার জোগাড় হল দীনেশের!
‘আপনিই তো বল্লেন যখন ইচ্ছে হবে আসবেন! তা তার মাঝে যদি অন্য কেউ আপনার কুলরক্ষা করতে চলে আসে, তখন কী হবে?’
দীনেশ জ্ঞান হারাত! কিন্তু এর পরের বাক্যটা শুনে তার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি রি রি করে উঠল!
গলার স্বরটা একটু গম্ভীর করে লক্ষ্মী এবার বলল, ‘রামবাগানে যখন যাচ্ছেন, ওখানকার কাউকেই বলুন আপনার কুলপ্রদীপকে পেটে ধরতে! আমি আপনার কুলরক্ষা করতে আসিনি!’
একবার, একবার দীনেশের খুন চেপেছিল সে রাতে। কিন্তু লক্ষ্মীর চোখ ছিল দ্বিগুণ খুনে।
দীনেশ এক পা-ও এগোতে সাহস পায়নি। হাতে করে কী ধরে আছে পেছনে? আঁশবঁটি নয় তো?
দীনেশ রামবাগান যায়নি সে রাতে। ভবেশ এবং অন্নপূর্ণা তো বটেই, ভবেশের প্রথমা স্ত্রী সুরবালা, তাঁর কন্যারা, দীনেশের ছোটভাই গোবিন্দ— সকলেই চমকাল! হল কী! এক রাতেই বউসোহাগী হয়ে উঠল নাকি দীনেশ!
যত দিন গেল, বোঝা গেল, বড়সড় গোলমাল আছে। দীনেশ বাড়ি থেকে বেরোয় না। সে রাতে লক্ষ্মীর শেষ কথাটুকু শোনার পর থেকে তার বাকশক্তি হারিয়ে গেছে। সে খুঁটে খুঁটে ভাত খায়। কোনওমতে ঘুমোয়। সারা সন্ধে ছাদে রাখা আরামকেদারায় বসে থাকে। পানদোষ উধাও! মেয়েদোষ উধাও!
লক্ষ্মী স্বামীর সব খবরই রাখে। উপর উপর দেখলে মনে হয় কোনও খোঁজই নেয় না।
অন্নপূর্ণা দু দিন প্রকাশ্যে বউকে ভর্ৎসনা করার চেষ্টা করলেন। বউয়ের দৃষ্টি দেখে তিনি বুঝলেন, তাঁর ছেলে এমনি এমনি এমন ছন্নছাড়া হয়ে যায়নি। এমন দৃষ্টি দেখলে মনের সব শান্তি নষ্ট হয়। অথচ মুখে মুখে বেশি কথাও বলা যায় না।
অন্নপূর্ণা উপায়ান্তর না দেখে বাড়ির কাজের লোকদের কাছে বউয়ের নামে শাপশাপান্ত শুরু করলেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, শিগগির গৃহকর্ত্রী হয়ে উঠছে লক্ষ্মী। অন্নপূর্ণার অকর্মণ্যতার সুযোগ নিয়েই।
কাজের লোকরা নতুন গৃহকর্ত্রী পেয়ে খুশিই হল। সংসারের হাল যেন ফিরছে! এমন মালকিনের নামে আড়ালেও নিন্দেমন্দ করা পাপ!
ভবেশ, সুরবালা আর তাঁর মেয়েরা— এরা আপন খেয়ালে থাকত। বুঝত, গোলযোগ কোথাও একটা ঘটছে, কিন্তু কোথায়, তা বোঝার চেষ্টাও করত না!
বাড়িটা ক্রমে পিশাচসিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল যেন।
কিন্তু বৌঠাকরুণের সঙ্গে ভাব জমিয়ে লক্ষ্মীর প্রথম বরফ গলাল গোবিন্দ। সে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। লক্ষ্মী তাকে পড়ানো শুরু করল। ক্রমে, গোবিন্দর বন্ধুবান্ধব হল। তারাও ঢুঁ মারত গোবিন্দর এই স্নেহশীলা বৌঠাকরুণের কাছে। কাঁসার থালায় করে সকলকে লুচি আলুভাজা আর সন্দেশ খাওয়াতে ভালবাসত লক্ষ্মী। বহিরঙ্গে কঠিনহৃদয় হয়েও লক্ষ্মীর বাৎসল্যরস যে এত তীব্র, তা গোবিন্দ ছিল বলেই বোঝা গেল।
এইভাবেই এসেছিল রমেন। রমেন্দ্রনাথ দেব! ব্রাহ্ম। পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ। গোবিন্দ তাঁকে একদিন হাত ধরে নিয়ে এসেছিল তার বৌঠাকরুণের সঙ্গে আলাপ করাতে।
দীনেশ একদিন ভবেশকে গিয়ে সোজাসুজি বললে, ‘বাবা। বিলেত যাব। ব্যারিস্টারি পড়তে।’
ভবেশ নির্বিকার চিত্তে রাজি হয়ে গেলেন। তাঁকে এতদিনে বৈরাগ্য খানিক পেয়ে বসেছে।
দীনেশ গেল বিলেত। গোবিন্দও নিজের মতো কলেজ এবং পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বৌঠাকরুণের কল্যাণে তাকে পড়ার নেশায় পেয়েছে। কিন্তু সেই বৌঠাকরুণের সঙ্গে তার যোগাযোগ খানিক কমে গেল। লক্ষ্মীর অবশ্য এসবেই কোনও প্রতিক্রিয়া হল না।
একদিন শুরু হল ফিসফাস। বড়সড় কেচ্ছা হয়েছে কিছু মুখুজ্জেবাড়িতে।
গল্পটা ছোট করে বললে দাঁড়ায়, রমেন দেবকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দীনেশ এখনও বিলেতে।
আর লক্ষ্মী নাকি গর্ভবতী।
কোত্থেকে একদল ব্রাহ্মণ এসে ভবেশকে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেল– এই অনাচারের বিহিত করতেই হবে। কেউ কেউ তাঁর কানে তুলল, রমেন আসত দুপুরবেলা, আর এলেই লক্ষ্মী দোর দিত। এই কানভাঙানিদের মধ্যে অন্নপূর্ণাও ছিলেন বটে!
ভবেশ বিহ্বল হয়ে পড়তেই পারতেন, কিন্তু তিনি লক্ষ্মীকে এই নিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। একদিন দুপুরে খাওয়ার পর শুধু তাঁর পেটে ব্যথা উঠল। ডাক্তার এল।
লক্ষ্মী গর্ভবতী নয়!
কিন্তু এই কেচ্ছা কানে গিয়েছিল লক্ষ্মীরও। এবং এই ডাক্তারি পরীক্ষা যে আদতে অগ্নিপরীক্ষা তা বুঝল সে।
অপমানে অধীর হয়ে সে সোজা শ্বশুরমশায়ের ঘরে গিয়ে দোর দিল। কী বলল কেউ জানে না, তবে তার পরের দিন শ্বশুরমশায় চিঠি লিখে ভোররাতে সংসার ছাড়লেন।
অন্নপূর্ণা চিৎকার করতে লাগলেন। ‘অলক্ষ্মী! তুই মরিস না কেন!’
লক্ষ্মী মনে মনে হাসল। এত সহজে তো সে মরবে না! মরলে সবাইকে মেরে মরবে! দীনেশ ফুলশয্যার রাতে তাকে অপমান করেছিল। রমেন্দ্রনাথ দেব তার সঙ্গে ভাল সম্পর্কের সুযোগ নিতে চেয়েছিল। ভবেশ কানাঘুষো শুনে তার পরীক্ষা নিতে চেয়েছিল। সকলকে সে যোগ্য জবাব দিয়েছে! তবে অন্নপূর্ণাকে সে মায়া করে! কিন্তু গোবিন্দ? সে-ও অবিশ্বাস করল তার বৌঠাকরুণকে?
মনের কোণে একটু দুঃখ দেখা দিল বটে, তবে প্রশ্রয় দিল না লক্ষ্মী।
দীনেশ বাবার সংবাদ পেয়ে ফিরল বিলেত থেকে। একদম অন্য মানুষ সে। ঢের সংযত। ঢের মার্জিত। ঢের আত্মবিশ্বাসী। তবে দেশীয় সব বিষয়েই তার চূড়ান্ত অবজ্ঞা। নেহাৎ এদেশেরও মাথায় রানি ভিক্টোরিয়ার হাত, নইলে সে দেশে ফিরতই না!
লক্ষ্মীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্বাভাবিক হল কিনা বোঝা গেল না। তবে লক্ষ্মী এবারে সত্যি গর্ভবতী হল।
জন্মাল লতা।
সাপ সাপ সাপ। লতা লতা লতা!
এ কথা তাকে শিখিয়েছিল পড়শি বাড়ির মেয়ে রমা। তার দশ বছর বয়সে।
‘কেন? সাপ দেখলেই লতা কেন বলতে হয়?’ লতা হেসে জানতে চেয়েছিল রমার থেকে।
‘জানি না বাবা! বলতে হয়!’ রমার উত্তর ছিল।
‘কে শিখিয়েছে তোকে?’ লতা হেসে জানতে চেয়েছিল। লক্ষ্মীর যুক্তিবাদী শিক্ষাই হোক বা বাবার ব্রিটিশপ্রেম, ছোট থেকেই কুসংস্কার মানতে মন চাইত না লতার।
‘খগেনদা!’ রমা বলল। ‘ওকে ওর বাবা শিখিয়েছে এটা।’
নিজেদের বাড়ির ছাদে জড়িয়ে থাকা একটা আগাছার থেকে একটা পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে লতা বলল, ‘সেও তো তোদের বাড়িতেই থাকে। আচ্ছা খগেনদারা কি সবাই তোদের বাড়িতে থাকে? ওদের নিজেদের বাড়ি কোথায়?’
রমা অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
লতা জিজ্ঞেস করে, ‘কী হল?’
‘খগেনদা বলে সাপ দেখলে, বা সাপের নাম করলে ওকে লতা লতা বলতে হবে না। ও ঠিক বেঁচে যাবে।’ ঘোরে বলে রমা।
‘কী করে?’ লতার বিস্মিত প্রশ্ন।
‘ওর হাতে কবচ আছে যে। আংটি!’
‘ধুর!’ কথাটা হেসে উড়িয়ে দিতে চায় লতা।
‘সত্যি রে! আমি দেখেছি। এই আংটিটা কেমন যেন অন্যরকম।’
খিলখিল করে হাসে লতা।
‘কেমনতর শুনি!’
রমার চোখ চিকচিক করে ওঠে। ‘সূর্যের আলোয় খগেনদা আমাকে ওই আংটি দেখিয়েছে। আংটিটার ঠিক মধ্যিখানে একটা ঝলমলে হীরে! জানিস লতা, হীরেটার রংটা কেমন যেন অদ্ভুত! নীল, অথচ ঠিক নীল নয়।’
রমা যা বলতে চাইল, অথচ বোঝাতে পারল না, হীরেটার রং আদতে আকাশি!
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহেশ সেন আসছেন শুনে ডাক্তারবাবু তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠলেন। চোখেমুখে জল দিয়েই ছুটে গেলেন। কাগজপত্রর দরকার ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজেই মেয়েটিকে নিয়ে যেতে এসেছেন। তাড়াতাড়িই সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
ম্যাজিস্ট্রেটের পাশে বসে দারোগা অবনীমোহন।
‘এত সকাল সকালই রওনা দেবেন?’
একগাল হেসে জানতে চাইলেন ডাক্তার ঘনশ্যাম সরকার।
‘কেমন আছে?’ ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই নির্লিপ্ত স্বরে জানতে চাইলেন মহেশ সেন।
‘ভালোই। জখম সেরে গেছে। আপনার কথামতো পুরোপুরি সেন্সে রাখিনি।’
‘ভালো করেছেন।’ ম্যাজিস্ট্রেট উঠে দাঁড়ালেন।
ডাক্তার আবার সব বন্দোবস্ত দেখতে গেলেন। অবনীমোহন বললেন, ‘ওকে কি লালবাজারে ক্রস করা হবে স্যার?’
ম্যাজিস্ট্রেট গম্ভীরভাবে শুধু বললেন, ‘হুম!’
ডাক্তার ফিরে বললেন, ‘এই কাগজটায় একটা সই করে দেবেন শুধু। এতে লেখা আছে, আপনি নিজেই আসামি লতা মুখোপাধ্যায়কে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।’
নির্বিকারে সে কাগজে সই করলেন ম্যাজিস্ট্রেট মহেশ সেন।
আবার আগামী সংখ্যায়