প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়
ডা. হৈমবতী সেন (১৮৬৬-১৯৩৩)-এর জীবন এক অত্যাশ্চর্য জীবন৷ সাড়ে ন বছর বয়সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি পুরুষের সঙ্গে বিবাহ, তারপর অকালবৈধব্য ও কাশীবাস— ঊনবিংশ শতাব্দীর আর পাঁচজন বাঙালি রমণীর মতো অন্তরালে ও তাৎপর্যহীনভাবে শেষ হতে পারত তাঁর করুণ জীবন। কিন্তু নিজের মানসিক জোর, ধীশক্তি এবং অধ্যাবসায়বলে তিনি নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছিলেন৷ এই হৈমবতীই পরবর্তীকালে ক্যাম্পবেল মেডিকাল স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পাশ করে ডাক্তার হন এবং অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে হাসপাতালে পুরুষ ডাক্তারদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা করলেন। সারাজীবন ধরে তিনি যে বিস্ময়কর সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরেও তার সংগ্রাম জারি ছিল— এই ব্যক্তিত্বের সামনে এসে আমাদের নতজানু হতে হয়৷ নানা সূত্র থেকে তথ্যসংগ্রহ করে এই মহাজীবনের কাহিনি লিখেছেন প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়। শ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ও সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত 'ডা. হৈমবতী সেন-এর জীবনকথা' বইটির নির্বাচিত অংশ রইল এবারের হুইলার্স স্টলের পাঠকদের জন্য।
একদিন আমি সুর করে মাস্টারমশাইকে রামায়ণ পড়ে শোনালাম। তিনি তো খুব খুশি, বললেন, ‘মণি তুমি তো চমৎকার রামায়ণ পড়তে শিখেছ।’ আমি শুধোলাম, ‘ঠাকুমা দিদিমাদের সামনে আমি সেই একইকম সুরে রামায়ণ-পাঠ করতে পারব?’ তিনি বললেন, ‘স্বচ্ছন্দে’। আমি তো ফুর্তিতে ডগমগ। সেদিনই বিকেলে ঠাকমা-দিদিমারা জড়ো হয়েছেন জ্ঞাতিভাই রামচরণের রামায়ণ-পাঠ শুনবেন বলে। আমি সটান সেখানে গিয়ে হাজির, বললাম ‘আমি রামায়ণ-পাঠ করব।’ তাঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘সে কী রে বিদ্যেধরী, তুই পড়বি? কী করে? কিল মারলেও কি একটা অক্ষর বেরোবে তোর পেট থেকে।’ বললাম ‘আমি পড়তে জানি, আমাকে পড়তে দাও, না পারলে তখন বলো।’ আমি তখন যেমনভাবে সুর করে রামায়ণ-পাঠ করা হয়, অবিকল সেই সুরে পাঠ করতে শুরু করলাম। তাক লেগে গেল সকলের, মুখ হাঁ, বাক্যি সরে না মোটে। তাজ্জব ব্যাপার। যখন অনেকটা পড়া হয়ে গেছে, রামচরণদা এসে হাজির। সব দেখলেন, শুনলেন, আমাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন, বললেন, ‘সত্যিই ও চমৎকার পাঠ করে, এবার থেকে ও-ই রামায়ণ-পাঠ করবে।’
বেসামাল ধাক্কাটা সামলে নিয়ে একটু থিতু হতেই বেশ সাড়া পড়ে গেল। এসব ও শিখল কোত্থেকে, কী করে? সকলে মিলে হায় হায় করতে লাগল, এরপর ওর কী হবে? ওঁরা মা-কে ডেকে পাঠালেন, বললেন, ‘দ্যাখো গে, তোমার বেহায়া মেয়ের কীর্তি! ও নির্ঘাত বিধবা হবে। এমন বিদ্যেধরী মেয়ে ঘরে থাকলে জাত তো তোমার যাবেই। তোমার আশকারায় ও সারাটা দিন বারমহলে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। এখন তো আস্ত একটা মরদানা-মেয়ে হয়ে উঠেছে। নিজেকে একজন কেউকেটা ভাবছে।’ এসব শুনে ওঁদের রামায়ণ-পাঠ করে শোনানোর সব উৎসাহ আমার নিভে জল হয়ে গেল। এমন নিদারুণ ‘বাহবা’ পেলে, অন্য কেউ হলে হয়ত জীবনে আর বই ছুঁতই না। কিন্তু আমি যে একটু অন্য ধাতুতে গড়া, অত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নই। বাড়ির ভেতর বই পড়া বন্ধ। পরোয়া নেই। গাঁয়ের কোনো একটা মহল্লায় চলে যেতাম, সারাটা বিকেল ধরে গোগ্রাসে পড়তাম – রামায়ণ, মহাভারত, কালিকাপুরাণ, গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী, ভক্তিরসামৃত এমন আরও অনেক বই। এত মন দিয়ে পড়ি দেখে অনেকেই আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। মনে জোর পেলাম, ফের যেন চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। এই সময় আবার ইন্সপেক্টর এলেন, তিনি আমার পড়া ধরতে লাগলেন। আমার পড়া দেওয়ায় তাঁর মন ভরে গেল। পুরস্কার দেওয়ার দিন তিনি আমাকে দুটো বই, একটা ফুলছাঁদের রুপোর কাঁটা, একটা চিরুণি আর একটা আরশি দিলেন। ফিরে যাওয়ার সময়ে বললেন, “এই মেয়েটির মগজটা খুব শার্প, ঠিকমতো লেখাপড়া করলে ও একদিন ‘মহীয়সী নারী’ হয়ে উঠতে পারে। আফশোসের কথা ওকে তো সেই-সুযোগটা কেউ কোনোদিন দেবে না।’ পুরস্কার পাওয়াতেই আমার কপালটা ভাঙল। দিকে দিকে রটে এল আমি বেহায়া, ধিঙ্গি, মরদানার মতো চালচলন। ‘ও বাড়ি বয়ে পুরস্কার নিয়ে এসেছে, এখন ওকে কে বিয়ে করবে। লোকে যদি জানতে পারে ওর গায়ের কালি কি কোনোদিন ঘুচবে?’ এমন অঢেল ‘সদাশয় বাহবা’ও কিন্তু আমার উৎসাহকে একফোঁটাও দমাতে পারেনি। ভাবলাম কাউকে যদি শেখানো যায় তবে চর্চাটা থাকে। কাকে পাই, কে আমায় সাথ দেবে? এর মধ্যে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। যথেষ্ট পড়তে শিখে গেছি; রামায়ণ, মহাভারত-এর মতো মোটা মোটা বই পড়তে পারি। এখন মনমতো একটা শাগরেদ জোটানো দরকার। বাছি কাকে? এই সময়টাতেই ছোটো-খুড়িমা প্রথমবার শ্বশুড়বাড়িতে পাকাপাকি থাকতে এলেন। তিনি আমার কাকার দ্বিতীয় বউ। যখন প্রথম এলেন তাঁর বয়স তেরো, আমার আট। সর্বক্ষণ তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরি, আমি ছাড়া তাঁর কথা বলার মতো আর আছেটাই-বা কে? আমরা খেতাম, চান করতাম, শুতে যেতাম – এককথায় সবকিছুই করতাম জোড় বেঁধে। এই খুড়িমা আসার পর থেকে আমি বারমহলে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়। এমন লক্ষ্মী মেয়ে, যা বলতাম, সব সোনামুখ করে মেনে নিত। আমার তো আনন্দ আর ধরে না। আমি শিশুশিক্ষা-র প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ আর আমার অন্য সব বই ওকে পড়তে দিলাম। একদিন দেখি, ও আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বলি, কী হল, অমন হাঁ করে কী দেখছ? ও বলল, একরত্তি এক মেয়ে তুমি, এমন ঢাউস ঢাউস রামায়ণ, মহাভারত গোটাটা পড়ে ফেল, আর আমি হাঁ হয়ে যাব না! আমি ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, একদিন ঠিক তোমাকে পড়ে শোনাব। খুড়িমা খুব খুশি হয়ে বলল, আমি তোমার কাছেই পড়ব; চুপিচুপি, কেউ জানতে পারবে না। বিকেলে আমি ওকে শিশুশিক্ষা-র প্রথম ভাগ পড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু বাবার কাছে ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা গেল না। তাঁকে বললাম, আমি রোজ খুড়িমাকে পড়াই। তিনি বললেন, হুঁ। মতলবটা তো এঁটেছ দারুণ। তুমি তো দেখছি বেচারা মেয়েটাকে বেদম পিটুনি খাইয়ে প্রাণে মারবার জোগাড় করেছ। কেউ যদি একবার টের পায়, তোমাদের দুটোকেই মেরে হাড়গোড় আর আস্ত রাখবে না। আমরা রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা নিরালা ঘরে বসতাম। ওই ঘরে বাড়ির নতুন কনেদের মজলিস বসত – ওরা তাসপাশা খেলত, নয়তো রান্নাঘরে খাবার দাবার ঝুলিয়ে রাখার জন্য যে শিকে থাকে দড়ি দিয়ে সেই শিকে বুনত, বা কাঁথা সেলাই করত। ওই সময়টাতে খুড়িমা ছাড়া বাড়িতে আর কোনো নতুন বউ নেই। খুড়িমা আর পাড়ার কচিকাঁচা মেয়ের দলই ঘরটাতে যেত। আমি কিন্তু কোনো-না-কোনো অছিলায় মেয়েগুলোকে ওই ঘরে ঢুকতে দিতাম না। আমি তো খুড়িমাকে পড়াব, কেউ টের পেলেই বিপদ; সেজন্য ওদের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে নয়তো মেরেধরে ঘর থেকে বার করে দিতাম। এরকম চলছিল বেশ কিছু দিন, কিন্তু অচিরেই আমার লেখাপড়ার পাট গেল চুকে।
বাড়ির সবাই আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগল। দুই ঠাকুমা ঘটক ডেকে পাঠালেন, বললেন সুপাত্রের খোঁজ করতে। আমাকে গৌরীদান করতে পারলে তো ওঁদের অনেক পুণ্য হয়। ক-দিন বাদেই ঘটকঠাকুর আগাম রাহাখরচ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পাত্রের খোঁজে। দিন পনেরো বাদে ফিরে এলেন বেশ কয়েকটি পাত্রের সুলুকসন্ধান নিয়ে৷ ওরা সকলেই কুলীন ঘরের। পাত্রের খবর এল শ্রীধরপুর, শোভনা, নড়াইল, খেজুড়া এমন আরও অনেক জায়গা থেকে। তাদের বয়স চব্বিশ, পঁচিশ, ছাব্বিশ, তিরিশ… বয়স বেড়েই চলেছে। তাদের কাউকেই বাবার পছন্দ হল না। সব ক-টা এক একটা গণ্ডমূর্খ — লেখাপড়ার ধারকাছ মাড়ায় না। এরপর ফের খোঁজখবর শুরু হল। শ্যাম আর রায়কাঠির রাজা, বনগ্রামের জমিদার — এঁরা এসে সব দেখলেন, শুনলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তাঁদের সকলের মুখে এক কথা– লেখাপড়া শিখে এ মেয়ে তো একেবারে বখে গেছে! এর সঙ্গে টক্কর দিয়ে একে মানিয়ে নেওয়া আমাদের কম্ম নয়। সব খবর পৌঁছে গেল অন্দরমহলে– তারা সব মুখিয়ে রইলেন, আমাকে উচিতমতো ‘স্বাগত’ জানাতে। তাঁরা তো গোড়া থেকেই জানতেন— যে মেয়ে এত এত পুরষ্কার পেয়েছে, তার তো খেরেস্তান হওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। তাঁরা বললেন, ‘ওকে তো এবার খেরেস্রান গঙ্গাবাবুর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই।’ এসব শুনে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। এসব চোখা চোখা বাক্যবাণ আমি দিনের পর দিন শুনে এসেছি; ওসব কথায় আমি কানও দিইনি, মাথাও ঘামাইনি, ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি। আমার সমস্ত ক্ষমতা উজাড় করে খুড়িমাকে পড়িয়ে গিয়েছি৷ তারও।শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ পড়া শেষ৷ এখন সে অন্যান্য বইও পড়তে পারছে। এখন ওকে লেখা শেখাই কী করে? আমি মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে কয়েকটা শরের কলম পেয়েছিলাম, আর ভাতের হাঁড়ির তলি চেঁছে কিছুটা ভুসো জোগাড় করলাম। ভাত ভেজে ভেজে ভুসিকালো করে পোড়ালাম, সেটা জলে গুলে একটা মাটির ভাঁড়ে রাখলাম। এই হল আমার কালি। এই কালি দিয়ে কলার পাতার ওপর লিখতাম। ছাপা-বইতে যা দেখতাম, নকল করে লিখতাম, নকল করে লেখার জন্য অন্য বইয়ের পাতাও ছিঁড়ে নিতাম।
এর মধ্যে বিয়ের একটা নতুন সম্বন্ধ এল। পাত্র যশোরের ডেপিটি ম্যাজিস্ট্রেট, তার ভাই খুলণায় পুলিশ ইনস্পেকটর। হবু বর জাতে কুলীন কায়স্থ, বয়স পঁয়তাল্লিশ। তার দু বউ মরেছে; এখন সে তিন নম্বর বিয়ের তোড়জোড় চালাচ্ছে। তার প্রথম পক্ষের দু মেয়ে বেঁচে আছে। দ্বিতীয় পক্ষের মা-ছেলে মারা গেছে একসঙ্গে। প্রথম পক্ষের আরও দু-টি সন্তান মারা গেছে। এ হেন ছেলেকেই সকলের পছন্দ হল। বাবা একটু পা ঘষছিলেন ঠিকই — ছেলের বয়সটা বড্ড বেশি। কিন্তু ঠাকমাদের কড়া ধমকে তাঁর আপত্তি হাওয়ায় উড়ে গেল। তাঁদের মুখে এক কথা– বর কনের বয়সের তফাত আবার কী! ওতে কিচ্ছুটি হয় না। বিয়ের জল গায়ে পড়লেই মেয়ে কেমন শাঁসেজলে ফুলেফেঁপে ডাগরডোগর চাঁদপানাটি হয়ে উঠবে দেখো। তার উপর ছেলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বলে কথা! দু-ভাই পুলিশ ইনস্পেকটর। পাকা দালানবাড়ি– বাড়িতে দুর্গোৎসব করার মতো যথেষ্ট ধনী। আমাদের জন্য এই পরিবার আর ছেলে একেবারে উপযুক্ত ঘর; রাজযোটক বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। এই ছেলের সঙ্গেই বিয়ের কথা পাকা করতে হবে। এই ছেলেকে মেনে না নিলে ওর কপালে আর বড় জুটবে না। বাবা আর ওজর-আপত্তি না তুলে ছেলের বাড়ি লোক পাঠালেন। তারা এসে বলল, ছেলে একেবারে কন্দর্পকান্তি! মায়ের তরফেও কোনো আপত্তি আর রইল না। সকলে মিলে আমার বিয়ের উৎসবের বন্দোবস্ত করতে উঠেপড়ে লাগলেন। তখন আমার বয়স সাড়ে ন-বছর।
শ্রাবণ মাসে চাঁদপানা-মুখ বরের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের সময়ে আমি ঘুমিয়ে কাদা। ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম, বড়ো ঠাকুমার বদলে বিছানায় একটা অচেনা লোক শুয়ে। সাবেককালের পালঙ্কের বিছানা– প্রায় ছত্রিশ ইঞ্চি উঁচু সিঁড়ি বেয়ে বিছানায় উঠতে হত। আমি দেখলাম কেউ একজন সিঁড়িটা সরিয়ে নিয়ে গেছে, ভাবলাম, হায় ভগবান! এখন আমি বিছানা থেকে নামব কী করে? দিলাম শেষে এক লাফ। গা-ভরা গয়না সব রুনঝুন করে বেজে উঠল। বাড়ির সকলে উঠল জেগে — বুঝল কী ঘটেছে, অবাকও হল বই কী। এ যে শঙখিনী কন্যা! এমন অলক্ষুণে ঘটনা কেউ কখনো দেখেছে না শুনেছে! আমি বললাম, আমার খিদে পেয়েছে। মা শুনে বললেন, আহা রে, বেচারা! সারা দিন কিছু পেটে পড়েনি; ওকে আর তোমরা গঞ্জনা দিও না তো বাপু। আমি খেতে বসলাম প্রত্যুষে; যখন দিনের আলো ফুটে উঠল, তখনও আমার খাওয়া শেষ হয়নি। ওই সাত সকালেই ‘একঘেয়ে পানসে বিয়ে’ট’র যত আচার-অনুষ্ঠান! মা বললেন, চটজলদি খেয়ে নাও। আমি গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করতে লাগলাম। আমার গা-ভরা ভারী গয়না, ভারী বেনারসিতে জড়িয়ে-মড়িয়ে একটা জড় পুটুলির মতো জবুথবু হয়ে রইলাম। উদবেগ, উৎকণ্ঠা, দুশিন্তায় আমার ভেতরে তখন তুমুল তোলপাড় চলছে। কী যে হচ্ছিল, তার কিছুই এখন আমার মনে নেই। একটা ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে– আমাদের পুতুলের বিয়েতে তো কনেকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়; আমার বেলাতেও মনে হয় সেরকমটাই ঘটবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই। বাবার সঙ্গে যে করে হোক কথা বলতে হবে, না হলে ওরা জোর করে আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে। আমি বাবাকে পাগলের মতো আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগলাম; কিন্তু কোথায় বাবা? মরিয়া হয়ে বারমহলের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছি– চারপাশের লোকজন হাঁ হাঁ করে উঠল, এ কী অনাছিষ্টি কাণ্ড! আমি ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম; নড়নচড়ন নেই। আমি তো বাবার কাছেই যাচ্ছি; এতে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হল? তখন কয়েকজন মিলে আমাকে বোঝাতে লাগলেন, এখন তো তুমি কনে, তোমার এখন বারমহলে যাওয়া সাজে না। বারমহল এখন বরযাত্রীতে গিসগিস করছে। তুমি ওদের বাড়ির কনে, ওদের কাছে গিয়ে তোমার মুখ দেখানো অশোভন। আমি শুধু বলতে পারলাম, চাই না ওদের বাড়ির কনে-বউ হতে! ওঁরা আমাকে ধরে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে গেলেন– কিছুতেই বাবার কাছে যেতে দিলেন না। কী করব আমি? মনের মধ্যে ঝড় বইলেও বাইরে শান্ত সংযত রইলাম। চোখের জল বাঁধ মানল না। বসে বসে ফোঁপাতে শুরু করলাম। মনে হতে লাগল, আমার শৈশবের বুঝি-বা এখানেই ইতি।
ডা. হৈমবতী সেন-এর জীবনকথা। প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়। সাহিত্য সংসদ৷ প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৯। মূল্য- ৩০০ টাকা।
বানান অপরিবর্তিত