সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
লেখক পেশায় প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষক। বিশ্বসাহিত্য, মার্গ সঙ্গীত আর সারা পৃথিবীর সিনেমার একনিষ্ঠ ভক্ত
তন্নিষ্ঠ অনুধ্যানে শিল্পী রাগ সাধছেন… “সখিরি ভোর হুয়েঁ হরি দর্শন কো যাও…”। কাফি ঠাটে রাগ হংসকিঙ্কিণীর সঙ্গে অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ রাগ ‘পটদীপকি’, যদিও পূর্বোক্ত রাগটিতে যেখানে ধ্যানশ্রীর অঙ্গসৌষ্ঠব, সেখানে পটদীপকি গাওয়া হয় ভীমপলাশের অঙ্গে – ফলত মধ্যম অত্যন্ত প্রবল। হরিদর্শনের আকুতিই হয়তো রাগের শ্রুতির উপান্তে এসে মিশে যায় জীবনরাগের প্রয়াগতীর্থে। আসরে আরও কিছু দুর্লভ রাগের সঙ্গে এই রাগটিও প্রায়ই শোনাতেন পণ্ডিতজি, পণ্ডিত যশরাজ। ওঁর দাদা মেওয়াতি ঘরের প্রণম্য শিল্পী পণ্ডিত মণিরামও এই রাগে সিদ্ধ ছিলেন। কিছু রাগ হয়তো শিল্পীর জীবনবোধ বা নিহিত যাপনের সঙ্গে আত্মীকৃত হয়ে যায় এমনভাবে, যাতে ওই রাগের চলন হয়ে যায় কবির কথায় ‘আলোর পানে প্রাণের চলা’। এক বিরাটের পানে যখন প্রাণের আহ্বান ডাক দেয় সুরের অর্ঘ্যে তখন এমন কিছু গায়ন বা বাদন হয়তো সম্ভব, যাকে ‘ডায়লেক্টিক’ ভাষ্যে আমরা ‘কন্টেমপ্লেটিভ’ আখ্যা দিতে পারি। পণ্ডিত যশরাজ সেই ধারার শিল্পীদের মধ্যে এক অন্যতম মোহিকান হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন, এই আবছায়া সময়ে। ফলে, গত ১৭ অগস্ট, ৯০ বছর বয়সে তাঁর পার্থিব শরীরের ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীকে আমরা হারালাম, রিক্ত হলাম মৌসিকির গহীনে।
ওঁর বাবা পণ্ডিত মোতিরামের কাছে প্রাথমিক স্বরশিক্ষা শুরু হলেও তাঁর অকালপ্রয়াণে তবলা শিক্ষার দিকে সাময়িক ঝোঁক হয় পণ্ডিতজির। যদিও যৌবনের দ্বারপ্রান্তেই তিনি তবলিয়া এবং সারেঙ্গী শিল্পীদের তৎকালীন সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়ে আবার ফিরে আসেন কণ্ঠসঙ্গীতের আঙিনায়। এই পর্বে তাঁকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিলেন বিদূষী আখতারি বাঈ। জানি না সুরসরস্বতী বেগম আখতারের প্রভাবেই কি না, খেয়ালের সঙ্গে ঠুমরিতেও সমান সাবলীল ছিল পণ্ডিতজির অধিকার।
মেওয়াতি ঘরানার যে ঐতিহাসিক রূপটা আমরা পাই সেখানে দিল্লির কাওয়াল বাচ্চোঁ কি ঘরানার সঙ্গে গোয়ালিয়রের ঐতিহ্য অঙ্গীকৃত হয়েছিল। এই ঘরানার প্রবক্তা বলে খ্যাত দুই ভাই ওস্তাদ ঘগ্গে নাজির খান এবং ইন্দোরের বীণকার ওস্তাদ ওয়াহিদ খান তাঁদের পৈতৃক সূত্রে কাওয়াল বাচ্চোঁ ঘরানায় মতো চঞ্চল তানকর্তব এবং মায়ের সূত্রে গোয়ালিয়র ঘরের নিষ্ঠ ও স্থিতধী গায়কী পেয়েছিলেন। তাঁদের মা ছিলেন গোয়ালিয়র ঘরের অন্যতম প্রবক্তা ওস্তাদ হদ্দু খানের কন্যা। ফলে সুরের সচ্চাই-এর সঙ্গে তানের প্যাঁচ-পয়জার আত্মীকৃত হয়ে এক অন্য মহিমা লাভ করে মেওয়াতি ঘরানা (রাজস্থানের মেওয়াত-এর অনুষঙ্গে)। এই ঘরের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয় তদ্গত ভাবের প্রকাশ এবং সেই কন্টেমপ্লেটিভ গায়নভঙ্গির অনুষঙ্গে। পণ্ডিত মণিরাম এবং পণ্ডিত যশরাজ, দুজনেই এই বিরাট ঐতিহ্যকে বর্ণনা করেছেন ‘শুদ্ধ বাণী’, ‘শুদ্ধ মুদ্রা’ এবং ‘শুদ্ধ সুর’ এর ত্রিবিধ সঙ্গমে।
সুফিয়ানা মৌসিকির ঐতিহ্যের সঙ্গে পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মের ভক্তিরসের একটি ধারা যুক্ত করেন পণ্ডিত যশরাজ, যেখানে মথুরা, বৃন্দাবনের প্রাচীন কীর্তনকার ধারার অনুষঙ্গে ‘হাভেলি সঙ্গীত’ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল তাঁর গায়নে। বলা যায়, শিয়া ঐস্লামিক ঐতিহ্যের সঙ্গে হিন্দু আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের ধারা একাঙ্গীভূত হয় পণ্ডিতজির প্রচেষ্টায়। এই ঘরের পণ্ডিত জয়বন্ত সিং-এর মতোই, ভক্তিরসে পরিপূর্ণ অসংখ্য বন্দিশ রচনা করে ঘরানার সামগ্রিক পরিধি বা ‘রেপার্টোয়ার’কে সমৃদ্ধ করেছিলেন পণ্ডিত যশরাজ। যদিও এক সময় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিভিন্ন ঘরানার এক মিলিত বর্ণালী বিচ্ছুরণের, যা নাকি বিশুদ্ধবাদীদের মতে ভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। তাঁর গায়নে একসময় ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের প্রভাব বা তাসির নিয়েও লিখেছিলেন সঙ্গীতবোদ্ধারা।
কিন্তু সেসব ছাপিয়ে থেকে যায় স্বরের শুদ্ধ আর্তি যা শ্রোতাকে নিবিষ্ট করে রাখে সেই আলোর পানেই। ওঁর উদ্ভাবিত যশরঙ্গী গায়ন পদ্ধতিতে পুরুষ ও স্ত্রী কণ্ঠ দুটি আপাতভিন্ন কিন্তু সঙ্গতিপূর্ণ রাগের যুগলবন্দি সেধে যায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যের অন্যতম অঙ্গ মূর্চ্ছনার অনুধ্যানে, যা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ‘টনিক চেঞ্জ’-এর কিছুটা সমানুপাতিক। পূর্বোক্ত রাগ পটদীপকি ছাড়াও আবিরী টোড়ি, নট নারায়ণ, গোরখ কল্যাণ প্রমুখের বিস্তারে যশরাজজির কণ্ঠে এক সিদ্ধ যোগীর তদ্গত গায়নে শ্রোতারা বারবার পেয়েছেন ‘তৃষ্ণার শান্তি’। খেয়াল, ঠুমরি, ভজন ছাড়াও রাগপ্রধান গান এবং এই ভাবের কিছু ফিল্ম সঙ্গীতে তিনি একইমানের সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এরই অভিজ্ঞান ছড়িয়ে আছে বসন্ত দেশাই এর সুরে ‘ল্যড়কী সহ্যাদ্রি কি’ (১৯৬৬) ছায়াছবিতে আহির ভৈরবে নিবদ্ধ ‘বন্দনা করো, অর্চনা করো’ অথবা ‘বীরবল মাই ফ্রেন্ড’ (১৯৭৫) সিনেমায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আর এক মহীরূহ পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর সঙ্গে যুগল গায়নে মালকোষ রাগে নিবদ্ধ ‘রঙ্গরলিয়া করত সৌতন কে’-র মতো বেশ কিছু গানে। আর ভজন গায়নে তাঁর প্রায় অলৌকিক মহিমা বিশ্বখ্যাত। ‘ওম্ নমো ভগবতে বাসুদেবা’ যখন সুরের ধারাপাতে নেমে আসত, ভক্তপ্রাণ শ্রোতার মন দ্রব হয়ে আসত ঐশী প্রেরণায়। সেই বৃন্দাবনের গোষ্ঠবিহারী যেন তাঁদের চেতনার দৃষ্টিতে আসন পেতে বসতেন পণ্ডিতজির মঞ্চের পাশে। শ্রোতার মনোজগতে এমন ঘটনা ওঁর অনুষ্ঠানে বহুবার ঘটেছে।
১৯৭২ সালে তাঁর বাবা এবং বড়দাদা অথবা এই পরিচয় ছাপিয়েও তাঁর দুই প্রধান সঙ্গীতগুরুর স্মরণে ‘পণ্ডিত মোতিরাম পণ্ডিত মণিরাম সঙ্গীত সমারোহ’-র সূচনা করেন যশরাজজি, যে উৎসব প্রায় অর্ধশতাব্দীর যাত্রাপথ পেরিয়ে আজও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অঙ্গনে। এছাড়াও মেওয়াতি ঘরের কণ্ঠশিল্পী ও বীণকার পন্ডিত জয়বন্ত সিং বাঘেলা, ওস্তাদ গুলাম কাদির খান এবং আগ্রা ঘরানার স্বামী বল্লভদাস দামোলজির কাছেও শিক্ষালাভ করেছিলেন পণ্ডিতজি। ঘরানার এই ভিন্ন আধারের নানা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর কণ্ঠে অনন্যসাধারণ স্বরক্ষেপের আভাস এনে দেয়। একজন সম্পূর্ণ শিল্পী তাঁর মগ্নচৈতন্যে যে অদেখা সীমান্তের পানে নিবিষ্ট যাত্রা করেন, সেই পথেরই যাত্রিক ছিলেন পণ্ডিত যশরাজ। ওঁর অগণিত শিষ্য-শিষ্যার কাছে এই পথেরই দিক্নির্দেশ করে গিয়েছেন তিনি।
এই প্রতিবেদকের সৌভাগ্য হয়েছিল পণ্ডিতজির এক সুযোগ্যা ছাত্রী, বিশ্ববিখ্যাত বেহালাবাদক বিদূষী কলা রামনাথের সান্নিধ্যে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দর্শকের আসনে থাকার। সেই অনুষ্ঠানে ‘গোরখ কল্যাণ’ রাগে যশরাজজির গাওয়া বিখ্যাত দ্রুত বন্দিশ ‘নেক কৃপা কর আইয়ে’ বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন বিদূষী শিল্পী, দু’কলি গেয়েও শুনিয়েছিলেন তাঁর গুরুর অনন্যস্বাক্ষর গায়নভঙ্গিতে। সেই বাদন এবং গায়নে গুরুর আধারে তাঁর পরম আশ্রয়ের ভাব ছুঁয়ে গিয়েছিল প্রতিটি দর্শককে। এই বিস্তৃত আধারের উৎস হয়ে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের অসংখ্য মুমুক্ষু যাত্রীকে আলোর সীমানা নির্দেশ করে গিয়েছেন পণ্ডিতজি। নিজের দুই কৃতী সন্তান সার্ঙ্গদেব এবং দুর্গা যশরাজ ছাড়াও সঞ্জীব অভয়ঙ্কর, সন্দীপ রানাডে, কলা রামনাথ, তৃপ্তি মুখোপাধ্যায়, সুমন ঘোষের মতো অসংখ্য গুণী শিষ্য-শিষ্যাকে দিয়ে গিয়েছেন এই মহান ঐতিহ্যের আলোকিত উত্তরাধিকার।
ভৌগোলিক রাষ্ট্রের সীমানা ছাপিয়ে বিশ্বসঙ্গীতের দরবারেও তাঁর গায়ন আদৃত হয়েছিল পরম শ্রদ্ধায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের নিউ হাইড পার্কে অবস্থিত ‘পণ্ডিত যশরাজ ইনস্টিটিউট ফর মিউজিক রিসার্চ আর্টিস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাপ্রিসিয়েশন’ অথবা কানাডার টোরোন্টোতে ‘পণ্ডিত যশরাজ ইনস্টিটিউট ফর মিউজিক’-এর মতো আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা ওঁর এই গায়নশৈলী অথবা সামগ্রিকভাবে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রত্নরাজির ঐশ্বর্যকে মেলে ধরেছে পাশ্চাত্যের কাছে। এইসব সংস্থায় প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে পাশ্চাত্যের অসংখ্য সঙ্গীতপিপাসু মানুষজন এই ঐতিহ্যের সাধনা করে যাচ্ছেন।
গত ১৭ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে আকস্মিক হৃদরোগে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে পটদীপকির সেই গহীন মধ্যম, পণ্ডিতজির শরীরী উপস্থিতি আর নেই এই নশ্বর পৃথিবীতে। কিন্তু সাচ্চা স্বরের আর্তি কোনওদিন স্তব্ধ হয় না। হিন্দুস্থানি মৌসিকির প্রতিটি আরোহণ-অবরোহণে তাই অলক্ষ্যে রয়ে যাবেন পণ্ডিত যশরাজ, তাঁর নিহিত স্বরের আহ্বানে।
Excellent naration.