রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
পাঁচ আগস্ট, ২০২০ ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। মাত্র কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোধ্যায় বিতর্কিত রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদের জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেওয়া হল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তথা আরএসএস-বিজেপির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে যুদ্ধকালীন দ্রুততায় তৈরি হতে চলে নতুন রাম মন্দির। আগামী পাঁচ আগস্ট অযোধ্যায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে মন্দিরের শিলান্যাস। কোভিড পরিস্থিতিতে জনসমাবেশের সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে যে জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট সেটিও খারিজ করে দিয়েছে৷ নিন্দুকদের মতে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের কুক্ষিগত করার প্রয়াস এই সরকারের আমলে সম্পূর্ণ হল। সেসব আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, শ্রীরামচন্দ্রকে রাষ্ট্রপুরুষ হিসেবে তুলে ধরে বেশ কয়েক দশক আগে বিজেপি যে রথ-রাজনীতির সূচনা করেছিল, পাঁচ আগস্ট তার একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে চলেছে৷ সেই উপলক্ষে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে আমরা ফিরে দেখলাম একটি পুরনো লেখাকে। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ বাবরি মসজিদ ধ্বংসেরও প্রায় বছর তিনেক আগে উৎস মানুষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিশিষ্ট দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য-এর এই লেখাটি। লেখাটির উপজীব্য, রামচন্দ্রকে আদৌ ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপুরুষ হিসেবে গণ্য করা যায় কিনা! আজ রাম মন্দির শিলান্যাসের প্রাক্কালে ও খোলাখুলিভাবে দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমরা প্রাসঙ্গিক-জ্ঞানে পুনঃপ্রকাশ করছি একটি এই প্রবন্ধটি।
চাই রাষ্ট্রপুরুষ
হালে একটা কথা চালু করার চেষ্টা হচ্ছে: শ্রীরামচন্দ্রকে সব ভারতবাসীরই রাষ্ট্রপুরুষ (জাতীয় নেতা) বলে মেনে নেওয়া উচিত। এক সিন্ধী নেতা এই সেদিন ময়দানে সভা করে বলে গেলেন,’ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা যদি রামায়ণকে শ্রদ্ধা করতে পারেন তাহলে ভারতের মুসলিমদের বাধা কোথায়?’ স্বস্তিকা বলে একটি ট্যাবলউএড -এ বেশ হেঁকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে: ‘এবং শ্রীরামিচিন্দ্রিকে যদি এ দেশের জাতীয় নেতা না বলা হয় তবে কাকে বলা হবে?’
ভারতের কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রকে রাষ্ট্রপুরুষ খাড়া করা যাচ্ছে না- সেই দ্বাপর যুগের পর এমন বিশাল শূন্যতা- ভাবতেও কেমন যেন লাগে! আদৌ রাষ্ট্রপুরুষ লাগবে কেন- এটাই অবশ্য প্রথম প্রশ্ন। ধরা যাক, তার দরকার আছে। তাহলেও একটা কথা থাকে। রাষ্ট্রপুরুষ হিসাবে কাউকে চালাতে গেলে তাঁর তো কিঞ্চিৎ সর্বভারতীয় মহিমা থাকা দরকার। শ্রীরামচন্দ্র-র কি তা আছে? সারা ভারতের সব প্রান্তের কথা বলতে পারব না। তবে মনে হয় উত্তর ভারতের চেয়ে দাক্ষিণাত্যে তাঁর প্রভাব অনেক কম। আমরা তো থাকি ভারতবর্ষের এক কোণে, পাণ্ডববর্জিত দেশে। তার কথাই ধরা যাক।
বাঙালির রাম-অভক্তি
বাঙলা আমাদের ভাষা। তার একটা বড় বেচাল দিক হলো: প্রয়োগে রাম-নামের কোনো মহিমা নেই। বহুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন:
‘হাঁদারাম’, ‘ভোঁদারাম’ ‘বোকারাম’ ‘ভ্যাবাগঙ্গারাম’ শব্দগুলোর ব্যবহার চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশের জন্য। কিন্তু ‘সিবুদ্ধিরাম’ ‘সুপটুরাম’ বলবার প্রয়োজন ভাষা অনুভব করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত এই যে ‘রাম’ শব্দের সঙ্গেই যত বোকা বিশেষণের যোগ, ‘বোকা লক্ষ্মণ’ বলতে কারও রুচিই হয় না।’ (বাংলা ভাষা পরিচয়, বিশ্বভারতী, ১৩৫৬, পৃ. ৯৬)
প্রবাদেও একই ব্যাপার৷ শ্রেণীবাচক কর্তৃপদে তীর্যকরূপের দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
যখন বলি ‘রামে মারলে মরব, রাবণে মারলেও মরব’, তখন ব্যক্তিগত রামরাবণের কথা বলি নে; তখন রামশ্রেণীয় আঘাতকারী ও রাবণশ্রেণীয় আঘাতকারীর কথা বলা হয় (ঐ, পৃ. ১০০)
আমাদের অবস্থা মারীচের মতো: রামের হাতে মরলে অক্ষয় স্বর্গলাভ হবে- এটা কিছুতেই ভাবতে পারি না।
আধুনিক বাঙলা সাহিত্যও সেই ধারাই বজায় রেখেছে। কৃত্তিবাস ওঝা ইত্যাদি যা করেছিলেন- করেছিলেন। তারপর সুকুমার রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ইত্যাদি রামকথার হদ্দমুদ্দ করে গেছেন। “লক্ষ্ণণের শক্তিশেল”, ‘” হনুমানের স্বপ্ন”, “উলট পুরাণ” — এসবই অতি উচ্চাঙ্গের রসিকতা। ফলে রামমাহাত্ম্য সর্বদাই চোট খেয়েছে। সে নিয়ে কেউ বিক্ষোভ দেখায় নি।
বাঙলা কেন উত্তরাবর্তের অন্যান্য প্রদেশের মতো রামভক্ত নয়? এর একটা কারণ বোধহয় এই যে, রামায়েত সম্প্রদায় বা বৈষ্ণবদের ভেতরকার রাম ‘কাল্ট” এখানে কখনই তেমন চালু হয় নি। বজ্রযানী বৌদ্ধদের পর থেকে শুধুই কৃষ্ণ-কালীর রাজত্ব। সারা উত্তর ভারতে রামলীলাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো মোচ্ছব লেগে যায়৷ বাঙলায় তার কোনো ছোঁয়া লাগে নি(এ বিষয়ে হুতোমের মন্তব্য খুবই লাগসই)।
হনুমান: খ্যাতির নদারদ
রামলীলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ- হনুমান। রামের মতো তাঁরও একটা আলাদা ‘কালট’ আছে। ভক্তরা হাত জোড় করে বলেন, ‘হামলোক মহাবীরকা জুতিকা গোলাম হ্যায়।’ এলাহাবাদের অভিজ্ঞতা থেকে শশিশেখর বসু (রাজশেখর বসুর দাদা) বলেছেন:
যে ছেলেটা রামলীলায় হনুমান সাজত, তার বাড়ি এক মাস হাঁড়ি চড়বার দরকার হতো না। পুরি মিঠাই লুচুই-হালুয়া, পেড়া বরফির পাহাড় জমে যেত। বাঙালী হনুমান হলে দুদিন শুকনো শাকনা খেয়ে বলতো, “মা গো, দুটি ঝোল ভাত রেঁধে দে, খোট্টাদের ক্ষীরের খাবার খেয়ে গলা চিরে গেল।”
আর এখানে? গোঁফ গজানোর পর কোনো ছেলে ন্যাজ পরে হনুমান সাজতে রাজি হবে? বন্ধু-বান্ধবদের আওয়াজে আর পাড়ায় টিকতে পারবে না। দূরদর্শনে যখন অতিবিলম্বিত লয়ে রামানন্দ সাগরের রামায়ণ চলছিল, তখন বাজারে একটা নতুন খেলা উঠল: নানা আকারের গদা। বাচ্চারা সেই দিয়ে সঙ্গীসাথীদের দমাদ্দম পেটাত (তাতে মা-পিসিদের বেলনাগুলো অবশ্য বাঁচত)। এখন? সিরিয়াল শেষ, খেল খতম। আর সেই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শোনা যায় না। গদার স্টক এখন গুদোমে- মহাভারত সিরিয়াল-এ দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের পর আবার হয়তো বেরুবে।
অথচ অন্যত্র দেখুন: মানুষের নাম ‘মহাবীর প্রসাদ’, ‘হনুমান সিং’, মহল্লার নাম ‘বাঁদরিয়াবাগ’, স্টেশনের নাম ‘হনুমানগঞ্জ’। কথাটা শুনে অবশ্য ওঁরা রাগ করেন। উলটে ঠেস দিয়ে বলেন, ‘বাঙ্গালী ভি রামদাস বোস হোতা হ্যায়, মহল্লাকে নাম বালীগঞ্জ ভি হোতা হ্যায়, তরকারিকে নাম ফুলকপি হোতা হ্যায়, (ক্রোধভরে) আপ কাঁহা হ্যায়? (কি বকচেন)।’
এই হলো প্রবাসী বাঙালীর অভিজ্ঞতা। আগেও, এখনও।
সব মিলিয়ে তাই সন্দেহ থেকেই যায়: রাষ্ট্রপুরুষ হিসেবে রাম কি বাঙলায় চলবেন? বরং রাষ্ট্রনারী হিসেবে কালী বা দূর্গা মন্দ হতো না। কিন্তু তাঁদের মহিমা তো ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোক তেমন জানে না!
রামায়ণ: এক নয়, অনেক
আবার রামের কথায় ফেরা যাক। সংস্কৃতে রামায়ণ বলে একটা মহাকাব্য আছে, কিন্তু ভারতের নানা অঞ্চলে তার নানান রূপ। একটু খোঁজ করলে জানতে পারবেন, এর আদিরূপ যে কী ছিল তা কেউ জানে না। ‘সপ্তকাণ্ড’ কথাটাই মায়া। পুরো উত্তরকাণ্ডটাই প্রক্ষেপ, অর্থাৎ পরে জোড়া হয়েছে। যুদ্ধকাণ্ড-র শেষে রামায়ণমাহাত্ম্য-সূচক শ্লোক পাওয়া যায়। তবু উত্তরকাণ্ড আবার ‘ফিন রামসে’ শুরু হয়েছে। আগের ছ খণ্ডেও প্রক্ষেপের শেষ নেই। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের পাঠ বহু ক্ষেত্রেই আলাদা। উপাখ্যানে তো বটেই, মূল আখ্যানেও বিস্তর ফারাক৷ বরোদা-ও ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট থেকে ব্যাপক পাঠভেদ-সংবলিত প্রামাণিক (ক্রিটিকাল) সংস্করণ বেরিয়েছে। ফোলিও সাইজের সাতটা ঢাউস খণ্ড। পাঠান্তর ও প্রক্ষেপের তালিকা দিতেই অত জায়গা লেগেছে৷
রামায়ণ বলতে সংস্কৃত-তেও যদি কোনো অনন্য পাঠ না থাকে, তবে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার — বাঙলা, অসমিয়া, ওড়িয়া, হিন্দি, তামিল, মলয়লম — রামায়ণগুলোর অবস্থা কল্পনা করুন। ধরুন ওড়িয়ায় শরলাদাস-এর বিখ্যাত বিলঙ্কা রামায়ণ। সেখানে রামের চেয়ে সীতার ক্ষমতা বেশি। সহস্রশির রাবণকে মারার সাধ্য রামের নেই, সীতার আছে! ক্যাথলিক পাদ্রি কামিল বুলকে হিন্দিতে রামকথা বলে একটা চমৎকার বই লিখেছিলেন। তার পাতা ওলটালেও বোঝা যায়: রামকথার কোনো একটি পরম্পরা নেই। দেশকালভেদে তার রুপান্তর হয়েছে সর্বত্র।
কোন রাম? কেন রাম?
এই এত রামের মধ্যে কোন রামকে তাবৎ ভারতবাসী ‘রাষ্ট্রপুরুষ’ বলে মানবে? রাজশেখর বসু দেখেছিলেন, ‘বাল্মীকি রামকে বিষ্ণুর অবতার বললেও তাঁকে সুখদুঃখাধীন মানুষরূপেই চিত্রিত করেছেন, কিন্তু কৃত্তিবাসাদি রামচরিত্রে প্রচুর ঐশ লক্ষ্মণ জুড়ে দিয়েছেন।’ আমরা এর কোন রামকে ‘রাষ্ট্রপুরুষ’ বলে ধরব? বাল্মীকির রাম, না কৃত্তিবাসের রাম?
রামভক্তরা হয়তো হাত-পা ছুঁড়ে বলবেন, আরে বাবা, ওসব পণ্ডিতি কুতক্ক থামাও। রামায়ণের যতই পাঠভেদ থাক, মূলে তো একটাই গল্প আছে। পিতৃভক্তি, প্রতিজ্ঞাপালন, একদারপরায়ণতা, ধর্মপ্রাণতা, প্রজানুরঞ্জন — এসবের জন্যেই রামচন্দ্রজী অত শ্রদ্ধেয়। সেইটুকু মানতে অসুবিধে কোথায়?
অসুবিধে আছে। এর সবক’টিকে যদিও বা কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই সদগুণ বলে ধরা যায়, তাহলেও ‘রাষ্ট্রপুরুষ’ বলে গণ্য হওয়ার প্রতিষ্ঠা হয় না৷ অনেক ছা-পোষা লোকও বিস্তর অযৌক্তিক পিতৃভক্তি দেখান, একটার বেশি বিয়ে করেন না, একাদশীর দিন কদাচ পুঁইশাক খান না, গোব্রাহ্মণের সেবা করেন, নিজের বা পরিবারের কাল্পনিক সুনাম বাঁচাবার জন্য নিরপরাধা স্ত্রীকে ত্যাগ করেন। তাঁরাও কি তবে রাষ্ট্রপুরুষ হয়ে যাবেন?
আর রামচরিত্রে ঘাটতিও তো প্রচুর। বালিবধকে মহাভারত-এ রামের অকীর্তি বলে ধরা হয়েছে। বনবাসে যাওয়ার সময়ে বা তার আগে ভরত সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যগুলো কি কোনো শুদ্ধসত্ত্ব লোকের মুখে মানায়? এর থেকে অবশ্য উলটো ব্যাপারটা বোঝা যায়: রামায়ণ মূলে ধর্মগ্রন্থ নয়, কাব্য; রামচন্দ্রও দোষে-গুণে মানুষ। তবু সীতাকে উদ্ধারের পরেই রাম তাঁকে যা অপমান করেন– আর তার উত্তরে সীতা যে কথাগুলো বলেন– তাও তো ভোলা যায় না। পাতালপ্রবেশের কথা পড়তে গিয়ে তো গলা বুজে আসে। ধুয়ার মতো ঘুরে ঘুরে আসে সীতার মিনতি:
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি
(তবে দেবী পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে আমায় আশ্রয় দিন)
স্থিতাবস্থার রক্ষক
‘রাষ্ট্রপুরুষ’ হতে হলে কোনো পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক চরিত্র -র রাষ্ট্রীয়-সামাজিক গুণ থাকা দরকার। রামচন্দ্র-র কি সে গুণ ছিল? বরঞ্চ শম্বুকবধের ঘটনায় একটা কথাই প্রমাণ হয়: তিনি শুধু স্থিতাবস্থা — যেমন আছে তেমন — রক্ষা করতেই আগ্রহী৷ শূদ্র তপস্যা করছেন বলে কোন ব্রাহ্মণের ছেলের অকালমৃত্যু হয়েছে — রাম তাই শম্বুকের শিরচ্ছেদ করলেন! রামায়ণ-এর ঐ জায়গাটা পড়তে গা রিরি করে। এটা ঠিক অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালনের নমুনা নয়, উচ্চবর্ণের প্রজাতোষণেরই প্রমাণ। রামচন্দ্রকে রাষ্ট্রপুরুষ বলে মানলে এ কথাও মানতে হবে: শূদ্ররা চিরদিনই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের সেবা করে যাবেন, মানুষ হিসেবে কোনো আলাদা মর্যাদা পাবেন না৷ উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে: কলিযুগে শূদ্ররা তপস্যা করার অধিকারী হবে, দ্বাপরেও তাতে বাধা আছে। কিন্তু কলিতে তাঁদের আর কোনো মানবমর্যাদা হবে কিনা সে বিষয়ে রামায়ণ নীরব।
রামায়ণ পড়ার কার্যকারণ
বাল্মীকি-রামায়ণ সারানুবাদের ভূমিকায় রাজশেখর বসু বলেছিলেন:
পুরাণকথার একটি মোহিনী শক্তি আছে। যদি নিপুণ রচয়িতার মুখ বা লেখনী থেকে নির্গত হয় তবে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলকেই মুগ্ধ করতে পারে। প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি আমাদের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে, তার ত্রুটি আমরা সহজেই মার্জনা করি। শিশু যেমন রূপকথার অবিশ্বাস্য ব্যাপার মেনে নিয়ে গল্প শোনে, আমরাও সেইরূপ পৌরাণিক অতিশয়োক্তি ও অসংগতি মেনে নিয়ে প্রাচীন সাহিত্য উপভোগ করতে পারি। এর জন্য ধর্মবিশ্বাস বা পূর্বসংস্কার একান্ত আবশ্যক নয়, উদার পাঠক সর্বদেশের পুরাণই সমদৃষ্টিতে পাঠ করতে পারেন।
গ্রীক মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিসি-র মতো রামায়ণ-মহাভারত পড়ে তার থেকে রস পেতে বাধা নেই। কিন্তু প্রত্যেক যুগের রচনাতেই সে যুগের ধ্যানধারণার ছাপ থাকে। পরের যুগে তার সব কথা কখনোই গ্রাহ্য হতে পারে না। হয়ও না। সুতরাং রচনাগুণ তারিফ করলেই তার থেকে রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক আদর্শও পেতে হবে– এমন আবদার অচল। কোনো অ-হিন্দু যদি রামায়ণ-কে কাব্য হিসেবেই নেন — সেটা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাকে কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ বলে মনে করা আর তার নায়ককে ‘রাষ্ট্রপুরুষ’ বলে মানতে হবে — এমন দাবি শুধু অযৌক্তিক নয়, অতি উৎকট মতলববাজি।
বানান অপরিবর্তিত
এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করায় সম্পাদকমণ্ডলীর প্রতি কৃতজ্ঞ।