এন্তেকালের চোদ্দ বছর পর ভিটে হারালেন ভারতরত্ন বিসমিল্লা

দীপঙ্কর দেব

 


লেখক তথ্যচিত্র নির্মাতা

 

 

 

 

খাঁ সাহাবকা ঘর মালুম হ্যায়?

প্রশ্ন শুনে ছোকরা রিকশাওয়ালা ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, খাঁ সাহাব? কৌন খাঁ সাহাব?

এযাবৎ শুনে এসেছি, বারাণসীতে খাঁ সাহাব বলতে একজনকেই বোঝায়। কিন্তু রিকশাওয়ালার ভাবলেশহীন কৌন খাঁ সাহাব শোনার পরে আর সে কথা বলার সাহস হল না।

তার আগে অবধি অবশ্য সবকিছু ঠিকই চলছিল। একের পর এক মন্দির দর্শন করিয়ে আমাদের গোধুলিয়ার মোড়ে নামিয়ে দিয়েই তার ছুটি। কিন্তু বাধ সাধলেন আমার দাদা। ৬০ বছরের জীবনে তাঁর অন্তত ২০-২২ বার বেনারস ভ্রমণ হয়ে গিয়েছে, কেবল এই একটা জায়গাই যা দেখা বাকি। অতএব, খাঁ সাহাবের বাড়ি খোঁজা শুরু।

এদিকে ‘আউট অফ সিলেবাস’ প্রশ্ন নিয়ে আমাদের তরুণ রিকশাওয়ালা যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন পাশের স্ট্যান্ড থেকে সঙ্কটমোচনের ভূমিকায় এগিয়ে এল মাঝবয়েসি একজন। হাঁ হাঁ, বিলকুল মালুম হ্যায়। থোড়া দূর হ্যায়। হাঢ়া সরাই মে। লে যাউঙ্গা।

সন্ধে হয়ে আসছে। দুদিন পরেই বকরি ঈদ। উঠে পড়লাম সঙ্কটমোচনের রিকশায়। বড় রাস্তা, ছোট গলি, মাঠ, চৌমাথা পেরিয়ে এগিয়ে চলল রিকশা। দাদা মুচকি হেসে বললেন, দ্যাখ, একেই বলে নামমাহাত্ম্য। কোথাও কিছু নেই, কেবল নাম বলতেই ম্যাজিকের মতো কাজ। বিসমিল্লা খান আর বারাণসীর এই হল কানেকশন। একবার নাকি, খাঁ সাহেবকে বিদেশ থেকে অফার দিয়েছিল, সেই দেশে গিয়ে থাকতে, তিনি হেসে বলেছিলেন, “কোনও অসুবিধে নেই। চলে যাব। শুধু দুটো জিনিস সঙ্গে চাই। গঙ্গামাইয়া আর বাবা বিশ্বনাথের মন্দির।” ভাবছিলাম, দাদাকে বলি, এই তো তোমার নামমাহাত্ম্য, আগের রিকশাওয়ালা তো আকাশপাতাল ভেবেও কুলকিনারা করতে পারল না। খাঁ সাহেবের প্রয়াণের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর নিজের শহরের নবীন প্রজন্ম যদি ভারতরত্নকে ভুলে যায়, তা হলে আর কিসের নামমাহাত্ম্য! কিন্তু, চেপে গেলাম। খাঁ সাহাবের মকানের সন্ধান পেয়ে উত্তেজনায় ফুটতে থাকা ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়কে খোঁচা দিতে ইচ্ছে করল না।

একটা বিশাল মাঠ পার হয়ে কাশীর বিখ্যাত গলিতে ঢুকতেই অদ্ভুত অনুভূতি হল। রিকশাওয়ালার গলায় আ গয়া খান সাবকা ঘর শুনে ভাল করে তাকালাম চারপাশটায়। অপ্রশস্ত, প্রায়ান্ধকার গলি। দিনমানেই খুব বেশি আলো ঢোকে না, এখন তো আবার সন্ধে। সেই ছমছমে আধো অন্ধকারের মধ্যে, আর পাঁচটা বাড়ির মতোই অতি সাধারণ দোতলা একটা বাড়ি। কোথাও কোনও নামফলকের বালাই নেই। ঠাটবাট তো নেইই। ঠিক জায়গায় এলাম কি না ভাবতে-ভাবতেই চোখে পড়ল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন এক বৃদ্ধ। আমার দাদার মুখে আবার সেই হাসি। ঠিক জায়গাতেই এসেছি। ওঁকে দ্যাখ। আমি নিশ্চিত, উনি খাঁ সাহেবের পরিবারের মানুষ। ভদ্রলোককে ভালো করে দেখে অবশ্য আমারও তাই মনে হল। চেহারায় আশ্চর্য মিল। আমাদের পরিচয় আর আসার উদ্দেশ্য জানাতে প্রৌঢ়ও তাঁর পরিচয় দিলেন। বিসমিল্লা খাঁ সাহেবের ভাইপো। আপাতত থাকেন এ বাড়িতেই।

সুদূর কলকাতা থেকে আসছি খাঁ সাহেবের বাড়ি দেখব বলে, শুনে একগাল হেসে আমাদের নিয়ে গিয়ে বসালেন ঘরের মধ্যে। অতি সাধারণ একটা বসার ঘর। নীল রঙের দেওয়াল। এককোণায় একটা তক্তপোষ। তার ওপর শস্তার নীল সুজনি। অথচ চোখ তুলতেই, দেওয়ালজোড়া আস্ত একটা মিউজিয়াম। খাঁ সাহেবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আর পুরস্কার নেওয়ার অসংখ্য ছবির পাশে ওঁর প্রমাণ সাইজের একটা পোর্ট্রেট। তার ঠিক পাশেই জ্বলজ্বল করছে ভারতরত্ন সম্মানের স্মারক।

তার কিছুদিন আগেই গৌতম ঘোষের তৈরি তথ্যচিত্রটি দেখার সুযোগ হয়েছিল। ভেতরমহলে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কোথায় কোথায় শুটিং হয়েছিল। তার গল্পও বিস্তারিত শোনালেন ভদ্রলোক। প্রতিটা ছবি দেখিয়ে কোন পুরস্কার কবে পাওয়া, কোন ছবি কোন অনুষ্ঠানের, সব গড়গড় করে বলতে লাগলেন তিনি। সবিস্তার বর্ণনা দিলেন খাঁ সাহেবের পরিবারের, কারা কোথায় আছেন এখন, কোন কোন শিল্পী এখনও যোগাযোগ রাখেন, কারা বিশেষ রাখেন না, সরকারকে বলে খাঁ সাহেবের নামে এই বাড়িতে কী কী করানোর ইচ্ছে রয়েছে, ইত্যাদি নানা কথা।

ইতিহাস ও বর্তমানের সেসব অমূল্য তথ্যের হিরেমাণিক মাথার মধ্যে দ্রুত সাজিয়ে নিতে নিতে বারবার দাদার দিকে তাকাচ্ছিলাম। দাদার চোখমুখ উদ্ভাসিত, নিজের মনেই বারবার বলছেন, “গোল্ডমাইন, আস্ত গোল্ডমাইন।” ভদ্রলোকের মুখেই শুনেছিলাম, ১৯৩৬ সালে এ বাড়ি কিনেছিলেন খাঁ সাহেব। ২০০৬ সালে খাঁ সাহেবের এন্তেকালের পর, দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এ বাড়িটিকে মিউজিয়াম বানাতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বেশ খানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন খাঁ সাহেবের পালিতা কন্যা সোমা ঘোষ। কিন্তু, বাড়ির মালিকানা নাতিদের হাতে চলে যাওয়ায় সে উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়। খাঁ সাহেবের স্মৃতি যে তাঁর নাতিদের হাতে সুরক্ষিত নয়, তা বোঝা গিয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ২০১৭ সালে তাঁর চারটি সানাই, যার মধ্যে তিনটি আবার রুপোর, নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। খাঁ সাহেবের ঠোঁটের ছাপ, আঙুলের দাগ আর কলজের হাওয়া লেগে থাকা যে স্মৃতিচিহ্নগুলির থাকার কথা ছিল জাদুঘরে, নিলামে যার দাম উঠতে পারত কয়েক কোটি টাকা, সেইসব স্মৃতি বিক্রি হয়ে যায় মাত্র ১৭ হাজার টাকায়।

বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ হয়নি। অন্ধকার নেমে আসায় ইচ্ছে থাকলেও দেখে আসা হয়নি দোতলার সেই ঘরটি, যে ঘরে বসে রেওয়াজ করতেন খাঁ সাহেব। যে ঘরের জানলার শিক পেরিয়ে ঢুকত সকালের রোদ, বিশ্বনাথ মন্দিরের ঘন্টার শব্দ, গঙ্গামাইয়ার আশীর্বাদ-মেশা হাওয়া। এই জানলা দিয়েই তাঁর সানাইয়ের সুর মিশে যেত হাঢ়া সরাইয়ের ছায়াচ্ছন্ন অলিগলিতে।

ফেরার পথে রিকশা অবধি এগিয়ে দিতে এসে বয়স্ক ভদ্রলোক আমার ছ বছরের কন্যাকে আদর করে বলেছিলেন, “মন লগাকে পঢ়াই করনা। বড়ি হোকে ফির সে আনা।” আমার কন্যাও সরল গলায় বলেছিল, “আসব।”

আজ সকালের কাগজে খবরটা পড়ার পর থেকে গোটা ব্যাপারটাকেই আস্ত একটা রসিকতা বলে মনে হচ্ছে। “আবার আসব।” আমার দাদাও বলেছিলেন, আপন মনে রিকশা করে ফেরার পথে। দাদারও আর যাওয়া হয়নি। এর কয়েক বছরের মধ্যে হঠাৎই মারা যান তিনি।

একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। বেঁচে থাকলে তাঁকে নিজের চোখে দেখতে হত, খাঁ সাহেবের সেই ইতিহাসবিজড়িত বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে তার জায়গায় শপিংমল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরই বংশধরেরা। আর, কী আশ্চর্য, সে খবরও এসে পৌঁছেছে তাঁর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীর (২১ অগস্ট) দু দিন আগেই। খবরটা পড়তে পড়তে আচমকাই মনে পড়ে গেল, ২০০২-এর মার্চে বরোদায় উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের স্মৃতিবিজড়িত দরগা ভেঙে দেওয়ার কথা। পাথর ছুড়ে, জ্বলন্ত টায়ার ছুড়ে তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল সেই দরগা। আর আজ, নিজের বংশধরদের অবিমৃষ্যকারিতায় নিজের বসতভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলেন ভারতরত্ন বিসমিল্লা খাঁ সাহেব।

দাদা হয়তো যেতে পারেননি আর, কিন্তু আমি আর একবার যাব। দেশজোড়া উন্মাদের প্রলয়নাচন যেদিন শেষ হবে, সেদিন। বাড়িটা হয়তো থাকবে না আর। কিন্তু, দেখে আসব, খাঁ সাহেবের ওই আটপৌরে দোতলা বাড়িটা ভেঙে যে শপিংমল উঠল, তার চেহারাটা ঠিক কেমন। শুনে আসব, তার কোনও জানলা থেকে খাঁ সাহেবের সানাইয়ের ফুঁ ভেসে আসে কি না।

আশা করি, হাঢ়া সরাইয়ের শপিংমল চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন রিকশাওয়ালার অভাব হবে না…


লেখার প্রথম চারটি ছবি লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত। বাকি ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...