মৃণাল চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
থেকে যাবে! এখানে থেকে যাবে!
আমার দুরকমের অনুভূতি হল, একই সঙ্গে। মনটা চিনচিন করে উঠল আমার পছন্দের লিস্ট থেকে আর এক বিদায়যাত্রীর বলা কথাগুলোয়। আর এক ভয়াবহ বিপন্নতার চাপে যদি আমাকেও থেকে যেতে হয়। সপুল্টুশ? এই নদী, যা কিনা নদী নয় পুরনো মানুষদের কাছে। এই হাট, যা অবাস্তব, আর এই স্লো-মোশন সারাজীবন সঙ্গে নিয়ে থেকে যেতে হবে!
মহিলাকে কেউ ‘জান’ বলে ডাকল। অন্য একটা মেয়ে ডাকল। ওর নাম ‘জান’! খুব নামী সব শায়েরি মনে পড়তে লাগল। বিশেষত ‘মেরি জান’ আমার খুব পছন্দের ডাক। আমি আমার মানসীদের এই নামে ডাকতে চাই। কী বাজে যোগাযোগ। কী করুণ। আমার স্বপ্ন এসে দেখা দিল এই দিগন্ত-পেরনো হাটে ‘মেরি জান’ হয়ে, অথচ ও এখানে থেকে যেতে চায়!
আমি অনেক ভেবে দেখলাম, এখানে থাকতে পারব না। তাছাড়া কাল বলেও তো কিছু নেই মনে হয়। হয়তো এটা এক আবহমান রাত্রির বাজার। পৃথিবীর সময়ের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। তাহলে কি এই পসরা বেচতে আসা মানুষরা আর ফিরতে পারবে না? অনন্ত কেটে যাবে, আর ওরা ভাববে একটা মাত্র রাত? সন্তোষ পালের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
মিষ্টির দোকানের সামনে একইভাবে বসেছিলেন তিনি। আমি একটু দূর থেকে ডাকলাম। অন্যদের সামনে আলোচনা করতে চাই না। উনি এলেন। সেই প্রসন্ন মুখের হাসি।
–এখানে সকাল হয়? বেলা বাড়ে? সন্ধে গড়িয়ে এমন রাত আসে? নাকি এটা শুধুই রাতের বাজার?
–আপনাকে তো ফিরে যেতে হবে। এসব নিয়ে কেন ভাবছেন?
–জানতে ইচ্ছে করছে।
সন্তোষ পালের হাসি কিছুটা ম্লান হয়ে এল।
–আমি বুঝতে পারিনি আপনি একা আসবেন না। সত্যিকারের একা মানুষরাই এই হাটে আসতে চায়। তাই বিধান। আমি ভুল করেছিলাম। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে আপনাকে আমি ভুল চিনেছিলাম।
–আমি ঠিক সঙ্গী নিয়ে আসিনি। আমি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতে পারি।
–সঙ্গী নয়? যে আপনার স্মৃতির কেয়ারটেকার সে সঙ্গী নয়?
‘স্মৃতির কেয়ারটেকার’! অবয়বহীন পুল্টুশকে মনে পড়ল।
–আপনি কিছুই ভুলতে পারবেন না। উনি ঠিক আপনাকে মনে করিয়ে দেবেন। এখানে যারা আসে, ফেরার পর তাদের কিচ্ছু মনে থাকার কথা নয়। এদিকে এখানে আমরা পাঁচজনের বেশি রাখতে পারি না। স্মৃতি নিয়ে এখানে থাকা যায় না। আপনাকে ফিরে যেতে হবে।
–কিন্তু ফিরে গেলেও এই রাতটা আমার মনে থাকবে। তাহলে?
আমার দিকে তাকালেন সন্তোষ পাল। হাসলেন। আমি বুঝলাম, কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি পাব না।
আমরা একদম অন্যদিকে এসে গিয়েছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। এখানে তেমন কোনও দোকান নেই। একটা স্টলে শুধু একটাই আলো জ্বলছে। একটা ঝোলানো লণ্ঠন। তার নীচে একটা বাতিল হয়ে যাওয়া প্রাচীন চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে একজন।
–কীভাবে ঠিক হয় কে থাকবে আর কে ফিরে যাবে?
–এক সময় লটারি হবে। খুব ধুমধাম করে।
আমি মনে মনে সেই মৃদু এবং শ্লথ ধুমধাম ভাবতে চাইলাম। ততক্ষণে আমরা এসে গিয়েছি এক বৃদ্ধের সামনে। আমাদের পায়ের শব্দে যাঁর ঝিমুনি ভাঙল।
–কী কত্তা, কেমন আছেন? — সন্তোষ পাল জিগ্যেস করলেন।
ঘোলাটে চোখ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হল। সময় নিলেন বৃদ্ধ।
–আমি কী নিয়ে এসেছিলাম, সন্তোষ? আশরফি? না হিং, নাকি শাড়ি?
–আপনি মসলিন নিয়ে এসেছিলেন। উদাসীহাটের শাড়ি। কবে সব বিক্রি হয়ে গেছে।
আবার চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল বৃদ্ধের। তবে হালকা হাসিও ভেসে উঠল চোখে। মাথা নিচু করে আবার ঝিমোতে লাগলেন। আমি জিগ্যেস করলাম।
–লটারিতে যার নাম উঠবে না, সে কী করবে?
–ফিরে যাবে। আপনার সঙ্গে ফিরে যাবে। অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে যায়। এর মধ্যেও আরও বন্ধু পেয়ে যায় তো। তাদের ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়।
–তার মানে পৃথিবীতে ফিরে আবার তাদের সঙ্গে দেখা হবে? একসঙ্গে ফিরব?
–পৃথিবী কোনটা, এটা না সেটা, জানি না। তবে দেখা হতেইপারে। তাদের সঙ্গেও আর আমার সঙ্গেও। সেই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর বারে। বা অন্য কোথাও।
আমার মাথায় একটা অন্য চিন্তা চলছিল। তার মানে জানের সঙ্গে আমার আবার দেখা হতে পারে? ও হেরে গেলে আমি ওকে পাব। মানে পেতে পারি? পুল্টুশের গোঁতলানো অগ্রাহ্য করে আমি প্রার্থনা করলাম, জান যাতে হেরে যায়। পরে কী হবে দেখা যাবে।
আমরা মৃদু গতিতে হাঁটছিলাম। সন্তোষ পালের মুখে আবার সেই নির্লিপ্ত, মজা-পাওয়া হাসিটা ফিরে এল। আমি লক্ষ করলাম, ওঁর হাসতে একটু সময় লাগল, ঠোঁট ধীরে ধীরে ফাঁক হল। সবায়েরই তাই হচ্ছে এই স্লো-মোশনের কারখানায়। আমার অবাক হওয়াটাও নিশ্চয়ই ওরকম দেখাল। তার মানে হচ্ছে, যে মহিলার ব্যাপারে আমি চান্স নিতে যাচ্ছি, সে নর্মাল মোশনে বাইরে বেরিয়ে অন্য এক মহিলা হয়ে যেতে পারে! যদি খুব রাগী হয়? যদি চিৎকার করে, মারে? বুল্টি পেপারওয়েট ছুঁড়ে আহত করেছিল রাজীবকে। হয়তো বুল্টির কথা-বললেই-মারব টাইপের রাগী মুখও একটু নরম দেখাত এখানে এই সন্ধের আলোয় আর মৃদু ফ্রেম-কমানো হাসি আর হাঁটাহাঁটিতে।
পুল্টুশ উস্কানি দিচ্ছে। আমার এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। এখানে কিছুই পড়ে নেই। আমি এসব দেখতে আসিনি। পুল্টুশ বুঝতে পেরে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুল।
–কখন ফিরব আমরা?
–তা জানার আগেই পৌঁছে যাবেন। লটারিটা শেষ হওয়ার পরে আর কিছুক্ষণ।
–তারপর এখানে কী হবে?
–যে ফিরে যায় সে এই প্রশ্ন করে। উত্তর না দেওয়া উচিত, তেমনই নিয়ম। সন্তোষ পাল একটু থেমে বললেন— আমি উত্তর দিই, কারণ এখান থেকে বেরিয়ে আপনার আর কিচ্ছু মনে থাকবে না। এইসব ছবি মুছে যাবে। আপনার সঙ্গীও সারাতে পারবেন না। আমরা এইসব ছবি পারাপার করি, ইচ্ছের ছবি বানাই, ছবিগুলো ভেসে ওঠে এরকম সব গুপ্ত হাটে। বহু বছর পরে পরে ফিরে আসে। আপনার কিচ্ছু মনে থাকবে না।
এমন নয় যে আমি ওঁর কথা শুনে চোয়াল ঝুলিয়ে চেয়ে রইলাম। তবে আবার ওই বিষণ্নতার সুর ভেসে এল কোত্থেকে। নম্র গলায় অনুমতি চাইলেন সন্তোষ পাল।
–লটারি শুরু হবে। আমি একটু কাজ সেরে নিই?
–আপনার সঙ্গে আবার কি আমার দেখা হতে পারে ওরকম কোনও বারে?
–হতে পারে। তখন অন্য কথা হবে।
–আপনার সব মনে থাকবে?
সন্তোষ পাল আর একটু বড় হাসি হেসে চলে গেলেন। আমি মাঝখানের মাঠে বসে পড়লাম। একটু দূরেই বাকি সঙ্গীরা বসেছিল একসঙ্গে। ওরা টুকটাক কথা বলছিল। হাসছিলও। কিন্তু মনে হচ্ছিল সবাই সটান বসে আছে। উত্তেজিত। বোধহয় লটারির কথা ভেবে উত্তেজনা। কিন্তু আমার কিছু হচ্ছে না। বরং ঘুম পাচ্ছে। এভাবেই কি সব ভুলিয়ে দেয় নাকি? ঘুম পাড়িয়ে? জেগে উঠে আমি কি নিজেকে মাঝদুপু্রে শিলিগুড়িতে আবিষ্কার করব? ভাবতে ভাল লাগল। হাই উঠছে একের পর এক।
লটারি শুরু হচ্ছে মনে হয়। এক মহিলা এসে ছড়িয়ে দিলেন কড়ির মতো কিছু। ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁজতে লাগল। আমার এত হাই উঠছে যে, চোখে জল আসছে। এই মহিলা সন্তোষ পালদের টিমের। আসার সময় ছিলেন। ওরা এখন দাঁড়িয়ে। কেউ কড়ি খুঁজে পেয়েছে, কেউ পায়নি। আমার এবার ঘুম পাচ্ছে। ওরা একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাসছে-কাঁদছে। জান, মেরি জান কাঁদছে দু হাতে মুখ ঢেকে। এই দৃশ্য আমি মনে রাখব, মেরিজান। তেরি কসম। আমার এত অঘোর ঘুম পাচ্ছে, তবু আমি তোমাকে দেখছি। মুখ দু হাতে ঢেকে স্লো-মোশনে কেঁদে যাচ্ছে মেরিজান। আমার জায়গায় ও থেকে যেতে পারে না? আমি কি কথাটা বলব কাউকে? আমার নিশ্চয়ই ওঠা উচিত। তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে জান। তুমি কেঁদো না। আই প্রমিস।
আবার আগামী সংখ্যায়