মরণ-মহোৎসবে: কোভিড-উত্তর বিপন্নতা — চতুর্থ বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের পূর্বে সংবাদ পাওয়া গেল, আমাদের দীর্ঘদিনের কমরেড, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ লেখক রায়া দেবনাথের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের পাঠক জানেন, যে কাগজের প্রায় জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন প্রসঙ্গে রায়ার লেখা আমাদের পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছে। রায়ার এই অকালমৃত্যুতে আমরা শোকাহত। ওঁর সমস্ত নিকটজন যথাশীঘ্র এই দুর্মর শোক সহ্য করার শক্তিলাভ করুন। 

 

অতিমারির নিত্যনূতন কৃতিত্বের এই ঋতুতে দেশবাসী যখন অনিশ্চয়তায় মুহ্যমান, তখন নেপ-এ দহি প্রায় মারিয়া আনিয়াছে। নেপ, অর্থাৎ নিউ এডুকেশন পলিসি বা নব শিক্ষানীতি-নামক একটি সুঁই হৃদরোগীর পীড়া-হ্রাসার্থ তাহার যকৃতে প্রয়োগ করা হইয়াছে। কী করিতে হইবে, সে-প্রসঙ্গে রোগীর অভিমত দেশের কল্যাণার্থ আপাততঃ প্রকাশ্যে আনা হইতেছে না।

কবাটবক্ষের ক্ষমাসৌন্দর্যের সুযোগ লইয়া নিন্দুকে ইতোমধ্যে যথারীতি কু ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহারা বলিয়া বেড়াইতেছে, যে এই নব শিক্ষানীতির শাখায়-শাখায় যে পুষ্পচয় শোভিত হইতেছে, তাহার সৌন্দর্য বা আঘ্রাণ লইতে পারাই হইবে ভারতের বিপুলসংখ্যক বিদ্যালয়মুখী অথবা প্রস্তুত শিশু-বালক-বালিকা-যুবক-যুবতীর ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সংপ্রশ্ন। কে পারিবে ও কে পারিবে না, তাহা নির্ধারণ করিবে তাহাদের বাপ-মায়ের আর্থিক সচ্ছলতা অথবা তাহার অভাব।

তথাপি ইহা তর্কের অতীত নহে, আপাততঃ কেবলই তর্কসাপেক্ষ। কাল, কেবলমাত্র কালই এই প্রশ্নের যথোচিত উত্তর দিবেন।

শিক্ষানীতির কথা স্থগিত রাখিলেও এই অতিমারির কাল অন্যান্য বহু বিষয়ে ঘটিতে থাকা অনেকানেক অন্যায়কে বোধ করি গর্দান পাকড়াইয়া চক্ষের সুমুখে হাজির করিল। সামাজিক দূরত্ব পালনে দেশবাসীকে বাধ্য করিতে শাসকের হাতিয়ার লকডাউন চক্ষের পলকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় পঁচাশি শতাংশের মুখের গ্রাস ছিনাইয়া লইতে উদ্যত হইল। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ নামক এক প্রজাতির প্রাণীকে আমরা অকস্মাৎ আবিষ্কার করিলাম। এই প্রজাতির প্রাণীরা দৈনিক দুইশত হইতে তিনশত টাকা উপার্জন করিয়া থাকেন, এবং নিজের ও পরিবারের উদরপূর্তির কারণে নিজগৃহ ছাড়িয়া প্রয়োজনে দেশের অপরপ্রান্তে মনুষ্যেতর জীবন যাপন করিয়া থাকেন। লকডাউনের ঘণ্টি বাজিলে তাঁহাদের উপার্জন বন্ধ হইল। আমরা তাঁহাদের অসহায়তা ও দুর্দশা প্রত্যক্ষ করিলাম। লকডাউন চলিতে-চলিতেই আমরা দেখিলাম, কেমন করিয়া নানান ছুতায় দেশের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দোষ দেওয়া চলিতে লাগিল। যেন দেশের সমগ্র দুর্দশার ভাগীদার একমাত্র তাঁহারাই। অন্যদিকে দেশের সনাতনী ঐতিহ্যের গান গাহিতে-গাহিতে মহাসমারোহে কত অনাচার আমাদের সুমুখে ঘটিয়া গেল, তাহার কিছু আমরা দেখিলাম, কিছু দেখিলাম না।

সামাজিক দূরত্ব সুনিশ্চিত করিতে ঘরে ঘরে অনলাইন পড়াশুনার ধুম উঠিল বটে, কিন্তু হিসাব কষিয়া দেখা গেল, দেশের মাত্র আট শতাংশ শিশুর কাছে অনলাইন অধ্যয়নের উপযোগী ব্যবস্থা রহিয়াছে। দেখা গেল, দেশের অর্ধেকের কম পরিবার দৈনিক বারো ঘণ্টা বা তদধিক বিদ্যুৎ পাইয়া থাকেন। তদোপরি, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা দুই-ই বর্তমান, এমন পুরুষের সংখ্যা মোটের দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ অর্ধেক আকাশের এক বিপুল ক্ষেত্রে আদতে অন্ধকার এবং অব্যবস্থা।

শ্বেত গলাবন্ধী কর্মীদের ক্ষেত্রে সুলভে যে গৃহ-হইতে-কর্ম যোজনার ব্যবস্থা হইল, তাহা গরীবগুর্বো মজুর, ট্যাক্সিচালক ইত্যাকার সুবিধা করিল না। ফলতঃ এই দুই দলের যাপনমানে যে বিপুল পার্থক্য বর্তমান ছিল, তাহা বাড়িল। বাড়িল গৃহহিংসার সংখ্যা, যাহা বিগত দশ বৎসরে সর্বোচ্চ বলিয়া দেখা গেল। ইউএন উইমেনের মতে নারীবিরোধী হিংসা হইতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অতিমারি তাহা বহুগুণ বাড়িয়া যাইবার সঙ্কেত লইয়া আসিল। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং স্বল্প সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মীদের উপর ‘বাণিজ্যিক কারণ’ দেখাইয়া যৎপরোনাস্তি অত্যাচার এবং অনাচার নামাইয়া আনা হইল। ‘ইউনিয়নবাজি মন্দ’ বিধায় আমরা তাহাও মানিয়া লইলাম।

কোভিড-ঋতুর ‘অ-কোভিডীয়’ দুর্দশাচয়ের— যাহার সকলই মনুষ্যসৃষ্ট— কয়েকটি পরিণাম লইয়া এই সংখ্যার মূল ভাবনা ‘মরণ-মহোৎসবে’ তৈয়ার হইল। লিখিলেন আশীষ লাহিড়ী, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, রুচিরা গোস্বামী, চিরশ্রী দাশগুপ্ত এবং অয়নেশ দাস

রিজার্ভড বগি ব্যতীত মেল ট্রেনের এই চতুর্থ বর্ষের চতুর্থ যাত্রায় স্মরণ করা হইল সদ্যোপ্রয়াত নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর এবং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীকে। রহিল পণ্ডিত রবিশঙ্করের শতবর্ষ উপলক্ষে লাজওয়ান্তি খান গুপ্তার একটি বিশেষ নিবন্ধ।

মেল ট্রেনের এই যাত্রা হইতেই আরম্ভ হইল নতুন ধারাবাহিক— বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘ছায়াপাখি’। তৎসহ গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, অণুগল্প, অন্যগদ্য, ফটোফিচার-আদি সমস্ত নিয়মিত বিভাগগুলি এবং স্টিম ইঞ্জিন, হুইলার্স স্টল, ডিসট্যান্ট সিগনালভালো খবর ইত্যাদি বিশেষ বিভাগগুলিও যথাবিহিত রহিল।

পড়ুন, সুস্থ থাকুন, সতেজ ও সচেতন থাকুন…

অলমিতি

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...