লাজবন্তী খান গুপ্তা
লেখক স্বর সম্রাট আলি আকবর খাঁ সাহিব মিউজিক ট্রাস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশনের ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর। মূল ইংরাজি থেকে লেখাটি বাংলায় তর্জমা করেছেন সুমিতা সরকার।
ছোটবেলায় দুই সঙ্গীতজ্ঞ মা-বাবার মধ্যে বেড়ে ওঠা, সেই সূত্রে বিস্তর ঘোরাঘুরি, আর এক বিশাল ও ব্যস্ত পরিবার যার বিস্তার একদিকে মাইহার থেকে কলকাতা হয়ে জয়পুর, আবার অন্যদিকে দিল্লি থেকে মুম্বই— আমাদের দিনগুলো ছিল হাসিখুশি আর আনন্দময় অভিজ্ঞতা নিয়ে বয়ে চলা একটানা অথচ সামান্য ঝাপসা একটা ছবি। কিন্তু সময় যত পেরোতে লাগল, সেই অস্পষ্টতা থেকে ফুটে উঠলেন একেকজন, যাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের মতো করে বিশিষ্ট। সম্পর্কগুলো আরও স্পষ্ট হতে থাকল, কিছু মানুষ আবার এমন প্রিয় হয়ে উঠলেন যে, তাঁরা সময়কে ছাপিয়ে তীব্রভাবে বেঁচে রইলেন আমাদের সঙ্গে— আমাদের মধ্যে।
পণ্ডিত রবিশঙ্করজি, যাঁকে তখন পিসেমশাই বলে ডাকতাম, ভারী আকর্ষণীয় মানুষ ছিলেন। মাইহার বা কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই প্রতিবার আমার গালে আলতো চাপড় মেরে মিষ্টি করে কথা বলতেন। খুব যে কথা হত তা নয়, কারণ আমি খুব একটা ‘গায়ে-পড়া বাচ্চা’ ছিলাম না, ভালোবাসতাম চুপচাপ দর্শক বা শ্রোতা হয়ে থাকতেই। আমরা তখন অন্নপূর্ণা পিসিমা (তাঁর তখনকার স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী) বা শুভদাদার (তাঁদের ছেলে, শুভশঙ্কর) সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম, পিসেমশাইয়ের সঙ্গে ততটা নয়। উনি ছিলেন আমার বাবার গুরুভাই। বাবা তাঁকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন (পণ্ডিতজির জন্মসাল ১৯২০, বাবার ১৯২২)। পণ্ডিতজি আবার ছিলেন খাঁ-পরিবারের আদরের জামাইবাবু— ভারতীয় পরিবারের একজন জামাইয়ের প্রাপ্য সবটুকু আদরযত্নই বর্ষিত হত তাঁর উপর। একধরনের অন্তরঙ্গতাও ছিল তাঁদের মধ্যে, যেটা বোঝা যেত যখন তাঁরা হেসে উঠতেন বা মুচকি হেসে ফিসফিস করে কথা বলতেন, অথবা যখন মঞ্চে যুগলবন্দি বাজাতেন, যা পরবর্তী সময়ে কিংবদন্তি-প্রতিম হয়ে উঠেছিল।
উস্তাদ আলি আকবর খাঁ ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর
আমার মা রাজদুলারী, আলি আকবর খাঁ আর পণ্ডিতজির মধ্যে ছিল এক স্নেহের বন্ধন— আমার যদ্দূর মনে পড়ে, তিনি ছিলেন মায়ের রাখিভাই। আর তারই ফলে এক অপূর্ব বাঁধন তৈরি হয়েছিল ননদ-বউদির মধ্যে— আমার মা আর পিসিমা… আর সেইসব ছিল আমার বেড়ে ওঠার সময়ের এক অন্যতম স্মরণীয় পর্ব, যার চারপাশে ঘিরে ছিলেন সম্পদের মতো মূল্যবান এবং প্রিয় মানুষেরা।
১৯৫৮ সালে আমার ছোটভাই দীনেশের জন্মের ঠিক পরে আমরা মুম্বইয়ের কোলাবায় আমাদের বাড়িতে চলে আসি। সেটা ছিল আমাদের প্রথম বাড়ি, আর সে কারণেই অসম্ভব প্রিয়ও। প্রায় সেই সময়েই বাবা-মা দীনেশকে নিয়ে পূর্ব আফ্রিকা সফরে চলে যান। তাঁরা ফিরে আসার পরেই নানান ঘটনা ঘটতে লাগল… কিছু তার সুখের, কিছু বা নয়।
পিসিমা কলকাতায় তাঁর কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুম্বই ফিরে এলেন। শুভদাদাকে নিয়ে তাঁর ফিরে আসার দিনটির কথা আমি কোনওদিন ভুলব না। ভুলব না স্টেশনে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। কখনও ভুলব না বাড়িতে পৌঁছনোর পর তাঁর অপূর্ব জীবন্ত চোখদুটি থেকে ঝরে পড়া বিষাদের কথা। আমার মা আর পিসিমা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিলেন। আমাদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, যতক্ষণ না অশ্রু যুক্তি ও শুশ্রূষাকেতার পথ ছেড়ে দেয়।
তিন ভাই
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে উস্তাদজি এবং পণ্ডিতজি
কিন্তু এখান থেকেই আমাদের জীবনের এক সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায় শুরু হল— যে অধ্যায় সঙ্গে নিয়ে এল পণ্ডিতজিকে, মালাবার হিলে তৈরি হল তাঁদের নতুন বাড়ি, সমস্ত শূন্যতা ভরে উঠল একে অপরের সঙ্গে থাকার আনন্দে। অনেক অপেক্ষার পরেই পাওয়া যায় এমন একাত্ম হয়ে কাটানোর মতো সময়— তা যতই মর্মান্তিক ও সংক্ষিপ্ত হোক না কেন; কঠোর সঙ্গীতসাধনার ফাঁকে মঞ্জুর করা একচিলতে সুযোগের ওপর যতই তা নির্ভর করুক না কেন। এক অদ্ভুত শুশ্রূষার পর্ব চলেছিল আমার পিসিমা আর পিসেমশাইয়ের মধ্যে; শুভদাদার হাসি আর ফুরোচ্ছিল না…
কোলাবা আর মালাবার হিলের বাড়ির মধ্যে যাতায়াত বেড়ে গেল দশগুণ… আর সকাল-সন্ধ্যায় বাজনার আসরে যাওয়া তো নিত্যদিনের উৎসবে পরিণত হল। জন্মদিনে বিশেষ করে আমার জন্য পাওনা ছিল মিষ্টি, তিলক, মালা আর বইয়ের পাঁজায় সাজানো অনুষ্ঠান। আমি সবচেয়ে বেশি কী চাই এটা কী করে তাঁরা জেনে ফেললেন? তা কি আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল? তাঁদের সংবেদনশীল মন কি তা অনুভব করেছিল? তাঁরা কি শুনে ফেলেছিলেন মায়ের বকুনি? তা কি বটুককাকাকে, আমাকে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই এনে দেওয়ার জন্য? কিংবা অনন্তরামদাদাকে, আমায় চাঁদমামা, রাজা ভাইয়া, পরাগ পত্রিকা এনে দেওয়ার জন্য? অথবা ছোটমামাকে, আমার পক্ষ নেওয়ার জন্য যখন মা ভয়ঙ্করভাবে আমার ওপর রেগে গিয়েছিলেন? নাকি বাবাকে, লুকিয়ে চাদরের তলায় বই পড়তে আমাকে টর্চ কিনে দেওয়ার জন্য-– যাতে আমি মায়ের রাগী গোয়েন্দা-দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাই?
মনে হয় তাঁর রাখিবোনকে এই ব্যাপারে বোঝানোর পেছনে ছিলেন স্বয়ং পণ্ডিতজি, সঙ্গে পিসিমাও; আর এখান থেকেই শুরু হল আমার বই সংগ্রহ করার ঝোঁক। সেগুলো বারবার করে পড়ে ফেলতাম, যতক্ষণ না আবার নতুন বইয়ের পাঁজা এসে পৌঁছচ্ছে সেইসব প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে।
একজন মানুষের সঙ্গে এমন মধুর সহমর্মিতা, এমন উজ্জ্বল বন্ধুত্ব কল্পনাও করা যায় না– যিনি কিনা একই সঙ্গে দূরের মানুষ, বিচ্ছিন্ন, আবার তাঁর একান্ত নিজস্ব ধরনে অসম্ভব স্নেহপ্রবণ। মনে পড়ে, একবার মা অভিযোগ করছিলেন সর্বক্ষণ রান্নাঘরে বাঁধা পড়ে যাওয়ায় রেওয়াজ করার সময় পাচ্ছেন না। মায়ের রাখিভাই সেটা শুনতে পেয়ে পরদিনই ছোটু নামে দুর্দান্ত এক গুজরাটি রাঁধুনিকে এনে হাজির করলেন… আর এই সব কিছুই ঘটল তাঁর অবিশ্বাস্য পরিমাণ কাজের মাঝে, সৃষ্টিশীল কাজ যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দাবি করে, ভ্রমণ আর যোগাযোগ আর রিহার্সাল আর রেকর্ডিং— অল্প কিছুসংখ্যক ‘সৃষ্টিশীল মানুষ’দের সঙ্গে যারা তাঁকে সবসময় ঘিরে থাকত।
কয়েক বছর পর আমি স্কুলে ফ্রেঞ্চ নিলাম। পণ্ডিতজি তাতে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন… হেসে আমাকে বললেন “পার্লে ভু ফ্রসেঁ?” যখন আমি উত্তর দিলাম “উই মঁ শের্ পিসেমশাই”, উনি আমার গালে একটি চুমু খেলেন আর বললেন “সেএ ত্রেস্ বিঅঁ শেরী।” তারপর আমার গর্বোজ্জ্বল বাবাকে বললেন, “আমাদের লাজো হবে একজন ভাষাতাত্ত্বিক সাহিত্যিক।” ওঁর আর পাঁচটা অমূল্য উক্তির মধ্যে এই কথাটিও আমি বাকি জীবনটা মনের মধ্যে লালন করব।
ওঁরা কী অসম্ভব পরিশ্রম যে করতেন… কিন্তু আমাদের জন্যও বিশেষ সময় করে নিতেন। ইচ্ছে করলেই সেই মধুর সময়খণ্ডগুলির স্বাদ নিতে পারি তাঁদের বাজনার আওয়াজের মধ্যে দিয়ে, সেই মূল্যবান ফোটোগুলি দেখে যেগুলো মা আমাকে ভরসা করে রাখতে দিয়েছিলেন।
‘অনুরাধা’ আর ‘গোদান’ সিনেমার প্রিমিয়ার, সঙ্গে ‘মেলোডি অ্যান্ড রিদম’, ‘নব রস রং’ ঐক্যবাদনের মঞ্চস্মৃতি এখনও মনে জ্বলজ্বল করে… ‘মেলোডি অ্যান্ড রিদম’ এবং ‘নব রস রং’ তাঁর বিশাল কীর্তি। এগুলি ছিল নানা শিল্পমাধ্যমের এক সমাহার, যেমন পুতুলনাচ, নৃত্যকলা, তাল ও সঙ্গীত, এবং মঞ্চে আলোছায়ার অপূর্ব খেলা। একইসঙ্গে এটি তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীদের জন্য একটি নিখুঁত প্রচারমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে তাঁরা তাঁদের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন।
যতই খ্যাতির সোপান বেয়ে উঠতে লাগলেন, পণ্ডিতজি ততই বিশেষভাবে পছন্দ করতে লাগলেন মঞ্চানুষ্ঠানকে এবং বৃন্দবাদনের দৃশ্য-নান্দনিকতাকে। সম্ভবত এর মধ্য দিয়ে একইসঙ্গে প্রতিভাত হত ভারতীয় রাজসভা ও সেখানে সঙ্গীতজ্ঞদের অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রাচীন ধারা, এবং পাশ্চাত্যের কনসার্ট ও অপেরা প্রদর্শনের ধরন। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু শিল্পী বেশি নজর দিতে থাকলেন তাঁদের পোশাকআষাক এবং চেহারার দিকে। উনি এতে অত্যন্ত বিরক্ত হতেন। তবে উনি ওনার তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গকে এক ছটাক কৌতুক দিয়ে নরম করে নিতেন। আমি ওঁকে একবার ব্যঙ্গ করে বলতে শুনেছি “সজ্জায় বেশি ভাব থাকলে, সুর ও তালের অভাব হয় তো দেখাই যায় না!”
সময় সরণী ধরে চলি! ষাটের দশক নিয়ে এল বীটলস্, উডস্টক ফেস্টিভ্যাল, পুরনো সিনেমায় সেতারের সুরের আবহে যোগসূত্রহীনভাবে প্রাচ্য বৈচিত্র্যকে দেখানোর চেষ্টা, আর একইসঙ্গে পাশ্চাত্যে মাদক ব্যবহার বাড়তে থাকা! যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তির সন্ধানে হিপি জমানা এবং ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ শ্লোগান! কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও কিছু বোধসম্পন্ন শ্রোতা তৈরি হচ্ছিলেন দূর সাগরপারে; আন্তরিক শ্রোতা যাঁরা আমাদের সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন গভীরভাবে; অনেকে এটি শিখতে শুরু করেছিলেন এবং এই পথে এগিয়ে চলেছিলেন।
আমাদের সুখের সময় ক্রমশ ছোট ছোট অবকাশকে জায়গা ছেড়ে দিতে লাগল। সেই অবকাশ ক্রমশ বৃহত্তর ব্যস্ততর হয়ে উঠতে লাগল যখন বাবা আর পণ্ডিতজির বিদেশভ্রমণ বাড়তে লাগল। এশিয়ান সোসাইটি ফর ইস্টার্ন আর্ট প্রথম বাবাকে শিক্ষক হিসাবে আমন্ত্রণ জানাল। শিল্পী/পরামর্শদাতা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছিল। অবশেষে কয়েকজন ছাত্রের কথায় তিনি রাজি হলেন নিজের ইন্সটিটিউশন খুলতে— দ্য আলি আকবর কলেজ ফর মিউজিক। প্রথমে এটি অস্থায়ীভাবে বার্কলে-তে শুরু হল। তারপর মারিন এবং আরও দু-একটা অস্থায়ী জায়গায় ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত স্থিতিলাভ করল সান রাফায়েল-এ। শুভদাদাও আমেরিকায় চলে এলেন, যদিও পিসিমা তাঁকে মিনতি করেছিলেন দেশে থেকে পিসিমার কাছে সঙ্গীতশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে। এর ফলে তাঁদের সম্পর্কে গভীর ফাটল ধরল। পিসিমা নতুন বাসায় একেবারে একা হয়ে গেলেন, যে বাসায় তিনি রেওয়াজ করতেন শান্তির পুনরাবির্ভাবের জন্য, যে বাজনা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর পিতার শিক্ষার কাছে।
তাই ১৯৭১-এ আমি যখন সানফ্রান্সিস্কোয় উড়ে গেলাম, গোল্ডেন গেট ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছলাম মারিন-এ, দ্য আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিক তখন টেরা লিন্ডা থেকে দ্য মারিন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে উঠে যাওয়ার কথা ভাবছে। পণ্ডিতজি তখন লস অ্যাঞ্জেলসের বাড়িতে থাকেন তাঁর সঙ্গিনী কমলা চক্রবর্তীর (মাসি) সাথে। আমরা তখন সবসময় একে অপরের বাড়ি যাওয়া আসা করছি, যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাকে নতুন করে তৈরি করার চেষ্টায়।
পণ্ডিতজি প্রায়ই মারিন-এ আসতেন, বিশেষ করে যুগলবন্দি বাজাতে আর স্কুলে শেখাতে। আমি জীবনে ভুলব না তাঁর শেখানো দুটি কণ্ঠসঙ্গীতের ক্লাস, যেখানে উনি ওনার সৃষ্ট দুটি কম্পোজিশন শিখিয়েছিলেন— দুটিই আমাদের পবিত্র জ্ঞানের দেবতাকে আবাহন করে— গণেশ ও তাঁর পিতা মহাদেব। উনি আমার বাসায় কটা রাতও কাটিয়েছিলেন— উত্তেজনায় আমি পাগলের মত রান্না করেছিলাম, আর আমার সমস্ত প্রিয়জনেরা আনন্দ করে খেয়েছিলেন এবং আমায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন আশীর্বাদে। এখন যখন পিছন ফিরে তাকাই, মনে হয়, দাদুর গুরুকুলে আমরা সকলে এক অকথিত ভালোবাসা আর বিশ্বাসের বাঁধনে বাঁধা ছিলাম, সে-বাঁধন ছিল সঙ্গীতের— একটানা শিক্ষার ব্যস্ততা, শান্ত আলাপ আর হাসিমজা— কী খাচ্ছি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, শুধু জানি যে সামান্যতম খাবারও অপূর্ব স্বাদের আর ভালোবাসার সঙ্গে পরিবেশিত… আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম যে আমি এখন যোগ্য অংশগ্রহণকারী হিসেবে বিবেচ্য হতে পারি— একইসঙ্গে স্কুলে ভাষা ও উচ্চারণ শেখানোর জন্য, এবং একজন দক্ষ গৃহকর্মী হিসেবে— ঠিক আমার দেশের প্রিয়জনেদের মত।
১৯৭২ সেপ্টেম্বরে দাদু যখন চলে গেলেন, আমরা তখন একসঙ্গে ছিলাম, কষ্ট পাচ্ছিলাম একইভাবে। আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল যেহেতু আমার স্বামীর দাদু খুব অসুস্থ ছিলেন এবং তাঁকে তাঁর পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে খান ও শঙ্কর পরিবারের সকলে এবং ছাত্ররা একত্রিত হলেন মুম্বাইতে, জাকির ভাই ও আব্বাজি সহ, এবং একটা ট্রেনে করে সকলে চললেন মাইহারে দাদুর শেষকৃত্যে অংশ নিতে।
একটা পুরো বগি ভর্তি করে আমরা বিভিন্ন-বাড়ি-থেকে-আসা খাবারের স্তূপসহ চললাম আঠেরো ঘণ্টার ট্রেনযাত্রায়। চলল সঙ্গীত বিনিময়, তবলা বোল, চুটকি, আর ছিল নিছকই পথের দুধারে গ্রামের দৃশ্য দেখার আনন্দ। ট্রেন পিপাড়িয়ার কাছাকাছি আসতেই পণ্ডিতজি আনন্দের সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠলেন! “দেখো,” উনি বললেন, “আমরা মিষ্টি মিষ্টি নামের স্টেশনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছি।” “পিপড়া কে পাতওয়া সারীখে ডোলে মনওয়া” সাহস করে গোদানের গানটা মনে করে বললাম, যেখানে একজন ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে আর গাইছে, মন তার কাঁপছে পবিত্র ডুমুর গাছের পাতার মত। পণ্ডিতজি হাসলেন, “মনে আছে তোমার?” “নিশ্চয়ই, পিসেমশাই … প্রত্যেকবার মাইহার যাওয়ার সময় আমার এই গানটা মনে পড়ে।”
মাইহারে সেই অসম্ভব ভালবাসার যাত্রাপথেই আমরা শেষবারের মত একত্রিত হয়েছিলাম— দিদিমার কাছে থাকার জন্য। শান্তভাবে তিনি তাঁর প্রিয়তম মানুষের চলে যাওয়াকে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিদিন বিকেল চারটেয় আমাদের বলতেন— “আমি তোমাদের দাদুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।” তারপর অস্থায়ী দরগার ভিতরে গিয়ে বসে থাকতেন, একে অপরের সঙ্গে থাকার জন্য; সেই সময়কে মনে করার জন্য যে সময় জুড়ে আছে দাদুর কণ্ঠস্বর আর পায়ের শব্দ, আর আছে তাঁর একটানা রেওয়াজের আওয়াজ, যা ঘুরে বেড়ায় আমাদের একান্নবর্তী বাড়ির প্রতিটি ঘরে— আমাদের গুরুকুলে!
পণ্ডিত রবিশঙ্কর, সুকন্যাশঙ্কর এবং অনুষ্কাশঙ্করের সঙ্গে লেখক
এগিয়ে চলি সময় সরণী বেয়ে। আমি আমার আমেরিকাবাসের কথা ভাবি, ভাবি সেই প্রবাস একজনকে কতরকম ভাবে প্রভাবিত করে। একইসঙ্গে এই ভাবনায় দৃঢ় হই যে আমাদের মহান সঙ্গীত রচয়িতারা আসলে জন্মজন্মান্তরের রোম্যান্টিক… তাঁরা বারবার প্রেমে পড়েন, বারবার। এর মধ্যে একধরনের সারল্য আছে… যাকে চেনা যায় আত্মার মাধুর্য রূপে! সেই ধারার গতিপথকে কেউ প্রশ্ন করে না। এমনকি সে যদি আঘাতও করে, তাকে স্বীকার করে নিতে হয়। পিসিমা তাঁর একাকী জীবন যাপন করতে করতে, মুম্বইতে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিতে দিতে, ছাত্র রুসি কুমার পান্ডিয়ার মধ্যে খুঁজে পেলেন এক চিরসাথীকে। রুসি কুমার শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিয়ে করতে রাজি করাতে পারলেন যাতে তিনি তাঁর সঙ্গী হতে পারেন। পিসিমা বিবাহবিচ্ছেদ চাইলেন। প্রাথমিক বাধা আর কিছু জঘন্য অভিজ্ঞতা পেরিয়ে (মূলত পুরুষদের দ্বারা), স্বীকৃতি এল, আর এল পিসিমার জন্য অকৃত্রিম সুখ। আর রুসি কাকু, তিনি সকলের মন জয় করলেন, যার মধ্যে আমিও আছি…… চিরকৃতজ্ঞ হয়ে।
তাছাড়া, কখনও পক্ষ নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি— কক্ষনও না। সঙ্গীতের ঐক্যময় শক্তির সামনে তা সম্ভব হয় না। গভীরতম শোক খুঁড়ে আনে মধুরতম ধ্বনি… স্বরগুলির মধ্যে তার আশ্রয় খুঁজে পায়, খুঁজে পায় মর্মভেদী নৈঃশব্দের মাঝে। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে অনুভব করি যে সে অনুসরণ করে সঙ্গীতের এক মুক্ত ঐতিহ্যকে। তার শিকড় এত গভীরে প্রোথিত যে তা শুধু দেশের নয়, অতিক্রম করে যায় কালের সীমাও।
পণ্ডিতজি তাঁর নিজের জন্য একটি চিরস্থায়ী আসন খোদাই করেছেন বিশ্বের সাঙ্গীতিক ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জিতে। তাঁর যাত্রাপথের প্রতিটি পদক্ষেপ, সাধনায় পূর্ণতা অর্জনের জন্য তাঁর ক্লান্তিহীন খোঁজ আজ সম্পূর্ণ। তাঁকে এবং অন্য প্রত্যেককে কাছে পাওয়া এক আশীর্বাদস্বরূপ, বিশেষ অধিকারস্বরূপ। আর এই মহিমময় আশীর্বাদের জন্য, চিরকাল কৃতজ্ঞতার আবরণে আবৃত থাকা যায়।
এপ্রিল ২৮ ২০২০
ছবিগুলি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
A tear drop in the vast canvas of life…in bengalee we say ” apoorba”..I don’t know the exact equivalent..