কুন্তল রুদ্র
লেখক কবি, প্রাবন্ধিক, আবৃত্তিকার এবং বোলপুর কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক
শান্তিনিকেতনে পৌষমেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরার দাম্ভিক আয়োজনকে সেদিন যারা দৈত্যকায় যন্ত্র এবং চিন্তাহীন সংঘবদ্ধতা দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা আর যাই হোক রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকের দাদাঠাকুরের দল নয়। শুরুতে কথাটা এভাবেই বলতে হল, কারণ ইতিমধ্যে সেদিনের বিধ্বংসী কাণ্ডের সঙ্গে ‘অচলায়তন’ নাটকে পাঁচিল ভাঙার এক সমান্তর-চিত্র আঁকার আয়োজন লক্ষণীয় হয়ে উঠছে বিভিন্ন মিডিয়ায়— ছবিতে, কথায়, লেখায়। এই তুলনার সূত্রে ভাঙনলীলাকে মহনীয় করে তুলে সামাজিক এবং বৌদ্ধিক মান্যতা দেওয়া হচ্ছে কিনা ভাবা প্রয়োজন। সত্যিই কি সতেরোই আগস্ট সকালের ধ্বংসলীলাকে তেমন মহনীয় কোনও কার্যক্রম হিসাবে চিহ্নিত করা চলে? তাহলে তার বিরুদ্ধে নিন্দারই বা ঝড় কেন? কোনও কোনও পর্যবেক্ষক বলছেন ঝড়কে দখিনা বাতাসে রূপান্তরের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।
আশ্চর্যের হলেও সত্যি, ঋষিকল্প যে মানুষটি কোনওদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতি না-করেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ বিকারের সম্ভাবনা এবং লুব্ধ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে মানবসভ্যতার সঙ্কটকে দ্রষ্টার মত তীক্ষ্ণ স্পষ্টতায় চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তিনিই নিজের স্বপ্ন-শ্রম-অধ্যবসায়ের অন্যতম সেরা এক ফসল বিশ্বভারতী যে কোনওদিন রাজনৈতিক শক্তির ঘোর বিবাদস্থল হয়ে উঠতে পারে তা অনুধাবন করতে পারেননি, পারলে তাঁর অবর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব সরকারে ন্যস্ত করা থেকে তিনি নিশ্চিতভাবেই বিরত থাকতেন। কী হলে কী হত না-হত সেই বিশ্লেষণ আজ অবশ্য গুরুত্বহীন, ঐতিহাসিকভাবে এটাই সত্য— বিশ্বভারতী এখন একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং অন্য সব কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একই সারিতে তার অধিষ্ঠান। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার যে নীতি এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বভারতীতেও তাই। সুতরাং রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে কব্জা করার যে আয়োজন জেএনইউ, দিল্লি বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই একই ছক বিশ্বভারতীতেও আজ লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। অথচ, অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রাচীরবেষ্টিত করাটা সেভাবে কোনও ইস্যু হয়ে ওঠে না, বিশ্বভারতীতে কেন হয়— নেতা আসেন, জনতা আসে, পে-লোডার আসে, শ্লোগান হয় আবার গানও হয়!
আলাপ-আলোচনায় বহু ক্ষেত্রেই এখনও বিশ্বভারতীকে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সেই অনন্যতার কারণ যে একটি বিকল্প স্বাধীন শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক শিক্ষাব্যবস্থা এবং তারই অনুসারী এক প্রতিষ্ঠান— তা বোঝার দায় যাদের সবার আগে, তাঁরা এর শিক্ষক বা অধ্যাপকমণ্ডলী। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, অ্যাকাডেমিক এবং আনুষঙ্গিক অপরাপর যোগ্যতাসম্পন্ন এ-কালের অধ্যাপকমণ্ডলীর সেই দায়বোধ একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। অন্যথায় এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক উৎসব-অনুষ্ঠান, যেগুলির সঙ্গে বিশ্বভারতীর নাড়ির যোগ, যেগুলি লঘু হলে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও লঘু হতে বাধ্য— সেগুলি এমন বিপন্ন হয়ে পড়ে! পৌষমেলা এবং বসন্তোৎসবের ক্ষেত্রে তো ঠিক তাই ঘটেছে, এবং সেই চিন্তাহীন চিত্তলঘুতা এখন হাত বাড়াচ্ছে ছাতিমতলা ও মন্দিরের উপাসনা অনুষ্ঠানের দিকে। রাজনীতিবিদ, দিল্লিতে যাঁরা অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিশ্বভারতীরও পলিসি নির্ধারণ করেন, তাঁদের দায় তো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু, সবাই তো আর নেহরু-ইন্দিরা নন, এখন তাই বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে বা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানে ভাঙা বাংলায় রবীন্দ্রনাথের কোনও বিশেষ কবিতা, অথবা তাঁর বিশেষ কোনও গানের দুটি লাইন, কিংবা তাঁর গ্রামোন্নয়নের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনও সহকারীর তৈরি করে দেওয়া কয়েক লাইনের নোটের অতিনাটকীয় উপস্থাপন যা ন্যাশন্যাল মিডিয়ায় প্রচারের সূত্রে অদূরবর্তী ভোটের লড়াইয়ে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দেবে— এইটুকুতেই তাঁদের রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনন্যতা বোঝার দায় ফুরিয়ে যায়! আর তিনি চলে গেলেই, ‘ভয়শূন্য চিত্ত! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা’— বলে স্থানীয় কর্তা আস্তিনের তলা থেকে ছুরি বের করে প্রকাশ্য শাসানি শুরু করেন। এই সেই পরিস্থিতি যখন নিরাকার ‘জনগণ’ গড়ার চেয়ে ভাঙার কাজটা সহজসাধ্য বুঝে ভাঙনের জয়গান গাওয়া উপযুক্ত নেতা পেয়ে পুলকিত বোধ করে ‘খোলা মাঠের খেলা’ খেলতে বিশেষ উৎসাহিত হয়ে পড়ে, ঠিক যেমনটি সতেরোই আগস্ট সকালে ঘটল।
বিশ্বভারতীর জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরার সাম্প্রতিক উদ্যোগের সূত্রপাত ২০০৭-০৮ সালে। প্রথম ঘেরা হয় একপ্রান্তে শ্রীনিকেতনে মৌলডাঙায়, যার পরিণামে মৌলডাঙা সাঁওতালপাড়া পাঁচিল-ঢাকা পড়ে। তাদের গ্রামে ঢোকার সোজা পথ ঘুরে যায় দেড় কিলোমিটার। যেহেতু ছোট গ্রাম, ভোটের হিসাবনিকাশে তেমন ইতরবিশেষ হওয়ার নয়, এবং যেহেতু অত্যন্ত বেশি শান্তিপ্রিয় এই সাঁওতাল উপজাতিরা, তাই তাদের কথা সেদিন কেউ বলেনি— বাম, দক্ষিণ, রাবীন্দ্রিক, গান্ধীবাদী— কেউ না। প্রাচীরবেষ্টনীর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যে প্রায় পনেরো কিলোমিটার পাঁচিল গাঁথা হয়েছে বিগত তেরো বছরে। পাঁচিল তুলতে বাধাদান, ঐক্যবদ্ধভাবে ধৈর্য্য নিয়ে চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায়, আবার নেতৃত্বের অভাবে ঐক্য গড়ে তুলতে না পারায় পিছু হটা— এই সব মিলেমিশে গত দেড় দশকের শান্তিনিকেতন একেবারে পাঁচিলময়। পাঁচিলের জন্য কত রাস্তা যে উধাও হয়ে গেল, কত পথ যে দীর্ঘতর হল! এখনও হয়ে চলেছে প্রতিদিন, পাঁচিল আর নতুন নতুন গলিপথ! নাগরিক গলির আধো-অন্ধকার আর দমবন্ধ বীভৎস বাতাসের দিন ঘনিয়ে এল খোলা মাঠের শান্তিনিকেতনে! নতুন রূপের অহঙ্কার এখন নতুন শান্তিনিকেতনে! কোথাও সাত ফুট, কোথাও আট ফুট, কোথাও দশ ফুট, কোথাও আবার এগারো ফুট উঁচু পাঁচিল সগর্বে সদর্পে বলছে— তোমাদের রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর কিছু অতিরিক্ত গুণমুগ্ধের জন্য এতটা দেরি হয়ে গেল আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে। তবে প্রায় সব আড়াল করে দিয়েছি, এখন আর তোমাদের সেই মান্ধাতা আমলের মন্দির ছাতিমতলা আম্রকুঞ্জ উত্তরায়ন নয়, এবার আমাদের দ্যাখো! দেখতে দেখতে চলে যাও ময়ূরাক্ষী ক্যানেল পেরিয়ে শনিবারের হাট! স্বভাবসুন্দরকে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক বিপুল ব্যয়ে কীভাবে কদর্য করে তোলা যায় তা দেখতে হলে একবার ঘুরে আসতে হবে এই নতুন শান্তিনিকেতনে! ওই পাঁচিল, ওই গলিপথে শান্তিনিকেতনের বর্ষা-বসন্ত আর কি আসবে? যেমন করে মোবাইল টাওয়ার কিংবা বিদ্যুতের হাই-টেনশন লাইনের বিপন্নতা থেকে বাঁচতে সভ্যতার ত্রিসীমানা ছেড়ে কত পাখপাখালি পালিয়ে গেছে, তেমনি করেই কি পাঁচিল আর গলির শানবাঁধানো পথের প্রতিবন্ধকতায় শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির আশ্চর্য স্বচ্ছন্দ রূপ, তার বর্ষা-বসন্তের সমারোহ চোখের আড়ালে চলে যাবে! তার বাতাসে শ্রাবণের আভাস, দৃষ্টিতে বসন্তের ফুলের বাহার, শ্রবণে পল্লবমর্মর— এ-সব থাকবে কেবল কবির কবিতায়, তাঁর গানের বাণীতে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বার খুলে তারা হয়তো আর ডাক দিতে আসবে না! উত্তরে কেউ বলতেই পারেন— ‘তাতে কী হয়েছে, তোমাদের গেঁয়ো পরিমণ্ডলটাকে কেমন পোক্ত করে বাঁধিয়ে দিচ্ছি সেটা দ্যাখো! রবীন্দ্রনাথ তো নীড়ের কল্পনা করেছিলেন, নীড় কি অমন খোলামেলা হলে চলে, তার ঘেরাটোপ চাই না!’
পাঁচ বছরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জীবন দিয়ে পাওয়া শান্তিনিকেতন চেনে না, তেমন কোনও দায়ও তাঁর নেই। তাঁর দায়, দুরমুশ করে আর-আর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে বিশ্বভারতীকেও এক করে দেওয়া। তাঁর দায়, দিল্লির পলিসি রূপায়ণ। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন? নাঃ, সে-সব বোঝার দায় নেই তাঁদের। পাঁচিল তোলার দায় অনেক বড়! বাইরে পাঁচিল, ভিতরে পাঁচিল, ভাগ ভাগ করে দাও, খোপ-খোপ! যে-খেলাটা খেলছে ওরা দেশজুড়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে, বিশ্বভারতীতেও ওদের সেই খেলা! তাই না এত স্পর্ধা, অনুভব-উপলব্ধির পবিত্র ক্ষেত্রগুলিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে হেয় প্রতিপন্ন করা। রবীন্দ্রনাথকে ওদের ভাঙতে হবে, ঠিক যেভাবে ভাঙছে গান্ধিজিকে। না-ভাঙলে, আমাদের প্রত্যয়ের মৌল ভূমিকে দুর্বল করতে না-পারলে ওদের গড়াটা ঘটিয়ে তোলা যাবে না। তাই-না, বিশ্বভারতীতে যিনি ছাত্রদের অসীম স্বাধীনতার চর্চা করেছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রদের পায়ে হাতে মনে মগজে বেড়ি পরানোর তৎপর মরিয়া আয়োজন। যাঁর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রকে দূরে রেখে সামাজিক সহযোগিতাকে ভিত্তি করে, সেখানেই সমাজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নাড়ির যোগকে ছিন্ন করার দাম্ভিক প্রয়াস। যেখানে শিক্ষকের সম্মান ছিল সর্বোচ্চ, সেখানে তাকে আজ ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিল্পির, গুণীর কদর কি কোনও যন্ত্ররাজ বা কোনও মহাপঞ্চক বোঝে! তাঁরা বোঝেন নিয়ম, বোঝেন ক্ষমতা!
‘অচলায়তনে’ই ফিরতে হল। নিয়মের নিগড়ে হাঁপিয়ে ওঠা পঞ্চক দাদাঠাকুরকে বলেছিল—
অচলায়তনে প্রণাম করে করে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে। তাতে নিজেকেই কেবল ছোট করেছি, বড়কে পাইনি।
ভয় দেখিয়ে জয় করতে চাওয়া আজকের বিশ্বভারতীতেও সেই অবস্থা, মানুষকে কত বেশি নত করা যায় নিরন্তর তারই আয়োজন সেখানে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন পারস্পরিক শ্রদ্ধার এক অনন্য পরিমণ্ডল, ছাত্রছাত্রীরা যে শিক্ষকদের হাত তুলে এখানে একদা নমস্কার করত সে নিছক নতুনত্বের চমক নয়। পঞ্চকের সদ্যোল্লিখিত কথার উত্তরে দাদাঠাকুরের মুখ দিয়ে সেই কথাই তো বলেছিলেন তিনি—
এই আমার সবার বাড়া বড়র মধ্যে এসে যখন বসি তখন যা করি তাই প্রণাম হয়ে ওঠে। এই-যে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মন তোমাকে আশীর্বাদ করছে— এও আমার প্রণাম।
এমন পারস্পরিক শ্রদ্ধার স্থল শান্তিনিকেতনকে কেবল বাইরে থেকে ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের পাষাণ বানিয়ে তোলা নয়, এখানকার মানুষদের, শিশুদের, বালক-বালিকাদের, ছাত্রছাত্রীদের মনকেও ওরা পাষাণ বানাতে চায়— চিন্তাহীন, নিয়মতান্ত্রিক। কেবল সিলেবাস বই পরীক্ষা আর নম্বর চাপা দিয়ে আগাগোড়া তাদের একেবারে চ্যাপ্টা করে দিতে চায়। ভিতরের পাঁচিলে লোহার দরজা বসিয়ে এমন পোক্ত করে তুলবার পরিকল্পনা যে বাইরের পাঁচিল ভাঙলেও ভিতরটা সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে।
রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর প্রতিষ্ঠানের চারদিক খোলা রাখতে চেয়েছিলেন সে কেবল খোলা মাঠে খেলার জন্যেই নয়। অচলায়তনের পাঁচিল ভেঙে সেখানে আসার পর গুরু তথা দাদাঠাকুর বালকদলের সঙ্গে কথোপকথনের সময় খোলা জায়গায় খেলতে গেলে পাপ হবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে গূঢ় তাৎপর্যব্যঞ্জক একটি কথা বলেছিল। সে তো একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথেরও কথা। কথাটা হল— ‘খোলা জায়গাতেই সব পাপ পালিয়ে যায়’। তবে কি সেইজন্যেই এই পাঁচিলের আয়োজন, ভিতরে বাইরে এত সব ঘেরাটোপ? কিন্তু কোন্ পাপকে আড়াল করার জন্য এই মরিয়া প্রয়াস? মানুষ মারার পাপ, মনুষ্যত্ব-বিকাশকে রুদ্ধ করার মহাপাপ! রবীন্দ্রনাথ তাঁর অর্ধেক জীবন দিয়ে বিশ্বভারতী নামক মানববৃক্ষের যে চারাটি রোপন করেছিলেন বিকাশমান সেই বৃক্ষটিকে ছেদন করার এক নিপুণ ষড়যন্ত্র! নৈবেদ্যের ৭২ সংখ্যক কবিতায় (চিত্ত যেথা ভয়শূন্য) রবীন্দ্রনাথ এক মুক্ত জীবনের, মুক্ত এক জ্ঞানচর্চাক্ষেত্রের ছবি এঁকেছিলেন। এ সেই সময় যখন বিশ্বভারতীর ভ্রূণটি তাঁর স্বপ্নে ডানা মেলছিল। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীতে সেই স্বপ্নই মানববৃক্ষশিশুর রূপ নিয়ে বিকশিত হতে শুরু করে। আজ শতাধিক বছর পর কার ভয় সেই ভয়শূন্য চিত্ত আর উচ্চ শিরকে? তাই কি জ্ঞানচর্চাকেও শৃঙ্খলিত করার আয়োজন— সারা দেশে এবং বিশ্বভারতীতেও?
বিশ্বভারতীকে ভয় পাওয়ার বাড়তি কারণও আছে। এই সেই উর্বর ভূমি যেখানে একটি বিকল্প শিক্ষার মডেল পরীক্ষিত হচ্ছিল। স্বাধীন শিক্ষার পরিপূর্ণ মানববিকাশের মডেল, প্রকৃতির পটভূমি আর সৃজনের হাতছানি তাকে অনন্য মাত্রা দিচ্ছিল। শ্রীনিকেতন জন্মের পর তার শিকড় আরও গভীরে ছড়াতে শুরু করে, দেশজ মানবভূমিতে সাড়া জাগতে থাকে বিকল্প কৃষি ও সমবায়ের পথ ধরে। কিন্তু সে শিকড় তো উন্মূলিত হয়ে গেছে ১৯৫১-য়, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমার আড়ালে! তাহলে আজ? আজ কেন ভয়? সেই রবীন্দ্রনাথ, কিছুতেই যাঁকে বাগে আনা যায় না, কোনও শিকলেই যাঁকে আবদ্ধ করা যায় না, কোনও ছকেই যাঁকে মানানো যায় না। অনস্তিত্বেও যিনি অস্তিত্ব, আজও যিনি জায়মান। আপন গানে কবিতায় রচনায় অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের কথাগুলির পরতে পরতে যিনি আগুন ঠুসে রেখে গেছেন— সেই মানুষটার ভয়, ভয় সেই আগুনের! তাই তো আজও এত শিকল দড়াদড়ি দিনেও তাঁর গানে চোখে চোখে আলো ছড়ায়, মন্দিরের পাশে এসে জড়ো হয় বেদনামথিত প্রতিবাদী তরুণের দল— তাদের চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের শান্তিনিকেতন! নিয়মকানুনের অসংখ্য পাঁচিল সত্ত্বেও ভিতরের আগুন এখনও সম্পূর্ণ নেভেনি যে! তাই প্রতিবাদ— শোভনসুন্দর, মানবিক, কল্যাণময়! এ কারও লেজের আগুন নয়— অন্তরের আবিলতা পুড়িয়ে আত্মশুদ্ধির আগুন। পাঁচিলের বিকল্পে এই কল্যাণময় আগুন হয়ত বহুদিন জ্বলবে শান্তিনিকেতনে!
This is the grand plan by Hindu dwajadhari goons. The writer has carefully and justifiably avoided naming names in this wonderfully written article, but this is India today.
অনবদ্য। বিশেষকরে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যুক্ত করে রবীন্দ্রভাবনাকে চিরন্তন করে তুলেছেন।