নীলাঞ্জন হাজরা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
অরণ্যের চেতনা
সালটা আজ আর মনে নেই৷ তবে ১৯৭১-৭২-এর আশপাশ হবে বোধহয়৷ সত্যি বলতে কী আগু-পিছু কিছুই মনে নেই৷ শুধু কাটা-কাটা কিছু চলমান ছবি৷ আমার বাবাকে আমার ঠাকুদ্দার দেওয়া, হ্যান্ডেলে ‘মেড ইন ইংল্যান্ড’ খোদাই করা সাইকেলের সামনের রডে চেপে চলেছি চাতালে৷ কলকাতায় লোকজনকে সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে চড়তে দেখি৷ আমার দেশ বিষ্ণুপুরে সে চলটা এসেছিল আমার বেশ বড় বয়েসে৷ আমার ধারণা সাইকেলের পিছনে আলাদা করে ক্যারিয়ার লাগাতে যে দাম লাগত সেটা বিষ্ণুপুরে অনেকেই দিতে পারত না৷ চলছিল বাচ্চা-বুড়ো সকলেরই সামনের ‘ব’-এর ওপরের রডটায় আড় হয়ে বসে থাকা৷ তাতে পশ্চাদ্দেশে ব্যথা হয়ে যেত বটে, কিন্তু নিরুপায়৷ সেভাবেই চলেছি চাতালে৷ বাবার সাইকেলে চেপে৷ সঙ্গে আর একটা সাইকেল-এ আমার সেজমামা৷
চাতাল? রানওয়ে৷ ইয়েস, বোমারু বিমান নামা-ওড়ার রানওয়ে৷ যেমনটা দেখা যাবে ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির সেই মাথা-ঘুরিয়ে-দেওয়া সিকোয়েন্সে৷ ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল এই রানওয়ে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়৷ জঙ্গলমহলে বেশ কয়েকটা৷ শাল-সেগুন-ক্যাঁদ-কুড়চি-পাকুড়-অশ্বত্থ-জাম-মহুয়া-পিয়াশাল-আম আরও অজস্র না-চেনা গাছের গাঢ় জঙ্গল পরিবৃত সেই দীর্ঘ সিমেন্টের রানওয়ে— চাতাল৷ বিষ্ণুপুর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর হয়ে জঙ্গলমহল ফুঁড়ে যে হাইওয়ে চলে গেছে তার থেকে অনেকগুলো ফ্যাঁকড়া বেরোনো টুকটুকে লাল এবড়োখেবড়ো মোরামের রাস্তা ধরে, দু-একটা মুসলমান গ্রাম পাশে রেখে তিন কিলোমিটারটাক গেলেই উঠে পড়া যায় এই চাতালে৷
চলেছি সেই চাতালে৷ আমার ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অরণ্যের সেই প্রথম পরিচয়৷ জঙ্গলের স্তব্ধতা আর শব্দ৷ আশ্চর্য এক নকশা আছে তার— একটা প্যাটার্ন৷ সাইকেলে চড়ে গেলে বা হেঁটে গেলেই তা বোঝা যায়৷ শহরের মতো এলোপাথাড়ি নয় সে শব্দপট, সেই সাউন্ডস্কেপ৷ ঋতুর সঙ্গে তার সম্পর্ক৷ ঋতু থেকে ঋতুতে বদলে যাবেই সে শব্দপট৷ যখন বর্ষা, ঘোর দ্বিপ্রহরেও তার পিছনে ফেলা থাকবে একটা টানা ঝিঁঝি-র ডাক৷ (উত্তরবঙ্গের অরণ্যে দেখেছি তার ভলিউম এতটাই যে তাকে আর পিছনে ফেলা আছে বলা চলে না)৷ সেই ডাক স্তব্ধতাকে বিরক্ত করে না৷ জলের ওপর তেলের মতো ছ্যাবড়া ছ্যাবড়া হয়ে ভেসে বেড়ায় না৷ হাল্কা রঙের মতো গুলে একাকার হয়ে যায়৷ জৈষ্ঠ্যের আগুন দুপুরে সেটা পাবে না৷ নিরেট নৈঃশব্দের গায়ে বুটি দিতে থাকবে দূর থেকে ভেসে আসা কাঠঠোকরার ঠক-ঠক, ঠক-ঠক-ঠক৷ আর সেই বুটিগুলোকে যুক্তকরা লাইনের মতো ডাহুকের হু-হু৷ শীতকালেও থাকবে ঝিঁঝি আর তার সঙ্গে ক্রমাগত উত্তুরে বাতাসে পাতা পড়ার শব্দ৷ দূর থেকে কিচ-কিচ-কিচ-কিচ করতে করতে উড়ে এসে একঝাঁক টিয়ার ঠিক মাথার ওপরে পাক খেয়ে ফের দূরে মিলিয়ে যাওয়া৷ তক্ষকের চাপা কাশি৷ গিরগিটির হঠাৎ সড়াৎ৷ বসন্তে সেই স্তব্ধতায় আঁকিবুঁকি কাটবে অদ্ভুত নাছোড়বান্দা কোকিলের একঘেয়ে চলতেই থাকা, চলতেই থাকা কুহু৷ কান করে দেখেছি প্রথম ভোরে বাঁকুড়ার জঙ্গলের সাউন্ডস্কেপ আর গোধূলির সাউন্ডস্কেপ কিন্তু এক নয়, যদিও দুটোই পাখির কিচির-মিচিরে ভরা৷ যেমন, গোধূলিতে দূর থেকে আসা গ্রামের পোষা বা জংলি মোরগের ডাক মিলবে, সন্ধ্যার আগে কিন্তু নয়৷ গোধূলিতে মিলবে জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামে বাড়িফেরতা গরুর পালের হাম্বা৷ এইরকম আর কি৷
বদলে যাবে অরণ্যের গন্ধপট৷ ওডোরস্কেপ৷ যার তানপুরার পিছনের সুরটা হবেই হবে একরকম পাঁচমিশেলি বুনো লতাপাতা-র একটু যেন তেতো গন্ধ৷ তার ওপর বর্ষায় খেলবে ভিজে মাটির গভীর গন্ধ, যার কোনও এক কথার বাংলা নেই, কিন্তু অপূর্ব একটা ইংরেজি শব্দ আছে— Petrichor! বসন্তে মালুম পড়বে আশেপাশে নির্ঘাৎ একটা মহুয়া গাছ আছে৷ শীতে— শুকনো ধুলোর গন্ধ৷ ঠাঠা গরমে— লাল কঠিন মাটি থেকে ওঠা একটা ভাপের গন্ধ৷
আর বদলে যাবে বনের দৃশ্যপট৷ ঠিক বর্ষার পরে, শেষ সেপ্টেম্বরে জঙ্গলের যে গাঢ় সবুজ দেখা যাবে, বসন্তে তত গাঢ় নয়, কিন্তু ফাল্গুনের জঙ্গলের সবুজের যে রকমফের, তা গুণে শেষ করা কঠিন৷ আর ঝরে পড়া শিমূল আর পলাশের আগুন-রঙা কার্পেট৷ গ্রীষ্মে ভূতভৈরব যাকে কলকাত্তাওয়ালিরা বলবে ল্যান্টানা সেই ল্যান্টানার রঙের তুবড়ি৷ শীতে জঙ্গল অনেক রুক্ষ৷ খয়েরি-খয়েরি৷ সেটা ওপর দিকটা৷ নীচটা লালে লাল— আমরা বলি শিঁয়াকুল৷ থোকা থোকা৷ সারা জঙ্গলময়৷
এ সবের সঙ্গেই অবিশ্যি সেদিনই পরিচয় হয়নি৷ কিন্তু এই জঙ্গুলে শব্দ-গন্ধ-বর্ণর অলীক দুনিয়ার সঙ্গে সে দিনই প্রথম পরিচয়৷ বাবার সাইকেলের হ্যান্ডেলে চেপে চলেছি অরণ্য পরিবৃত চাতালে৷ দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়া গাছের সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া টুকটুকে লাল জমিতে আলো-ছায়ার দুলতে থাকা ফুলকারি করা সরু অরণ্য পথ ধরে৷ খবর এসেছে— চাতালের কাছে বাঘে এক কাঠুরেকে মেরেছে৷
তখন আমার বয়স বছর পাঁচেক৷ খবর এসেছে বাঘে কাঠুরে মেরেছে আর সেই বাঘকে গুলি করে মেরেছে বন দপ্তর৷ আর আশপাশের গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করতে যে, সত্যিই মারা পড়েছে বাঘ, সেই বাঘ রাখা হয়েছে চাতালে৷ সেই আমার অরণ্যের সাথে প্রথম পরিচয়৷ চাতালের সঙ্গেও৷ যে চাতালে ফিরে ফিরে যাওয়া কোনওদিন শেষ হয়নি৷
কিন্তু সে দিন চাতালে মরা বাঘের দেখা মেলেনি৷ সেই সন্ধ্যাতেই মায়ের সঙ্গে বেশ সাজুগুজু করে, প্রায় বিয়েবাড়ি যাওয়ার মতো, সে মরা-বাঘ শুয়ে থাকতে দেখে এসেছিলাম বিষ্ণুপুরের এসডিপিও-র বাংলোর টুকটুকে লাল মেঝের ওপর৷ আসলে বাঘ নয়, চিতাবাঘ৷ স্পষ্ট মনে আছে মা একটু ছুঁয়ে বলেছিল, ‘ভেলভেটের মতো’৷ আর বাঘটাকে যে গুলি করে মারা হয়েছে, কানের পাশে একটা ফুটো ছাড়া তার আর কোনও চিহ্ন ছিল না— একছিটে রক্তও নয়৷ আগুন-হলুদের মধ্যে কালো বুটি শুধু৷
সেই ১৯৭১-৭২-এ বিষ্ণুপুর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ঘন জঙ্গলে এমনই দু-একটা বাঘের আনাগোনা থাকলেও, হাতির কথা কেউ কস্মিনকালেও শোনেনি৷ অরণ্য তখন ছিল প্রাণ-ভরপুর৷ এক মানুষ উঁচু উইঢিবিগুলোর জটিল গর্তের নেটওয়ার্কে ছিল গোখরো আর চন্দ্রবোড়া সাপেদের রাজত্ব৷ জঙ্গলের সরু অলিন্দ ধরে পথচলতি মানুষকে পায়ে কামড়ে দিলে বাঁধন-টাধন দিয়ে, ওঝার তুকতাকে বেঁচে যেত অনেকেই৷ কিন্তু কাকভোরে প্রাতঃকৃত্য সারার সময় পশ্চাদ্দেশে ছোবল দিলে বাঁচানো যেত না৷ বিষ্ণুপুর থেকে অরণ্যপথে ১২ কিলোমিটার, আর বাস-রাস্তায় ২৪ কিলোমিটার দূরে এক জাদুবাস্তব বিস্তীর্ণতার মধ্যে ছিল পাঁচমুড়া গ্রাম৷ সে গ্রামের কুমোরদের চাকে গড়া সম্পূর্ণ গতিহীন লম্বাগলা ছাগল-মার্কা ঘোড়া তখনও ভারতের হস্তশিল্পের লোগো ছিল কিনা, এবং সুগন্ধী সুবেশিতারা ‘ওয়াও! হোয়াট আ বিউটিফুল ব্যাঙ্কুরা হর্স!’ বলে উত্তেজিত হয়ে তখনও সে পোড়ামাটির ঘোড়া কিনে নিয়ে যেত কিনা কে জানে? কিন্তু সে গ্রামের ছোট্ট কলেজেই মাস্টারি করত আমার মা-বাবা দুজনেই৷
সেই কলেজের পাশেই কলেজের একমাত্র এক কামরার কোয়ার্টারে ছিল আমাদের বাস৷ আর সেই কোয়ার্টারের টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিতে প্রায়শই দেখতাম মা গুঁজে রেখেছে নীলকণ্ঠ পাখির পালক৷ আমাদের বারান্দা থেকে কুড়োনো৷ অনেক, অনেক বছর পরে আমার এক বান্ধবী যখন আমায় চিঠিতে ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ নামের একটা ‘অসাধারণ’ বই অবশ্যই পড়ে দেখতে বলল, তখন আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, ‘ওরেব্বাবা, নীলকণ্ঠ পাখিরও আবার খোঁজে যেতে হয়!’৷ বইটা রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলেছিলাম৷ আমার এই বিস্ময়ের কথা অবিশ্যি মেয়েটিকে জানানো হয়নি৷ আজ এই কোয়ার্টারে শুনেছি কেউ থাকে না— হাতির ভয়ে৷ আর এই পাঁচমুড়া থেকে গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটি বা শীতের ছুটির শুরুতে-শেষে আমাদের পরিবারের বিষ্ণুপুর যাতায়াত ছিল কংসাবতী সেচ ক্যানাল পাড়ে পাড়ে রামদেও আর নিতাইয়ের দুটো রিকশায়৷ বাক্স-প্যাঁটরা চাপিয়ে বাবা একটায়, আমি আর মা আর একটায়৷ এ পথে আজকাল, বিশেষ করে যখন ধান পাকার বাস বাতাসে ছড়াতে শুরু করে, আর চট করে কেউ এভাবে যাতায়াত করে না, বিশেষ করে ভোরে বা শেষ বিকেলে— হাতির ভয়ে৷
সে সময় এমন ভয়ের কথা কেউ কখনও শুনেছে, শুনিয়েছে বলে মনে পড়ে না৷ সাঁওতাল গ্রামের পাশ দিয়ে, তকতকে কালোর ওপর সাদা আলপনা কাটা পরিপাটি বাড়ির পাশ দিয়ে, লাউ-করলা মাচার পাশ দিয়ে, নেড়ির দলের তারস্বর চিৎকারের পাশ দিয়ে, মাথা-ধরানো মহুয়া-মদভাটির পাশ দিয়ে চলতে চলতে রাস্তার পাশের কোনও আশুত গাছের তলায় নিতাই আর রামদেও-র দু’দণ্ড জিরোনোর ফুরসতে দেখতাম শিকার— মসৃণ কুচকুচে কালো গায়ের একটা লোক তূণ থেকে বার করেছে তির৷ ছিলায় টান৷ কয়েক মুহূর্ত নিথর৷ তারপর পাং৷ ইউক্যালিপটাস গাছের ছালওঠা ধবধবে গুঁড়িটায় গিয়ে বিঁধেছে সেই তির, যে তিরের সরের ডগায় উল্টো করে লাগানো একটা লম্বা মোটা পেরেক৷ ইয়া গোবদা কাঠবিড়ালিটা ছটপট করছে তখনও৷ গুঁড়ির ঝকঝকে সাদা গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা৷ কিংবা ধড়পড় করতে করতে তির বেগে ওদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শুকনো ক্যানাল, ক্যানাল-পাড় টপকিয়ে এ দিকের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল একটা দাঁত বের করা শুয়োর৷ তার পরেই তার পিছনে পিছনে ল্যাঙট-পরা কয়েকটা লোক৷ হাতে টাঙি, তির, দা৷ আর তার একটু পরেই আকাশ বিদীর্ণ করা তীক্ষ্ণ চিৎকার৷ বুক হিম করা মরণ-চিৎকার৷ তারও পরে একটা লাঠিতে বেঁধে সেই বনশুয়োরের দেহ কাঁধে ঝুলিয়ে বিজাতীয় ভাষায় বকবক করতে করতে চলে গেল রক্তে মাখামাখি লোকগুলো ক্যানাল পাড়ের রাস্তায় রক্তের ছোপ ফেলে রেখে৷ সেই বয়সেই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল জঙ্গলের সঙ্গে এই মানুষদের সম্পর্ক৷ খিদের সম্পর্ক৷ মুনাফার বা নৈতিকতার সম্পর্ক নয়৷
সেই ১৯৭০-এর দশকের গোড়ায় বিষ্ণুপুর আর আজগুবি গ্রাম পাঁচমুড়ার মধ্যে অরণ্য-অলিন্দ পথে রামদেও আর নিতাইয়ের রিকশা চড়ে যাতায়াত করতে করতেই মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল বাঁকুড়ার জঙ্গলের আনাচেকানাচে যে কালো-কালো লোকগুলো থাকে, জঙ্গলের সঙ্গে তাদের কোনও ছেঁদো সেন্টিমেন্টাল সম্পর্ক নেই৷ পরবর্তীকালে প্রথম যৌবনে হাতি তাড়া করতে করতে সে ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হয়েছে৷ সম্পর্কটা একেবারেই খিদের, আর হয়তো কিয়দাংশে সুস্থ থাকার, কিন্তু সেটা সামান্যই৷ অরণ্যের অধিকার নিয়ে তাদের ততটুকুই মাথাব্যথা যতটুকু তাদের মুখের গ্রাস জোগায়৷ কাঠবিড়ালি, মেঠো ইঁদুর, ঢ্যামনা সাপ, বুনো শুয়োর, তিতির, বটের, বনমোরগ তাদের নিত্যনৈমিত্তিক শিকার৷ মরা গাছের শুকনো কাঠ তাদের ঘরের উনুনের আগুন জোগায়৷ সমস্ত শীত ধরে সারাটা জঙ্গল জুড়ে ঝরে পড়া শালপাতা কাচের চুড়ি পরা হাতে মেশিনের গতিতে ছোট ছোট কাঠি দিয়ে বুনে তৈরি করে ফেলা থালা (আজকাল যে ‘মেশিন প্রেস্’-এ তৈরি শালপাতার কানা-উঁচু থালা মায় বাটিও পাওয়া যায় তা এসেছে বহু বহু পরে) গ্রামের মুদির দোকানে বেচে চাল-ডাল-তেল-নুনের দু পয়সা রোজগার৷ মহাজনকে জলের দরে দিয়ে দেওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা ক্যাঁদ গাছের পাতা, যাকে বলে কেন্দু বা তেন্দু, যা ভারতের হাজার হাজার কোটি টাকা বিড়ি-ব্যবসায় অপরিহার্য, আর অন্ধ্রপ্রদেশ-ওড়িশায় মাওবাদীদের জোগানো সাহসেই যার ন্যায্য দাম দাবির প্রথম আন্দোলন৷ কখনও বা আলুর বস্তার সাইজের মৌচাক ভেঙে উপরি টু-পাইস৷ আর শুধু গনগনে আগুন ঘিরে সান্ধ্য নাচের আসরের জন্যই নয়, শুকিয়ে জমিয়ে রেখে ভয়ঙ্কর অনটনের দিনে চাল-আটা না কিনতে পারলে সিজিয়ে খিদে মেটানোর জন্যে মহুয়া সোনালি হওয়ার অপেক্ষা৷ এ ছাড়া অসুখে-বিসুখে জঙ্গল থেকে তোলা নানা শিকড়-বাকল৷ এমনই দেখেছি আদিবাসীদের সঙ্গে জঙ্গলের সম্পর্ক৷ কিন্তু সে জঙ্গল হাতির আতঙ্ক তৈরির কারখানা— এমনটা আমাদের শৈশবে কখনও দেখিনি৷
আমাদের কৈশোর পর্যন্ত বাঁকুড়ার জঙ্গল ছিল নাক-চোখ-কানের হাজার কৌতূহল তৈরির ইস্কুল৷ সে কৌতূহল রক্তের মধ্যে এমন গুলে গিয়েছিল যে বাঘ-ভালুক-হাতি-হরিণ দেখতে জঙ্গলে যাওয়ার কথা আজও আমি কল্পনা করতে পারি না৷ দেখেছি অনেকই৷ জলদাপাড়া-হলংয়ের বাংলোর ঠিক পিছনে যে নুন-ঢিবি দেওয়া মাঠ, তাতে ফটফটে জ্যোৎস্নায় জানোয়ারদের যে থিয়েটার দেখেছি তা এখন মাঝে মাঝে স্বপ্ন মনে হয়৷ হরিণের পাল, লাফাতে লাফতে পিছু নেওয়া বাচ্চা সহ মা-গণ্ডার, একপাল বন-শুয়োর আর এক ঐরাবতের আশ্চর্য আসা-যাওয়া৷ আসলে দুনিয়ার সব জঙ্গলই সারাক্ষণ চলতে থাকা অনন্ত নাটকের মঞ্চ৷ সে মঞ্চে প্রত্যেকের আনাগোনা, অবস্থান, দাঁড়ানো, ক্রিয়াকলাপ নির্ধারিত হয় অন্যদের আনাগোনা, অবস্থান, দাঁড়ানো, ক্রিয়াকলাপের নিরিখে৷ উত্তেজনায় টানটান এক রুদ্ধশ্বাস মিজঁ-সিন৷ হরিণের পাল নিশ্চিন্তে ঘাস খেতে খেতে সহসা গলা উঁচু করে স্থির হয়ে যাবে, কারণ লাঙ্গুর বাঁদর মাটিতে পড়ে থাকা ফল কুড়িয়ে খাওয়া আর এ গাছ থেকে ও গাছে খেলাধুলো বন্ধ করে উঠে পড়েছে মগডালে, শুরু করেছে তার সতর্ক-বার্তা, ওয়ার্নিং কল৷ বাঘ৷ সে আসছে যে দিক দিয়ে হাওয়া বইছে ঠিক তার উল্টো দিক থেকে, যাতে হরিণের নাকে কিছুতেই তার গায়ের বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধ না পৌঁছয়৷ তার কানেও এসেছে লাঙ্গুরের ডাক৷ সে জানে এবার তাকে লুকিয়ে পড়তে হবে লম্বা ঘাস জমিতে৷ হনহনিয়ে চলা ছেড়ে গুড়ি মেরে মেরে, এক-পা এক-পা করে৷ কান খাড়া৷ শরীর গুটোনো৷ চোখ সোজা হরিণের পালের দিকে৷ লাঙ্গুর চুপ৷ সে আর দেখতে পাচ্ছে না বাঘ৷ মঞ্চে ফ্রিজ করে যাওয়া হরিণের পালের অতর্কিত দৌড়৷ হাওয়া যে দিকে বইছে সেই দিকে, কারণ তারা জানে তার উল্টোদিকের ওই ঘাসজমিতে ওঁত পেতে আছে মৃত্যু৷ পৌঁছতে হবে নদীর ওই বাঁকটা অবধি, কারণ ওখানে জলে নেমে মস্তি করছে হাতির পাল৷ বাঘ হাতিকে বড় ডরায়৷ যতটা পারে এড়িয়ে চলে৷ এই ভাবেই চলতে থাকে অরণ্যের রঙ্গমঞ্চের অনন্ত নাটক৷ যার রোমহর্ষক বর্ণনা পড়তে হলে তুলে নিতে হবে সেই আশ্চর্য মানুষটির লেখা— জিম করবেট৷ বিশেষ করে তার যে বইয়ের নাম— Jungle Lore!
আর আমার এই চিরকালের হিরো-র নামে নামাঙ্কিত অরণ্য জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক বা অভয়ারণ্যেই শুনেছিলাম সেই বজ্রনির্ঘোষ, উত্তরবঙ্গের এক ৮৬ বছরের বৃদ্ধ শিকারি আজ থেকে ২৫ বছরটাক আগে যাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘নাদব্রহ্ম’ বলে৷ ধিকালা৷ জিম করবেট অভয়ারণ্যের বেশ ভেতরে পর্যটকদের থাকার একটা কেন্দ্র৷ পিছনে পাহাড় গড়িয়ে নেমে যেখানে সমতলে মিশেছে কিছুটা নীচে, সেখানে বয়ে চলেছে সরু রামগঙ্গা৷ তার পিছনে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, তার পর জঙ্গল৷ বেলা তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে৷ শীতকাল৷ ন্যাতানো রোদ বাইরে৷ শুয়ে আছি ঘরে৷ চোখটা একটু লেগে এসেছে৷ হঠাৎ সেই ব্রহ্মনাদ৷ সারাটা ঘর কেঁপে উঠল ঝনঝন করে৷ মাত্র একবারই৷ এক লহমায় দৌড়ে রামগঙ্গার দিকে৷ দেখি পিঠে মাহুত একটা হাতি, যেমন হাতিতে চেপে জঙ্গল ঘোরানো হয় পর্যটকদের, সেই হাতি কান ছড়িয়ে, শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে৷ থরথর করে কাঁপছে৷ পাড়ে আমার মতো অনেকেই৷ কী ব্যাপার৷ না, বেশ মজা করছিলেন হস্তি মহাশয়৷ পাথর দিয়ে মাহুতের দলাই-মলাই৷ পাল্টা মাহুতকে ভিজোতে শুঁড়ের ফোয়ারা৷ এই সব চলছিল৷ হঠাৎ সেখানেই জল খেতে হাজির এক বাঘ৷ চকিতে মুখোমুখি৷ আর একত্রে চিৎকার৷ না৷ বাঘের দেখা মেলেনি৷ কোনও দিনই মেলেনি৷ সুন্দরবনে প্রাক্তন চোরা-শিকারির সঙ্গে ভুটভুটিতে রাতের পর রাত থেকে, দিনের পর দিন দশ ফুট খাঁড়িতে খাঁড়িতে ঘুরেও মেলেনি৷ একবার নয় অন্তত বার তিনেক৷ ডুয়ার্সের জঙ্গলে শুনেছি প্রচুর চিতাবাঘ আর ভালুক আছে৷ বছরের পর বছর টৈ টৈ করে ঘুরেও দেখা মেলেনি৷ কোনও আক্ষেপ নেই৷ আসলে সে সব দেখার জন্যে যারা অরণ্যে যায় আমি কদাচ সে দঙ্গলে নই৷
কারণ, ওই যে, সেই চার-পাঁচ বছর বয়েস থেকেই জঙ্গল আমার চোখ-নাক-কানের লাখ কৌতূহলের ইস্কুল৷ যতবার জঙ্গলে যাই, তা মেটাতে মেটাতেই দিন চলে যায়৷ বর্ষায় দার্জিলিং পাহাড়ে পড়ে থাকা পচা গাছের গুঁড়িতে গজিয়ে ওঠা ছত্রাক, মানে মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতা দেখেই আমার দিন কেটে যায়৷ কিংবা বুনো নাম-না জানা মাকড়শার জালের আজব নকশার ওপর ঝলমল করতে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা!
অরণ্যের সম্পর্ক
তিন ধরনের অরণ্যগামী মানুষ দেখেছি আমি— যারা পেটের টানে যায়, যারা নিখাদ কৌতূহল নিবৃত্ত করতে জঙ্গলের অগুন্তি রং, শব্দ, গন্ধের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়ায়, আর যারা জানোয়ার দেখতে যায়৷ (এখানে অবিশ্যি চোরাশিকারি আর ফরেস্ট অফিসারদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে গাছ কেটে পাচারকারীদের আমি ধরছি না)৷ বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব হিমালয়, ডুয়ার্স, খানিকটা উত্তর হিমালয়, একটু আধটু ঝাড়খণ্ড— এ সব অঞ্চলের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে আমার ধারণা হয়েছে, জঙ্গল বাঁচানোর পক্ষে কথা বলার লোক দ্বিতীয় আর তৃতীয় দলের মধ্যেই সব থেকে বেশি৷ এর মধ্যে জানোয়ার দেখতে জঙ্গলে যানেওয়ালারা অবিশ্যি জঙ্গলটাকে খানিকটা এক্সটিক চিড়িয়াখানা হিসেবেই দেখে— জঙ্গল ‘বেড়াতে’ গিয়ে মোবাইলে তারস্বরে ‘জানু মেরি জান’ চালিয়ে রেখেছে, এমন দেখেছি আকছার৷ কিন্তু তাদের সঙ্গেও জঙ্গলের একটা রোমান্টিক সেন্টিমেন্টাল সম্পর্ক থাকে৷ যেটা আমার মতো ওই মাঝখানের দলের লোকেদের মধ্যে থাকে আরও তীব্রভাবে৷ এ ছাড়া এই দু দলেরই একটা অংশ অন্তত ক্লাইমেট চেঞ্জ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, প্যারিস চুক্তি এ সব বিষয়ে দু-চার কথা জানায়, ‘পৃথিবীকে রক্ষা করতে’ (আসলে যার মানে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে) জঙ্গল বাঁচানো কতটা জরুরি তাও খানিকটা জেনে ফেলেছে৷
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, যে-কালো-কালো মানুষগুলো জঙ্গল-মহলের জঙ্গলে থাকে, তাদের মধ্যে এই অরণ্য-রোমান্টিকতা কিংবা মানব সভ্যতা রক্ষার তাগিদ কোনওটাই বিন্দুমাত্র নেই৷ তাদের মধ্যে ‘জঙ্গল’ বাঁচানোর কোনও ‘তাগিদ’ আমি অন্তত কোনও দিন দেখিনি৷ বিশাল কর্পোরেট কোম্পানির বড় বড় ক্রেন আর লোহার দৈত্যের মতো ভীষণ দেখতে মাটি তোলপাড় করা হরেক নাম-না-জানা যন্ত্র হাজির হলে তারা যে মাঝেমাঝেই ভয়ঙ্কর খেপে ওঠে, আমি মনে করি না সেটা ‘জঙ্গল’ বাঁচানোর জন্য৷ সেটা তাদের ভাতের থালায় হাত পড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে মানুষের অতি স্বাভাবিক রুখে দাঁড়ানো৷
আর তারা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ‘পবিত্র কুঞ্জ’, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘Sacred Grove’, সেই সেক্রেড গ্রোভে হাত পড়লে৷ কারণ ওই সেক্রেড গ্রোভ আসলে তাদের সেই ঠাকুরের নৈবেদ্য, যে ঠাকুর রক্ষা করে তাদের ভাতের থালা, যাকে আমরা ‘জঙ্গল’ বলে থাকি৷ কী এই সেক্রেড গ্রোভ? সরেজমিনে জেনেছিলাম এমনি এক সেক্রেড গ্রোভ-এ ঢুকে পড়ে৷ মাওফ্লাং৷ মেঘালয়ের রাজধানী শিলং শহর থেকে কিলোমিটার ২৫৷ গাড়ি নিয়ে চলেছি৷ উত্তরপূর্ব হিমালয়৷ দুনিয়ার সমস্ত সবুজ যেন একটা কাপড়ে কাচিয়ে শেষ বিন্দু পর্যন্ত নিংড়ে সেখানে ফেলেছে প্রকৃতি৷ তার মধ্যে দিয়ে চলেছে মিশকালো মসৃণ আঁকাবাঁকা হাইওয়ে৷ মূল রাস্তা থেকে যদ্দূর মনে আছে ডাইনে বাঁক নিয়ে কিছু দূর গিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ালো একটা জায়গায়৷ আর যাবে না৷ দড়ি দিয়ে বাঁধা চেকপোস্ট৷ এক খাসি ভদ্রলোক ২৫ টাকা না কত যেন একটা নিলেন৷ রিসিপ্ট দিয়েছিলেন কিনা আজ আর মনে নেই৷ এর পর হাঁটা৷ বিস্তীর্ণ ভেলভেট মাঠ৷ আর জায়গায় জায়গায় ছড়ানো বড় বড় পাথরের চাঙড়৷ অদ্ভুতভাবে সাজানো৷ মনোলিথ বা ওবেলিস্ক৷ পাশে খাসিদের লিংগ্দোহ্ উপজাতির গ্রাম৷ এই সব ওবেলিস্ক-এর সামনেই হয় সে গ্রামের নানা পরবের সময় বলি৷ ভেড়া বলি, মোরগ বলি৷ যেমন পরব তেমনি বলি৷ সেই ভেলভেট মাঠ— আক্ষরিক অর্থেই যাকে ইংরেজিতে বলে flushing meadow— পার করে ঢুকে পড়ি জঙ্গলে৷ অনির্বচনীয় সে অভিজ্ঞতা৷ দুনিয়ার কোনও ক্যামেরায় তা ধরা যাবে না৷ শুধু একটাই শব্দ চলতে পারে সে অরণ্যের বর্ণনায়— আদিম৷ লিখতে বসে চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছি কী দেখেছিলাম সেখানে— গাছ-লতাপাতা-ঝোপ৷ বিপুল সে সব গাছের গুঁড়ি আর মোটা মোটা ডাল থেকে পুরু হয়ে ঝুলছে শ্যাওলা৷ কয়েক লক্ষ ঝিঁঝি একসঙ্গে ডেকে চলেছে টানা৷ ঝিঁঝির ডাক যেমন সাধারণত কাঁপে— ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ— এটা সেরকম নয়, এটা একটা তীব্র ধাতব শব্দ একটানা— কিঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁ৷
আলো একটু কমে এল৷ হাল্কা একটা কুয়াশা৷ শিরশিরে ঠান্ডা৷ ৫০০০ ফুট৷ কোনও বাতাস নেই৷ এগিয়ে চলেছি৷ এমন কোনও জঙ্গলে এর আগে বা পরে আমি ঢুকিনি যার মধ্যে বহু ফ্যাঁকড়া বেরোনো সরু সরু পায়ে চলা পথ নেই৷ মাওফ্লাংয়ে নেই৷ মাটি থেকে গলা অবধি উঠে গেছে ঝোপ৷ মাথার ওপর থেকে, এপাশ ওপাশ চারপাশ থেকে গাছের ডালে জড়ানো ঘন লতা নেমে এসেছে মাটি অবধি, ঠিক যেমন লতা আঁকড়ে টারজান এ গাছ থেকে ও গাছে দোল খেতে খেতে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়! সব কিছু ভিজে ভিজে৷ সপসপে নয়, স্যাঁতসেতে৷ একটা বুনো ভারী গন্ধ, ভেজা মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে আটকে আছে৷ কারণ কোনও বাতাস নেই৷ যে দিকেই এগোতে যাই কিছু দূর এগিয়েই সামনে পুরু শ্যাওলা আর ছত্রাকে ঢাকা মোটা গাছের ডাল, কখনও গুঁড়ি৷ একটা গুঁড়ির ওপর পা রেখে টপকাতে যাই— ভস্ করে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে যায়৷ দেখে বোঝাই যায় না, ভিতরে ভিতরে পচে নরম হয়ে গেছে৷ কুল কুল করে লাল ডেঁয়ো পিপড়ে বেরিয়ে আসে৷ কিলবিল করতে করতে কী একটা চলে গেল৷ শিউরে উঠি এক মুহূর্ত৷ ঝিঁঝির টানা ডাক এখানে সেখানে ছিঁড়ে একটা কাক ডাকছে৷ গম্ভীর গলা৷ এটা দাঁড়কাক৷ চারপাশে তাকাই— কিচ্ছু নেই, শুধু গাছ আর গাছ আর মাটি থেকে গলা অবধি উঠে যাওয়া ঝোপ আর মাথার উপর থেকে, চারপাশের বিরাট বিরাট ডাল থেকে নেমে আসা মোটা মোটা লতা৷ হঠাৎ একটা অপার্থিব ভয় বুকের মধ্যে চেপে বসে৷ আমি একা৷ আমাকে কেউ দেখছে৷ লক্ষ রাখছে৷ আমার শরীরে এসে সে দৃষ্টি লাগছে৷ আরও কিছুটা যাই৷ দৃষ্টি চলেছে আমার সঙ্গে৷ চকিতে একবার ঘুরে দাঁড়াই৷ কিচ্ছু নেই, শুধু গাছ আর গাছ আর মাটি থেকে গলা অবধি উঠে যাওয়া ঝোপ আর মাথার উপর থেকে, চারপাশের বিরাট বিরাট ডাল থেকে নেমে আসা মোটা মোটা লতা৷ দৌড়নো শুরু করি৷ পালাতে হবে৷ বেরোতে হবে এই জঙ্গল থেকে৷ এ জঙ্গল আমাকে চাইছে না৷ I am not welcome here৷ এখানে সেখানে জল জমে আছে৷ পিচ্ছিল মাটি৷ আমি কোনও ক্রমে পিছলে পড়া সামলে দৌড়চ্ছি৷ আলোর দিকে দৌড়তে হবে৷ সে দিকেই সেই মাঠ৷ কতক্ষণ দৌড়েছিলাম কে জানে? আলোটা বাড়ল৷ মাঠ৷ যেখান দিয়ে ঢুকেছিলাম তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে৷ একটা মোনোলিথ৷ হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ি৷ গলানো সোনা রোদ৷ ঝিরিঝিরি একটা বাতাস বইছে৷ ‘শ্যার! আপ ইটনা, জলডি জলডি চলে আয়ে?’ বুকটা ধড়াস করে ওঠে৷ আমার অহমিয়া ড্রাইভার৷ গুয়াহাটি থেকেই আমার সঙ্গে আছে৷
উত্তর দিইনি সেদিন৷ মাওফ্লাং৷ ভেলভেট সবুজ পাহাড়ের খাঁজে ৭৮ হেক্টর জুড়ে ছড়ানো ছোট্ট একটুকরো সেক্রেড গ্রোভ৷ খাসি উপজাতির পবিত্র কুঞ্জ৷ হাজার বছর ধরে কোনও কিচ্ছু সঙ্গে নিয়ে এ অরণ্যে কেউ ঢোকেনি যা সেখানে সে ফেলে আসতে পারে৷ কঠোরভাবে নিষেধ৷ লাভাসা-র নিষেধ৷ নিষিদ্ধ কোনও কিচ্ছু নিয়ে বেরিয়ে আসা৷ একটা শুকনো পাতাও না৷ ফল, ফুল কিচ্ছু না৷ কঠোরভাবে নিষেধ আগুন জ্বালানো৷ যারা অমান্য করে তারা পথ হারিয়ে ফেলে৷ আর বেরোতে পারে না৷ খাসিরা জানে লাভাসা-র ক্ষমতা৷ আনা যায়— শুধু কিছু শিকড়-বাকল-পাতা ওষুধ হিসেবে৷ তাও বহু মন্ত্রতন্ত্র পড়ে, বলি দিয়ে, লাভাসাকে খুশি করে, বুঝিয়ে যে মানুষটাকে বাঁচাতে ও পাতাটা, ওই শিকড়টা দরকার৷ হাজার বছর ধরে লাভাসা নজর রাখছে এ জঙ্গলের ওপর৷ একবিংশ শতকে গমগমে ভারতের বুকে একটুকরো প্রগাঢ় আদিমতা৷ সমস্ত শরীরে আমি টের পাই এই আদিমতার সঙ্গে আমার অস্তিত্বের মৌলিক— প্রতিটা রোমকূপে রোমকূপে— বিরোধ আছে৷ আমার আর লাভাসা-র পাশাপাশি সহাবস্থান সম্ভব নয়৷
কিন্তু ওই খাসি মানুষগুলোর সম্ভব৷ এখনও সম্ভব৷ আমার মনে হয় যে সাড়ে দশ কোটি আদিবাসী মানুষ আছেন এ দেশে, তাঁদের হয়তো তিন চার কোটির সঙ্গে এ সহাবস্থান আজও সম্ভব৷ সেই জন্যেই সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে আছে এমন প্রায় এক লক্ষ ছোট ছোট সেক্রেড গ্রোভ৷ জঙ্গলের সঙ্গে আদিবাসীদের পেটের টানের সম্পর্ক যত কমবে, যত তাঁরা চাষাবাদে ঢুকে পড়বেন, চাকরি পাবেন, কিংবা ‘উন্নততর জীবন’ পেতে তাঁদের কৌম সমাজ ভেঙে যোগ দেবেন রাষ্ট্রের দলে, এই সেক্রেড গ্রোভের সংখ্যা কমবে৷ লাভাসারা তাঁদেরও ছেড়ে চলে যাবে৷ কিন্তু যেখান যেখান থেকে চলে যাবে লাভাসারা, সেখানে সেখানেই ফেলে রেখে যাবে আদিম অভিশাপ৷ বর্ণ-গন্ধ-শব্দে ঠাসা সেই আশ্চর্য জীবন-ভরপুর জঙ্গল হয়ে উঠবে মৃত্যু আর ভয়ের গোলকধাঁধা৷ তেমনটা যে আমি নিজের চোখে দেখেছি বাঁকুড়ায়৷ হাতি তাড়া করতে করতে, হাতির তাড়া খেতে খেতে৷
মাওফ্লাংয়ে গিয়ে আমার প্রথম মনে হয়েছিল যে, প্রকৃত জঙ্গলের সঙ্গে চাষাবাদ বা শিল্প সভ্যতার মানুষের সখ্যের সহাবস্থান সম্ভব নয়৷ শহুরে ‘যুক্তি’বাদী পাঠকের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও এক অতিন্দ্রীয় উপলব্ধিতে, ভয়ঙ্কর ভয়ের সুড়ঙ্গ বেয়ে, সেই মনে হওয়াটা এসেছিল৷ যদিও মাওফ্লাং পর্যটন আকর্ষণ৷ লোকেরা দিব্যি দল বেঁধে গিয়ে পোজ মেরে ছবিও তুলে আসে সেখানে৷ তাদের কাছ থেকে তোলা টাকাতেই চলে জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের উন্নয়ন, পুরোটা না হলেও খানিকটা৷ আমি নিশ্চিত কিছুদিন পরে লাভাসা সেই পবিত্র কুঞ্জ ছেড়ে চলে যাবে৷
যেমনটা আমি দেখেছি বাঁকুড়ার অরণ্যপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ‘থান থেকে’ বহুকাল চলে গিয়েছে ‘সিনি’, গবেষকের পাণ্ডিত্যের ভাষায় যার নাম ‘আবরণ দেবতা’৷ যদিও এখনও জঙ্গলমহল ঘুরলেই দেখা যাবে বট-আশুত-পাকুড় ইত্যাদি নানা গাছের নীচে সিঁদুর লেপা, পয়সা ফেলা ভাঙা, আধভাঙা, গোটা পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়া, থ্যাবড়া নাক, খাটো খাটো হাত-পায়ের ছোটো ছোটো পুতুল৷ সেই সবই হল ‘থান’৷ বগা সিনি, কুদ্রা সিনি, এক এক গ্রামের এক এক সিনির থান৷ অজস্র আজও আছে৷ কিন্তু সিনি নেই৷ যে সিনির নিয়ন্ত্রণে ছিল আশপাশের মনুষ্যজীবন, সে আর একেবারেই নেই৷ আর সিনির সেই ছেড়ে যাওয়া জঙ্গলে, বাঁকুড়ায়, পুরুলিয়ায়, পশ্চিম মেদিনীপুরে এসে হাজির হয়েছে ক্ষুধার্ত ক্রুদ্ধ মারমুখী হাতির পাল৷
সাল তারিখ আমার আজ ঠিক মনে নেই কিন্তু নিশ্চিত ১৯৮০-র দশকের একেবারে শেষের আগে নয়৷ ১৯৮৭-৮৮ হবে সম্ভবত৷ হঠাৎ এক ছুটিতে বাড়িতে, বিষ্ণুপুরে, এসে শুনলাম চাতালে আর যাওয়া যাচ্ছে না৷ কেন? না, বুনো হাতির পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে৷ আর আমায় পায় কে! তখন আমার ছিল দুরন্ত এক তিন গিয়ারের স্কুটার— প্রিয়া৷ প্রিয়াকে নিয়ে দৌড়৷ হাতির প্রতি আমার একটা অদম্য টান তৈরি হয়েছিল সেই ইস্কুল জীবনেই জিম করবেট পড়ে৷
জঙ্গলের সঙ্গে যাদের নয় খিদের সম্পর্ক, তাদের প্রত্যেকের জিম করবেট পড়া উচিত বারবার৷ জিম করবেট পড়ে জঙ্গল বাঁচানো যাবে না৷ কিন্তু জিম করবেট অনেক অনেকবার পড়ার পর কেন জঙ্গল, জীবনের যে আদিম কারখানার নাম জঙ্গল, সেই জঙ্গল আর বাঁচানো যাবে না তার একটা বোধ তৈরি হতে পারে৷ জিম করবেট পড়ে জানা যেতে পারে মানুষ কীভাবে তার নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে দুনিয়ার টুকরো টুকরো কিছু অংশকে এখনও ‘জঙ্গল’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেও রাখতে পারে৷ কারণ জঙ্গলের সঙ্গে যার খিদের সম্পর্ক নয়, সারা দুনিয়ায় তেমন মানুষদের মধ্যে জিম করবেটই প্রথম যিনি উপলব্ধি করেছিলেন আজ যা আধুনিকতম পরিবেশ আন্দোলনের গোড়ার কথা, আসল কথা— সরকারি আইন করে নয়, স্টুপিড, একমাত্র গণচেতনা তাড়িত গণআন্দোলন করেই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব, খানিকটা৷ নতুবা নয়৷
১৯৪৪৷ প্রথম প্রকাশ পেল জিম করবেটের প্রথম বই— The Man-eaters of Kumaon৷ সারা দুনিয়া জুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেল৷ লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি৷ আলাদা করে মার্কিন এডিশন৷ হলিউডের ছবি (যা দেখে করবেটের স্বভাবসিদ্ধ রসিক মন্তব্য ছিল— The tiger was the best actor!)৷ সেই থেকে আজ অবধি ধারবাহিকভাবে এ বই (এবং এর পর তাঁর লেখা আরও ছটি বইয়ের অনেকগুলিই) ‘বেস্ট সেলার’ লিস্টের তালিকায় রয়েই গিয়েছে৷ আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই৷ প্রথমে জানা গেল, শিকার কাহিনি অনেকই লেখা হয়েছে, কিন্তু তাকে এমন ‘হুডানিট থ্রিলার’ কেউ করে তুলতে পারেনি— প্রথমে ভিলেনকে শনাক্ত করা, তার পর সুকৌশলে তাকে খতম৷ তাই করবেট অনন্য৷
পরে খেয়াল হল, করবেট নিজে কিন্তু কখনও, একটিবারের জন্যও, তাঁর শিকার করা কোনও নরখাদক বাঘ-চিতাবাঘকে ‘ভিলেন’ বলছেন না৷ শিকার কাহিনির বাইরেও এখানে সেখানে লেখা তাঁর অনেক প্রবন্ধ সামনে এল, তিনি হয়ে উঠলেন ‘বাঘ সংরক্ষণের প্রথম প্রবক্তা’৷ তারপর খেয়াল হল, ইংরেজ হয়েও গাড়োয়ালের মানুষের প্রতি তাঁর আশ্চর্য ভালোবাসার কথা৷ আমরা প্রকৃত ‘ভারতপ্রেমী’ জিম করবেটকে আবিষ্কার করলাম৷ আর এই সেদিন, এক মহা-মার্কসবাদী উঠে পড়ে লাগলেন, তিনি প্রমাণ করেই ছাড়বেন যে করবেট আসলে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের চতুর দালাল৷ (ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলিতে প্রকাশিত সে লেখার গাল ভরা নাম— Jim Corbett’s Green Imperialism৷ নিশ্চিত ‘লাভাসা’ আর ‘সিনি’-রা এই বিপ্লবীকে ক্ষমা করেছেন, তাই প্রসঙ্গ বাড়ালাম না৷)
কিন্তু এরই মধ্যে কোথাও চাপা পড়ে গেল, আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের প্রথম সনদ, করবেটের ম্যান-ইটার্স অফ কুমাওঁয়ের ‘অথর্স নোট’-এর সেই অমোঘ কয়েকটি বাক্য— A tiger is a large hearted gentleman with boundless courage. If he is exterminated, as exterminated he will be, unless public opinion rallies to his support, India will be the poorer having lost the finest of her fauna৷ এখানে ‘unless public opinion rallies to his support’ হল ১৯৪৪-এ করা সেই অমোঘ আধুনিক উচ্চারণ— যদি জনমত তার পক্ষে না দাঁড়ায়৷ হক কথা করবেট সাহেব৷ পরিবেশ আর জঙ্গলের পক্ষে গণআন্দোলন যতদিন না শুরু হবে, ততদিন সব ‘ক্লাইমেট এগ্রিমেন্ট’ ঠনঠন ঢুন্ডুন রাম! হাতি তাড়া করতে করতে, আর হাতির তাড়া খেতে খেতে প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি কী গভীর সত্য এই উচ্চারণ৷