রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত
লেখক নাট্যব্যক্তিত্ব
ইব্রাহিম আলকাজির কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার কথা। নিজেকে সর্বক্ষণ সচেতন ও প্রস্তুত রাখা যেন তাঁর কাছে একটা মন্ত্রের মতো ছিল। এমনকি নিজের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেও তেমনটাই দাবি ছিল তাঁর। ছাত্রছাত্রীদের ক্ষমতা যতটা, নাট্যগুরু হিসেবে আলকাজি তার চেয়ে অধিক তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে জানতেন৷
মনে পড়ছে, আমরা একবার নান্দীকার-এর উৎসবে ওঁকে সম্মান জানাব বলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। উনি এসেছিলেন। আমরা ওঁকে সাম্মানিক হিসেবে যে অর্থটুকু দিয়েছিলাম, তা উনি না নিয়ে আমাদের গ্রুপের বাচ্চাদের জন্য দিয়ে গেলেন। নিজে হাতে সেবারের এক্সিবিশনটা সাজালেন। তাঁর সমস্ত কাজই নিখুঁত, নিজে প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী, কিন্তু তাঁর সব কাজে এই যে শৃঙ্খলা তা কিন্তু কখনও শৃঙ্খল বলে মনে হয়নি, বরং তা কাজের অলঙ্কার হয়ে উঠেছিল।
কলকাতায় আমরা যে থিয়েটার করে এসেছি বা এখনও করছি, আর আলকাজি সাহেব মহারাষ্ট্রে তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে থিয়েটার করে এসেছেন, এই দুইয়ের তুলনা করা অবশ্য ঠিক হবে না। তিনি যে থিয়েটারটা করেছেন তাতে উপকরণ, অর্থ ও আয়োজন এত বেশি যে বাংলায় থিয়েটার করতে বসে আমরা তা কখনও ভাবতে পারিনি। এখানে আমরা সবসময়ই একটা অভাবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থিয়েটার করেছি৷ তবে কাজ তো কাজই। সেই জায়গা থেকে উনি অসামান্য সব প্রোডাকশন করেছেন, আমাদের আগে উনি ‘তুঘলক’ করেছেন, ঠিক সেই সময় বাংলায় শম্ভু মিত্র প্রমুখ একইভাবে উৎকৃষ্ট মানের কাজ করেছেন। তবে এটা ঠিক, বাংলায় থিয়েটারের চর্চা বরাবরই বেশি ছিল, আজও তাই। হিন্দিতে যাকে বলে থিয়েটারের ‘মাহল’, সেদিক দিয়ে বাংলা বরাবরই কিছুটা এগিয়ে।
আলকাজি সাহেবের সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্তের স্মৃতি মনে পড়ছে। সালটা সম্ভবত ১৯৭৫। আমি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা দেখতে গেছি। আলকাজি স্বাভাবিকভাবেই তখন আমাকে চিনতেন না। আমি নিজের পরিচয় দিলাম। উনি তখন যত্ন করে নিজে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে আমাকে পুরো ক্যাম্পাস, জেন্টস হস্টেল, লেডিস হস্টেল, ক্লাসরুম, এমনকি টয়লেট অবধি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন৷ সেই অভিজ্ঞতা আমি কলকাতায় ফিরে ‘Now’ পত্রিকায় লিখেছিলাম। লোকে সাধারণত তেলা মাথায় তেল দেয়, কিন্তু এই যে আমার মতো একজন অচেনা অজানা মানুষকে এনএসডি-র অধিকর্তা হয়েও এতখানি গুরুত্ব দিলেন, প্রথম পরিচয়েই দায়িত্ব নিয়ে প্রতিপালন করলেন, এটা ইব্রাহিম আলকাজির চরিত্রের একটা বড় গুণ।
নানা বিরল গুণের অধিকারী এই মানুষটির প্রয়াণে ভারতীয় থিয়েটারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হয়ে গেল।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত