ইব্রাহিম আলকাজি
কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব ইব্রাহিম আলকাজি-র এই সাক্ষাৎকারটি প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে গৃহীত ও প্রকাশিত। সেই সময় আলকাজি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-র প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সেই সময়ে ভারতবর্ষে নাট্যমঞ্চের সামগ্রিক ছবি এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। 'Mainstream' পত্রিকার জন্য এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আনিস চিস্তি।
ভারতের থিয়েটার কি সত্যিই আবির্ভূত হয়েছে? আমাদের দেশের থিয়েটার ঐতিহ্য কি শুধুমাত্র ইতিহাসের উজ্জীবন নাকি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমসাময়িক উপাদানও আছে?
আমি জানি না আমাদের থিয়েটার ঐতিহ্য শুধুমাত্র ইতিহাসের উজ্জীবন— একথা বলতে ঠিক কী বোঝায়। আমরা কোন থিয়েটার ঐতিহ্যের কথা বলছি? বলা হয়, আমাদের প্রাচীন ধ্রুপদী ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছর আগে অবলুপ্ত হয়েছে। আবার বাংলা, গুজরাত, মহারাষ্ট্রে গত এক-দেড়শো বছরে থিয়েটারের ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। এই দুই ‘ঐতিহ্য’ কি পরস্পরের থেকে খুবই আলাদা?
ভারতের নিজস্ব থিয়েটার আবির্ভূত হয়েছে কি না এর উত্তর দিতে গেলে দেখা দরকার থিয়েটার কি বৃহৎ সংখ্যক মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠতে পেরেছে? মানুষ কি এক বিশেষ অভিজ্ঞতার অর্জনের জন্য থিয়েটার দেখে, যা অন্য কোনও শিল্প দিতে অক্ষম? নাকি সে স্রেফ অভ্যেসের বশে স্রেফ বিনোদনের জন্য থিয়েটারে যায়? এখানে আমি সেই উচ্চমার্গের থিয়েটারের কথা বলছি যা মানুষকে শুদ্ধ করে, উজ্জীবিত করে, তাকে এক সংবেদী, চিন্তাশীল, বুদ্ধিমান মানুষে পরিণত করে৷
আজকের ভারতীয় নাটক তার মূল্যবোধ তিনটি আলাদা আলাদা ঐতিহ্য থেকে আহরণ করেছে— প্রাচীন ধ্রুপদী, লৌকিক ও পাশ্চাত্য থিয়েটার। এই সময়ে যেহেতু এক প্রাণবন্ত আধুনিক থিয়েটার দরকার, তার জন্য আমাদের থিয়েটারকে এক নতুন দিশা দিতে হবে, এই তিন ঐতিহ্যের মধ্যে কোনটিকে অনুসরণ করতে হবে বলে আপনার মনে হয় এবং কেন?
কোন ঐতিহ্য অনুসরণ করতে হবে, সেটা প্রশ্ন নয়। জান্তব ও চলমান থিয়েটার তার অনুপ্রেরণা যে কোনও কিছু থেকেই নিতে পারে— ঐতিহ্য থেকে, পরিবেশ থেকে, এমনকি ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে অন্য দেশের আইডিয়া বা প্রভাবও আত্মস্থ করতে পারে। শিল্পী ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে অথবা ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে— দুভাবেই সৃষ্টিশীল হতে পারেন৷ কিন্তু মৃত ঐতিহ্য শুধুমাত্র ‘অনুসরণ’ বা পুনরুচ্চারণ করলে তিনি সৃষ্টিশীল নন। মৃত ঐতিহ্য আবার বেঁচে ওঠে না। ঠিক তেমনিভাবে জীবিত ঐতিহ্যকে মেরে ফেলাও যায় না৷ সম্ভবত যিশু খ্রিস্ট বলেছিলেন, ‘মৃতরাই মৃতদের কবর দিক।’
কোনও একটি বিশেষ ঐতিহ্য নিয়ে গোঁড়ামি নিষ্প্রয়োজন৷ যা কিছু জীবিত ঐতিহ্য, তাদের সবকটির প্রতিই আমার শ্রদ্ধা আছে।
যেমন, কারও কারও মতে সবচেয়ে তীব্র যে থিয়েটার আন্দোলন, বাংলার আধুনিক থিয়েটার, তার কথাই ধরো। আমরা বলতে পারি না, তা প্রাচীন ধ্রুপদী থিয়েটার থেকে এসেছে। বরং এতে পশ্চিমের প্রভাব সুস্পষ্ট। উৎপল দত্ত বা শম্ভু মিত্রর কথাই ধরা যাক। তাঁদের উপর স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেশট, পিস্ক্যাতোর এবং পরবর্তীকালের রাশিয়ান পরিচালকদের প্রভাব আছে। আমার মনে হয় আমরা প্রাচীন ধ্রুপদী থিয়েটারের কথা বলতে পারি না, কারণ নাটকের জীবন্ত ঐতিহ্যে তার উপস্থিতি প্রায় নেই।
আমরা লৌকিক ঐতিহ্য সম্পর্কে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কারণ আমাদের অনেকেরই আগের প্রজন্ম ছোট শহর বা গ্রাম থেকে এসেছে। তার মধ্যে অনেক আকর্ষণীয় ও ছবির মতো ব্যাপার আছে৷ মাটির গন্ধ আছে, সহজ কাব্যময়তা আছে৷ লৌকিক থিয়েটার অবশ্যই আধুনিক থিয়েটারে অবদান রাখতে পারে কিন্তু তা নিজেই সমসাময়িক থিয়েটার হয়ে ওঠার দায়িত্ব নিতে পারে না৷
আজ যখন আমরা অ্যাটম বম্বের কথা বলছি, পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলছি, তখন বিষয়গুলো ভীষণ জটিল হচ্ছে। সুতরাং নিজের ক্ষেত্রে আপাদমস্তক বিপ্লব না ঘটিয়ে থিয়েটার আর থাকতে পারবে না।
ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটক নিয়ে কথা বলে তখনই লাভ আছে যখন প্রচুর সমসাময়িক নির্মাতা সমসাময়িক দর্শকের জন্য সমসাময়িক বা ধ্রুপদী শৈলীতে সেরকম নাটক করছেন। সংস্কৃত ধ্রুপদী থিয়েটার নিয়ে কাজ করছেন। এমন কাউকে আমি তখনই গুরুত্ব দেব, যখন জানতে পারব শেষ তিন বছরে সে যথেষ্ট সমসাময়িক সংস্কৃত নাটকের জন্ম দিয়েছে। যদি সে শেষ দশ বছরেও তেমন কিছু না করে থাকে, তাহলে তার বিষয়ে কথা বলে লাভ নেই৷ কারণ মঞ্চের প্রায়োগিক সমস্যাগুলি মঞ্চেই সমাধান করতে হয়। নাট্যশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লাভ নেই, তাকে মঞ্চে প্রয়োগ করাটাই কাজ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রাসলীলা, রামলীলা, নৌটঙ্কি বা ভবাই— এই ধরনের নাট্যরূপগুলিতে কতটা গুরুত্ব আরোপ করা উচিত? তাদের কি আমরা সংরক্ষণ করব, না কি অবহেলা করব?
আমার মনে হয় না অবহেলা করা উচিত। সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীন এই সমাজে তা বড় কঠিন কাজ৷
আপনার মতে, অনূদিত সংস্কৃত নাটকের উপস্থাপনার সুযোগ কতটা ও তার সঠিক পদ্ধতি কী?
সংস্কৃত থেকে অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় নাটক অনুবাদ না হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে উপস্থাপনাটি ব্যক্তি নির্মাতার নিজস্ব কল্পনার উপর নির্ভর করবে৷
একজন হয়ত বুঝতে চাইল কীভাবে এই নাটকগুলি অতীতে প্রদর্শিত হত। স্টেজের অনুপাত ইত্যাদি নিয়ে ভাবার চেয়ে সে নিজেই নাট্যশাস্ত্রের নির্দেশমতো একটি স্টেজ তৈরি করে নিতে পারে ও একটি ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটক বাংলা, মারাঠি বা যেকোনও আধুনিক ভারতীয় ভাষায় উপস্থাপন করতে পারে। সেই নির্মাতার অবদান অবশ্যই স্বীকৃত হবে ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটক সংক্রান্ত অনুসন্ধানে ও গবেষণায়।
আবার কেউ হয়ত ভাবলেন, তিনি আধুনিক দর্শকের কাছে নাটকটি উপস্থাপন করছেন, তাই মৃচ্ছকটিক তিনি প্রসেনিয়ামে করলেন এআইএফএসিএস থিয়েটারে। এরকম নিরীক্ষাও মন্দ নয়।
তৃতীয় আরেকজন হয়ত বলল, প্রসেনিয়ামের যুগ চলে গেছে, তাই সে এরিনা স্টেজের আয়োজন করল ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটকের জন্য। এরিনা স্টেজকে আধুনিকতম আবিষ্কার ভাবা হয় থিয়েটারে, অথচ সত্যি তেমনটা নয়। তা অতি প্রাচীন। পথশিল্পীরা, সে যাদুকর হোক বা সাপুড়ে, তা বহুদিনই ব্যবহার করে।
তেমন উপস্থাপনা হলে, আমরা অবশ্যই এই নিরীক্ষকদের থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু সংস্কৃত নাটক পুনরুজ্জীবিত করতে হলে মনে রাখতে হবে যেন তার নিজস্ব সৌন্দর্য, কর্তৃত্ব ও গুরুত্ব বজায় থাকে। কারণ শৈলীর থেকেও সেই প্রাচীন শিল্পীর কল্পনা ও নিজস্ব আঙ্গিক বেশি শ্রদ্ধাযোগ্য।
আপনার একটি এক্সপেরিমেন্টাল এবং বহুচর্চিত কাজ, ‘অন্ধা যুগ’ নিয়ে কথা বলা যাক। অনেক টাকা ঢেলে এতে বিরাট কিছু প্রাপ্তি হয়নি— অনেকে বলেন। এ ধরনের সমালোচনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
প্রথমত এটি কোনও পরীক্ষামূলক নাটক ছিল না। সরল একটি উপস্থাপনা ছিল। শুধুমাত্র একটা ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষের প্রেক্ষাপটে নাটকটি অভিনয় করলেই তা পরীক্ষামূলক হয় না। আমার নাটক সম্পর্কে এমন সব দাবি করা হয়, যা আমি নিজে করি না। দ্বিতীয়ত, এটা ভুল যে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নাটক করলেই, প্রচুর খরচ হয়। ফিরোজ শাহ কোটলায় নাটকটি করতে আমাদের যা খরচ হয়েছে তা একই সংখ্যক শো করতে এআইএফএসিএস থিয়েটারে যা খরচ পড়ে তার চেয়ে কম।
আমার মনে হয় কৃপণ থিয়েটার করার বিষয়ে আমার খ্যাতি আছে, অল্প দিয়েই বিস্তর করতে আমি সক্ষম। তুলনামূলকভাবে বললে, একটা স্থানীয় গ্রুপ একটি প্রোডাকশন যে টাকায় বানায়, আমাদের স্কুল সে টাকায় পাঁচটি প্রোডাকশন বানায়। আমাদের মাত্রাজ্ঞানের কোনও ধারণা কি পাওয়া গেল?
শেষত, অন্ধা যুগ-এর কী প্রাপ্তি? তা হিন্দি থিয়েটারকে নতুন মর্যাদা ও মাত্রা দিয়েছে। প্রমাণ করেছে, আগে যাকে ব্যর্থ মনে করা হত, তা একটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি নাট্য। প্রমাণ করেছে এই স্কুলের একজন মাত্র ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট টার্ম-এর নাট্যছাত্র আশি ফুট স্টেজে চূড়ান্ত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে অভিনয় করতে সক্ষম।
জাতীয় থিয়েটার কি এখনই প্রয়োজন নাকি আমাদের বর্তমান মূলধন সারা দেশের থিয়েটার কর্মকাণ্ডের উন্নতিতে লাগানো উচিত ও জাতীয় নাট্যের আগমনের জন্য অপেক্ষা করা উচিত?
আমার মনে হয় সবর্দাই, ‘এখন’-ই জাতীয় নাট্যের উপযুক্ত সময়। ভবিষ্যতের অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা ফেলে রাখা যায় না৷ অনেক থিয়েটার আন্দোলন হয়েছে, ভারতের বড় বড় সব শহরেই থিয়েটার নিয়ে কাজ হয়েছে৷ বোম্বেতে অসংখ্য শ্রুত বা অশ্রুত কাজ হচ্ছে। কলকাতা, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ এমনকি দিল্লিতে— কোথায় না হচ্ছে!
ন্যাশনাল থিয়েটার শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশে অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় নাট্যদলের মূল্যবান অভিজ্ঞতা হবে সারা দেশে ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন ভূপ্রকৃতিতে অভিনয় করা৷ একজন শিল্পনির্দেশক থাকবেন, যিনি ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবেন। চুক্তির ভিত্তিতে এক বছরে তিনজন নির্মাতা কাজ করতে পারেন, যাঁরা আবাসিক রেপার্টারি কাম্পানিতে থিয়েটার শেখাবেন। একটা কুড়িজন মতো অভিনেতার কেন্দ্রীয় দল থাকবে। তারা শম্ভু মিত্রর মতো মানুষের সাথে কাজ করতে পারে, যিনি হয়ত আমন্ত্রিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক করলেন এক বিশেষ সময়ে। একই অভিনেতারা হয়ত তারপর অন্য এক নির্মাতার সঙ্গে কাজ করলেন, হয়ত কন্নড় থেকে হিন্দিতে অনুদিত কোনও নাটক করলেন। একই বর্ষে তৃতীয়জন হয়ত এলেন কোনও ধ্রুপদী পাশ্চাত্য নাটকের হিন্দি অনুবাদের অভিনয় করাতে। এই আবাসিক নাট্যদলের পাশাপাশি থাকবে আরও এক নাট্যদল যারা সারা দেশে ঘুরে বেড়াবে।
সাধারণভাবে এবং বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভালো থিয়েটার নির্মাণে আমেচার থিয়েটারের গুরুত্ব কী?
পশ্চিমে তো থিয়েটার আন্দোলন অনেকাংশেই অ্যামেচারদের শুরু করা। স্তানিস্লাভস্কি সহ অনেক বড় পরিচালকই অ্যামেচার হিসেবে শুরু করেছিলেন।
অ্যামেচার থিয়েটারের কিছু সুবিধা আছে। তাতে আছে সাহস, উদ্দীপনা, দৃষ্টিভঙ্গির সতেজতা, বৌদ্ধিক সংহতি এবং যার ফলে তাদের আত্মাকে শয়তানের কাছে বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে না৷
বিশ্ববিদ্যালয় তো পথপ্রদর্শক হতে পারে প্রগতিশীল থিয়েটার আন্দোলনের। পশ্চিমেও তেমনটাই হয়েছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ড্রামাটিক সোসাইটির দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। সচরাচর প্রফেশনাল থিয়েটার আমেচার থিয়েটারের জন্য নীতিনির্ধারণ করে না, বরং উল্টোটাই ঘটে।
(মেইনস্ট্রিম, অক্টোবর ১০, ১৯৬৪)