হেগড়ের বোমাবাজি: বিএসএনএল ও দেশপ্রেম রহস্য

সুজন ভট্টাচার্য

 


লেখক প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক

 

 

 

 

‘গোটা বিএসএনএল বিশ্বাসঘাতকে ভরে গেছে। … বিএসএনএল-এর কর্মীরা বিশ্বাসঘাতক, এক সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতির জন্য তারা কাজ করতে রাজি নয়। সরকার বিএসএনএল-কে বেসরকারি হাতে তুলে দিলেই ৮৮ হাজারের বেশি কর্মচারীকে লাথিয়ে বের করে দেওয়া হবে।’ কোনও ফালতু লোকের কথা নয়। ব্যবসাক্ষেত্রে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা নয়। ১০ আগস্ট কথাগুলো বলেছেন বিজেপি-র এমপি অনন্তকুমার হেগড়ে। যে সে লোক নন তিনি। নরেন্দ্র মোদি-র প্রথম দফার সরকারে রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। দপ্তরটাও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। Skill Development & Entrepreneurship। এখন অবশ্য ভোটে জিতলেও মন্ত্রীর কুর্সি-টা চলে গিয়েছে। হয়তো সেই জন্যই হেগড়ে এখন উঠেপড়ে লেগেছেন প্রধানমন্ত্রীর নেকনজরে আসার জন্য। বিএসএনএল-এর কর্মীদের ফাঁসিকাঠে তোলবার আগে এই হেগড়ে সাহেবের রিপোর্ট কার্ড-টা একবার দেখে নেওয়া যাক।

প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোজগার এবং কর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালেই তৈরি করা হল National Skill Development Corporation of India। আর ঘোষিত হল ‘প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা’ যা PMKVY নামেই পরিচিত। আর বিভাগীয় মন্ত্রী হিসাবে তার দায়িত্ব ছিল হেগড়ে সাহেবেরই। শুরুতে বেশ হইহই করে বাজারে সাড়া জাগিয়েছিল এই প্রকল্প। নানাধরনের কাজের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বহু সংস্থা এগিয়েও এল। কিন্তু মাসতিনেক যেতে না যেতেই বোঝা গেল কর্মসংস্থান মুখের কথা নয়। তার পরিকাঠামো তৈরির দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। সেটার মুরোদ অন্তত তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের যে নেই, মাথারা সেটা সবথেকে ভাল জানতেন।

যখনই বোঝা গেল আর যাই হোক কর্মসংস্থানের গল্প নেই, তখনই শুরু হয়ে গেল খেল। রাতারাতি প্রকল্পের শর্ত বদলে ফেলা হল। কর্মসংস্থানের দায়িত্ব ঠেলে দেওয়া হল প্রশিক্ষক সংস্থার উপরেই। একেকজন প্রশিক্ষিত অন্তত ছয় মাস উপার্জন করছেন প্রমাণ না দিতে পারলে প্রশিক্ষণ সংস্থা তার প্রাপ্য টাকা পাবে না। না, অসুবিধে কিছু নেই। সরকার আমাদের চিরসদয়। তাই কর্মসংস্থানের সঙ্গে প্রশিক্ষণের কোনও সম্পর্ক রাখার কাহিনি আর রইল না। অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ যদি কোনও সংস্থায় ঝাড়ুদারের চাকরি করে, তাতেও চলবে। তাহলে প্রশিক্ষণের দাম কী রইল, এই প্রশ্ন তুলতে গেলেই কড়া চোখের ধমকি। ফলে দু বছরের মধ্যেই রাফায়েল কিংবা সুপ্রিম কোর্টের বিজয় মাল্য-র ফাইলের মতই ভারতের আকাশবাতাস থেকে মুছে গেল Skill India শব্দটি। দ্বিতীয় দফায় তার নাম আর কেউ নেয়নি।

কথাগুলো বলতে হল শ্রীযুক্ত অনন্তকুমার হেগড়ের কর্মদক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যই। না, বিজ্ঞাপনের নামে বিপুল সরকারি টাকা সাইফন হয়ে যাবার পরেও তার নামে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ কেউ তুলবেন না। কারণ তুললেই সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট, র, ইনকাম ট্যাক্স সব্বাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই মানুষটিই বিএসএনএল-এর কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুললেন। কেন তাঁরা দেশদ্রোহী? হেগড়ে উত্তর দিয়েছেন, ‘সরকার অর্থ দিয়েছেন, জনগণের পরিষেবা চাই এবং পরিকাঠামো-ও প্রস্তুত। তবুও এরা (বিএসএনএল কর্মীরা) কাজ করবে না। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল ভারতের কথা বলছেন, তহবিল আর প্রযুক্তি দিয়েছেন। আর এরা কাজ করতে আগ্রহী নয়।’ ব্যস, আর কোনও বিচারের দরকার আছে? সাতদিন ফাঁসি-র হুকুম তো শ্রীযুক্ত হেগড়ে দিয়েই দিয়েছেন।

কোনও সন্দেহ নেই বিএসএনএল-এর কর্মীরা সব্বাই বিশ্বাসঘাতক, দেশের সঙ্গে গদ্দারি করছেন। আসুন আমরা সেই গদ্দারির নমুনাটা ভাল করে বুঝে নিই যাতে অদূর ভবিষ্যতে যখন বিএসএনএল-নীতাভাবির ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে উপঢৌকন দেওয়া হবে, তখন আ‘মোদি’ত হয়ে থালাবাটি পেটাতে পারি। হেগড়ে সাহেবের বক্তব্যের তিনটি পয়েন্ট।

১। প্রধানমন্ত্রী বিএসএনএল-কে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়েছেন।

২। উপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রযুক্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

৩। বিএসএনএল কর্মীরা তাও কাজ করে না বলেই প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং বেসরকারিকরণ করতেই হবে।

তাহলে এক এক করে অভিযোগগুলো দেখা যাক। হেগড়ে সাহেবের সুবিধার জন্য আমরা পিছন থেকে হাঁটতে শুরু করি।

 

বিএসএনএল ও কর্মসংস্কৃতি

এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে বিএসএনএল-এর কর্মসংস্কৃতি অন্যান্য বেসরকারি টেলিকম সংস্থাদের তুলনায় খুবই খারাপ। লাইন পেতে দেরি হয়, লাইন খারাপ হলে সারাতে জান কয়লা, বিল নিয়ে সমস্যা হলে দৌড়তে দৌড়োতে পায়ের নড়া খুলে যাবে, ইত্যাদি অভিযোগের পাহাড় জমে আছে ইতিমধ্যেই। সবটা হয়তো সত্যি নাও হতে পারে। কিন্তু অনেকটাই সত্যি। যতদিন ভারতে অন্য কোনও টেলিকম অপারেটর ছিল না, তখন না হয় মানুষ মেনে নিতে বাধ্য ছিল। কিন্তু এয়ারটেল, ভোডাফোন বা সাধের দাদাবৌদির জিও-র সঙ্গে তুলনা করলেই বিএসএনএল-এর হাল-টা বোঝা যাবে। তাহলে মানুষ যাবে কেন বিএসএনএল-এর কাছে? এই যে গ্রাহকসংখ্যার বিচারে আজ জিও, ভোডাফোন আর এয়ারটেল বিএসএনএল-কে টপকে গেছে, সে কি আর এমনি এমনি? গ্রাহক অপদস্থ হয় বলেই অন্যত্র সরে যাচ্ছেন। এইভাবে অপদস্থ করে কারা? নিঃসন্দেহে কর্মচারীরাই। ফলে ইউক্লিডিয় জিওমেট্রির স্বতঃসিদ্ধ, কর্মচারীদের জন্যই বিএসএনএল ডুবেছে।

আসুন, একটা মজার তথ্য দিই। ট্রাই-এর তথ্য অনুযায়ী গতবছর ভারতে বিভিন্ন অপারেটরের গ্রাহকসংখ্যাটা একবার দেখা যাক:

অপারেটর গ্রাহক (কোটি) শতাংশ
রিলায়েন্স জিও ৩৭.০০ ৩১.৪১
ভোডাফোন-আইডিয়া ৩৩.২৬ ২৮.২৩
ভারতী এয়ারটেল ৩২.৭৩ ২৭.৭৮
বিএসএনএল ১১.৮১ ১০.০২
অন্যান্য ৩.০০ ২.৫৫
মোট ১১৭.৮০ ১০০.০০

 

দেখাই যাচ্ছে, টেলিকম সার্ভিসের প্রায় ৮৮ শতাংশ তিন প্রাইভেট অপারেটরের হাতে। বিএসএনএল সেখানে এক নগণ্য খেলোয়াড়। ঠিক আছে। তাহলে এ বছর এপ্রিল মাসের চেহারাটাও একবার দেখা যাক:

অপারেটর গ্রাহক (কোটি) শতাংশ
রিলায়েন্স জিও ৩৯.৫৮ ৩৩.৮৫
ভোডাফোন-আইডিয়া ৩২.০১ ২৭.৩৭
ভারতী এয়ারটেল ৩২.৭৯ ২৮.০৬
বিএসএনএল ১২.২০ ১০.৪৩
অন্যান্য ০.৩৬ ০.২৯
মোট ১১৬.৯৪ ১০০.০০

আহামরি কিছু বদলাল কি? সেটাও নাহয় একবার দেখা যাক –

 অপারেটর গ্রাহক (কোটি)
২০১৯ ২০২০ বৃদ্ধি হার
রিলায়েন্স জিও ৩৭.০০ ৩৯.৫৮ ২.৫৮ ৬.৯৭
ভোডাফোন-আইডিয়া ৩৩.২৬ ৩২.০১ (-) ১.২৫ (-) ৩.৭৬
ভারতী এয়ারটেল ৩২.৭৩ ৩২.৭৯ ০.০৬ ০.১৮
বিএসএনএল ১১.৮১ ১২.২০ ০.৩৯ ৩.৩০
অন্যান্য ৩.০০ ০.৩৬ (-) ২.৬৪ (-) ৮৮.০
মোট ১১৭.৮০ ১১৬.৯৪ (-) ০.৮৬ (-) ০.৭৩

 

তাহলে কী দাঁড়াল? লকডাউনের মধ্যে ভারতে টেলিকম গ্রাহকের সংখ্যা সামান্য হলেও কমেছে। সবথেকে বড় আঘাত খেয়েছে ছোট-ছোট সংস্থা আর ভোডাফোন-আইডিয়া। এয়ারটেল মোটামুটি একই জায়গায় রয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়েছে রিলায়েন্স জিও। আর তার পরেই আছে বিএসএনএল। কর্মীরা যদি কাজ না-ই করে, তাহলে এটা সম্ভব হল কী করে? তাহলে তো অঙ্ক মিলছে না। হেগড়ে সাহেবের হিসাবটাই তো ভিত্তিহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে?

হ্যাঁ, হেগড়ে সাহেব বলতেই পারেন, সরকার যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছেন, সেই অনুপাতে কিছুই হয়নি। সেই অঙ্কটা একবার তাহলে দেখা যাক।

 

সরকারি অনুদান: ঘোষণা ও বাস্তব

গতবছর সেপ্টেম্বর মাসেই বিএসএনএল এতটাই আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যে কর্মচারীদের মাইনে দেওয়াও আটকে যায়। এই পরিস্থিতিতে সংস্থার কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ দাবী করেন। তারা দাবী করেন উপযুক্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে না বলেই বিএসএনএল ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তারা সংস্থার পুনরুজ্জীবনের জন্য ৭৪,০০০ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ দাবী করেন। ১০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। বরং বিএসএনএল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ৯০,০০০ কোটি টাকার তহবিলের কথা বলেন। যারাই সামান্য পাটিগণিত শিখেছেন, ধ্যাষ্টামোটা বুঝে যাবেন। যাই হোক, কেন্দ্রীয় সরকারের এই ঘোষণায় দেশজুড়ে ব্যাপক শোরগোল পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকার ৬৯,০০০ কোটি টাকার পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করেন।

এই প্যাকেজের চারটি অংশ। বিএসএনএল আর এমটিএনএল-এর সংযুক্তি, বাজারে বন্ড ছেড়ে এবং অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে আর্থিক ক্ষমতা বাড়ানো, স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প চালু করা এবং ফোর-জি পরিষেবা চালু করা। নিঃসন্দেহে খুব ভালো খবর। তাহলে তো হেগড়ে সাহেব ভুল কিছু বলেননি। তাহলে দেশদ্রোহী কর্মচারীদের জন্যই বিএসএনএল এখনও দাদাবৌদির জিও-কে টপকে যেতে পারল না। মুশকিল, মুশকিল। প্যাকেজ ঘোষণার চার মাস পরে এই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএসএনএল কর্মচারীরা দেশব্যাপী অনশন কর্মসূচি পালন করেন। কেন? কর্মচারী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, প্যাকেজ ঘোষিত হলেও বাস্তবে কেবল স্বেচ্ছাবসর ছাড়া আর একটিও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি ৮০০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সিলমোহর দিলেও সেটাও বাস্তবায়িত হয়নি।

তাহলে কী দাঁড়াল? যে আর্থিক সাহায্য বা তহবিলের কথা হেগড়ে সাহেব বলেছেন, সেটা বাবা বিশ্বনাথের গাঁজার কলকের ধোঁয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাস্তবে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প নিয়ে চাপাচাপি করা ছাড়া সরকার অন্য কোনও সাহায্য করেনি। এমনকি ফোর-জি স্পেকট্রাম-ও বরাদ্দ করেনি। আজকের বাজারে যে ফোর-জি পরিষেবা ছাড়া টক্কর নেওয়া যায় না, সেটা শিশুরাও জানে। ঠিক সেই জায়গাটাতেই কুড়ুলের কোপ মেরে রেখেছে সরকার। আর সেই পাপ যাতে ধরা না পড়ে তার জন্য কর্মীদের দেশদ্রোহী সাজালেন অনন্তকুমার হেগড়ে। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে সংযোগ রক্ষার জন্য ইলেকশন কমিশনের নির্দেশে বিএসএনএল-কে ফোর-জি স্পেকট্রাম ব্যবহার করতে দিতে সরকার বাধ্য হয়। ব্যস, ঐ পর্যন্তই।

 

দেশদ্রোহী কে

২৩ অক্টোবর, ২০১৯ পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করেও আজ পর্যন্ত সেটা বাস্তবায়িত করা হয়নি। বিএসএনএল-এর ঠিকা-শ্রমিকরা তো বটেই এমনকি স্থায়ী কর্মচারীদেরও মাইনে হয়ে পড়েছে অনিয়মিত। আর সরকার এই চাপটা রেখে যাচ্ছে যাতে ভয়ে স্বেচ্ছাবসর নিতে সবাই বাধ্য হয়। লকডাউনের মোচ্ছবের মধ্যে সরকারি সংস্থা বেচে দেবার যে মহান বাসনা কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছেন, বিএসএনএল-এর নাম সেই তালিকাতেও আছে। দেবর লক্ষ্মণ যদি রাজপাটে বসেন, তাহলে নীতা ভাবিজির আহ্লাদের কথা তো মাথায় রাখতেই হয়। বিএসএনএল যদি তুলে দেওয়া যায়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সর্বোচ্চ লাভবান হবে জিও। সেই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই নোংরামো। দেশের জনগণের করের টাকায় বানানো সরকারি সম্পদ যারা এইভাবে নয়ছয় করে আসল দেশদ্রোহী তো তারাই।         

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4657 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...